দেবব্রত সরকার :
দাদা আমি সাহিত্য পাত্রিকা "এবং সইকথা''র পক্ষ থেকে এসেছি । আপনার একান্ত
সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে ।
বিকাশ সরকার: এসো । বসো দেবব্রত ।
দেবব্রত সরকার: আপনি
কি একান্তে নিজেকে সাজিয়ে উঠেছেন । দেখে সময় সময় ভাবি । এ কবি বলেই সম্ভব হয়েছে
।
বিকাশ সরকার: (এক মুখ হেসে ) না না ঐ আর কি ।
দেবব্রত সরকার : দাদা চা বানালেন । চা খেতে খেতে। জানতে চাইলাম , দাদা আপনার
প্ৰথম কবিতা কোথায় ছাপা হয়েছে? তখন আপনার বয়স কত ছিল? আপনার নিজের কাছে সেরা কবিতা
কোনটি? একটু জানতে চাই।
বিকাশ সরকার: এটা ১৯৭৮ সালের কথা। আমি তখন অষ্টম শ্ৰেণিতে পড়ি। তখন আমার
একটা কবিতা বেরিয়েছিল ‘লাল নক্ষত্ৰ' পত্ৰিকায়। সেটা হলো আমার প্ৰথম প্ৰকাশিত
কবিতা। যদিও আমি ওই পৰ্বের কবিতাগুলোকে কবিতা বলে মনে করি না। তাই আমি কোনও
সংকলনেই সেই পৰ্বের কোনও কবিতা রাখিনি। আর সেই অৰ্থে প্ৰথম প্ৰকৃত কবিতা ‘দেশ'
পত্ৰিকায় বেরিয়েছিল ১৯৮২ সালে অৰ্থাৎ পাঁচ বৎসর পরে। কবিতাটির নাম ‘চিঠি পোড়ানো
উৎসব'। আমি একাদশ শ্ৰেণিতে পড়তাম। আমার এবং মল্লিকা সেনগুপ্তের দুজনেরই প্ৰথম
কবিতা ‘দেশ' পত্ৰিকার একই সংখ্যায় বেরিয়েছিল। আমি ওই ‘চিঠি পোড়ানো উৎসব'
কবিতাটাকেই মনে করি আমার প্ৰথম প্ৰকাশিত প্ৰকৃত কবিতা, যেহেতু আগের কবিতাগুলো আমার
নিজেরই পছন্দ হয়নি। তবে সেই কবিতাগুলোও কিন্তু অনেকেরই খুব পছন্দের ছিল।
সেরা কবিতা হিশেবে একটা বিশেষ কবিতার নাম বলা আমার পক্ষে
অসম্ভব। আমার প্ৰিয় কবিতার মধ্যে আছে বাবাকে নিয়ে লেখা ‘অনন্তছুতোর'। এটাই আমার
সবচেয়ে বড় কবিতা। এটা আমার পিতৃতৰ্পণ। ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি' আমার আরেকটা প্ৰিয়
কবিতা। ‘গয়েরকাটাসমগ্ৰ' আর ‘বিকাশঝোরা' কবিতাদুটিও এই তালিকায় রাখব। তবে সেরা
পঙক্তি কোনটা সেটা এক বাক্যে জবাব দিতে পারি- ‘আমি যা কিছু লিখি তার আধখানা লিখে
দেন বাবা'– এটাই আমার সেরা পঙক্তি।
দেবব্রত সরকার : আপনার প্ৰথম কাব্যগ্ৰন্থটি সম্পৰ্কে একটু বিশদ জানতে চাই।
বিকাশ সরকার: ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জলপাইগুড়ির সুশান্ত নিয়োগীর
উদ্যোগে প্ৰকাশিত হয় প্ৰথম কবিতা সংকলন ‘কনিষ্কের মাথা'। সুশান্তদা ‘যুদ্ধযাত্ৰা'
নামে একটি অসাধারণ পত্ৰিকা বের করতেন। একদিন আমাকে সুশান্তদা আমাকে বললেন, ‘বিকাশ
অন্তত গোটা কুড়ি কবিতা দাও। এবারের ‘যুদ্ধযাত্ৰা'য় তোমার গুচ্ছ কবিতা ছাপা হোক।
কুড়ি-পঁচিশটি কবিতা তুমি পাঠাও। আমি বাছাই করে নেব।' আমি কবিতা পাঠালাম। জুন-জুলাই
