চৌকি থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। যদিও মা, বাবা পই পই করে বারণ করেছে এইসময় পা ঝুলিয়ে রাখতে। তবু আমার বেশ লাগে। কুল কুল করে শব্দটা পাচ্ছিলাম, তখন বুঝতে পারছিলাম আসছে। এবার আমার পায়ের পাতা স্পর্শ করল, খেলে বেড়াতে লাগল, আমি জানি এরপর বাড়বে। তবে হাঁটুর কিছুটা নিচেই থেমে যাবে। তখন চলে আসতে পারে খরিস বা কালাচ। পা খানিকে যদি আশ্রয়স্থল ভেবে বসে! আশ্রয়দাতাকে তো কিছু দিতে হয়, তাই না? ও যদি চুমা দেয়? একেবারে খালাস হয়ে যাব। এমনিতেই এখান থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র যাওয়া বিশাল ব্যাপার। রাতে বিরেতে তো কথাই নেই। খেয়া নির্ভর জীবন যে! তাতে এখন ত্র্যহস্পর্শ যোগ! যাওয়ার কোন ব্যাপারই নেই। আচ্ছা, ত্র্যহস্পর্শ যোগ কথাটা লাগ বুঝে বলতে পারলাম তো! বিপিনবাবু দুঃখ করতেন, “তোরা ইংরেজিটা পারিস না তাই নিয়ে কিছু বলি নে, কিন্তু বাংলাটাও শিখলি না!” বিপিন বাবু শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর পড়তে বলতেন। টুকটাক পড়েছি। মহেশটা তো বেশ, না! ভালো। অপুর পাঁচালী ভালো, তবে আমার আর দুঃখের বারোমাস্যা ভালো লাগে না। বাঃ, আবার বারোমাস্যা বললাম!
এখন আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে।
সেই ভয়ানক দিনে অমাবস্যা ছিল তো। আজ পাঁচদিন পেরোতে চলল। মাঝরাতের দিকে একফালি চাঁদ
ওঠে আকাশে। ফ্যাকাশে, মরা আলো। সেই মরা আলোই সারা শরীরে মেখে, আলো দোলাতে দোলাতে নাচাতে
নাচাতে সে গুঁড়ি মেরে উঠে আসে। নিঃশব্দে বাড়ে। তবে সীমাজ্ঞান আছে। চৌকি অবধি পৌঁছায়
না। চৌকি এমনি পাতা থাকলে হয়ত পৌঁছাত, কিন্তু চৌকি ইট দিয়ে উঁচু করা আছে। চৌকিতে মা
তুলে রেখেছে বাসনপত্র, কৌটো কাউটি, গ্যাসের উনুন, বালতি। নইলে সে যাবার সময় কাকে সঙ্গে
নিয়ে যাবে বোঝা দায়। চৌকির এক কোনে মা , বাবা গুটিসুটি মেরে হাঁটুর উপর মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
বুকলু শুধু মায়ের গায়ে ঠেস দিয়ে বাসনপত্রের ফাঁক দিয়ে জায়গা বার করে পা মেলে ঘুমচ্ছে।
আহা, একটু ঘুমোক ওরা। মা তো চাঁদ ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়বে। ততক্ষণে মেঝেতে
হালকা মিহি পলির আস্তরণ থাকবে। নারকোল ঝাঁটা দিয়ে যতটা পারা যায় পরিষ্কার করে রান্না
চাপাবে। রান্না হয়ে গেলে খাবার আবার চৌকিতে তুলে দেবে। রান্না আর কি! ভাতে ভাত জুটছে
এই ঢের! বাসন মাজা কি ঝকমারি! বাবা ইস্কুলের টিপকল থেকে একবালতি জল তুলে এনে দেয়। জল
আমিও তুলে আনতে পারি, কিন্তু কেমন যেন লাগে!
