দুটো লাইনের মধ্যে ফুট দশেক জায়গা, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত। বেশ কিছুক্ষণ হল একরাশ আলো আঁধারিকে মাথায় নিয়ে এখানেই জমিয়ে রাখা স্লিপারগুলোর ওপর বসছে আবার দাঁড়াচ্ছে। বেশির ভাগ সময়টাই দাঁড়িয়ে থাকছে, এপার ওপারের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া মানুষগুলোকে কুড়ি ফুট দূর থেকে দূর থেকে দেখার চেষ্টা করছে। আবার স্লিপারের ওপর বসে পড়ছে। সারা দিন ঝিমঝিমে বৃষ্টির পর এখনও লাইনের পাথরগুলো ভিজে। এপার ওপারের রাস্তায় আলো ফুটছে দুটো একটা করে। ঝম ঝম করে ট্রেন চলে গেল এর মধ্যেই কয়েকটা। যতটা সময় এগিয়ে যাচ্ছে ততটাই উশখুশ করছে অনন্ত। মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে মাথাকে শান্ত থাকতে বলছে। পাশের দোপাটি ফুলের গাছগুলোতে ভরতি ফুল ফুটে রয়েছে। কিছু নীচে ঝরে পড়ে আছে। জলে ভিজে, তাদেরই মতো অবস্থা অনন্তর।
মাঝে মধ্যে কিছু মানুষ পার হয়ে যাচ্ছে লাইন। অনন্ত উশখুশ
করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই হাতের মোবাইল বেজে উঠল। বেজেই থেমে গেল। এখন মিসড কল করার আর ততটা চল নেই। তবুও
অনন্তর মোবাইলে মিসড কল এলো। অনন্ত নেড়ে চেড়ে দেখছে, আর প্রতীক্ষা বাড়ছে। তাহলে কি মীনাক্ষী সামনেই কোথাও রয়েছে। ও কি দেখতে
পাচ্ছে না। চিনতে পারছে না তাহলে? সেদিন রাতে অনন্ত ওর ফোন
নম্বর দিয়েছিল মীনাক্ষীকে। কী মনে হয়েছিল তখন, এখন মনে হচ্ছে
না দিলেই ভালো হতো!
বেশ কিছু প্রশ্ন ঘোরা ফেরা করছে মনের মধ্যে। মুহূর্ত সুযোগ
না দিয়েই তারা ধুপধাপ শব্দ করে হেঁটে চলেছে মাথার ভিতর। তাহলে এখানে আসা ভুল!
এভাবে না আসলেই ভালো হত! এমনও কিছু বিস্ময় ঘুরছে মনে। কিন্তু এ ছাড়া যে আর উপায়ও
নেই। এর থেকে বেশি কি বা করতে পারত অনন্ত। কারো ভালো করা কি পাপ!
এর মধ্যে ঝম ঝম করে আরেকটা ট্রেন চলে গেল। একটু গরম গরম
লাগছে। ঘামছে কি? ঠিক বুঝতে পারছে না বলেই ঘাড়ে হাত
রাখল। কিন্তু বোঝা কি গেল কিছু। এমন পরিস্থিতি আগে কখনও হয়নি। আবার গিয়ে বসে পড়ল
স্লিপারের গাদায়।
এই নিয়ে টানা তিন দিন অনন্ত ঠিক এই সন্ধ্যা নামার সময়ে এই
জায়গায় অপেক্ষা করছে। অনেকেই ওকে এখানে দাঁড়িয়ে উশখুশ করতে দেখেছে। আর অনন্ত মুখ
ঘুরিয়ে নিয়েছে অস্বস্তিতে। ঠিক কতটা সন্দেহ তাদের মনে জাগছে তার তল খুঁজে পাই নি
অনন্ত।
এবার মনে মনে ঠিক করে নিলো আজ যদি না দেখা হয় আর আসবে না
এখানে। এভাবে রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। মীনাক্ষী এর আগে দুবার ওকে
এখানে আসতে বলেছে কিন্তু নিজে আসেনি। পরে রাতে একটা অজুহাত দিয়ে দিয়েছে। আজ আসবে
কিনা বুঝতে পারছে না অনন্ত। সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে মীনাক্ষীকে ঘিরে, কিন্তু মানতে চাইছে না অনন্তর মন। “নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে না হলে আসবে
না কেন?” বলেও আবার পিছিয়ে আসছে। অনেক অনেক প্রশ্ন থেকে থেকে
জেগে উঠছে আবার নিভে যাচ্ছে।
গত তিন দিন আগে এই লাইন পার হতে গিয়ে অনন্ত একটা ফোন কুড়িয়ে
পেয়েছিল। বেশ ভালো দামী ফোন বলেই মনে হয়েছিল অন্ধকারে। পরে দেখেছিল স্ক্রিন চিড়
ধরেছে। কিন্তু ততক্ষণে হাতে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছে অনন্ত। ফোন অন করতেই কিছু
আজেবাজে ম্যাসেজ ঢুকেছিল। অনন্ত দেখেনি। তারপর একটা ফোন ধরবে কি ধরবে না করে
ধরেনি। তারপর আরও একটা ফোন, এবার ধরেছিল অনন্ত। একটা খশখশে গলার
লোক কথা বলেছিল। ঠিক কি বলেছিল তা অনন্ত বুঝতে পারে নি। শেষে রাত দশ’টার সময়
মীনাক্ষী ফোন করেছিল। মীনাক্ষীকে চিনত না অনন্ত সেদিনই প্রথম কথা বলা। আর তার পর
থেকে এই আজকে পর্যন্ত অনন্ত শুধু ছবি দেখে একজনকে চিনেছে। শুনেছে ফোনের ওপার থেকে
শান্ত সমাহিত একটা গলা। যে গলায় কোনো উত্তেজনা নেই, উৎকণ্ঠা
নেই। হারিয়ে যাওয়া জিনিসকে ফিরে পাওয়ার জন্য। ফোন হারিয়েছে বলে কোনো দুঃখও নেই।
শুধু বলেছিল, “ফোনটা আপনি পেয়েছেন? আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন?” কেমন উত্তেজনাহীন মানুষ,
অনন্তর বিস্ময় জেগেছিল। তার প্রথম ফোনটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে
গেলে অনন্ত ঠিক থাকতে পারেনি। আর এই মেয়েটা! অনন্তর নিজেকে কেমন ছোট মনের মনে
হয়েছিল। তারপর ভেবেছিল, হয়তো ফিরে পাবে না ধরে নিয়েছিল,
এখন পাবে জেনে এতটা শান্ত।
এইরকম নানা ভাবনা খেলছে মাথায়, কিন্তু কোনো ভাবনাই স্থির হয়ে বসছে না, অনন্তকেও বসতে
দিচ্ছে না। আবার একটা ট্রেন চলে গেল ঝমঝমে আওয়াজ তুলে। মাথার উপর মেঘে ছেয়ে থাকা
আকাশ আর তার নীচের অন্ধকার খানিকটা চমকে উঠল। পকেটে রেখে দেওয়া মীনাক্ষীর ফোনটা
আবার বেজে উঠল। অনন্ত ফোনটা ধরল। ফোন ধরার পর কিছুক্ষণ ঘ্যাষঘেষে শব্দ হল, কানে রেখে শোনার চেষ্টা করল, অপেক্ষা করল কথা শোনার।
বারকয়েক বলল, “হ্যালো... হ্যালো...” কিন্তু কোনো আওয়াজ অন্য
দিক থেকে ভেসে এলো না।
লাইন পার হয়ে বহু মানুষ এপার থেকে ওপারে চলে যাচ্ছে ওপার
থেকে এপারে চলে আসছে। রাত বাড়ছে অনন্ত সেই সেখানেই দাঁড়িয়ে। দুপারের রাস্তার আলোর
চারধারে কঠিন কুয়াশার শরীর জমা হতে শুরু করেছে। চারপাশ আসতে আসতে শান্ত হয়ে আসছে
মীনাক্ষীর গলার মতো। দুরন্ত ট্রেন আরও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে অনন্তর মাথার মধ্যে।
1 মন্তব্যসমূহ
দারুণ লাগল। আপনি অনবদ্য।
উত্তরমুছুন