মাসের মধ্যে লেখা পঁচিশটি কবিতা আমি পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু সেগুলো যে বই হয়ে বের
হবে সেটা সুশান্তদা আমাকে বলেননি। নামটাও তিনিই পছন্দ করেছিলেন– ‘কনিষ্কের মাথা'।
এমন-কি কভার ডিজাইনটাও ছিল তাঁরই। বইটা বেশ হইচই ফেলেছিল। তবে প্ৰশংসার বদলে
নিন্দাই জুটেছিল বেশি। অশ্লীল কবিতা, নোংরা কবিতা, কবিতাই নয় এইসব– এমন প্ৰচুর কথা
শুনেছি তখন। গালিগালাজও শুনেছি। কিন্তু যাঁরা কবিতার প্ৰকৃত পাঠক তাঁরা কিন্তু
বইটির ভূয়সী প্ৰসংসা করেছেন। বিশেষ করে বৰ্ষীয়ান কবি নিত্য মালাকারের মন্তব্য আজও
মনে পড়ে। তিনি একটি আলোচনায় লিখেছিলেন, ‘কনিষ্কের মাথা'র কবিকে শ্ৰীবিকাশ সরকার না
বলে মসিয়েঁ বিকাশ সরকার বলাই যুক্তিযুক্ত, কেননা এই কবিতাগুলো বাংলাভাষায় ফরাসি
কবিতার সুগন্ধ। এই মন্তব্যটি আজও আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। উদ্দীপ্ত করে। এত বছর পর
বইটি ‘সৃষ্টিসুখ’ আবার নতুন করে প্ৰকাশ করল, সেটা থেকে বোঝাই যায় কবিতাগুলো অপাঠ্য
ছিল না। এই সুযোগে আমি প্ৰকাশক রোহন কুদ্দুসকে ভালোবাসা জানাতে চাই।
দেবব্রত সরকার : অভিযোগ ওঠে কবিতার দুৰ্বোধ্যতা নিয়ে। একজন অগ্ৰগণ্য কবি
হিসেবে আপনি কি স্বীকার কর যে কবিতায় দুৰ্বোধ্যতার বিষয়টা সত্যি রয়েছে?
বিকাশ সরকার: আজেবাজে অভিযোগ। আমি ‘দুৰ্বোধ্য' শব্দটাই ব্যবহার করব না,
কারণ দুৰ্বোধ্য শব্দটার মানে হল যেটা বোঝা যায় না। তুমি যেটাকে দুৰ্বোধ্য ভাবছ
সেটা তো আরেকজনের কাছে জলবৎ তরলং হতে পারে। তাই না? আজ আমার একটি কবিতা তুমি পড়লে,
পড়ার পরে তুমি বললে যে এটা বোঝা যাচ্ছে না; কিন্তু সেই কবিতাটিই কিন্তু আরেকজন
প্ৰাঞ্জল করে বুঝতে পারছে। তার মানে হলো দুৰ্বোধ্য কথাটা ঠিক নয়। যেমন ধরো আমার
সেই কৈশোরে লেখা ‘যুদ্ধবিরোধী কবিতা'টি। এখানে একটি পঙক্তি আছেঃ ‘গ্ৰাফের উপর
দাঁড়িয়ে উন্মাদের মতো হাসছেন বুড়ো কলম্বাস'। কেন লিখেছি তা অনেকেই জানেন না। এই যে
ক্ৰিস্টোফার কলম্বাস লোকটা, তাঁকে ইতিহাসে খুব মহান করে দেখানো হয়। কিন্তু আসলে এই
স্পেনিয়াৰ্ডটি এক চূড়ান্ত বৰ্বর মানুষ। উত্তর আমেরিকার আদিবাসী নিধনযজ্ঞের শুরুটা
করেছিলেন এই হাড়বজ্জাত লোকটা। যদি এই ইতিহাস তুমি না জানো তাহলে কবিতাটিও বুঝবে
না। কিছুই না জেনে যদি কেউ কবিতা পড়তে যায় তাহলে সমস্যা তো হবেই, সেটা পাঠকের
অক্ষমতা, কবির কোনও দায় নেই।
দেবব্রত সরকার : তার মানে পাঠকেরও দায়িত্ব রয়ে যায় কবিতা পড়ার জন্য নিজেকে
শিক্ষিত করে তোলার?
বিকাশ সরকার: অবশ্যই দায়িত্ব থাকতে হবে। দায়িত্ববান এই শ্ৰেণিটি বরাবরই
সংখ্যালঘু। যে ব্যক্তি পত্ৰিকা খুলে কবিতা পড়বেন তাঁকে প্ৰথমেই শিক্ষিত হয়ে আসতে
হবে। শিক্ষিত মানে কিন্তু আমি ডিগ্ৰির কথা বলছি না, এই যে শিক্ষার কথা আমি বলছি
সে-শিক্ষাটা হেচ্ছ ধারাবাহিক পাঠ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কবিতা নামক বিষয়টিকে সম্যক
আত্মস্থ করা। এটা তো আর পিএইচডি করেও পাওয়ার জিনিস নয়। এটা একটা ধারাবাহিক পাঠের
মাধ্যমে প্ৰাপ্ত স্বশিক্ষা, যা যে কোনও প্ৰকৃত কবিতাকেই হৃদয়ঙ্গম করতে সাহায্য
করবে। যে-কোনও সুকুমার শিল্প সম্পৰ্কিত শিক্ষাগুলো হলো সাধনা। এটা প্ৰযোজ্য
কবিতার ক্ষেত্ৰেও। তাই একজন কবিকে যখন আমি স্পৰ্শ করতে যাব, তিনি কী ভেবে এই
পঙক্তিগুলো লিখেছেন, তাঁর চেতনা কী সেটাও তো অল্পবিস্তর জানতে হবে। আর সেসব জানতে
গেলে কবিতার ধারাবাহিক উত্থান-পতনেরও যৎসামান্য জানতে হবে। তবেই না আসবে কবিতা
বোঝার প্ৰশ্ন। আমি একবার পড়েই তার আদ্যোপান্ত বুঝে যাব, এটা সম্ভব নয়।
দেবব্রত সরকার : এই যে পাঠকের সঙ্গে কবিতার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাহলে
সাহিত্যের ক্ষেত্ৰে বাংলা কবিতার অবস্থান ঠিক কোথায়?
বিকাশ সরকার: পাঠকের সঙ্গে কবিতার যে দূরত্বের কথা তুমি বলছ এটা কিন্তু
চিরকালীন একটা ব্যাপার। সারা পৃথিবীতেই দেখা গেছে যে কবিতার সঙ্গে সহবাস করতে
পারেন এমন পাঠক খুব কম। বিশেষত কবির সমকালীন সময়ে খুব কমই দেখা যায়। যার জন্য
অধিকাংশ কবির ক্ষেত্ৰেই দেখা গেছে যে তিনি সমকালে ততটা সমাদৃত হননি। ফ্ৰান্সের মতো
দেশে, যেখানে মানুষ অনেক বেশি শিল্পসচেতন সাহিত্যসচেতন, সেখানেও কিন্তু এই একই ছবি
দেখা গেছে। যেমন জঁ নিকোলা আর্তুর র্যাঁ বোর কথাই ধর না কেন, যখন জীবিত ছিলেন,
অৰ্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় কিন্তু তাঁর কবিতা একেবারেই সমাদৃত হয়নি। উপেক্ষিতই ছিলেন।
পাণ্ডুলিপি পৰ্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। শিল্পের নানা শাখার ক্ষেত্ৰেই এটা
সত্য। ভিনসেন্ট ভ্যান গখের কথাই ধর। গখের জীবদ্দশায় মাত্ৰ দু-তিনটে ছবি বিক্ৰি
হয়েছিল অত্যন্ত সস্তায়। আর এখন তাঁর ছবি কোটি কোটি ডলারে নিলাম হয়। পাঠকের সঙ্গে
কবির, দৰ্শকের সঙ্গে চিত্ৰকরের এই যে দূরত্ব তা হলো মেধার ফারাক। লেখালিখির
ক্ষেত্ৰে কবিতা হলো সবচেয়ে কঠিন মাধ্যম। কাজেই কবিতা বুঝতে হলে পাঠককেও শিক্ষিত
হতে হয়।একজন কবি বা একজন লেখক বা একজন নাট্যকার বা একজন চিত্ৰকর, এঁরা কিন্তু
সবসময়ই সমাজের যে আপামর জনসাধারণ তাঁদের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে থাকেন। তাঁদের
চিন্তাচেতনা, তাঁদের ভাববিশ্ব সবসময় অগ্ৰগামী। তিনি হয়তো ধর এই ২০২১ সালের একজন
কবি বা একজন চিত্ৰকর, অৰ্থাৎ তিনি বাস করছেন ২০২১ সালে, কিন্তু তাঁর মানসিকতা
কিন্তু ১০০ বৎসর পরেরও হতে পারে। শিল্পীরা সাহিতি্যকরা তাই ভবিষ্যতের মানুষ। তাঁর
সঙ্গে বা তাঁর সৃষ্টিকৰ্মের সঙ্গে একজন পাঠক যখন কমু্যনিকেট করতে চাইবেন, তখন এই
সমস্যা তো হবেই।
দেবব্রত সরকার : তাহলে এই যে দূরত্ব
তার কারণ কী?
বিকাশ সরকার: যাঁরা প্ৰকৃত
কবিতাপাঠক তাঁদের কাছে কিন্তু সমস্ত ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে যায়। তাঁরা বোঝেন কোনটা
বানানো আর কোনটা স্বতঃস্ফূৰ্ত কবিতা। যতই মানুষের মতো সেজে থাকুক, তাঁরা ঠিক ধরতে
পারেন এটা তো মানুষ নয়, এটা আসলে একটা রোবট। তবে এঁদের সংখ্যা কম। কোনকালেই-বা
এঁদের সংখ্যা বেশি ছিল বলো? প্ৰকৃত পাঠক, প্ৰকৃত শ্ৰোতা, প্ৰকৃত দৰ্শক– এঁরা
বিরলপ্ৰজাতির, চিরকালই। তেমনি প্ৰকৃত কবি বা চিত্ৰকরও বিরল। আমি ইেচ্ছ করে কিছু
কঠিন কঠিন শব্দ বসিয়ে দিলাম, অভিধান দেখে দেখে, তারপর একটা কবিতা তৈরি করলাম।
যেহেতু আমি নিৰ্মাণশৈলীটা বেশ ভাল জানি ফলে আমি একটা জিনিস দাঁড় করিয়ে দিলাম;
কিন্তু সেটা প্ৰকৃত পাঠকের কাছে ধরা পড়ে যাবে। জীবনানন্দের কথা ধর, জীবনানন্দ খুব
সহজ সরল শেব্দ ও পঙক্তিতে জীবনের কঠিন জটিল কঠোর সত্যগুলোকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন,
কিন্তু তাঁর আমলে বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্ৰনাথ দত্তেরা ছিলেন দাপুটে কবি। আজ জীবনানন্দ
সকলকে ছাপিয়ে গেছেন। তিনি তো প্ৰত্যেক প্ৰকৃত কবিতাপাঠকের হৃদয়ে। তাহলে বুঝেছ তো,
আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু কঠিন শব্দ দিয়ে একটা জিনিস তৈরি করলাম তাহলেই সেটা কবিতা
হলো না। কবিতার তো রস দরকার। জীবনানন্দের জন্য আজকের পাঠক পাগলের মতো। কারণটা খুব
সহজেই আমি জীবনানন্দের রস উদ্ধার করতে পারি, কবিতা হিসাবেও সেগুলি অসাধারণ, তাঁর
প্ৰতিটি কবিতাতেই আছে স্বকীয়তার স্পৰ্শ। তো দুটোই তোমার হতে হবে, ১. কবিতা হিসাবে
তার উত্তরণ হতে হবে, আর ২. সেটার রস যেন পাঠকের কাছে গিয়ে পৌঁছয়, এটা তো কবিরই
দায়িত্ব।তাহলে আর দূরত্ব থাকবে না।
দেবব্রত সরকার : উপন্যাস, গদ্য, ছোটগল্প, কবিতা সবচেয়ে বেশি আনন্দ কোথায় পান?
বিকাশ সরকার: একটা কবিতা লিখে উঠতে পারলে যে আনন্দ পাই সেটা একটা গল্প লিখে
উঠলে বা একটা উপন্যাস লিখেও সেই আনন্দই পাই। সবাই তো আসলে আমারই সন্তান, তাই
প্ৰত্যেকের প্ৰতিই অপত্য স্নেহ আছে। কিন্তু একটা কথা অনেকেই জানেন না, সেটা হলো,
আমি কিন্তু কবিতা দিয়ে আমার লেখালিখি শুরু করিনি, শুরু করেছিলাম নাটক দিয়ে। টানা
ছ'টি নাটক লিখেছিলাম এবং সবক'টিই একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছিল। কবিতার ক্ষেত্ৰে যেটা
হয় সেটা হল একটা ঘোর কাজ করে, একটা অতীন্দ্ৰিয়তাও বলতে পারো। এটা একটা খুব জমাট
বিষয় তো, তাই শব্দ খুঁজতে হয়, ছন্দটা কানে লাগছে কি না সেটাও ঠিক দেখতে হয়, এবং
সবার ঊৰ্ধ্বে হলো সেটাকে মানোত্তীৰ্ণ হতে হয়। কিন্তু আমি যখন গল্প বা উপন্যাস
লিখতে যাব, আমি প্ৰচুর শব্দ পাই হাতের সামনে, আমার কোনও সংলাপ বা বিষয় ব্যাখ্যা
করার অবাধ সুযোগ থাকে, প্ৰচুর স্পেস থাকে, তাই তুলনামূলকভাবে সেগুলো আমার কাছে
সহজতর মনে হয়। কিন্তু কবিতায় সেই স্পেস নেই, আমি খুব কম জায়গার মধ্যে প্ৰাচুৰ্যের
প্ৰাসাদ দেখাব, তো সেটা কিন্তু সবসময়েই চ্যালেঞ্জিং। আর যেটা চ্যালেঞ্জিং সেখানে
সাফল্য এলে তোমার তো আনন্দ বেশি হবেই। গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্ৰে আজ যেখানে গিয়ে
শেষ করলাম ওখান থেকেই আবার শুরু করা যায়। চাইলে সেটাকে আর একটু বাড়ানোও যায়।
কিন্তু কবিতায় ওটা হয় না। কবিতা থেকে শব্দ বাদ দেওয়া যায় না, জোড়াও খুব কঠিন।
কবিতা আসলে স্বপ্নের মতো, একবার ভেঙে গেলে আর সেই স্বপ্নে ফেরা যায় না।
দেবব্রত সরকার : শুরুর দিনগুলির কথা কিছু বলুন?
বিকাশ সরকার: ‘দেশ'-এ আমার ‘চিঠি পোড়ানো উৎসব' প্ৰকাশিত হওয়ার পর বাবা
একদিন বললেন, ‘এবার কিন্তু তোকে লিখেই যেতে হবে এবং লিখতে গেলে আরও পড়তে হবে।
এতদিন যা পড়েছিস, সেসব তো পুরনো লেখা। নতুন লেখালিখি পড়তে শুরু কর।' সে-সময়ে
মাথাভাঙার নকুল মণ্ডল, সুব্ৰত রায়; বানারহাটের অনুভব সরকার; বীরপাড়ার শিশির
রায়নাথ; ধূপগুড়ির চিত্ৰভানু সরকার; জলপাইগুড়ির সুশান্ত নিয়োগী, বিজয় দে, সমর রায়চৌধুরী,
শ্যামল সিংহ, গৌতম গুহরায়, শুভময় সরকার; শিলিগুড়ির অলোক গোস্বামী, কিশোর সাহা,
মৈনাক ভট্টাচাৰ্যের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তেন
আজকের খ্যাতিমান কবি প্ৰবালকুমার বসু, তাঁর সঙ্গেও আমার খুব হাৰ্দ্য সম্পৰ্ক তৈরি
হয়।এই সময় আমার পড়াশোনাও এক নতুন খাতে বইতে থাকে। আমি এ-সময় শাৰ্ল বোদলেয়র, পল
ভালেরি, ফ্ৰানজ কাফকা, আলবেয়ার কামু, জ্যাক কেরুয়াক, ওয়াল্ট হুইটম্যান, অ্যালেন
গিনসবাৰ্গ, গ্ৰেগরি কৰ্সো, উইলিয়াম বারোজ পড়ি। এবং জাঁ আৰ্তুর র্যাবোঁ। তবে শুধু
এসবই নয়। সালভাদর দালির ‘ডায়েরি অব এ জিনিয়াস', ভ্যান গখকে লেখা থিওর
চিঠিপত্ৰগুলি, বিটদের নানান সাক্ষাৎকার, মাগারেট এটউড-এরিকা জংয়ের কবিতা, ব্রেশটের
নাটক, লাতিন আমেরিকান লেখালিখিও পাঠ করি নতুন বন্ধুদের, বিশেষত সুশান্ত
নিয়োগী-শিশির রায়নাথ-অরুণেশ ঘোষ প্রমুখের সুবাদে।আমার পাঠ অভিজ্ঞতাতেই এই নতুন পাঠ
আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। এমন-কি নিজের আগের লেখালিখিগুলিও পানসে, বানানো মনে হতে থাকল।
আমি সে-সময় বহু কবিতা পুড়িয়ে ফেলি।
দেবব্রত সরকার : এক বিত্তহীন পরিবারের সন্তান, অনেক লড়াই করেছেন। সেসব কিছু
জানতে চাই।
বিকাশ সরকার: হ্যাঁ, আমি এক দিনমজুর পরিবারের সন্তান তো, ফলে মধ্যবিত্তদের
রংঢংগুলি খুব তীব্ৰভাবে লক্ষ্য করেছি। মধ্যবিত্তরা এই যে মূল্যবোধগুলি গড়েছে তা
স্ৰেফ আত্মস্বাৰ্থে; এর সঙ্গে সমাজের, দেশের কল্যাণের কোনও সম্পৰ্ক নেই। তাই তাদের
‘কনিষ্কের মাথা'র কবিতাগুলো সহ্য হয়নি। আমার কথাই ধরো না। আমার সহপাঠীদের বেশ কজন
ছিল বেশ ধনাঢ্য, বনেদি, রাজনৈতিক পরিবারের ছেলেমেয়ে। এদের ঘটা করে জন্মদিন হতো।
কারও জন্মদিনেই আমাকে কেউ কোনওদিন নেমন্তন্ন করেনি। আমাদের স্কুলে
রবীন্দ্ৰজয়ন্তীতে জাঁক করে সাতদিন উৎসব হতো। কোনওদিন কেউ আমাকে তাতে অংশগ্ৰহণ করতে
দেয়নি। আমি নাটক খুব পছন্দ করতাম। অথচ কোনও নাটকেই কেউ আমাকে ডাকত না। এসব কেন হতো
তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ। সব সমাজেই এটা ঘটে। সব শহরেই এটা বিভিন্ন ফৰ্মে
ঘটে।মধ্যবিত্তদের এই যে ভণ্ডামিসৰ্বস্ব সংস্কৃতি, তা আমি সেই স্কুলজীবনেই টের পেয়ে
যাই। বাবা বলতেন, ‘দুঃখ পাস না। এই ঘটনাগুলি উপভোগ করতে শেখ। একদিন এসব লিখবি।