দিনের বেলায় যখন আসে, বুকলুর
খুব আনন্দ! নৌকা ভাসায়। অবশ্য শুকনো কাগজ পাওয়াই মুশকিল! আমার ঘরে দেওয়ালের তাকে ছিল।
আমার পড়াশোনার সুবিধা হবে বলে দক্ষিণের মাটির ঘরটায় থাকতাম। বাবা একটা চেয়ার টেবিলও
কিনে দিয়েছিল। আছে, এখনও। উলটে পড়ে, পায়া ভেঙে গেছে। ঘরটার উপর আমগাছটা পড়ে ঘরটা শেষ।
মরে গেছে। মরে গেছে কি? গাছচাপা পড়ে মানুষ মরে। ঘর মরে কি? যদি সারাই করিয়ে নেওয়া হয়,
তবে আবার বেঁচে ওঠে তো! তাহলে মরা কিসের? মানুষ বা গাছ একবার মরলে সারাই করলেও আর বাঁচে
না। তাহলে ঘর বেঁচে ওঠে, নাকি ঘর মরেই না? বড্ড শক্ত করে ভাবছি নাকি? ঘর নতুন করে উঠলে
পুরনো ঘরের গন্ধ, হুবহু পুরনো ঘরের মত আলো আঁধারি হয় কি? তবে ঘর মরে গিয়ে নতুন ঘর জন্মায়।
এমনি এমনি জন্মায় কি? টাকা লাগে তো! তাই তো বাবা সারাদিন জল ভেঙে ভেঙে বিডিও অফিস যায়। যদি সরকারি সাহায্য মেলে!
সাহায্য ছাড়া বাঁচা যায় নাকি? অথচ কলেজে ডি এম স্যার বলেছিলেন, “অন্যের দয়ায় বাঁচা,
বাঁচা নয়। অলওয়েস বি ইন্ডিপেন্ডেন্ট।“ তখন আমি ভাবতাম ইন্ডিপেনডেন্ট হব। কারোর দয়ায়
বাঁচব না। আচ্ছা, ইন্ডিপেনডেন্ট কে? আমিই বা কে? আমি কি ভারতীয়? তাই তো লিখি। ভারত
কি ইনডিপেন্ডেন্ট? তাইই তো জানি! তাহলে আমরা কি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নই? ডি এম স্যার তাহলে
কেন ইন্ডিপেনডেন্ট হবার কথা বলেছিলেন? আসলে আজ বুঝছি আমরা কোনওকালেই ইন্ডিপেনডেন্ট
নই। চরের মানুষ ইন্ডিপেনডেন্ট হয় না। সেই ভয়ানক রাতের পরেরদিন সকালে রামকৃষ্ণ মিশনের
সন্ন্যাসীরা খাবার নিয়ে এসেছিলেন বলে খেয়ে বেঁচেছিলাম। পরপর তিনদিন দুপুরে খিচুড়ি খাইয়েছিলেন।
না হলে? জল এনেছিলেন। না হলে? মরতাম। তাহলে আমাদের বাঁচা ডিপেন্ড করল সন্ন্যাসীদের
দয়ার উপর। আচ্ছা, সন্ন্যাসীরাও তো ভারতীয়, নয়? তাহলে ডাঁসা আর কাটাখালির মাঝের চরের
ভারতীয়রা ভারতীয়দের দয়া ছাড়া বাঁচে না?
