চেপে বসা ট্রেনটার ড্রাইভার যে কে, কেউ কি জানে! নিশ্চিত, জানিচিনি নেই। ‘উঠে পড়ো হে, উঠে পড়ো’-ই প্র্যাকটিস, নিয়মে গড়ানো। কোথায় যে যাবে, জানে প্রায় সবাই। ‘কোথাও একটা যাবেই’ ভেবে উঠে পড়েছে যারা, ভাবছে না শেষাবধি কোথায়! চলেছে, যাওয়াটা জরুরি ও নির্দেশিত, আর নির্দেশটা নিজেরই।
দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্টিম লম্বা হুইসেল। মোটা হাফপ্যান্ট বেলচা-কয়লা। বাষ্প যেন
কম না-পড়ে। জল থাকা না-থাকা আল্লা কসম; নির্দ্বিধায় ঠেলে চলেছে আগুন উসকে। পুড়ে
খাক হলে কোম্পানি দায়ি নয়। দায়ি আর কেই বা হয় ভগবান ছাড়া। ভক্তি অটুট শক্তি, চুইয়ে
নামে পরম্পরায়, মস্তিষ্কে; প্রশ্নছাড়া।
পথ লম্বা জিগজিগানো। প্রতিটি খাঁজে রকমারি। খরিফ-রবি একসঙ্গে দুপাশে;
শস্যের হলুদে সবুজে ঘন বিতর্ক। জলায় মাছ, ডাঙায় বক, মাঝে উড়তে হুয়ে মাছরাঙা।
অগোছালো সূর্য দাঁত মাজে জেগে উঠে; স্নো-পাউডারে সাজানো চাঁদ পোয়াতি। সব্বাই চলেছে
দিনে রাতে ট্রেনে। ধোঁয়া পড়ে থাকছে পেছনে। মত বদলে গন্তব্যহীন নেমে যে পড়বে, উপায়
নেই; ট্রেন চলছে। বোতামটেপা নির্দেশ ফিরিয়ে নিতে অনেক সময় হাপিত্যেশ। ড্রাইভার কি
একবার বিরতি চাইতে পারে না! ট্রেন চলছে…
০১-০১-২০২২
লক্ষ্যটি তার দরজা খুলে বেড়ালপায়ে। দরজাটা তার চৌকাঠ নিয়ে ঘোড়াঘাম। চৌ-কাঠে
তে-কাঠই সাব্যস্ত, বাকিটা মোজাইক। তে-কাঠের ভূমি-সংস্করণ ফুটবল মাঠের লম্বায়
জালজড়িয়ে। লক্ষ্যের দিকে গোলা যা ছিঁড়ে দিতে পারে। তে-কাঠ তোয়াজের অপেক্ষায় থাকে,
হুস-হাস উড়িয়ে দেয়, ফিরিয়ে। লক্ষ্যগুলো দূরের বেলুনশরীরে চুপসে আসে…
কার জাল ছিঁড়ে লক্ষ্য বেরিয়ে আসে ঘোর বর্ষায়! শিকে ছেঁড়ে বুঝি এক-আধটার।
তখন জন্মদিন ও বেলুন ঢাউস। ঘর-চৌকাঠের তে-কাঠকুনো মাকড়শার জাল মিটমিট। ঘরে গোল,
মাঠে আয়তাকার।
এত যে খেল-খেলোয়াড়ি, আঘাতের দাগগুলি কাঠরঙের। দিন গুণে-গুণে বসন্তপাতার
তালাশ। আঁসু আর সর্বনাশ তার সবকিছু নিঃশেষে ফুরিয়ে ফেলতে চায়। পারে না। জলছাপ মাঠ
পেরিয়ে ঘরের তে-কাঠে অজস্র হতে থাকে। যে-কোনো সাধারণ একটি দিনে মাঠ ঘরকে টিজ করতে
থাকে…
০৩-০১-২২
পরকীয়ার রং অনেক রকম হতে পারে। আমি ভাবি নীল অথবা গোলাপি। বিছানা একটা বাসি
শব্দ; কিন্তু তার চাদরের রং নীল হলে, কী ভালোই যে লাগে! পিংক-সিটি জয়পুর থেকে
ফেরার সময় আকাশের চোখ রাঙানি আমার মোটেও ভালো লাগেনি। কেন, সে কি গোলাপি হতে চেয়ে
লজ্জায় লাল হয়েছিল? মেঘের সঙ্গে তার পরকীয়ার কথা কেই বা না জানে!