লিখে দেখবি কত আনন্দ।' মধ্যবিত্তসুলভ এই দুঃখবোধগুলি তাড়ানোর জন্য বাবা আমাকে
নানান টোটকা দিতেন। কখনও বলতেন, ‘ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা'টা দেখলে তোর কষ্ট অনেক
কমে যাবে।' কখনও বলতেন, ‘বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী'টা পড়ে দেখ, মন ভালো হয়ে
যাবে।' তারপর যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন আমার চারপাশের এই ভণ্ডামিগুলিই খুব বড় হয়ে
ধরা দিল।
দেবব্রত সরকার : শৈশব-কৈশোরের কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাই।
বিকাশ সরকার: আমার শৈশব-কৈশোর বলতে কিছুই নেই। শুধু কমবয়সের কিছু
কঠিন-কঠোর-জটিল অভিজ্ঞতা আছে। আমার ‘অশুভ পঙক্তিসমূহ' কবিতাটির কথাই ধর। ওই যে
লিখেছি ‘আমি কোনওদিন ফুটবল খেলিনি, কেননা গাৰ্হস্থ্যের কাছে জমা আছে আমার রুগণ দুই
পা'। আমার সমবয়সি বন্ধুরা যখন খেলত, আড্ডা মারত, তখন আমাকে ভাতশিকারে বেরতে হতো।
জঙ্গলে, পাহাড়ে, করাতকলে, ছাপাখানায় আমাকে দুটো মুঠোভরা ভাতের সন্ধান করতে হতো। আমাদের
তীব্ৰ অভাবের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। পুজোর সময় আমাদের দেওয়া হতো স্কুলড্ৰেস। আমার
মেজ বোন, যে হেপাটাইটিসে মারা গেছে, একটা ববিপ্ৰিন্ট জামা চেয়েও পায়নি। কিন্তু তখন
সেই জামাগুলি ছিল খুব সস্তা। ‘দেশ'-এ যে আমার ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি' কবিতাটি বেরিয়েছে
তাতে আমার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলির কথা আছে। আমার বাবা একবার রেশন আনবেন বলে কুড়ি
টাকা ধার করেছিলেন, কিন্তু টাকাটা হারিয়ে যায়। সেদিন বাবাকে হাউমাউ করে কাঁদতে
দেখেছিলাম।
দেবব্রত সরকার : আপনার লেখায় অনেকের কথা পাই।তাঁরা
ধোপা, মজুর, শ্রমিক। এরা কী বাস্তবেই ছিলেন?
বিকাশ সরকার:
কিশোর বয়সেই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে নানা পেশায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। জঙ্গলে দিনহাজিরা করা, বাস-ট্ৰাক রং করা, দেয়াল লেখা, লিনো কেটে প্যাকেজিংয়ের ব্লক তৈরি করা, ফোটো বাঁধাই ইত্যাদি বিচিত্ৰ সব কাজ। এবং তথাকথিত অভিজাত বলতে যা বোঝায় তেমন কোনও বন্ধুও আমার ছিল না; বা উল্টো করে বললে বোঝায় গয়েরকাটার অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা এক ক্লাসে পড়লেও আমাকে বন্ধুর মৰ্যাদা দিত না। অবশ্য তাতে আমার খুব একটা দুঃখও ছিল না। আমার আশৈশব বন্ধু ছিল মদেশিয়া ছেলে ভটু গোয়ালা, কালিয়া লোহার, কামারের ছেলে হারি মূণ্ডা, বিহারি ধোপা শংকর রজক, নেপালি মুন্নি ছেত্ৰিরা।