প্রবাহে প্রবাহে
নদীর কাছে এলেই আমার ঘাটের কিনারে চুপটি করে বসে সাদা আদ্দির ফ্রক পরা উস্কোখুস্কো চুলের এক দোলনা। দোলে আর দোলে। তার গায়ের ভেতর বেশ গাঁদা ফুলের গন্ধ।মিষ্টি, তীব্র অথচ যাই যাই ভাব। পাশাপাশি বসে থাকি,সে দুলতেই থাকে। পরিচিত জগৎ চরাচরে হৈ হুল্লোড় আসা যাওয়া এক সময় চোখের ভুল বলে মনে হয়। ওর দিকে চেয়ে থাকি। অভিমানে ঠোঁট ফোলায়। দুমুহুর্ত স্থির হয়েই ঝরনা হয়ে ওঠে।
আমার কত কথা ডুব সাঁতারে মেহগিনি বনে লুকিয়ে যায়,সাঁঝবাতির নরম
আলোয় মুখটুকু দেখে কে?ফ্যাকাশে আলো নিয়ে আকাশ, চুঁইয়ে ওঠা অপমানের ঠোঁট মুছিয়ে
দেবে বলেই শিউলি ছড়ায় উঠোন জুড়ে। এই তো আসন্ন সন্ধ্যাকে আঙুলে জড়িয়ে এসেছি,মনে
রেখেছো কি আমায়? নাকি ভুলে গেছো বেমালুম?
কি কাণ্ড ভুলি তার যো আছে? বিক্রমাদিত্যের মতো ঘাড়ে করে বয়ে
বেড়াচ্ছি।এতটুকু সুযোগ পেলেই অস্তিত্ব জানান দেয় স্বমহিমায় আর আমি কেবল বেভুল হয়ে
পড়ি। নদীর কাছে পালিয়ে আসি সেতো কেবল মুখ দেখবো বলেই।বিস্ময়ে তাকায় সেই ঘোলাটে
চোখ? প্রশ্নটা বুঝতে পারি কিন্তু কি করে বোঝাই কি চাই? হয়তো একটা নৌকো।চিরকালের মতো
ভেসে যাওয়া যাওয়া যাবে এমন একটা। তখন আনমনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যায় ঘোর লাগা
নৌকার ছইয়ের ভেতর।ভোরের আলোয় আস্ত একটা সবুজ পাহাড় আবিস্কারের পর ঝরনা হয়ে ঝাঁপিয়ে
পড়তে সময় লাগেনা। সকালের বাসি মুখে উড়ে আসে শৈশবগন্ধ আবার দুপুর বাড়লে পাহাড়টা নীল
সমুদ্র হয়ে যায়।ভাসিয়ে মাতিয়ে ডুবিয়ে নিয়ে যায়। পিঠের মধ্যে লেগে থাকা কাঁটাগুলো
ঘষে ঘষে তুলে দেয়। হাওয়ায় উড়তে থাকে জমিয়ে রাখা নোনা মুহূর্ত।সন্ধ্যা হলে ঘিয়ের
প্রদীপের গন্ধ আচ্ছন্ন করে। সন্ধ্যামালতীর ঝোঁপের পাশে হিসেব মেলাতে বসলে
রঙিন আকাশ হয়ে তার পাশটিতে আমায় হাত ধরে নিয়ে বসায়।নীচে শান্ত ব্যর্থতার দীঘিতে
মুখ দেখি,সন্ধ্যাতারা হয়ে। নৌকোটা খুঁজে পেলে এমন অনেক কিছুই ঘটে যায়। শুধু
কতটা,ঠিক কত পা হাঁটলে পাওয়া যাবে এই ধাঁধাঁ কাটিয়ে উঠতে পারিনা। কারণ রাত হলে
আজকাল আর নেশা জমে না তেমন। ঘোর হিসেবী মন খেরোর খাতায় নামতা পড়ে। সেও বোধহয় তখন
ভেসে যায় চেনা স্রোতে।
আমার নীলচে ব্যথা তার চোখেও উজিয়ে আসে। যেন বলে আমাদের কল্পনার
কোনো সমাধান নেই তাই সাধ,সাধ্যের মধ্যে রাখিনা আমরা। এই মিলটুকু আজীবন বেঁধে
দিয়েছে আমাদের। নদীও ঘোলা হতে থাকে।ভিটেকুমারীর পুজোয় শিমুল ফুলের স্তূপে হাতড়াতে
থাকে উপড়ে নেওয়া শেকড়,বুক থাবড়াতে থাকে,ও আমার হারিয়ে যাওয়া চুকিতকিত একবার
ঝাঁপিয়ে আয় জীবনে,রেখায় রেখায় বদলে যাক ছন্দ নতুন করে শুরু করি আরেকবার।গলা জড়িয়ে
কাঁদি দুটিতে। নদীর প্রবাহ আমাদের সহজ করবে বলে গান ধরে। "দুর্লভ মনুষ্য জন্মে
কি পূণ্য কাজ করেছো/জন্ম হলে মৃত্যু আছে তার উপায় কি ভেবেছো?" ভাবিনিতো ও
সদানন্দ কাকা আমায় নেবে তোমার নৌকায়? নীল ছাপা লুঙ্গিতে সোডার গন্ধ।তেলচিটে চুলে
পান খাওয়া দাঁত হাসে।উঠে পড়ি,জড়ো হয়ে বসি।সেঁউতিতে পা ছোঁয়াই। পরখ করে নিতে চাই আমি
কি অন্নপূর্ণা?পিঠের জরুলে আঙুল ছোঁয়ায় শৈশব। এই যে এখনো দেখা হয় এখনো মনে আসে
ইঁটের রাস্তার ধুলো এইতো পরম পাওয়া। সহজ হয়ে থাকা কি কম রে মণি?
সব তেতো লাগছে রে এই তামাম দুনিয়া বড্ড তেতো।বুকে টেনে নিয়ে কে
যে কখন আছড়ে ফেলে কে জানে?শুধু ব্যথা টনটন করলে এমন কুয়াশা হয়।শীতের ভেতর উদোম
হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ঐ দেখ চেনা ঘরে চেনা মুখের ওম সুখ শুধু এই পোড়া ভাগ্যে
নিমন্ত্রণ জোটেনা,হ্যাংলার মতো যেচে যাবো! সেই জোর পাইনা।কৌলিণ্য না থাকলে
অর্বাচীনকে কত আর জাপটে ধরা যায়রে মণি! সন্ধ্যামালতীর গাছটা ছেঁটে দিলো
হরিমতী,বলে,গেঁয়ো গেঁয়ো লাগে এখানে সাইকাস লাগালে আভিজাত্য বাড়বে। তাই হবে হয়তো
আমার শুধু অম্বলের চোঁয়া ঢেকুর। ছ্যাঁক লেগেছে বুঝলি!বাতিল হলে এমন মাথাব্যথা,জ্বরজ্বর,গলার
কাছে দলা পাকানো ভাবনা উপসর্গ গুলো চিলচিৎকার জোড়ে। ঐ দেখ শকুনের দল ওৎ পেতেছে এবার
আমায় ছিঁড়বে বলে।আত্মগোপন করার জন্য মহাপ্রস্থানে যাইরে। রইলো এদিককার জমি জিরেত
ফেরার ইচ্ছা হলে একঘরে থাকার আড়াল নিয়েই ফিরবো নয়তো ঝাপসা হতে আর কতক্ষণ?
আমার ভেতর কথা বলে সে বা তার ভেতর আমি। শুধু বুঝি নদীর কাছে
ফিরতে আমাকে হবেই। সঙ্গত কারণ ছাড়াই নিজেকে খুঁজে পাই যদি কোথাও অনায়াসে তবে ছাড়ি
কি করে? প্রবাহে প্রবাহে কত কথা,কত নাম,কত ডাক। যা কিছু হারিয়েছি যা কিছু অতীত সব
কিছু ফেরৎ পেতে হলে আমায় আসতে হবে।বহুদিন একই ছিলাম সংসারের চেনা ছকে এবার কিঞ্চিৎ
ফ্যাকাশে বা বর্ণহীন হয়েছি হয়তো।প্রয়োজন ফুরাবে এই তো নিয়ম। সবকিছু ধীরে ধীরে সরছে
মনে হচ্ছে। চুপ করে হেরে যাওয়া দেখবো ভেবেছি। জানি এ সময় কেটে যাবে। তারপর নতুন করে
জেগে উঠবো। পাহাড়,সমুদ্র আর জঙ্গল একসাথে আঙুলে জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরবো
দিগন্ত। হয়তো চুপ করে থামবো,বসবো...নদীটার পাশে।
0 মন্তব্যসমূহ