ভোর হল, দোর খোলো। বাইরে এক পৃথিবী সকাল আড়মোড়া ভাঙছে। এইসব সময়ে তার
শব্দ পায়, বাক্য পায়, রঙ পায়, পটি পায় এবং সে তাদের প্রতিহত করে। প্রাণপণে প্রতিহত
করে। উন্মাদ্গ্রস্ত থমথমে বাতাসে পেরোতে থাকে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রাক বা বাসের
শব্দ। তার তেরো তোলা ফ্ল্যাটের ওপরে দাঁত মাজা বা বাসনমাজার মত গা ঘিনঘিনে শব্দেরা
আসে না। আসে হাওয়ার শব্দ ও ম্যাক্সিমাম হালকা ভেসে আসা টিভিশব্দ। পাখিশব্দ বলতে
হতাশ বেহুদা শালিকের। কারণ সে নিয়ম করে ওদের বাসা খুঁজে বার করে ও ভেঙে দেয়।
বস্তুত এখানে শালিকের এত অত্যাচার সে মাঝে মাঝে এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টটিকে
‘শালিকনগর’ বলে ডাকে। সে বিছানা থেকে ওঠে ও মুতে এসে জিনস ও জামাটা গলিয়ে দরজা খুলে রাস্তায় চা খেতে বেরিয়ে পড়ে। শ্রাবস্তী এখন ঘুমোচ্ছে। পাশেই লিফট। লিফটের
বোতাম টেপার সময় প্রতিদিন সে মনে মনে
ভাবে কখন লিফটের রোপটা ছিঁড়ে লিফটটা তালগোল পাকিয়ে নীচে পড়বে। অবশ্য সেইমুহূর্তে
সে লিফটের ভেতরে না বাইরে থাকবে এই
সংশয় তাকে চিরকাল পীড়িত করেছে। এপাড়ার চায়ের দোকানের চরিত্রগুলোও অসম্ভব অস্থির ও মূর্খ। বাংলা কাগজ পড়ুয়াদের রাজনৈতিক
নুন-তেতো মেশানো আলোচনা। সে ভাবল, গান্ডুগুলো কেন টেলিগ্রাফ রাখে না ? রোজকার হতাশা ও বিরক্তি ছাড়াও ইংরাজি কাগজে আরও অনেক কিছু
থাকে। থাকে পাশ দিয়ে হেঁটে চলা মানুষের সচল ভাস্কর্য, কুকুর চিৎকারের মোমশিল্প, মর্নিং স্কুলে যাওয়া
মেয়েদের ঘুম ভাঙা চোখের পেন্টিং। সে সকাল
সকাল কাগজের বিবরণ থেকে ওই রঙ, রেখা, আয়তন গ্রাস করে নিতে চায় কিন্তু গিলতে পারে না। আসলে রোদ ওকে বাধা দেয়। ও জানে রাতে গভীরতা এলে এইসব রঙ ওর আরও
কাছাকাছি আসবে। আকার স্পষ্ট হবে অন্ধকারের ফ্রেমে। একমাত্র বিচ্ছিন্নতাই
নির্বিশেষকে বিশেষ করে তোলে। তাই ও ক্রমাগত অন্ধকারের প্রেমে যোগ্য হয়ে ওঠে। অবশ্য
শ্রাবস্তীর প্রেমেও খানিকটা...।
‘দিদি চা’ । দোকানের তরুণী মেয়েটি প্রতিদিনকার রোলকলের
নিয়মানুবর্তীতায় চিনি ছাড়া লাল চা এগিয়ে দেয়। তারপর ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে তার ভারী বুকের দিকে তাকায়। সেইমুহূর্তে তার মনে পড়ে সে আজ তাড়াহুড়োয়
ব্রা পরতে ভুলে গেছে এবং কোন ওড়না নেই। অবশ্য সে ওড়না খুব কমই ব্যবহার করে।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে বোঝে মেয়েটির বুক অপুষ্ট, ছোট কিন্তু অতিব্যবহৃত বলে ঝুলে
যাওয়া। তাই কি মেয়েটি তাকে...। পেটে চাপ বাড়ছে। তাকে দ্রুত চা শেষ করতে হবে। এরপর
খানিকটা হাঁটা। ওই দশদ্রোণের দিকটাতে এখনও খানিকটা নেকেড প্রকৃতি আছে। সে সাধারণত
ওই দিকেই যায়। তবে মন বেশি খারাপ
হলে চিনার পার্কের দিকে। মন খারাপ হলে সে ব্লু দেখে অথবা মানুষ দেখে। মিলিয়ে দেখে পঞ্চাশ হাজার বছরে এই হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি,
হোমো ইরেক্টাস বা আরও আরও প্রজাতিগুলো থেকে কতটা বিবর্তিত হয়েছে। মিলিয়ে দেখে তাদের চতুরতা, ও যৌন বুভুক্ষার কো-অর্ডিনেটের শিফটিং। এটা
অবশ্য বাসে উঠলে আরও ভালো বোঝা যায়। সে তাই পারতপক্ষে বাসে ওঠে না। বাসে
মাঝবয়সিনীদের গায়ে বা পাছায় লিঙ্গ ঠেকিয়ে যখন কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, সেই স্ত্রী
প্রজাতির প্রাণীটির সেটা অপছন্দের কিনা, সেটা তাদের তখনকার বডি ল্যাংগুয়েজ থেকে বেশ বোঝা যায়। সে তখন উৎসুক হয়ে তাদের লক্ষ্য করার চেষ্টা করে। একবার সে
দেখেছিল একটি টিশার্টের পিঠে সদর্প ঘোষণা ‘আপনার ওটিকে আমার পেছনে নয়, নিজের কাছেই
রাখুন।’ সব সময় অবশ্য বোঝা যায় না। অনেকে আবার ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগ করে। নড়াচড়া
করে অন্যের সুবিধে করে দেবার চেষ্টা করে। পরে বাড়ি ফিরে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে
হয়তো। বোঝা যায় এই যৌনপীড়ন স্ত্রীপ্রাণীটি বেশ উপভোগ করছে। এইসময় তার খুব হাসি
পায়। খাদ্য আহরণ বা যৌনতা কোন বিষয়েই মানুষ আসলে গত পঞ্চাশ হাজার বছরে খুব বেশি এগোতে পারেনি।
হেঁটে ফিরে গিয়ে এবার তাকে তার অসমাপ্ত কাজটা নিয়ে বসতে হবে। এখন সে
একটা মেল ন্যুডের সিরিজ করছে। সে মূলত সেইসব লাইনেই খেলে,
যেখানে ছবি বাজারে খাবে, কারণ এটা সে বুঝে গেছে ‘মানি ইজ দ্য পেট্রল অফ লাইফ’। সে তো আর কোনও বড় ছোটো দিদি বা পিসি নয়, যে তার তুলি মোছা ক্যানভাসও
লোকে টাকার বস্তা দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে। সে দেখেছে টাকার বাজারের সাপলুডোর সঙ্গে তার ছবিরও অনেকটা যোগাযোগ রয়েছে। যখন মানি মার্কেট ভালো থাকে, গ্যালারিগুলোর যেন আলাদা রমরমা, একজিবিশনের বাহার। মনে হয়
একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরাই সব ছবি কিনে রাখে। এখন যেমন মেল ন্যুড খুব ভালো খাচ্ছে। মার্কেট আরও রগরগে ন্যুড চাইছে,
যার ভেতরে একটা যৌন উন্মুখতা রয়েছে। এখন বেডরুমে একটা দুটো ন্যুড পেন্টিং পয়সাওয়ালা দম্পতিদের শিল্প
স্ট্যাটাসকে ঠেলে আকাশে তুলছে। আর কে না চায় তার ছবি বেশি বিক্রি হোক।
শ্রাবস্তীর অবশ্য কোনও ছবিতেই একদম ইন্টারেস্ট নেই। ছেলেদের ছবিতে তো
নেইই। তার কাজ সে ঘুরেও দ্যাখে না। ছেলে বাচ্চা থেকে শুরু করে সে কোনরকম পুরুষকেই পছন্দ করে না। এমনকি স্টাড
কুকুরকেও না। অবশ্য তাতে তার খুব একটা কিছু
আসে যায় না। সে শাহিনকে মডেল করে এই সিরিজটা করছে। শাহিনের সিক্স প্যাক, তার খুব ভালো লাগে। শাহিন করতেও পারে
অনেকক্ষণ ধরে আর করেও খুব ভালো। মডেল হিসেবে পয়সা চায় না। সব মিলিয়ে বেশ সস্তা ও পুষ্টিকর। যে কোনও
বিষয়েই ছেলেটার একটা আকর্ষণীয় আর মৌলিক মতামত আছে। সেইজন্যেই সে ভবিষ্যতেও মেল ন্যুড আঁকবে, এবং তার সঙ্গে
শোবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে ফ্ল্যাটে ফিরতে হবেই...। সে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল।
প্রথমত আমি কাউকে চাই না
সে একজন স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার মানুষ জাতীয় প্রাণী। যেহেতু আমাদের
আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে সরাসরি দাসত্বের প্রচলন এখন আর নেই ( ঘুরিয়ে দেখলে আছে তো
অবশ্যই)। সে কখনো কোনও মানুষের, পার্টির বা রাজনীতির দাসত্ব করেনি। যদিও ঠিক হোক বা ভুল হোক মার্ক্সবাদের বেসিক তত্ত্বগুলোর প্রতি তার বা আমার কিছুটা
দুর্বলতা এখনো আছে। সেই দুর্বলতার প্রকাশও কখনো
কখনো আমরা করে ফেলি। আজকাল অবশ্য মূল বিষয়টাতেই তার সন্দেহ হয়। আমরা সবাই কি আসলে বেঁচে থাকার দাসত্ব করি না ? লোকে জি-এফ বা বি-এফের বহু
ন্যাকামোও তো দাঁত কেলিয়ে সহ্য করে নেয়। আমাদের বাধ্যতামূলকভাবে সহ্য করতে হয়,
বাবা মায়ের অত্যাচারের দাসত্ব, স্বামী বা স্ত্রীর সম্পর্কের দাসত্ব, সন্তানের ইমোশনাল দাসত্ব, চাকরি বা অন্য কোনও খাদ্য সংগ্রহমূলক গ্যাঁড়াকলের
দাসত্ব, এবং কখনো কখনো নেশা বা কবিতা লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি না জায়েজ বেগুনি
ক্রিয়াপদের দাসত্ব। যা প্রকৃতপক্ষে হোমো স্যাপিয়েন্সের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকিরণের
ইতিহাসের একান্ত বিরোধী ও দ্বন্দ্বমূলক। আসলে গত বেশ কয়েকশো বছর ধরে “সমাজ” নামক বস্তুটির ক্ষমতা বা ‘র’ পাওয়ার আর
“বাজার” বস্তুটির বানিয়ে তোলা হাফ ইনফরমেশন অবিসংবাদী প্রভুর মত এমন এক পরিকাঠামো তৈরি করে দিয়েছে, যা অবিশ্রাম নজরদারি করে চলেছে আমাদের বিবর্তনের ওপর।
নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমাদের হাঁটা, চলা, আদর
করা, যৌনতা, খাদ্যাভ্যাস, ধারণা, এবং, ইত্যাদ্ প্রভৃতি সবকিছুকে। একটা উদাহরণ
দিলে ব্যাপারটা হয়তো পরিষ্কার
হতে পারে। কয়েকবছর আগে একজন বিজ্ঞাপন জিনিয়াসের মাথায় আসে, ছেলেদের সাবান ও মেয়েদের সাবান এই দুই সাবানকে পৃথকীকরনের ধারণা। ফলত, একই সাবান
দুটি ভিন্ন রঙে ও মোড়কে একই বাথরুমে একইসঙ্গে ঢুকে পড়ে, এবং পরিবারে সাবানের বাজেট এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এখন
লোকে সিরিয়াসলি বিশ্বাস করে মেয়েদের সাবান ছেলেরা মাখতে পারবে না কারণ তাদের স্কিনের গঠন ইত্যাদি,
ইত্যাদি...। এইভাবেই তো নৈতিকতা, শালীনতার ধারণাও ক্রমাগত পালটেছে বা পালটায়।
প্রাচীন মিশরে বংশের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য মায়ের পেটের ভাইবোনরা বিয়ে করতো, ভারতেই একটা ট্রাইবে এখনো মা ও মেয়ে একই পুরুষকে বিয়ে
করে। অবশ্য এগুলো হয় একটা পুরনো বা একদম বিচ্ছিন্ন ব্যাপার। যাই হোক, সে বিয়ে ব্যাপারটাকেই পছন্দ করে না কারণ তার মনে হয়, যে
কোন স্বাধীন চিন্তার ডিসকোর্স অন্যের উপস্থিতির প্রতিফলনে খানিকটা হলেও ডিভিয়েটেড
হয়। চিন্তা তো আলোর মতোই। একা থাকলেই একমাত্র আলোতে আগুন ধরানো সম্ভব।
আসলে
ব্যাপারটা হচ্ছে, গোদার একবার কোনও এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে সিনেমায় শুরু, মধ্যভাগ এবং শেষভাগ যে নির্দিষ্ট ক্রমেই আসতে হবে তার কোন
বাধ্যবাধকতা নেই।
‘রোল, ক্যামেরা, অ্যাকশন’...। আলতো করে শাহিনের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে শ্রাবস্তী। চোখ বন্ধ, শাহিনের
নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। আদর শিরশির করছে হাতের পাতায়, নাকের ও মুখের
স্পর্শে। শাহিন যথারীতি ঠাণ্ডা, ও প্রফেশনাল। মুখের ভেতরের মিন্টের গন্ধ তার নাকে
আসছে। ‘কাট’- ডিরেক্টর সুন্দর এগিয়ে আসে। ‘এক ঘর হয়েছে শ্রাবস্তী। শুধু তোর ডান
দিকে স্কিনের টোনটা একটু বার্ন আউট করে গেছে। ওকে, ওটা কোন ইস্যু নয়। এডিট ঠিক করে
দেবে। আফটার অল তোদের একটা কেমিস্ট্রি
তো ছিলই একসময়। শ্রাবস্তী আর শাহিন দুজনেই পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে। ‘যাই হোক।
খানিকটা ব্রেক। পোস্ট লাঞ্চ আবার কাজ শুরু করব। তোরা কস্টিউম চেঞ্জ করে নিস। পরের
সিনটা খুব ইম্পরট্যান্ট।’ শ্রাবস্তী কারো দিকে না তাকিয়ে চেঞ্জিং রুমের দিকে হাঁটা
দেয়। পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকরি। সেলেবদেরও কোন নিরাপত্তা নেই। শাওমির লেটেস্ট মডেলের ফোনটা এই
মুহূর্তে সাইলেন্ট মোডে। আয়না দিয়ে নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে শ্রাবস্তীর মনে পড়ে যায় আনন্দীর ভারী বুক দুটোর কথা। আনন্দী আর সে,
দুজনে নিউটাউনের একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করে। দুজনেই এক বিছানায় ঘুমোয়।
তবে শ্রাবস্তী যেমন যে কোন পুরুষ প্রাণীকেই পছন্দ করে না, আনন্দী তেমন নয়। সে
পেশাদার শিল্পী, পুরুষের শরীরের পেশী, ভাঁজ, কারভিং স্বাভাবিকভাবেই তাকে আকৃষ্ট
করে। আসলে জৈবনিক ভাবে প্রকৃতি পুরুষপ্রাণীদের সুন্দর করে গড়ে তুলেছে। যে কোনও
পুরুষ পাখির রঙের বাহার দেখলেই এটা বোঝা যায়। সেলফিশ জিনের বিস্তারের জন্যেই হয়তো
এটা প্রয়োজনীয়। সেই কারণেই মাঝে মাঝে শ্রাবস্তী ওর ওপর ভয়ঙ্কর রেগে ওঠে। আবার মাথা
ঠাণ্ডা হলে ওর অর্থনৈতিক বাধ্যতা ওকে আনন্দীর কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। একা একা
রাজারহাটের এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া জোগানোর ক্ষমতা ওর নেই। মডেলিঙের
টাকা যা হাতে আসে তার থেকে এজেন্সি অনেকটাই কেটে নেয়। না দিলে, কালকের থেকে নতুন কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে
যাবে। একটা এজেন্সিতে ঝামেলা করলে, গোটা কোলকাতার সব এজেন্সিগুলো একসঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এবং এটাও সত্যি, বাড়ি ফিরে
আনন্দীকে দেখলে ওর একটা নিরাপত্তার বোধও আসে। হয়তো ওর কোন্নগরের ছোটবেলা, বারবার
বাবার চাকরি হারানো, ভাড়া দিতে না পেরে এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ভেসে বেড়ানো,
এইগুলো মনের গভীরে ভেসে ওঠে। ও ছোটবেলা থেকে মাকে দেখেছে, বাবার অত্যাচার ও
নিপীড়নের শিকার একজন মানুষ। বাবার রোজগার কম, কিন্তু মেজাজ ছিল সাংঘাতিক। বাবা কখনো চিৎকার শুরু করলে সে আর তার বোন, ভয়ে চৌকির তলায় লুকিয়ে থাকত।
ওর বোন ছিল লেখাপড়ায় ভালো। কিন্তু লেখাপড়া ওর কোনও দিনই ভালো লাগত না। ও পছন্দ করতো নিত্যনতুন পোশাক, সাজগোজ। কিন্তু তা ছিল তাদের আয়ত্তের
বাইরে। একটু বড় হতেই বুঝতে পারল, এই
শরীরটা ছাড়া তার আর কোনও সম্পদ নেই। তবে এইটাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করার মত সহজাত
বুদ্ধি তার ছিল। প্রথমে পার্থদা, তারপর দেবাশিসদা, এভাবে একে একে দাদা ধরে ধীরে
ধীরে সে ওপরে উঠে আসার চেষ্টা করেছে। এভাবেই নতুন নতুন মইয়ের সুচারু ব্যবহার আজ
তাকে পৌঁছে দিয়েছে রাজারহাটের এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। পুরুষেরা ভেবেছে তারা তাকে ব্যবহার করছে, সে কিন্তু নির্ভুল জানতো তার
ক্যাপিটাল এই শরীরটা, এটাকে ইনভেস্ট করেই যা পাবার তাকে খুব দ্রুত পেতে হবে। আর
সেইজন্যেই হয়তো পুরুষদের প্রতি এখন তার একটা বিবমিষা এসেছে। সে নিজেও ঠিক বোঝে না,
সে প্রকৃত অর্থে লেসবো না বাই। তবে শাহিনের ব্যাপারটা তার কাছে ছিল সম্পূর্ণ
আলাদা। একমাত্র শাহিনই তার বোধকে প্রকৃত ঘেঁটে দিতে পেরেছিল। এবং তারপরই সে বুঝতে
পারে সম্পর্ক আসলে একটি ডায়াগোনাল অভ্যেস, যা আসলে ভিন্নমুখী দুটি সরল রেখাকে জুড়ে রাখে।
শাহিন কলেজ জীবন থেকেই মডেলিং করে। মেটিয়াবুরুজের ব্যবসায়ী বাড়ির
ছেলে, অভাব শাহিন ছোটবেলা থেকে কখনো দেখেনি। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ও জিম করা
শরীর, এবং লখনৌ ঘরানার মুসলমানি জিন তাকে সফল মডেল বানানোর দিকে সদর্পে এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার আপাত উচ্ছলতার আড়ালেও নিজস্ব
একটা গভীর আইডেন্টিটি ছিল। হয়তো সবাই
বুকের গোপনে সেই আইডেন্টিটি বহন করে চলে। একটা সোনার দোকানের অ্যাডফিল্মের কাজে তার সঙ্গে প্রথম শাহিনের আলাপ হয়। শাহিনের তহজীব
ও তকল্লুফ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে চার ফেলে এবং অল্পদিনের মধ্যেই বুঝে যায় মাছ গাঁথবে না। শাহিন তাকে
নিজের এজেন্সির মডেল কো-অরডিনেটরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। নতুন কাজ পেতে সাহায্য করে, কিন্তু বিনিময়ে সে কিছুই চায় না। যদিও শ্রাবস্তী দিতে
প্রস্তুত ছিল। তারা দুজনে সেইসময় অনেক কাজ একসঙ্গে করেছে। শ্রাবস্তীর জীবনে এইরকম
অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। তার মনে হয় নিজস্ব মিস্টার পারফেক্টকে সে পেয়ে গেছে।
এভাবেই একদিন একটা প্রোডাক্টের প্রমোশন পার্টিতে সে আর শাহিন । রাত গভীর হওয়ায়
শাহিন তার ফ্ল্যাটে থেকে গেছে। সেদিন আনন্দী নেই। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শাহিনকে
আদর করতে করতে ঘর বাঁধার প্রস্তাব দেয়। শাহিন সরাসরি তাকে জানায় সে যে পরিবারের
সন্তান, সেখানে কোন মডেল মেয়েকে সে বিয়ে করতে পারবে না। তার মায়ের পছন্দ করা সম্পর্কিত মাসতুতো বোন, যারা পারিবারিক ভাবে তাদের বংশের
উপযুক্ত, তার সঙ্গেই তার বিয়ে তার আব্বা ও আম্মা ঠিক করে রেখেছেন। এছাড়া সে নিজের
বউ হিসেবে যে আর্কিটাইপের কথা ভাবে তার সঙ্গে শ্রাবস্তী কোনভাবেই মেলে না। সরি।
এরপরও শ্রাবস্তী তাকে নিজের সমস্ত ম্যাজিক দিয়ে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করে, এবং
চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ হয়। সে সেই মুহূর্ত থেকে পুরুষের সঙ্জ্ঞা নতুন করে শিখতে শুরু করে। সে উত্তেজিত হয়, শাহিনকে অপমান করে, এমনকি তার গায়ে
হাত তোলে। ঠাণ্ডা ও শান্ত শাহিন তাকে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ না করে নিজের পোশাক
হাতে নিয়ে জাঙ্গিয়া পরে মাঝরাত্রে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। যৌনতার বিকল্পে তখন তার
হাতে শুধুমাত্র যোগ্য অন্ধকার। সেদিন থেকেই শ্রাবস্তী অন্ধকারকে ভয় পায়। রাত নামলে ভয় করে ওর। আলোপুরুষের প্রতি ওর ঘৃণা ও বিবমিষা বলকে বলকে উগরে ওঠে।
If rape is inevitable, enjoy it
আনন্দী সাধারণত নিজের ছবি শেষ হবার আগে কাউকে দেখায় না। প্রথমত সে
কাজ করে দুপুরের উজ্জ্বল আলোয়, যখন বাড়িতে আর কেউ নেই। তার রুম পার্টনার তখন বেরিয়ে গিয়েছে, কাজের
মাসীও বাসন ধুয়ে চলে গেছে। তার কাজ করার জায়গাটাও এমন কোনায় যে চট করে ইজেলটা চোখে
পড়ে না। এই ন্যুডটা সে একটা পুরনো বিজ্ঞাপনের আদলে আঁকছে। বিজ্ঞাপনটা সে তাদের
বাড়িতে পড়ে থাকা একটা খবরের কাগজে পেয়েছিল। মডেল ছেলেটার মুখের মধ্যে একটা কীরকম
কাঠিন্য আছে। সে এই রাফনেসটাকেই ধরতে চাইছে। তার এই ছবিটা একটা ধর্ষণের অ্যাবস্ট্রাকশন। জীবন তো
প্রতিমুহূর্তে আমাদের সবাইকে ধর্ষণ করে এবং নিজেও ধর্ষিত হয়। এই ভাবনার প্রতিফলন
রয়েছে তার এই ছবিতে। অবশ্য ছবিটা এখনো শেষ হয় নি।
শ্রাবস্তী সাধারণত
ছবিতে একদমই আগ্রহী হয় না। প্রফেশনাল হিসেবে সে অল্প অল্প ফটোশুট বোঝে। শুনে শুনে বোঝে মিটার, এক্সপোজার, মুখের ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল। তবে তার আগ্রহের
পরিধিও জলের বর্গক্ষেত্রের মত। অল্পসময় পরেই উবে যায়। আজ এককাপ সবুজ চা নিয়ে একা
ঘরে ঘুরতে ঘুরতে তার হঠাৎ কী মনে হল, সে ক্যানভাসটার সামনে দাঁড়াল। ঢাকা খুলতে তার দিকে চেয়ে আছে নগ্ন শাহিন। ক্যানভাসে সেই শরীরী
অন্ধকার যা সে একান্ত নিজের হিসেবে পেতে চেয়েছিল। এই সেই শরীর যা সে জাগাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে বার বার। এই
অন্ধকার যা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বারবার। সে ছোট থেকে যা যা চেয়েছে কোনও না
কোনও ভাবে হাত ফসকে তা উড়ে গেছে পরিচিত অন্য কারোর বাড়ানো হাতের দিকে। মা, বাবা সারাজীবন তার চেয়ে বোনকে বেশী ভালবেসে এসেছে, বোনের লেখাপড়ার
মাথা তার চেয়ে বেশী ভালো ছিল বলে। শেমলেস অ্যাজ এ ন্যুড স্ট্যাচু। আনন্দী তাহলে এখন এই শরীরের ঘ্রাণে
ডুবে আছে ? কেন কেন কেন ? হঠাৎ শ্রাবস্তী বাটার নাইফটা তুলে নিয়ে ক্যানভাসটার ওপরে
সরাসরি বসিয়ে টেনে দিল। তারপর ঘন কালো রঙ তুলিতে নিয়ে খুব আদরে বুলিয়ে দিতে লাগলো
শাহিনের নগ্ন শরীরে।
ব্যক্তির
শরীর, যৌন অভ্যাস, যৌন ভাবনা ইত্যদি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলির সাপেক্ষেই ক্ষমতা
নির্ধারণ করে দেয় তার সুস্থ বা অসুস্থতার প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা।
ঢেউযাপনের মত অস্থির হয়ে আসছে অন্ধকার। ভাঙাচোরা হরফ হয়ে
ক্যানভাসগুলো জেগে আছে। বিছানায় পরস্পরকে জড়িয়ে শ্রাবস্তী ও আনন্দীর নগ্ন জ্যামিতি। একটা চলে যাওয়া গাড়ি থেকে
আলোর বল্লম এই খরখরে টেক্সচারকে বিঁধিয়ে দিয়ে এইমাত্র ফিরে গেল। এভাবেই বিকল্প
তৈরি হয়। হাত উপচে একদিন আচরণ এভাবেই হয়তো খুঁজে নেবে আমাদের।
0 মন্তব্যসমূহ