একদা লিখেছিলাম 'শব্দ নয়, ফিরে চল শব্দহীনতায়' । শূন্য এবং প্রথম দশকের কবিতা যেন শব্দযাপনের ভিতরে সেই শব্দহীনতার কথাই বলে। প্রতিটি উচ্চারণে নির্লিপ্তির স্বর্গ রচে চলেন এই সময়ের কবিরা। পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম্ কিংবা অবিনির্মাণ তত্ত্বের হাত ধরে কবিতার বিশেষ অর্থ প্রতিষ্ঠার দিকে ঝোঁক ম্রিয়মাণ হতে হতে ক্রমাগত এক ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয়ে চলেছে নতুন নতুন তত্ত্বের, শৈলীর অথচ কবিতা নিজেই তা জানেনা; এই না জেনে ওঠার কৌশল এবং দৃঢ়তার মধ্যেই আত্মগোপন করে আছে এ সময়ের কবিতা যেখানে অক্ষরের কোন দায় নেই অর্থকে প্রতিষ্ঠা দেবার; ব্যাকরণের পরিচর্যাও বলা যায় ভীষণরকম আত্মগত। এ হেন বোহেমিয়ানিজম্ -এ ভরপুর কবিতারা গাম্ভীর্য এবং মাদকতা, মেধা ও মননের সৌষ্ঠব এবং 'ফিল ইন দ্য ব্ল্যাংকস' এর মত
উল্লম্ফনধর্মীতার
সমান পারিপাট্যে নজর কাড়ে পাঠকের। ব্যঞ্জনা এবং চেতনার সহজিয়া অভিব্যক্তি যেন আদম-ইভ
এর মত জড়াজড়ি করে রয়েছে কবিতার চারণভূমিতে। কখনো বা নির্মম কর্ষণে শব্দ-কৃষকের বোধ
এক নিরাকার শূন্যতায় বিলীন হতে চায়, অস্তি থেকে নাস্তি আবার নাস্তি থেকে অস্তি-র
গর্ভে বিলীয়মান বোধ উদ্দীপ্ত হয় স্ব-স্ব নক্ষত্রমন্ডলে; নির্বিশেষ থেকে বিশেষ–বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে বিচ্ছুরিত
হয় তার আলো। সেই আভায় পাঠককুল কখনো সংশয়ান্বিত, হতাশ, জীবন ও প্রকৃতির সাদৃশ্য ও
বৈসাদৃশ্যের দোলাচলতায় দ্বিধাগ্রস্ত আবার কখনো নীরবতার ঐকান্তিক ভাষায়, বেদনার মন্থনে
উত্থিত অমৃতরসে , আনন্দবাদী মগ্ন চৈতন্যে আপ্লুত হয়ে পড়েন। শূন্য ও প্রথম দশকের কবিতা
তাই একইসঙ্গে নিরাসক্ত, প্রত্যয়ী এবং উদ্ধত শুধুমাত্র জীবন ও শব্দের দর্পে।
কবিতাসমূহে
তাই বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয় না কবির এ উপলব্ধি–
'জগৎসংসারে
সুখ-দুঃখের পারে বসে/কেবলমাত্র মৃত্যু দেখছিলাম /আমার... আমাদের ভালোবাসার মৃত্যু...'
('শেষ জবানবন্দী', অলক্তিকা চক্রবর্তী)
অথচ দৃশ্যেরও
জন্মান্তর ঘটে মুহূর্তেই 'আসঙ্গ' এর অভিমুখ পরিবর্তিত হলে ; সেখানে কাম-ক্রোধ-রিরংসা-বেদনা
তার শরীরী সত্তা হারায়, প্রেম আরও মানবিক হয়ে ওঠে–এও এক উত্তরণ যেখানে 'মৃত্যু ছাপিয়ে
মহাকাল/ প্রেম শুধু শেষ কথা বলে' ('শেষ কথা', ঐ)
পাথর কেটে
কেটে খোদাই করা হয় কবিতার গোটা শরীর অথচ বাসনারা থেকে যায় অধরা, বিমূর্ত।
'অসাড় নশ্বরতার
পাশে শুয়ে আছে রুমাল/ঝেড়ে ফ্যালা পুরানো ছেলেটির গন্ধ, আর/ফাঁকা-ফাঁকা বুকে দুটি/বদ-অভ্যাস'
('অভিযোজন থেকে অভিসার নামে চিল্কার পাড়ে', অভিজিৎ দাস কর্মকার)
প্রত্নরহস্য
খনন করতে করতে এই দশকের কবিতা হয়ে পড়ে অ্যাবসার্ড।শব্দ-বাক্যের পারিপার্শ্বে কোনরকম
বাঁধ বা পরিখা নির্মাণের পরিবর্তে এক্ষেত্রে নির্মিত হয় উৎপাদন কৌশল; উৎপাদকের বীক্ষণ