নীল গাই আমি দেখিনি, শুনেছি মাত্র। গোলাপি হরিণ সিংহের থাবার নিচে
কাতরাচ্ছে এমন কথা শুনিনি। যে সরোবরে তারা চুমুকে জল পান বা চেটে খায়, তার রং নীল।
আকাশ প্রতিবিম্বিত। দূর, বহুদূর থেকে এদের পরকীয়ার ধরন আর পাঁচটার মতো নয়।
আমি আকাশ নই, বাতাস নই, মেঘ কিংবা সরোবর নই। আমি নীলগাই বা হরিণ নই। আমার
ছেঁড়া চাদরের রং বিবর্ণ নীল। আমার মাথা ও পাশবালিশের কভারের রং ছোপধরা গোলাপি।
দুইয়েরই অনেক অংশের রং সাদা। নীলচে ও গুলাবি-সাদা। সাদা আর কতটুকুই বা পরকীয়ার
সঙ্গে মানানসই! অথচ, পরকীয়া-রে তুহু মম শ্যাম সমান।
০৭-০১-২০২২
আমার একটা গামবুট ছিল। ছিল বলছি এই কারণে সে এখন নেই। দেহত্যাগ করার আগে
আমি তাকে ত্যাগ করি। বড়ো শখে কিনেছিলাম। বৃষ্টির দিনে প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্যে আমি
হাঁটছি, অথচ আমার পা ক্লিন এবং পিছলে পড়ছি না, আর পাঁচজনের মতো। এই থ্রিলটা…
গামবুটের রং সাধারণত কুচকুচে কালো। আমারটা বাদামি। জেল্লাটা কম। আমার মতো।
পা মাথায় উঠতে থাকে, জায়গা দখলের মানসিকতা নিয়ে। আমি রাগতে শুরু করি, গামবুট উলটে
রাগ দেখাতে ব্যস্ত। পরতে গেলে সায় দেয় অতিকষ্টে, পা সামান্য ছুঁড়ি তো অসামান্য করে
ছাড়ে, পিছলে যাওয়ার পূর্বাভাস। পায়ের নীচের পৃথিবী থেকে আমি প্রায় চোদ্দ ইঞ্চি
ওপরে উঠে থাকি…
সয় না। পরিত্যাগ জরুরি। কাউকে কি দেওয়া যায়! দিলে তাকেও মাটির ওপর ভাসিয়ে
তুলবে। ডাস্টবিনে ফেলে দিলে, কেউ না কেউ ঠিক কুড়িয়ে নিয়ে পরবে, নয়তো সস্তায় বিক্রি।
সুতরাং তার গঙ্গাপ্রাপ্তিই সমাধান। ভাসিয়ে দিয়ে, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি, মুচকি
হাসছে। ভাবখানা, ‘কেমন দিলাম!’ বলছেও, ‘চলি ইয়ার, সাগরে গিয়ে পড়ব’। রাগের পারা
উঠেও নেমে আসে। পায়ের দিকে তাকাই। প্যাচপ্যাচে কাদায় দাঁড়িয়ে আছি, কাদা না
গঙ্গামাটি? পাড়ে উঠতে উঠতে অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আমার একটা গামবুট ছিল’…
০৮-০১-২০২২
অনেকানেক মনদশায় এক হরিণের চঞ্চলচিহ্নগুলি খুঁজে ফিরি। ম্যাজিশিয়নের হাতে
নকলতাসের সন্ত্রাস আর হরিণদৌড়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র পেয়ে যাই। হ্যারিকেনের
দপদপানি আর বাঘের হা-মুখে হরিণকণ্ঠায় একইরকমের ভয়। শিবের জটা ঘিরে সাপের হিস্হিস
আর হরিণের মাথায় আঠারোনলা বন্দুক একই রকমের রাগ আমাকে তাতায়। মনের একটা দশাবিশেষ;
বিউগল যাকে স্বাগত জানাতে গিয়ে থমকে যায়।
দশার দশাবস্থানের কথা রোজ চায়ে গলা ভেজায়। ইস্ত্রি করা জামা-প্যান্টে সাজে।
পায়ের হাড় ভাঙলে এক্স-রে মেশিনের সামনে দাঁড়ায়, খুঁড়িয়ে। দশাবস্থানের গান গালে রুজ
মেখে রোজ গলিতে হাঁটাচলা। কম আলোয় কুন্দফুলের গন্ধ খদ্দের ধরে আনে কোঠায়।
দশাবস্থানের কবিতা রোজ মাঝখানে সিঁথি কেটে রকের গরমটুকু পাছায় মেখে নেয়। হৈচৈ-এর
মধ্যে একলা হতে গিয়ে কান্নায় ভাঙে।
মনের লুচ্চা থেকে সাধু-সাধু ভাব, অ থেকে হ, আ থেকে হা। আহা-র পর ঘাটে
স্নান, জলপায়ের ছাপ ফেলে চিলেকোঠা। শান্ত-কে অশান্ত দিয়ে বহুবার ভাগ। অচেনা ভাগশেষ
আর বন্দি হরিণের ঘাস থেকে মুখ তুলে নির্নিমেষ, দুই-ই আমাকে মগ্ন করে আরও কিছু
আবিষ্কারের দিকে, ভেতরে ঝুঁকে পড়ি…
১০-০১-২২
3 মন্তব্যসমূহ
মনের কাছের লেখা। মা খুব সহজে ছুঁয়ে যায় । ভাবায়। না ভাবতে পারলে মনের ছোট দূর হয় না । ঠিক যেমন ঘুরতে যাওয়াটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনের জন্য ❤️
উত্তরমুছুনএমন লেখা মাঝে মাঝে পড়াবেন তখন ঘুরতে যেতে পারি না , সেই সময়ের জন্য ...
যে-কোনো সাধারণ একটি দিনে মাঠ ঘরকে টিজ করতে থাকে…/আমার ছেঁড়া চাদরের রং বিবর্ণ নীল।/পা মাথায় উঠতে থাকে, জায়গা দখলের মানসিকতা নিয়ে। /পায়ের নীচের পৃথিবী থেকে আমি প্রায় চোদ্দ ইঞ্চি ওপরে উঠে থাকি…/ শান্ত-কে অশান্ত দিয়ে বহুবার ভাগ।/ ...... আলাদা উচ্চারণ , আবিষ্কার! মুগ্ধপাঠ !
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন