কে ডাকছে নদীর ধারে? কে ডাকছে নির্জন দুপুরের উদাসী জানালায়? শূন্যে একটা চিল উড়ে যাচ্ছে। কার বাঁশি বাজছে দূরে । নির্বাক রমণী বসে আছে এলোচুলে। হাওয়ায় দুলছে ছাদের শাড়ি। হঠাৎ কার ভ্রু'র নাচন মনে পড়ে! ভাবনা শুধু বিস্তৃতি চায়। আলো-অন্ধকারে, শূন্যে কাছে দূরে — তার শুধু বলা, না-বলা পাক খায়।
এখানেই
ফিরে ফিরে আসি নীরব সংলাপে। দুরন্ত অদৃশ্য ঘোড়া। মৃত লণ্ঠন জ্বলে। প্রজাপতি
ওড়ে নাথিংনেস্এর বাগানে বাগানে। তুমি হাত বাড়াও —সোনালি যুবতী হাত। কত কত
সান্নিধ্যের আরাধনায় ডাকি। নৌকা যায় স্রোতের কাহিনিতে। রূপকথার আলো এসে পড়ে। তবু
সেই অন্ধকারে প্রাচীন জাদুকর ফিরিয়ে দেয় মৃতের প্রাণ। কাহিনি সমাপ্ত হলে আবার
সূচনার দিকে হাঁটে। সব প্রাণ পাখি। লালনে লালনে দেশ বাউল, অথবা বাউলানি। আমরা সবাই
মুগ্ধগীতি গাই। কেউ কেউ সোনার হরিণী পঞ্চবটীতে ফিরে পাই।
চোখ মেলেছি
চোখ বুজেছি
বুঝেছি হেয়ালি
যা বলেছি অথবা বলিনি
সবটাই লিখেছি ইশারায়
আমাদের বেঁচে থাকা
জীবনের ইশারা।
আমাদের ভাবনা শব্দের
ইশারা।
আমাদের কবিতা শৈল্পিক
পর্যটনের ইশারা।
দুয়ার খুলি । চাঁদকে
ডাকি । স্বপ্ন দেখি। ঘুমাই। জাগি । কান্না থামাই । হাসতে থাকি । বাসর সাজাই ।
বাসনা বাজাই। জ্বর ছেড়ে গেলে উঠোনে দেখি হলুদপাখি। রোদের ভাষা ছড়িয়ে পড়ে। শিশির
লেখে শরৎ বানান। খাতার পাতায় কুমুদ ফোটে। রং-পেন্সিল এসব পারে। তারপর সবাই শীতের
দিকে যেতে যেতে আগুন পোহাই।
আমাদের
আসক্তি-প্রশ্রয় প্রেম, পায়রা—মুকুট—ঢেউ সবই ইশারায় বাক্য হয়ে যায়। শীতল সুগন্ধ
মায়ায় শব্দ হয়ে যায়। সভ্যতা, পাশাখেলা, ভূলোক-দ্যুলোক, ছলাৎ ছলাৎ, ঝাড়ফোঁক,
হরিমতী, বিজ্ঞাপন আমাদেরই কৌশলী মগ্নহরণ চোখের প্রলাপ। এসবই সবাক-নির্বাক,
বোধ্য-দুর্বোধ্য। সসীম ও অসীমার বাগান। জল তুলে, জল ফেলে, কুয়ো খুঁড়ে, আগুন
নিভিয়ে, পরোপকারে নিরাকারে সহস্র বছর পার হয়। তবু আমরা তথ্য ও তত্ত্বের কাছে বসি।
গুমটি খুলে পান ও দেয়াশলাই বিক্রি করি। কবিতা এসে হেসে বসে।
কবিতার
দুরূহতা, সুদূর প্রসারিততা, গূঢ়তা ইশারারই ভাষাব্যঞ্জনে পরিব্যাপ্ত । অস্পষ্ট
অধিজগতের অনিয়ন্ত্রিত বিস্ময় নিয়েই তা চিরদিন বিমুগ্ধ করে এসেছে। থিওজজিক্যাল
ব্যাপার থাকলেও সময় ও সমাজের প্রজ্ঞাপনে সেই ইশারা বহুমুখী পর্যায়ে উত্তরণ
ঘটিয়েছে। আদি কবিতা চর্যাপদেরই সূচনায় লুই পা যখন লিখলেন :
“কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল
।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল
॥"
দেহ তরু। তার পাঁচটি
ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে। অর্থাৎ মানব শরীরকে বৃক্ষ হিসেবে উল্লেখ করে
তার পাঁচটি ডালকে পঞ্চইন্দ্রিয় বোঝানো হয়েছে। কুক্কুরী পা-এর পদে দেখতে পাই :
“দিবসহি বহুড়ী কাউহি
ডরভাই ।
রাতি ভইলে কামরু জাই
॥"
দিনের বেলা বউটি কাককে
দেখে ভয় করার ভান করে, কিন্তু রাতের বেলায় সকলের চোখ এড়িয়ে কামক্রীড়ায় যায়।
কুক্কুরী
পা-এর আর একটি পদে দেখতে পাই :
“টালত মোর ঘর নাহি
পড়বেষী।
হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি
আবেসী ॥
বেঙ্গ সংসার বডহিল জাঅ
।
দুহিল দুধু কি বেণ্টে
ষামায় ॥"
টিলায় ঘর । কোনো
প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাতও নেই। নিত্যই উপোস অতিথির। অথচ ব্যাঙের সংসার বেড়েই
চলেছে। দোয়ানো দুধ আবার বাঁটে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যাঙের অসংখ্য ব্যাঙাচির মতো সন্তান।
এবং অর্জিত খাদ্য খুবই কিঞ্চিৎকর বলে অকুলান হয়। তাই এই উপমাগুলি সেই ইশারা বহন
করছে। সিদ্ধাচার্যদের কাছে দেহই ব্রহ্মাণ্ড। দেহকে ঘিরেই শ্বাসবায়ুকে সঠিকভাবে
নিয়ন্ত্রণ করে মহাসুখ বা সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব। তাঁরা কুলকুণ্ডলিনীরূপিণী শক্তিকে
জাগাতে চাইলেন যোগসাধনার দ্বারা। এরই সংকেতবহ ভাষা ব্যবহার করলেন চর্যাপদে।
ইশারাবদ্ধ হল পদগুলি। তেমনি দেহযন্ত্রে সংকেত পেতে চাইল শিবশক্তির অলৌকিক অনন্তের
মহিমায় ।
"শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে"র
রাধা যখন বললেন :
“
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি
কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি
এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর
বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো
আঊলাইলোঁ রান্ধন।।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি
সে না কেন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ
নিশিবোঁ আপনা।।ধ্রু।।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি
চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ
কৈলোঁ কোণ দোষে।।
অঝর ঝরএ মোর নয়নের
পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ
বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।।
আকুল করিতেঁ কিবা
আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী
নান্দের নন্দন।।
পাখি নহোঁ তার
ঠাঞি উড়ি পড়ি জাওঁ।
মেদনী বিদার
দেউ পসিআঁ লুকাওঁ।।
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি
জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে জেহ্ন
কুম্ভারর পণী।।
আন্তর সুখাএ মোর কাহ্ন
আভিলাসে।
বাসলী শিরে বন্দী গাইল
চণ্ডীদাসে।।"
রাধা শ্রীকৃষ্ণের
প্রকৃত ভক্ত বলেই তাঁর বাঁশি শুনতে পান। বাঁশিই পরব্রহ্মের ইশারা । তাই পার্থিব
কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। শরীর ও মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। গোঠ গোকুলের ডাককে উপেক্ষা করা
যায় না। তাঁর কাছে তো ভক্তের আত্মসমর্পণ করাই একমাত্র উপায়। পাখি হলে তিনি উড়ে
চলে যেতেন। কুমোরের চাকের মতো মন পুড়ে যাচ্ছে। সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলিতেই ভগবানের এই
বাঁশি বেজে চলা ভক্তগণ শুনে থাকেন। তাই তাঁদের অভিসার, চরম কৃচ্ছ্রসাধনা চলতে
থাকে। বর্ষা, বজ্রপাত, গুরুজনের বাধা, কিন্তু তারপরও কি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলন
ঘটবে? ভক্ত যদি “মানস সুরধনী" পার হতে না পারে? গোবিন্দ দাস বলেছেন :
“সুন্দরি কৈছে করবি
অভিসার।
হরি রহু মানস
সুরধনীপার।"
একটি ইশারা “মানস
সুরধনীপার" অর্থাৎ হরি যদি মনে না থাকে তো বাইরে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
চণ্ডীদাসের রাধা সাধিকা । তাঁর ইশারা দেহের মধ্যেই ফুটে ওঠে। ভাবে ও আচরণে স্পষ্ট
হয়। রাধা একদৃষ্টে আকাশে চেয়ে থাকেন। ময়ূর-ময়ূরীর কণ্ঠ নিরীক্ষণ করেন। মেঘে মেঘে
খুঁজে পান। পূর্বরাগের সেই সর্বময় ইশারা প্রাকৃতিক আয়োজনেই সমৃদ্ধ। পদকর্তা বলেন :
“চণ্ডীদাস কয় নব
পরিচয়
কালিয়া বঁধুর
সনে।"
এই আধ্যাত্মিক ইশারা
আধ্যাত্মিক পূর্বরাগেরই পরিচয় বহন করে চলেছে।
বাউল
সাধক এবং সুফি সাধকেরাও মনের মানুষকে খুঁজেছেন নিজের মধ্যেই। নিজেরই নানা
কর্মক্রিয়ার ইঙ্গিতে উপলব্ধিও করেছেন। এ যুগের গায়কও (রুবেল ভট্টাচার্য) যখন গেয়ে
চলেন :
“ইশারায় কইবি কথা গোঠে
মাঠে
দেখিস যেন কেউ না জানে
কেউ না বোঝে কেউ না
শোনে
কিছুদিন মনে মনে ঘরের
কোণে
শ্যামের পিরিত রাখ
গোপনে........."
তখন সেই গুহ্যতত্ত্বের
কথাই এসে যায়। চর্যাপদের “অপনা মাংসে হরিণা বৈরী" থেকে লালনের “খাঁচার ভিতর
অচিন পাখি" কিংবা সুফি সাধক শাহ ফরিদুদ্দীনের :
“তপি তপি লুপি লুপি হাথ
মরোড়উ ।
বাউলী হোউসো শহু লোরউ ॥
তই সহি মন মহিঁকীয়া
রোষ।
মুঝ অওগণ সহি (তাস)
নাহি দোষ ॥"
অর্থাৎ “বিরহ-জ্বরে
পুড়ে পুড়ে আমি হাত জোড় করছি। পাগলী হয়ে আমার স্বামীকে খুঁজছি। সখি, সে মনের
মধ্যে রাগ করেছে আমার গুণহীনতায়। তার কোনো দোষ নেই।"
এই স্বামীও মনের মানুষ।
যে কৃষ্ণ, সে-ই তো প্রিয়তম। সে-ই তো রবীন্দ্রনাথে এসে “জীবনদেবতা"। সব
বিশেষ্যগুলিই “তুমি* সর্বনামের ইশারায় মিশে গেল। রবীন্দ্রনাথও গাইলেন :
“যে কেবল পালিয়ে
বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে,
সে কি আজ দিল
ধরা গন্ধে-ভরা বসন্তের এই সঙ্গীতে॥
ও
কি তার উত্তরীয় অশোকশাখায় উঠল দুলি।
আজ
কি পলাশবনে ওই সে বুলায় রঙের তুলি।
ও
কি তার চরণ পড়ে তালে তালে মল্লিকার ওই ভঙ্গীতে॥
না
গো না, দেয় নি ধরা, হাসির ভরা দীর্ঘশ্বাসে যায় ভেসে।
মিছে এই
হেলা-দোলায় মনকে ভোলায়, ঢেউ দিয়ে যায় স্বপ্নে সে।
সে
বুঝি লুকিয়ে আসে বিচ্ছেদেরই রিক্ত রাতে,
নয়নের
আড়ালে তার নিত্য-জাগার আসন পাতে--
ধেয়ানের
বর্ণছটায় ব্যথার রঙে মনকে সে রয় রঙ্গিতে॥"
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র
সৃষ্টিতেই এই ইঙ্গিত জাগ্রত করেছেন। পরমাত্মাকে “সে", “তুমি",
“প্রিয়তমা", “সুন্দরী" “অসীম", “বড়ো আমি" বলে উল্লেখ করেছেন।
নিজে ভিখিরি হয়ে, অতিথি বা দরবেশ হয়ে হাত পেতেছেন। রহস্যলোকের চিরন্তন সেই ডাক
তাঁর “ডাকঘর" নাটকের অমলের কণ্ঠে। “রাজা" নাটকের রানির আকুলতায়।
"রক্তকরবী"র রঞ্জনের বিদ্রোহে । “সোনার তরী"র “নিরুদ্দেশ যাত্র"তে
“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী"র বিস্ময়ে :
“আর কত দূরে নিয়ে যাবে
মোরে
হে
সুন্দরী?
বলো কোন্ পার
ভিড়িবে তোমার
সোনার
তরী।
যখনি শুধাই, ওগো
বিদেশিনী,
তুমি হাস শুধু,
মধুরহাসিনী--
বুঝিতে না পারি, কী
জানি কী আছে
তোমার
মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি
তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে
আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে
তপন
গগনকোণে।
কী আছে হোথায়-- চলেছি
কিসের
অম্বেষণে?"