স্ট্র্যাটেজি সফল হিসেবে চিহ্নিত হয় যখন কবি জানান–'অক্ষরে অক্ষরে মননের আদর্শলিপি
কথা/বলে; তবুও/আবশ্যিক কোন documents দেখতে পাচ্ছি না' আবার যখন তিনি দেখেন 'জ্যোৎস্নার
সময়সীমায় চাতক পাখিটি/ রংবদল করে।/কালো।বাদামি।সাদা।'(ঐ)
উৎপাদনের
যান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বৌদ্ধিক প্রজননেও সুদূরপ্রসারী কারণ আস্ত পৃথিবীটাই একটি বিপণনকেন্দ্র।
উপযোগী উপাদান
আয়ত্তে আনতে আনতে চৈতন্য হাতড়ে বেড়ায় সভ্যতার থেকে
আরও কয়েক
হাত এগিয়ে থাকা আলো। সুপ্তির মধ্যেই সক্রিয় হতে থাকে বোধ–চৈতন্য বিলাস। সংবেদী কবি-হৃদয়
অনায়াসেই নিরীক্ষণ করেন–'নৈসর্গিক ড্রয়িংরুমে আলো আঁধারির/প্রসব যন্ত্রণায় / ভাগ
হয়ে যাচ্ছে নিরক্ষীয় হৃদ্যতা।' ('নিরক্ষীয় হৃদ্যতা', মন্দিরা ঘোষ)
এই 'মাছুয়া'-রা
গমন এবং প্রত্যাবর্তনে কেমন যেন মানুষেরই বিকল্প হয়ে ওঠে। এই দশকের কবিতার আবেদন অন্তরালবর্তী।
মানুষের ভিতর মনে অনুভূতির যে বাষ্প নিরন্তর উদ্বায়ী তার রুদ্ধ পরিনতিই শব্দের নিজস্ব
শৃঙ্খল গড়ে তোলে; তাকে কবিতা এবং অভিযোজন দুইই মনে করা যেতে পারে।
সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সত্তারা বিবর্তিত হয়ে ঢুকে পড়ে আত্মলীনতায়। এই নির্লিপ্ত
আত্মপরতাকে এ যুগ হয়তো ধৃষ্টতা মনে করে কিন্তু এ আত্মপরতায় জন্ম নেয় আত্মবোধ–আত্মমূল্যায়ণ।
আত্ম-এর মধ্যে বিরাজমান সমগ্রকে আবার সমগ্র-এ সঞ্চরমান 'আত্ম' কে টের পান কবি–
'আত্মস্বাদে
ক্রমে ক্রমে লীন হচ্ছে আস্বাদ।'('আশ্চর্য মলম', সঞ্জয় আচার্য)
সেই নিমজ্জিত
তৃতীয় সত্তার স্বর কখনো উঠে আসে এভাবেই–মনে করিয়ে দেয় অন্তর্লীন অজস্র ব্যথা— 'হাঁটুতে
-এ ব্যথা, কোমরে-এ ব্যথা, শিরায় শিরায় ব্যথা...'(ঐ)
দৈনন্দিন
যাপনে এখানে চোখে পড়ে টুকরো মানুষ; ছোট ছোট মাংসের ড্যালা হয়ে রয়ে যায় অস্তিত্ব,
সমগ্রের দর্শন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, অংশের মধ্যে বিরাজিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই চিহ্নিত করে
কবিতার অনুষঙ্গগুলিকে এবং প্রশ্নবোধক হয়ে
ওঠে সমস্ত জাস্টিফিকেশনগুলি। একটি ত্রিভূজে কবির সত্য এবং পাঠকের সত্য সম্মিলিত হয়ে
কবিতার সত্যে অনায়াস পৌঁছনো সম্ভব হয় না, তার আগেই আমরা ধাক্কা খাই একাধিক গলিতে
বিন্যস্ত রাস্তার কোনটি সঠিক এই ধারণার কাছে কারণ যুগের দাবি মেনে এখানে কেবলমাত্র
সরলরৈখিক একটি পথই স্বীকৃত নয়, সমান্তরাল অযাচিত বহু বাঁকেও বসানো থাকে 'রাজা', 'মন্ত্রী' ও নানাবিধ সৈন্যসামন্ত যেগুলি
অতিক্রম করে পাঠক যে কেবল স্বাভাবিকতারই সম্মুখীন হবেন এমনটিও নয়, দেখা মিলতে পারে
কোনো এক ভয়ংকর অন্ধকার লিপ্সা–আচ্ছন্ন স্কুল বাড়ি।
'অন্ধকারের
ভাষা আছে একটি। আমি/সেই ভাষা শেখানোর ইশকুলে পড়ি। যদিও/মনোযোগী ছাত্র আমি কোনওকালেই/ছিলাম
না। সহপাঠীদের কথা আমি এখানে/জানানো অনুচিত হবে। শুধু আমাদের তেমন/পারস্পরিক কোনও প্রতিযোগিতা
নেই।/অন্ধকারের এই ভাষা শিখেছিলাম বলে/ধীরে ধীরে অনেকেই আমার সঙ্গ ত্যাগ করে/গেছে।
তাদের ভয়ের কথা বুঝি। ঘুমোনোর/সময় তারা মাথার ওপরে খুলে রাখে /জানলা। দেখে এক অন্ধকার
কুয়োর মধ্যে/ চাঁদ পড়ে গিয়ে, ভেসে আছে তার মৃতদেহ।/এই বীভৎস দৃশ্য থেকে ভয় পাওয়া,
বিশেষ/অপরাধ নয়। অন্ধকারের ভাষা শিখেছিলাম/বলে আমি বুকের ভেতর একটা ক্ষীণ আলো/জ্বালিয়ে
রেখেছি।যাতে সিঁড়ি দিয়ে নামার/ সময় কোনও অসুবিধে না হয়। যারা সিঁড়ি দিয়ে নামে,
তাদের ভেতর কেউ নয়। শুধু/রোল কল হলে তারা নীরবে হাত তুলে, বসে/ পড়ে।' ('ভাষা শেখানোর
স্কুল', দীপ শেখর চক্রবর্তী)
এই কুয়াশা
, মোহভঙ্গই কি আশ্বস্ত জীবনকে নৈরাশ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়? তরুণ প্রজ্ঞা যত বয়োবৃদ্ধির
দিকে হেঁটে যায় খাতায় তত উপচে পড়ে রক্ত-পুঁজ-বমন, অসহ্য গন্ধে শীতল হয়ে আসে ইটের
ফাঁকে সঞ্চিত সূর্যরশ্মি। নিরুত্তাপ প্রদাহে এক পরষ্পরবিরোধিতায় লিখিত হয় পরাবাস্তব
কথন। তুমুল স্ববিরোধিতায় নষ্ট হয় 'আকাশের গায়ে কোটি বছরের প্রজাপতি ও বিশ্বাস' ঘুম
আর মৃত্যু সমার্থক হলে চেতনার জড়ত্ব গ্রাস করে আমাদের সমস্ত উচ্ছ্বাস; ক্লীবতা আর
বৈকল্যে ধুঁকতে ধুঁকতে 'সমস্ত দৃশ্য আমাদের
কাঠে, আগুনে আর আদরে মুছে যায় ক্রমশই...'('একটি পরাবাস্তব সিনেমার দৃশ্য', বিশ্বজিৎ
দাস)
এও এক আত্মক্ষয়,
আত্মনিবেদন–পথিকের সাধনাই তো তাই, নিজেকে চিনতে চিনতে জীবনকে চিনতে চাওয়ায় রত অসংখ্য
মুদ্রাদোষ সম্বলিত সত্তাদের ব্যপ্তি, একইসঙ্গে অনন্ত
কৃষ্ণগহ্বরে
, কিংবা আগুনের ব্যাধি-কূপে পতনোন্মুখ পতঙ্গ মন–এই দ্বিচারিতাও স্বেচ্ছাচার বৈকি! তাই
কখনো
'সু' জমছে।
অক্ষরে টোকা
দিয়ে পেড়ে নিচ্ছে ধানগন্ধ/
উপশম।'
আবার এড়াতে
না পারা 'স্বমেহন গেঁজিয়ে বিনির্মাণ।চিনে নিতে হয়/আত্মধ্বস, মচকানো ক্রিয়াপদ/এমনকি
স্বেচ্ছাচার' ('গুনগুন অন্ধকার', অরণ্যা সরকার)
এ পর্যায়ের
কবিতারা তাই স্বয়ং অসুখ আবার অসুখের অব্যর্থ নিরাময়। যে কবি নিরীক্ষণ করেন–
'চেনাশোনা
বর্তমান আসলে তা নয়/রহস্যে ঘেরা জাল অধিকারের আস্বাদ/ফুল ছিঁড়ে নাও থাকবে রসাল বৃন্ত/চাপা
চাপা আর্তনাদ' ('অভয়ারণ্য', সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)
তিনিই 'বিবর্ণ
কঙ্কাল' এ দেখতে পান 'বেঁচে আছে এখনও দুএক
প্রস্থ রঙ' ('নির্বাসন', ঐ)
'নদীর ভিতরে
আরও এক নদী' হয়ে থেকে যাওয়া চৈতন্যের নিরন্তর অভ্যেসে পালিত কবি-জীবন সংক্রামিতের
মত যাপন করে দূরত্ব, এই সময়ের কবিতা তাই দূরবর্তী; অনেকটাই হেমন্তের পরিসর। সন্ধ্যার
অবদমনে হতাশ্বাস আলো দিক পরিবর্তন করলেও তা শেষপর্যন্ত আপোষহীন। তাই আমরা স্বীকার করি
অথবা নাই করি প্রেম এবং প্রেমিকার মত কবিতা দিয়েই আজও পাথর গলানো হয়, যে পাথর আসলে
পৃথিবীর সনাতন দ্বিধা স্বরূপ।
ছবি ঋণ:সুবল দত্ত
0 মন্তব্যসমূহ