অবশ্য এভাবে আগে বুঝতে শিখি
নি। এখন ভাবছি। ভাবতে ভাবতে দেখছি সামনে প্রসারিত জলরাশি। মৃদু তরঙ্গ তুলে বয়ে চলেছে।
এখন আর কুলুকুলু শব্দ নেই। যখন সমুদ্রের প্রেমপত্র নিয়ে আসে তখন কুলুকুলু আওয়াজ হয়।
তারপর জল জেঁকে বসে। তখন দিগন্ত বিস্তারী জল ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় কেমন অচেনা লাগে।
মাঝে মাঝে বেঁকে যাওয়া ছোটগাছ জেগে থাকে। হাত তুলে বলে বেঁচে আছি। বড়্গাছ সব সেদিনের
ঝড়ে পড়ে গেছে। দুদিনের মধ্যে সেগুলো কেটেকুটে সাফ। পড়ে যাওয়া গাছ কেটে কুটে সাফ হওয়া
তো একরকম, সুঁদরী, বাইন, হেঁতাল, শ্যাওড়াগাছ তলে তলে কাটা হয়ে পাচার হয়ে যায়। নদীর ধার গুলো কামানো মাথার মত অস্বাভাবিক লাগে।
এইজন্যই তো ঝড় এত বেড়ে গেছে। পরিবেশ বিজ্ঞান বইএ লেখা আছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন। আমাদের পড়তে
হয়। এলাকার লোকরাই যুক্ত। কাকে কি বলা যাবে! তবে সেদিনের ঝড়ের কথা আর ভাবতে চাই না।
আমাদের পাকাঘর আছে বলে আমরা ঘরেই থাকতে পারি বলে গেছিলেন বিডিও। কাঁচাবাড়ির সবাইকে
স্কুলঘরে রেখেছিল। এখন করোনাকাল। কি এক ভাইরাস এল! সবসময় মাস্ক পর, আর দূরত্ব রাখ।
লকডাউন। কলেজ ছুটি। বাবার সিকিউরিটির কাজটা আছে, কিন্তু মাইনে নেই। বাবার তিরিক্ষি
মেজাজ। মায়েরও। বুকলু একটু খাই খাই করে, করবে না? বাচ্চা মানুষ! মা চেঁচায়, “মর, মর,
মরতে পারিস না? গরীবের খাই খাই রোগ!” বুকলু ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আমি বুকলুকে বোঝাই,
আমি চাকরি পেয়ে বুকলুকে হাসনাবাদের রেস্টুরেন্টে খাওয়াব। অমিত, অপরাজিতা, প্রণব, স্মৃতিকণারা
যায়। আমি যাবার কথা ভাবি নি কখনও। ঈশিতা একদিন
বলেছিল, “চল, হোটেলে খাবি? আমি খাওয়াব।“ ঈশিতা আমার পাশেই বসতে চায়, আমি জানি। ঈশিতা
বগলকাটা টাইট জামা পরে লিপস্টিক লাগিয়ে আসে। ভালো লাগে না। ওর সাথে খেতে যাওয়ার প্রশ্নই
নেই। কেকা বললে? কেকা বলবে না। কেকাদের অবস্থা খুব খারাপ। কেকা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটাই
দেয় নি। কাজ খুঁজছে।
অল্প বাতাস দিচ্ছে। অল্প বাতাসে
জেগে থাকা গাছগুলো যেন হাতছানি দিচ্ছে, “আয়…আয়…” যেন প্রেতিনী ধ্বংসের দিকে ডাকছে।
তবে বাতাস কি প্রেতিনীর শ্বাস? তা হোক, অল্প বাতাসে ঘাম গায়ে আরাম লাগছে। বাতাস আরামের।
বাতাস আরামের অথচ সেদিনের প্রলয়ও তো বাতাসই করল! প্রেডিকশন ছিল। উমপুন আসছে। উমপুন
মানে আকাশ। আকাশ নেমে আসবে মাটিতে। তাতে আমাদের সিধা পাতাল প্রবেশ হতে পারে। সবাই সতর্ক
হয়েছিল, কিন্তু নদীর চরে বাস যাদের, তাদের সতর্কতা কি পাঁচতলা বাড়ির সদরে তালা দেওয়ার
মত নিজের হাতে?মাটির বাঁধের ভরসায় বাঁচামরা। মা মানত করেছিল, ঠাকুর, ছেলেপুলে নিয়ে
বাঁচি যেন। আয়লার স্মৃতি বয়স্কদের বুকে ভয়ের দাঁত বসিয়ে দিচ্ছিল। আয়লায় জল আদর করে
তুলে নিয়ে চলে গেছিল। সমুদ্রের জিম্মা করে দিয়েছিল। সমুদ্রের সেরকম দাবী ছিল হয়ত… কত
ঘর খালি হয়ে গেছিল। নুন জলে জলকর শেষ, চাষ শেষ হয়ে গেছিল। আয়লার সময়আমরাও স্কুলবাড়িতে
ছিলাম। বুকলু তখন মায়ের কোলে। শুনেছিলাম উম্পুন
নাকি আরো ভয়ানক হতে পারে। ভাবছিলাম, কি হবে? দুরন্ত জলের পাক খেতে থাকা ঘূর্ণি আদর
করে কোলে তুলে নিয়ে সমুদ্রের নিচে মীনমহলে পাঠিয়ে দেবে? মৎস্যকণ্যারা স্বাগত জানাবে?
দ্য লিটল মারমেড? ফ্যান্টাসি থাক। সেরকম হলে
ভয়ের, তবে একবারে শেষ। বেঁচে গেলে প্রতিদিন মরতে মরতে বাঁচা। ডি এম স্যারকে দেখা হলে
বলতে হবে, “উই আর নট ইন্ডিপেনডেন্ট স্যার…” দেখা হলে, তবে। দেখা হবে তো! সেইদিনে মনে
হচ্ছিল আর দেখা হবে না কারোর সাথেই। সুঁইইইইইইইই করে তীব্র হাওয়ার দাপট দৈত্যের মত
বড়বড় গাছকে উপড়ে ফেলছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে এলো জল। তীব্র…… ক্ষিপ্র…… বাবা চেঁচাল,
“চৌকিতে উঠে দাঁড়াও সব। বাঁধ ভেঙেছে মনে হচ্ছে…” রিফ্লেক্সেই চৌকিতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম।
বাঁধ ভেঙেছে? তবে তো নদীই ঢুকে এসেছে গিলে খেতে… নদী নালার দেশে বাস। নদীকে ভয়ানক মনে
হয় নি, সেদিন মনে হচ্ছিল, “তুলি লক্ষ লক্ষ ফণা, ফুঁসিছে, গর্জিছে নিত্য, করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের লালায়িত মুখ…” অত বিপদের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ মনে পড়াতে বিপিনবাবুর
মুখটা ভেসে উঠেছিল। আমগাছটা পড়ে আমার তপোবনের সমাধি রচনা হল, বুঝতে পারলাম। বইগুলো
ভিজছে একা একা… এঘরে জানলা দিয়ে মহাসমুদ্র
ঢুকে আসছে। আমরা প্রতিবাদ করি না। নদী ঘরে ঢুকে এলে জানলার সমুদ্রে কি হবে! “সাগরে
যার বিছানা মা, শিশিরে তার কি করিবে…” আচ্ছা, রামপ্রসাদ কি সুন্দরবনের চরের ঝড় দেখেছিলেন?
আমাদের পাকা ছাদ উড়ে যায় নি,
এটাই বিশাল ভাগ্য এখানে। যারা স্কুলবাড়িতে ছিল, তাদের সব গেছে। গেরুয়ামাসী কাঁদছিল,
“আমাদের মাজা ভেঙে গেছে” বলে। গেরুয়ামাসীকে কেন সবাই গেরুয়া বলে জানিনা। মাসী লাল পার্টি,
ঘাস পার্টি, গেরুয়াপার্টি কিছুই করে না। কিন্তু ত্রাণ নিতে গেলে কে কোন পার্টি সেটা
দেখা হয়। পার্টির লোকেরা ত্রাণ নিয়ে আসে। বাবা যেতে চায় না, বলে, “শালা, ভিখিরির মত
হাত পেতে দাঁড়াব?” মা বলে, “কেন? ঝাবে নি কেন? সরকার থেয়ি দিতেছে, এ তো আমাদের হকের
পাওনা… তুমি না গেলি, আমি গে নি আসব…” বাবা
যায়। বুক্লু সকালে গুঁড়ো দুধগোলা খায়। গেরুয়ামাসী ত্রাণে চাল পায় না। ঘাস পার্টি বলে,
“মাসী তুমি ভোটটা কারে দাও জানতি বাকি নি আমাদের!” মাসী গেরুয়া পার্টির কাছে যায়। ওরা
বলে, “মাসী, চিঁড়া নি যাও, ভোটতো ঘাসে দাও…, ” মাসী গেরুয়া পার্টির ছেলেদের সাধাসাধি
করে, “দু’গা চাল দাও মানিকেরা, আমি তুমাদেরই ভোট দোব, ওরা চাল দেল নাই, ভোট দোব?…” এখন এ তল্লাটে গেরুয়া রঙ ভালো ধরেছে। আমি ভাবি,
তবে কি কলিমুদ্দিনকে শত্রু ভাবব? কলিমুদ্দিনও কি তাই ভাবছে? একলাইনে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি
খেলাম কিন্তু। মহারাজদের দেওয়া। ঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়ে শহর কলকাতার দিকে রওনা হয়েছিল।
কলকাতা থেকে আমাদের স্যার ম্যাডামরা আসেন। ফিটফাট, ঝকঝকে। শহর কলকাতায় ঝড় এমন গা জোয়ারি
করতে পারবে না। করলেও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নইলে ভাবা যায়, শ্রীলেখা ম্যাম,
প্রীতম স্যার এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আছেন? কিম্বা শ্রীলেখা ম্যাম ছিপছিপে কাদা ঝেঁটিয়ে
রান্না বসাচ্ছেন? শ্রীলেখা ম্যাম রান্না করেন না। বই পড়েন, ফেসবুক করেন, লিপস্টিক লাগিয়ে
কলেজে আসেন। ভেবে লাভ নেই। আমাদের নিকষ অন্ধকারে এখন কতদিন জলসই পাতিয়ে ভুখাপেটের ডাক অগ্রাহ্য করে
বাঁচতে হবে। সেদিন সারারাত চৌকি থেকে নামার সাহস হয় নি। পরদিন সকালে ঘরে হাঁটু ডোবা
জল ছিল। উঠোনে আরো বেশি। তার মধ্যে ভুলাদা জানিয়ে গেছিল দুপুরে খিচুড়ি মিলবে। আমার
মোবাইলে অল্প চার্জ বাকি ছিল। কটা ছবি তুললাম। জলসাম্যের। জল কেমন করে উঁচু নিচু ডুবিয়ে
দিয়ে অন্য চিহ্ন মুছে দিয়ে জলতলে সাম্য ধরে রাখে! ডি এম স্যার সাম্যবাদ পড়ান। আমাদের
জীবনও যদি তাই হত! খিচুড়ি খেতে খেতে বড়রা বলছিল, তত ভয়ানক হয় নি অন্তত। চরের মানুষেরা
জানে ঝড় মানে কি আর ঝড়ের পরের জীবন কি। ঝড়ে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকবে এ রাতের পর ভোর হবার
মতই সহজগ্রাহ্য। খিচুড়িও মহারাজরা দেবেন, এই স্বতঃসিদ্ধান্তও। মানুষ পাতার থালায় খিচুড়ি
নেবার আগে কপালে হাত ছোঁয়ায়। মহারাজদের দান। ক্যান উই বি ইন্ডিপেনডেন্ট?
এখন রাত তিনটে। বেশিরভাগ বড়গাছ
অতীত হয়ে যাওয়ায় পাখির ডাকও ভেসে আসছে না। দমধরা নীরবতা। নৈঃশব্দের ভাষা? আমি কি লিখতে
পারব? লিখলে নৈঃশব্দের ভাষা লিখব কেন? আমাদের জলজীবন লিখব না? আমার ডোবানো পা ছুঁয়ে
ভাঁটার টান লেগেছে। জল ফিরে যাচ্ছে। দুদিন বাদে সরকারী লোক আবার বাঁধ দেবার দেখাশোনা
করতে এসেছিল। ওরাই বলে গেছে, বাঁধ যেখানে ভেঙেছে সেখানে দুশো ফুট গভীর ধস। ওদিকে কেউ
যেন না যাই। আমরা যাই না। জল যায়। নৈঃশব্দের মধ্যে কিসের আওয়াজ ওটা? ঝুম…ঝুম… বুঝেছি।
বাসসন্তীদির নুপূরের আওয়াজ। বাসন্তীদিকে কেউ পছন্দ করে না। এখানে থাকে না। শহরে থাকে।
তবে কলকাতায় নয়, দিল্লি, মুম্বাই কোথাও হবে। এরকম বিপর্যয়ের পর বাসন্তীদি গ্রামে আসে।
তারপর গ্রাম থেকে হারিয়ে যায় দু একটা মেয়ে। কয়েক বছর পরে ফিরে আসে কেউ কেউ, ঘরে নিলে।বাসন্তীদির
ঝুম ঝুমের পরে ছপ ছপ কার পায়ের আওয়াজ? বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। কেকার নয়ত? কেকা হারিয়ে
যাচ্ছে? আমি কি দৌড়ে যাব? নাঃ, লাভ হবে না। কেকা আর আমার পড়ার টেবিলে পেয়ারা রেখে যাবে
না… মরণদশা! এত জলে থেকে থেকে চোখটাও জলে ডুবল?… চাঁদ নিভে যাচ্ছে। কেকা যদি কয়েকবছর
পর ফিরে আসে, টেবিলে পেয়ারা রাখে, কি করব? না, কেকা চলে গেলে ওর না ফেরাই ভালো। না
ফেরাই ভালো। মানুষ জল নয়। জোয়ার ভাঁটার মত আসা যাওয়া মানুষের জীবনে চলে না। শুধু ভরপেট
খেতে পায় যেন মেয়েটা।
চাঁদ সরে যাচ্ছে আকাশের সীমানা
থেকে। জল সরে যাচ্ছে গেরস্থালীর সীমানা থেকে। গভীর গর্তে গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করবে পরবর্তী জোয়ারের। জীবন সরে
যাচ্ছে। এইই তবে জীবন চরার মানুষের? ভোটের আগে কত প্রতিশ্রুতি… ভালো লেগেছিল। প্রথম
ভোট দিয়েছিলাম তো! বাবা বলেছিল, “সব শালা সমান!” আমি ভেবেছিলাম জোয়ারের মত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ আছড়ে পড়বে আমাদের
চরে। কাটাখালি আর ডাঁসা দিয়ে ঘেরা চরে। পাকা
রাস্তা হবে, পাকা বাঁধ! ঝড়ের আগে একটু আতঙ্কহীন রাত…… আজ বুঝতে পারছি, জলের জীবন আর
ভোটের জীবন এক। জল যেমন ডাঁসা বেয়ে এসে জোয়ারে ঘর ভরিয়ে দেয়, ভাঁটায় নেমে গিয়ে অতলান্ত
ধসে গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করে পরবর্তী জোয়ারের,
ভোটের প্রতিশ্রুতিও ভোটজোয়ারে ভেসে এসে জীবন ভরিয়ে দেয়।বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে
উই উড বি ইনডিপেনডেন্ট। ভোট মিটে গেলে কোন
অতলে তলিয়ে যায়… ফের ভোটের আগে জোয়ার আসে। এও এক জলের জীবন।
0 মন্তব্যসমূহ