রহস্য রোমাঞ্চ ঘেরা
ইঙ্গিতের এই শৈল্পিক পর্যটন। অফুরন্ত অভিসার যাত্রা। মনের মানুষ মনে থাকলেও তাকে
উপলব্ধি করার আয়োজনেই কবিরা তাঁদের সৃষ্টিকে বহুমুখী করে তুলেছেন। প্রকৃতিও তাঁদের
কাছে পাঠশালা হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশও এই শৈল্পিক অভিসারে বনলতা সেনের মুখোমুখি
বসেছেন, যখন শুধু অন্ধকারই বিরাজ করেছে চারিদিকে। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের
মতন রাত্রি নেমে এসেছে। ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলেছে চিল। সব পাখি ঘরে এসেছে,
সব নদীও। তখন তো জীবনের সব লেনদেন হারিয়ে গেছে। অথবা “রূপসী বাংলা"য়ও মৃত্যুর
ইঙ্গিত, নির্জনের ইঙ্গিত, একাকীর ইঙ্গিত আরও দুর্মর হয়ে উঠেছে। কবি লিখেছেন :
“তোমার বুকের থেকে
একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চলে
যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক
ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, – কুয়াশায়
ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান
একদিন; – হয়তো বা
নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো
ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে –
হৃগয়ে ক্ষুদের গন্ধ
লেগে আছে আকাঙ্ক্ষার তবু ও তো চোখের উপরে
নীল মৃত্যু উজাগর –
বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ –
কখন মরণ আসে কে বা জানে
– কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাল ভাঙে – ছিঁড়ে
ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ
জানি নাকো; তবু যেন মরি
আমি এই মাঠ – ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন
এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে –
রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে;— তারি নিচে
শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।"
নক্ষত্র ঝরার ইঙ্গিত,
কুয়াশায় রূপশালী ধান ঝরার ইঙ্গিত, গাংচিলের শালিকের প্রাণ ছিঁড়ে নেওয়ার ইঙ্গিত,
ঝড়ে পদ্মের নাল ভাঙার ইঙ্গিত। নিমপেঁচার অন্ধকারে গান গাওয়া, হৃদয়ে আকাঙ্ক্ষার
খুদের গন্ধ সবই তো জীবনের ভেতরে বাসনার বাজনা। তারপর বাঁকাচাঁদ, শূন্যমাঠ, শিশিরের
ঘ্রাণ সবই এই বাসনাকে উজ্জীবিত করার রূপচিত্র । মৃত্যু এবং জীবন এবং সবশেষে
“অর্ধনারীশ্বর" সেই প্রজ্ঞারই অনুরণন যা পরোক্ষভাবে শিল্পীর ব্যাপ্তি ও
শাশ্বত অনুজ্ঞার প্রশ্রয়। “অবসরের গানে"ও কবি লিখেছেন :
“সে-সব পেঁচারা আজ
বিকেলের নিশ্চলতা দেখে
তাদের নাম ধরে যায়
ডেকে ডেকে।
মাটির নিচের থেকে
তা'রা
মৃতের মাথার স্বপ্নে
নড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভুত ইশারা!"
শিশিরের জলের স্বাদ
ইঁদুরেরাও জানে। কিন্তু মৃত সেই ইঁদুরদের নাম ধরে ডাকলে মাটির নিচ ইশারা জেগে ওঠে।
ইশারার মৃত্যু নেই। বিনয় মজুমদারও তাঁর চেনা রাস্তাটিকে অনন্তে পৌঁছানোর রাস্তা
এবং বাড়িটিকে অনন্তের বাড়ি বলেছেন। “মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে
যায়" এই ইশারাও মানুষের জীবিত সত্তার প্রকাশকে অনন্তের সারসের নিরিখে নিবেদন
করেছেন। ইংরেজ কবি পি বি শেলি প্রতিটি কবিকেই তো ইশারার পাখি বলে মনে করতেন। তাই
তিনি লিখেছিলেন :
“A Poet is a
nightingale who sits in darkness, and sings to cheer its own solitude with
sweet sounds; his auditors are as men entranced by the melody of an unseen
musician, who feel that they are moved and softened, yet know not whence or
why.”
অন্ধকারে বসে থাকা
নাইটিঙ্গেল মধুর সুরে গান করে। তার নিজস্ব নির্জনতা যেমন প্রফুল্ল করে তেমনি
অন্যদেরও তার সুরের অবগাহনে সঞ্জীবিত করে। তারা ভাবতে থাকে সে কীরকম পেলব ও নরম
হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ জানে না কেন এই গান। কোথা থেকে তার উদ্ভব। ইশারা সেই গোপন
সত্তাটির অনন্তযাপনের প্রজ্ঞাময় বোধের ভাষা । যা বলা যায় না। উপলব্ধি করা গেলেও
প্রকৃত সত্যকে বোঝা যায় না। প্রকৃত সত্য তো বিষাদ, কষ্ট, শূন্যতা ও ব্যর্থতারই
প্রজ্ঞাপারমিতা । তার ভাষা চিরদিন উহ্যই থেকে যায়।
0 মন্তব্যসমূহ