কিশোর বয়সেই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে নানা পেশায় জড়িয়েআমি এখনও গয়েরকাটায় গেলে শংকরের সঙ্গে কালিয়ার সঙ্গে আড্ডা দিই। তবে মদ্যপান করতে করতে ভটু আর হারি মৃত। মুন্নিও দারিদ্ৰ্যের ভয়ংকর তাড়নায় নিজেকে শেষ করেছে। এদের বন্ধুতা আমাকে লড়াই করার শক্তি জুগিয়েছে। আমার ‘বিষাদবালক' বইটিতে যে ‘বিকাশঝোরা' কবিতাটি আছে তা আসলে ভটুরই প্ৰেমগাথা। তেমনি ‘গয়েরকাটাসমগ্ৰ' কবিতায় তুমি মুন্নিকে পাবে, তিতো-হারিকে পাবে। এরা কেউই কোনও বানানো চরিত্ৰ নয়। আমার বেঁচে থাকার তীব্ৰ লড়াইয়ের দিনগুলিতে যা-কিছু প্ৰেম, যা-কিছু প্ৰেরণা, যা-কিছু পাথেয়–সব এদের কাছ থেকেই পেয়েছি। আর আমার পরিবার। আমার মা-বাবা-ভাই-বোন, পরে আমার স্ত্রী ও কন্যা সব্বাই যে বিপুল সমৰ্থন আমাকে চিরকাল জুগিয়ে গেছে তার কোনও তুলনাই হয় না। কেননা জীবনে এত আঘাত, এত বঞ্চনা, এত তাপ আমি পেয়েছি, আমার পরিবারের লোকেরা তা ভাগ করে না নিলে একা সইতে পারার ক্ষমতা আমার কস্মিনকালেও হতো না।
• PREMIK
PREMIKADER JONYO (প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য) Poems 1985
• PHnASIGAACHH (ফাঁসিগাছ) Poems 1987
• LENDU ROYER
JIJEEBISHA (লেন্দু রায়ের জিজীবিষা) Novel 1995
• JAAKE
DEKHAMATRO GULI KORA HOBE (যাকে দেখামাত্র গুলি করা হবে) Short Stories 1996
• KANISKER MATHA
O ONYANYO KOBITA (কনিষ্কের মাথা ও অন্যান্য কবিতা) Poems 1999
• JAADUR GAHANA
AAKHAA (জাদুর গহন আখা) Poems 2000
• AAGUNER SnEK (আগুনের সেঁক) Novel 2007
• GAIRKATASAMAGRA
(গয়েরকাটাসমগ্র) Poems 2007
• BISHAADBALOK (বিষাদবালক) Poems 2008 ISBN 978-81-7756-719-9
• NIRBACHITO
KOBITA (নির্বাচিত কবিতা) Poems 2009 ISBN 81-89742-78-7
• ANANTACHHUTOR (অনন্তছুতোর) Poems 2010 ISBN 978-81-7756-895-0
• AANANDADOTAARAA
(আনন্দদোতারা) Poems 2012 ISBN 978-93-5040-134-7
• NEELONTHEE
BROJO (নীলকণ্ঠী ব্রজ) Translation 2013 ISBN
978-93-82250-91-3
• APARUP KATHA 1,
2, 3 (অপরূপ কথা ১, ২, ৩) Translation of Fairy Tales, 3
Volume) 2014
• MANASAMANGAL (মনসামঙ্গল) Short Stories 2015
• ASTRO (অস্ত্র) ISBN 978-93-84186-05-0Novel 2015
• SHRESTHO KOBITA
(শ্রেষ্ঠ কবিতা)ISBN 978-93-80904-85-6 Collection of
Best Poems, 2017
• BIKASHJEEVON (বিকাশজীবন) ISBN 978-93-87715-03-5 A Collection
of writings about Bikash Sarkar, Edited by Gobinda Dhar 2018
• LENDU ROYER
JIJIBEESHA (লেন্দু রায়ের জিজীবিষা) ISBN 978-93-87715-57-8 A collection
of two Novels, 2020
• HALLUCINATION SERIES (হ্যালুসিনেশন সিরিজ) ISBN 978-93-87715-72-1 Poems 2020
1 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন