সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সুদীপ পাল




কালচক্র     


                              
              
                              (১)


আশ্রমে মধ্যে আজ প্রবল ব্যস্ততা। সকাল থেকেই কিছু পণ্ডিতবর্গ, গুরুশ্রেণীয় পুরুষগণ একটি বিশেষ কাজে নির্লিপ্ত। আশ্রমাধক্ষ্য বৃদ্ধ মহাপণ্ডিত শ্রীজীব গোস্বামীর কঠোর নির্দেশ, এই কাজের ব্যাপারে কোনো কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। খুব গোপনে কাজ সারতে হবে। ইতিমধ্যে রাজপুতানা জয়পুরের রাজদরবার থেকে এসে পড়েছে রাজপত্র।
পণ্ডিতাচার্য ডেকে পাঠালেন আশ্রমের তিন অতীব মেধাবী, গুণসম্পন্ন, ঈশ্বরপ্রেমী যুবক শিষ্যদের। এই তিনজন আশ্রমের সম্পদ, তাই তিনি ঠিক করেছেন এদের উপরেই এই গোপন কার্যের দায়িত্ব তুলে দেবেন। এদের মধ্যে তুলনামূলক বয়স্ক ও স্থিরচিত্ত ব্রাহ্মণশিষ্য তথা আচার্য্যকে ডেকে বৃদ্ধ পন্ডিত বললেন, 
" মদীয় এহেন দুর্মূল্য সম্পদ লইয়া তোমরা গৌড়দেশে  যাও। তোমরা ত্রয়ী ভিন্ন কেহ এ কর্মের নিমিত্ত উপযুক্ত নহে।" 
আচার্য্য বললেন, " কিন্তু প্রভু, আপনাকে ছাড়িয়া আমরা কেমনে যাইব?" 
বৃদ্ধ মহাপণ্ডিত অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, " ইহাই ঈশ্বরের নির্দেশ।প্রভু স্বয়ং তোমাদিগকে নিযুক্ত করিয়াছেন। তোমরা যাও। নিজ কার্য সমাপ্ত করিও। সর্বকার্য সম্পন্ন হইলে, পুনরপি একবার বৃন্দাবনে আসিবে। তোমাদের নয়ন ভরিয়া দেখিয়া, নিজ দেহ ছাড়িব।"
আচার্য্য,পণ্ডিত গোস্বামীর পায়ে লুটিয়ে পড়েন। বৃদ্ধ শ্রীজীব গোস্বামী আশীর্বাদ দিলেন। 
সব কাজ পণ্ডিতের নিজ তদারকে হচ্ছে। একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে, বড় বড় আটটি সিন্দুকে ভরে দেওয়া হচ্ছে, আশ্রমের চিরকালের সম্পদ। সেই সিন্দুকগুলিকে অতীব সুন্দর কারুকার্যপূর্ণ কাঠের বাক্সে, মোমজমার আবরণে সুরক্ষিত করে চারটি বড় বড় শকটে তোলা হল। চারটি বৃষ চালিত শকটের সাথে, ১০ জন সশস্ত্র প্রহরী ঠিক করে দেওয়া হল।
রাত্রির ভোজনের পর তিনি তাঁর তিন শিষ্যদের ডেকে পাঠালেন। তাঁদের হাতে রাজপত্র ও পথের খরচ তুলে দিয়ে বললে, 
"এই লউ যাত্রার খরচাদি। গন্তব্যে পৌঁছাতে দুইমাস কাল লাগিবে। তিনজনে একত্রে থাকিও সর্বদা। কোনো বিপদ আসন্ন হইলে প্রভুর নাম স্মরণ করিবে, তিনিই তোমাদের উদ্ধার করিবেন।" 
তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কনিষ্ঠ ব্রাহ্মণশিষ্য নরোত্তম বললেন, 
"আমরা সন্ন্যাসী। আমরা কী রূপে গৃহাভিমুখে যাত্রা করিব। তদাপি আপনাকে ছাড়িতে হৃদয় চাহিছে না। আপনার সঙ্গ ব্যতিত স্বর্গও যে সুখকর নহে।"
জ্যেষ্ঠ বললেন, 
" নিজস্ব সম্পদ অপরকে বিতরণ করাই ধর্ম। গৌড়ের এখন সংকট, আমাদের অপেক্ষা তাহাদের ইহা সর্বাধিক প্রয়োজন। আমি তোমাদের গুরু, তোমাদিগকে আদেশ করিতেছি, দ্বিরুক্তি করিও না। "
এরপর তিনজন বাক্যব্যয় না করে গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। বৃন্দাবন থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আশ্রমের অমূল্য সব রত্ন নিয়ে গৌড়াভিমুখে পাড়ি দিলেন চৈতন্যপ্রেমী শিষ্যত্রয়, পণ্ডিত শ্রীনিবাস আচার্য্য, ঠাকুর মহাশয় নরোত্তম দত্ত এবং শ্যামানন্দ কৃষ্ণদাস। 


                               (২)


গুরুর আদেশ, কোনোমতেই যেন কেউ টের না পায় তন্মধ্যে কি আছে। এই সম্পদ দূরাচারীর হস্তগত হলে সমাজে নেমে আসবে ঘোরতর বিপদ। তাই তাঁরা পথ সতর্কে চললেন প্রভু শ্রীচৈতন্যের নাম জপ করে। রাজপত্র দেখিয়ে তাঁরা প্রথমদিন আগ্রায় আতিথ্য গ্রহণ করে। পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু করে। এইভাবে একমাস পর্যন্ত তাঁরা একরাজ্য হতে অন্য রাজ্যে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করে।মাসাধিক কাল অতিক্রম করে এভাবে একদিন তাঁরা এসে পৌঁছালো ঝারিখন্ড অঞ্চলে। এইখানে পথ দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি পথ যায় শহরকোলাহল মধ্যে, অন্যটি যায় গভীর অরণ্যে। গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করলে, 
" পূজ্য, কোনপথে অগ্রসর হইব?" 
আচার্য্য বললে, " বনপথে যাওয়াই শ্রেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা গৌড়ে পৌঁছাইয়া যাইব। তাছাড়া, আমরা প্রভুর এই যাত্রাপথটি একবার স্বচক্ষে দেখিতে চাই।" 
চারটি শকট সেই পথেই চললো। 
তাঁরা গুরুর কাছে শুনেছিলো, একবার প্রভু চৈতন্য এই বনের মধ্যে ভক্তির আবেশে বৃক্ষ ও লতাগুল্মকে কৃষ্ণ সম্বোধনে জড়িয়ে ধরেন। 
এই অরণ্যে কোকিল-ময়ূরের সুমধুর ডাক শুনে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পাগল ঠাকুরের পদধুলির আশায়, তিনজনে বারবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এইভাবে তাঁরা ইটা প্রদেশ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল। সেদিনের মত যাত্রা সেখানেই সমাপ্ত করা হল। সকলে একটি জলাশয়ের নিকট স্নান করে ভাতে-ভাত খেয়ে নিদ্রা গেলেন, আর একদল পাহারা দিল। 
ইতিমধ্যে কতকগুলি হিঃস্র নেত্র তাদের অলক্ষে,শকটের উপর পড়েছে। পরদিন মধ্যাহ্নে পাঁচজনের একটি দল, বৃন্দাবনবাসী এই দলের কাছে আগত হয়। তাদের মধ্যে একজন, প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করে, " আপনারা কোথায় যাইতেছেন?" 
প্রহরী উত্তরে বলে, " সে কথা জানিয়া তোমার কি লাভ বাপু?" 
আগন্তুক জিভ কেটে বলে, " না না আমি সেই অর্থে কিছু বলি নাই। আমরা আপনাদের সাহায্যপ্রার্থী।" 
প্রহরী বলে, " এ ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো সাহায্য করিতে পারিব না। তোমরা যাত্রী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতবর্গের স্মরণাপন্ন হও।" 
সেই আগন্তুক, লীলাক্রান্ত তিন সন্ন্যাসীর কাছে এসে বলে, " প্রভু, আমরা আপনাদের নিকট সাহায্য প্রার্থী। আমরা ভৃত্যগিরি করিয়া বহুবর্ষ পর নিজ গ্রাম তামরে ফিরিতেছি। সঙ্গে কিছু অর্থও আছে। তাহার সুরক্ষার জন্য আমরা আপনাদের সাথে সাথে চলিতে চাই। "
শ্যামানন্দ সন্দিগ্ধ চিত্তে প্রশ্ন করলো, " এই রাজ্য কি সুরক্ষিত নহে?" 
আগন্তুক বলল," প্রভু, আমরা শুনিয়াছি এখানে নাকি দস্যুদের প্রচণ্ড উপদ্রব। পাষন্ডবর্গ ধনী পথিকদের মারিয়া সর্বস্ব লুঠ করিয়া লয়।"
তিনজনে চমকে উঠল। তৎক্ষণাৎ প্রহরীদের ডেকে সতর্ক হতে বলল এবং আগন্তুক দলটিকে রক্ষা করার আদেশ দিল। পণ্ডিতদের সমস্ত কাজে নতুন দলটি যথাসম্ভব সাহায্য করে। তাঁদের লীলাপ্রেম দেখে, তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। তাঁদের সাথে সখ্যতা হওয়াতে, রাত্রিকালে আগন্তুক ব্যক্তিটি জিজ্ঞাসা করে, 
" প্রভু, আপনাদের দেখে আমরা ধন্য। আপনারা কি কোনো বিশেষ কাজে কোথাও যাইতেছেন?" 
শ্রীনিবাস অাচার্য্য বললে, 
" আমরা গৌড় দেশে একটি বিশেষ কার্যে যাইতেছি।" 
-"এই চারটি শকটে করিয়া আপনারা কি লইয়া যাইতেছেন?" 
শ্যামানন্দ সম্পদের আতিশয্যে বলে উঠল, "রত্ন।" 
আগন্তুক বললে, "সাবধানে যাইবেন। এই পথ ভালো নহে। কিছুদূর পরেই দূর্জন রাজার রাজত্ব।"
আচার্য্য বললে," প্রভুর রাজ্যে আমাদিগের কোনো বিপদ নাই।" 
তাঁরা নিদ্রা গেলে, রাত্রের কুহেলিকায় সকলের অগোচরে আগন্তুক দল অরণ্যে মিলিয়ে গেল। 


                              (৩)


এদিকে রাজঅন্তঃপুরের গোপন মন্ত্রণাকক্ষে, রাজ্যের প্রধান গুপ্তচর বটনাথ ভট্ট তার পাঁচজন অনুষঙ্গ নিয়ে উপস্থিত হয়। সে রাজাকে সেলাম জানিয়ে গৌড়গামী যাত্রীদলের বিবরণাদি দেয়। মহারাজ, রাজজ্যোতিষ বাচস্পতিকে ডেকে পাঠান, ওই সিন্দুকের মধ্যে কি আছে গণনা করার জন্য। 
বিচক্ষণ জ্যোতিষাচার্য গণনা করে বললেন,
 " মহারাজ, তন্মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বর্তমান। উহা আমাদের রাজ্যের ভাগ্য ফিরাইতে পারে। ভগবান প্রদত্ত এই উপহার ফিরাইয়া দিলে রাজ্যের অঘোর বিনাশ ঘনিয়ে আসিবে।" 
মহারাজ, ভট্টকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, 
" ওই পথচারীদিগের যেন কোনো বিনাশ বা রক্তক্ষয় না হয়। সঙ্গে করিয়া দুইশত দস্যু লইয়া যাও। সব লুন্ঠন করিয়া আনো। ঠিকমতো কাজ হইলে, তোমাদিগকে ধনসম্পদে ভরাইয়া দেব। কিন্তু মনে রেখো, রক্তক্ষয় যেন না হয়। "
মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে গুপ্তচর বেরিয়ে পড়ল রাজপোষ্য লোহিতলোলুপ, ধনপিশাচ দস্যুদের উদ্দেশ্যে। তামর অঞ্চলে পৌঁছে দস্যুগণকে সমস্ত কাজের বিবরণ দিলেন। সেখানে মাতৃপূজা করে, তারা অপেক্ষা করতে লাগলো ব্রজদলের। রাজার রাজ্যে প্রবেশ না করা পর্যন্ত তারা কোনো প্রকার হামলা করবে না, এই তাদের নিয়ম। 
সেই রাত্রে পণ্ডিতবর্গ তামর অঞ্চলের আগে তাঁদের রাত্রিবাস করে। অর্থাৎ সেই রাত্রিটিও তাঁদের নির্বিঘ্নে যাপন হল। পরদিন সকালে পরিব্রাজকগণ পুনরায় নিজ যাত্রা শুরু করলেন। তাঁরা অরণ্যমধ্যে রঘুনাথপুর ছাড়িয়ে পঞ্চবটি অঞ্চলের দক্ষিণে মালিয়ারা গ্রামে আহারাদি সম্পন্ন করে। গ্রামীণ লোকজনের আতিথ্যে তাঁরা খুব খুশি হয়। সেই রাত্রিও নির্বিঘ্নে কাটিয়ে তাঁরা পরদিন আবার রওনা দিল। দস্যুগণও অরণ্যের আড়ালে আড়ালে তাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। কিন্তু সঠিক স্থানের অভাবে তারা নিজ কার্য সম্পন্নে ব্যাহত হয়। 
পথে পণ্ডিতত্রয়ী শ্রীকৃষ্ণের নামকীর্তনে বিভোর হয়ে পড়ে। নিজেদের অন্তরের সমস্ত রসটুকু রঘুনন্দনের চরণে সমর্পিত করে। সমগ্র অঞ্চল ধন্য ধন্য হয়ে ওঠে তাঁদের এই নামগাথায়। অবশেষে রাজার রাজ্যে গোপালপুর নামক গ্রামে, ভৌমিক বাড়ির পীড়াপীড়িতে সেই রাত্রে তাঁদের সেইখানেই ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। টানা একমাসের পথশ্রম ও কীর্তনের জ্বরে বিহ্বল হয়ে সকলেই সেইরাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেই সুবর্ণসুযোগ দেখে ভট্ট সহ দস্যুগণ চারটি শকট লুঠ করে নিয়ে যায়। বিনা বাধায়, বিনা রক্তপাতে তাদের লুন্ঠনকার্য সফল হল। 
              
                               (৪)


বিশাল ধনসম্পদের আগমনের আশায় মহারাজ বিশ্রাম করতে পারলেন না সারা রাত্রি। তিনি মনে মনে ভাবলেন, রাঢ় মল্লভূমে বিষ্ণুপুরের সিংহাসনে একচ্ছত্রাধিপতি তিনি। মহাবিক্রমের সাথে বারবার পাঠানদের আক্রমণ ধূলিসাৎ করেছেন। মহারাজা মানসিংহের পুত্রকে কতুল খাঁ এর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে "বীর" উপাধি পেয়েছেন। সমগ্র বিষ্ণুপুরবাসীকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার্থে, জলসংকট দুর করতে ৭ টি বাঁধ রচনা করেছেন। কিন্তু এত কিছু করেও তিনি আজ ' ডাকাত রাজা' জনগণের কাছে! 
অনুতাপে বিদ্ধ মহারাজা বীর হাম্বীর মল্লের অশ্রু তাঁর শয়নশয্যা সিক্ত করে ফেলে। 
স্বগতোক্তি করেন.., আমি তো নিজের জন্য এইসব কিছু করিনি। প্রজাদের হিতের কারণে বারবার অস্ত্র তুলে নিয়েছি স্বহস্তে। রক্ত লাগিয়েছি নিজের রাজত্বে, নিজের বিক্রমশীল নামে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। ইতিহাস আমার অবদান একদিন ঠিক স্মরণ করবে। 
তিনি ভাবেন, এই বিপুল সম্পদ হাতে এলে আর দস্যুবৃত্তি করব না। সব ছেড়ে দিয়ে নিজ রাজ্যের উন্নতি করব। 
এই সব ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে প্রধান ভৃত্য সুকমলের শব্দে। সে বলে, 
"মহারাজ, উহারা আসিয়াছেন। তাঁহারা আপনার দর্শনকাঙ্খি। উহাদিগকে মন্ত্রণালয়ে আনিয়াছি।" 
মহারাজা হাম্বীর তড়িঘড়ি মন্ত্রণালয়ে আগমন করেন। তিনি দেখেন সেখানে রয়েছে চারটি পেল্লাই মাপের অপূর্ব কাঠের বাক্স, তার মধ্যে রয়েছে চারটি লোহার সিন্দুক। 
মহারাজ কাজে খুশি হয়ে, একহাজার স্বর্ণমুদ্রা উপহার স্বরূপ প্রদান করে ওদের বিদায় জানালেন। কক্ষে উপস্থিত মাত্র দুইটি ব্যাক্তি, মহারাজ ও রাজজ্যোতিষ। মহারাজা হাম্বীর প্রথম সিন্দুক খুলে দেখেন তাতে রয়েছে লাল কাপড়ে মোড়া তালপাতায় লেখা প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ। 
হতাশ মহারাজ বলেন,
"কোথায় রত্ন? সবই তো পুস্তক!" 
সব সিন্দুক খুলে দেখা গেল তাতে রয়েছে, ১২১ খানি ভক্তিগ্রন্থ। সনাতনের "হরিভক্তিবিলাস", "হরিভক্তিরসামৃত সিন্ধু", কৃষ্ণদাস কবিরাজের " চৈতন্যচরিতামৃত", "উজ্জ্বল নীলমনি", "ললিতমাধব", "বিদগ্ধমাধব", "দানকেলী-কৌমুদী" প্রভৃতি গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের সর্ব্বপ্রধান রত্নভান্ডার।
হাম্বীর রাজ, জ্যোতিষাচার্যকে বললে, 
"এই তোমার ভবিষ্যৎবাণী!" জ্যোতিষী লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলেন। 
মল্লরাজ চৈতন্যচরিতামৃত হাতে নিয়ে, মুক্তারূপ অক্ষরগুলি দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, 
"রত্ন বই কি! যে জহরত চিনে, তাহার নিকট এগুলি রত্নই বটে।" 
মহারাজ গুপ্তচর ভট্টকে ডেকে বললে, 
"কোন্ মহাত্মার আজীবনের ফল লইয়া আসিয়াছ? তাঁহাদিগের উপর অত্যাচার কর নাই তো? তাঁহাদের নিঃশ্বাসে আমার রাজপ্রসাদ দগ্ধ হইয়া যাইবে।" 
ভট্ট বললে, 
"মহারাজের নিষেধ স্মরণে রাখিয়া আমরা কার্য সম্পন্ন করিয়াছি। নিরীহ সন্ন্যাসীদিগের উপর কোনো অত্যাচার হয় নাই।" 
রাজা অনেকক্ষণ চুপ করে, অনুতপ্ত হৃদয়ে মৌন হয়ে রইলেন। 


                               (৫)


বৃন্দাবন থেকে শ্রীনিবাস আচার্য্য, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে বৃদ্ধ শ্রীজীব গোস্বামীর মনে বড় ব্যথা অনুভব হয়। কিন্তু তাঁদের হাতে বিশাল বড় দায়িত্ব। গৌড়ের পতিত হিন্দু সমাজকে আলোর দিশা দেখাতে, বৃন্দাবনের অমোঘ সাধনার ফল সেখানে বিলিয়ে দিতে যাচ্ছে এই তিন যুবক। শুধু গ্রন্থ পাঠালেই হবে না, তাদের নিপুণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন, তাই শ্রীজীব গোস্বামী বুকে পাষান চাপিয়ে ব্যথিত হৃদয়ে তাঁদের বিদায় দিয়েছেন। 
এই তিন শিষ্য শিক্ষা-দীক্ষায় একে অন্যের দোসর। তাঁদের মধ্যে শ্রীনিবাস ব্যতিক্রমী। বাল্যকালেই তাঁর শ্রী প্রেম, জন্মস্থান নবদ্বীপে আগুনের মতোন ছড়িয়ে পড়ে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তি দেখে অনেকেই তাকে চৈতন্যের সাথে তুলনা করে। বিভিন্ন স্থানে ভাগবতের পথ থেকে বঞ্চিত হয়ে, অবশেষে বৃন্দাবনের জীব গোস্বামী তাকে শিষ্য করেন। প্রথম দর্শনেই গোস্বামী বুঝেছিলেন, শুভ্রজ্যোতি মুখমন্ডল, পদ্মলোচন, আজানুলম্বিত হস্তবিশিষ্ট এই বালকটি কোনো সাধারণ বালক নয়। সময়ের সাথে তাঁর এই ধারণা আরও দৃঢ় হতে থাকে। এর কিছুকাল পরে রাজপুত্র নরোত্তম, গৃহত্যাগী হয়ে এবং কৃষ্ণদাস শ্রীকৃষ্ণ প্রেমে ব্যাকুল হয়ে জীব গোস্বামীর নিকট উপস্থিত হয়। সেই থেকে এই তিন শিষ্য অভিন্ন হৃদয়। 
বৃদ্ধ পন্ডিতাচার্য দিবারাত্রি প্রভুর চরণে ত্রয়ীর মঙ্গলকামনা করে চলেছেন। একদিন গোস্বামী কৃষ্ণের স্বপ্নাদেশ পেলেন, শ্রীনিবাসের বিশ্বজোড়া খ্যাতি হবে। সে নিজের কার্য সম্পন্ন করবে। তার গুনে সমগ্র ভারতবর্ষ গুণময় হয়ে উঠবে। 
এই আশ্বাসবাণী পেয়ে, বৃদ্ধ পণ্ডিত সম্বিত ফিরে পান।
একদিন তিনি দিনের পূজাচারে লিপ্ত। এমতাবস্থায় একজন শিষ্য, পণ্ডিতের কাছে একটি চিঠি এনে দিলো। চিঠি পড়েই তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তাঁদের এতদিনের সাধনার ফল চুরি গেছে। কোনো এক দূরাচারী রাজা সর্বস্ব লুঠ করে নিয়েছে। শ্রীনিবাস তাঁর দুই শিষ্য ভাইকে গৌড়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তিনি নিজে পুঁথি খুঁজে বের করার আমরণ পন নিয়েছে। 
এই সংবাদে আশ্রমের সকলেই বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ, এইসব মহামূল্যবান পুঁথির আর কোনো নকল নাই। কথা ছিল গৌড়ে পৌঁছে, সেখান থেকে পুস্তকের নকল করে সমগ্র দেশে বিলিয়ে দেওয়া হবে। চৈতন্যচরিতামৃত খ্যাত পণ্ডিত শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ এতটাই শোকাগ্রস্ত হন যে, তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই গঙ্গাপ্রাপ্তি লাভ করেন। অন্যদিকে শ্রীজীব দুরূহ শোকে মূহ্যমান হয়ে আত্মহননে উদ্যোগী হন। কিন্তু গঙ্গার পাড়ে, শ্রীকৃষ্ণের দর্শনলাভে তা বিফল হয়। 


                                (৬)


মহামূল্যবান প্রাচীন রত্নের চুরির শোকে যখন সবাই ভেঙে পড়েছে, তখন আচার্য্য স্তম্ভের মত দৃঢ় ও সমীরণ রূপ শান্ত। সে নরোত্তম ও শ্যামানন্দকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দিল এবং প্রহরীগণদের বৃন্দাবনে ফিরে যেতে বলল। গোপালপুর থেকে বেরিয়ে শ্রীনিবাস জঙ্গলে জঙ্গলে রাজার খোঁজ করে। কখনো কোন গ্রাম পেলে সকলের কাছে রাজার খবর চায়। কিন্তু, রাজার ভয়ে তারা মুখ খুলতে চায় না। এইভাবে একগ্রাম হতে অন্য গ্রামে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটোছুটি করেন শ্রীনিবাস। কখনো কোথাও একটু জল পান করে দিন যাপন করে কিংবা কোনোদিন উপবাসে থাকে। রাত্রিবেলা কোনো গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। একদিন রাতের শয়নে খোলা আকাশের চাঁদ ও তারার মাঝে গুরু পণ্ডিত শ্রীজীব গোস্বামীকে দেখতে পায় ক্ষুধাতুর শ্রীনিবাস। তৎক্ষণাৎ উঠে গুরুকে প্রণাম করে বলে, 
"যাবৎ এই হৃতরত্নের সন্ধান করিতে না পারি তাবৎ আমি এইখানেই থাকিব। পুঁথির উদ্ধার চেষ্টায় আমার প্রাণ গেলে তাহাও মঙ্গল।" 
শ্রীজীব বললেন, 
"জানিও, ইহাই চৈতন্যের ইচ্ছা নিশ্চয়ই।" 
গুরুর আশ্বস্ত বাণীতে নতুন উদ্যম খুঁজে পেল শ্রীনিবাস। এইভাবে নয়দিন জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্তে খোঁজার পর, দশমদিনে যশোদা নদীর তীরে দেউলি নামে এক গ্রামের প্রান্তে উপস্থিত হয়। ক্লান্ত হয়ে একটি অশ্বথ গাছের নিচে আশ্রয় নেয় শ্রীনিবাস। 
কিয়ৎকাল পরে সেখানে দিয়ে এক যুবক, বটু ব্যাকরণের একটি অংশ বারবার বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। শ্রীনিবাস দেখে তাম্রবর্ণ, মস্তকমুন্ডিত যুবকের দেহের কটি দেশে একটি কাপড় মাত্র। সে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে দেখে শ্রীনিবাস বললে, 
" তোমার নাম কি?" 
যুবাপুরুষটি বললে, 
"আমি সদকলোগুরু রঘুনাথবংশীয় কৃষ্ণবল্লভ ভট্টাচার্য।" 
"তুমি ব্যাকরণের যেই অংশটি পড়িতেছ, তাহা খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। এসো আমি তোমাকে ইহা শিখাইয়া দেব।" 
তারপর শ্রীনিবাসের ব্যাকরণের সহজ সরল ব্যাখ্যা শুনে, কৃষ্ণবল্লভ তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। তার এইরূপ বর্তমান অবস্থার সম্বন্ধে প্রশ্ন করে কৃষ্ণবল্লভ। তখন শ্রীনিবাস সমস্ত ঘটনাটি কৃষ্ণবল্লভকে সবিস্তারে বলে। 
কৃষ্ণবল্লভ তাকে নিজের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে, শ্রীনিবাস আনন্দের সাথে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। 
বাড়ি পৌঁছে ব্রাহ্মণ যুবা আব্দারের স্বরে বললে, 
"আপনি আমাকে ব্যাকরণ ও অলঙ্কার পড়িতে সাহায্য করিলে আমি চিরকৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ থাকিব।" 
শ্রীনিবাস যুবার আগ্রহ দেখে রাজি হয়ে গেল। স্নান ও আহারাদির পর, রাত্রে প্রদীপের আলোয় শ্রীনিবাস তাকে পড়াতে আরম্ভ করল। 
পড়ানো শেষ হলে আচার্য্য তাকে জিজ্ঞাসা করে, 
"তোমার নৃপতি সম্বন্ধে কিছু বলো আমাকে। "
কৃষ্ণবল্লভ তাঁকে মহারাজা বীর হাম্বীরের রাজ্যবিজয় ও দস্যুবৃত্তি সম্পর্কে বলে। 
শ্রীনিবাসের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, তাঁদের বৈষ্ণব সাহিত্যের সমস্ত ধন রাজার আলয়েই লুক্কায়িত আছে। 
কৃষ্ণবল্লভ প্রতিদিন রাজসভায় অপরাহ্ণে পণ্ডিতাচার্য ব্যাসাচার্যের ভাগবতমের ব্যাখ্যা শুনতে যায়। পরদিন শুনতে গিয়েও সে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো। তার আগমনে উৎসুক্য শ্রীনিবাস জিজ্ঞাসা করলে, 
"কি শিখিলে আজ?" 
কৃষ্ণবল্লভ বললে,
"আমার মন আপনার শ্রীচরণে পড়িয়াছিল। আপনার সঙ্গের জন্য উৎকুন্ঠিত ছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিয়াছি।" 
সূর্য যেরূপ পৃথিবীকে আকর্ষণ করে, সেইরূপ শ্রীনিবাসের বিষণ্ণ, করুনমূর্তি ও অগাধ পাণ্ডিত্য কৃষ্ণবল্লভকে আকর্ষণ করেছে। 
শ্রীনিবাসের একপ্রকার অনুরোধে ও পীড়াপীড়িতে কৃষ্ণবল্লভ পরদিন তাকে শাস্ত্রব্যাখ্যা শোনাতে রাজসভায় নিয়ে গেলো। প্রথমদিন শ্রীনিবাস ব্যাসাচার্যের ভাগবতমের ব্যাখ্যা নির্বাক হয়ে শুনলো। পরের দিন আর থাকতে না পেরে বললে, 
"হে পন্ডিতজ্ঞ, আপনি মূল গ্রন্থের প্রশস্থ পথ ছাড়িয়া এ কি ব্যাখ্যা করিতেছেন?" 
ব্যাসাচার্য একথায় কোনো কর্ণপাত না করে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে গেলেন। তৃতীয় দিন শ্রীনিবাস বললে, 
"আপনি ভাগবতমের রাসপঞ্চাধ্যায় ব্যাখ্যা করিতেছেন আপনার মত। আপনি শ্রীধরের টীকা ব্যবহার করিতেছেন না কেন? "
একথার উত্তর না দিয়ে সভাপন্ডিত ব্যাখ্যা আরম্ভ করতে গেলে রাজা হাম্বীর বললেন, 
"এই ব্রাহ্মণ যুবা আপনার ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট নহে। তবে কি আপনি ভুল ব্যাখ্যা করিতেছেন? "
রাগে, বিরক্তির সুরে ব্যাসাচার্য বললেন, 
" আমার ব্যাখ্যায় ভুল ধরিতে পারে এরূপ কোনো পণ্ডিত বর্তমান এই প্রদেশে?" 
শ্রীনিবাসের দিকে রক্তোজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বললেন, 
" আসুন, আপনি ভাগবতম্ ব্যাখ্যা করুন। দেখি আপনি কত বড় পণ্ডিত! "
ব্যাসাচার্যের বেদীতে বসে আচার্য্য ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করল। তার কন্ঠ, অদ্ভুত পাণ্ডিত্য ও সুরের মহিমায় সমস্ত স্বর্গের দেবদেবী যেন একচিত্তে শ্রীনিবাসের ব্যাখ্যা শুনছেন। তার হৃদয়ের বীণার ঝংকারে সমস্ত রাজপুরী আন্দোলিত হয়ে উঠল। আচার্য্যের ব্যাখ্যা যেন শ্রীপ্রভুর পাদপদ্মে নৈবেদ্যর মত উপস্থাপিত হল। 
রাজা, ব্যাসাচার্য ও সমস্ত রাজ্যবাসী এই ব্যাখ্যা শুনে অভিভূত। 
সভাভঙ্গের পর রাজা শ্রীনিবাসের পিছন পিছন গিয়ে তাকে তাঁর প্রাসাদে থাকার জন্য প্রার্থনা করতে আরম্ভ করলেন। অগ্যতা কৃষ্ণবল্লভকে বিদায় জানিয়ে পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্রীনিবাস আচার্য্য রাজ ভবনের একটি কক্ষে আহারাদি করে রাত্রের কীর্তনে লিপ্ত হলেন। তার কণ্ঠ শুনে পাষান গলে যায়। তৎক্ষণাৎ মহাবিক্রমশালী, পরাক্রমী রাজা হাম্বীর মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচার্য্যের পায়ে পতিত হন। 
রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, 
" আপনি কে? শুনিয়াছি বিপদে পড়িয়া আপনি এখানে আসিয়াছেন। আমি আপনার কীরূপে সাহায্য করিতে পারি তাহা বলুন।" 
শ্রীনিবাস আচার্য্য সমস্ত বর্ণনাদি দিল। সব শুনে রাজা বললেন, 
"প্রভু, আপনার যা শাস্তি হয় আমাকে দিন। আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবে আপনার সমস্ত পুঁথি রাজভান্ডারে অক্ষত অবস্থায় আছে। "
রাজার রাজবেশ ধুলায় লুন্ঠিত হল। শ্রীনিবাস রাজাকে আলিঙ্গন করে বললে, 
" তোমার কৃষ্ণপদে মতি হউক।" 
কোনো হারানো সন্তানকে ফিরে পেলে মায়ের যে অবর্ণনীয় আবেগ কাজ করে, শ্রীনিবাসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। সমস্ত পুঁথি ফিরে পেয়ে তিনি আনন্দিত হলেন। শ্রীনিবাস তৎক্ষণাৎ গুরু শ্রীজীব গোস্বামী ও নরোত্তমকে চিঠি লিখে সব ঘটনা জানান দিলো। 
কিন্তু শ্রীনিবাস আচার্য্যের আর গৌড়ে ফেরা হোল না। তার ছোঁয়ায় রাজা, রাণী ও রাজপণ্ডিত বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হোল। বিষ্ণুপুর হয়ে উঠল দ্বিতীয় বৃন্দাবন,গুপ্ত বৃন্দাবন। 
জীবগোস্বামীর স্বপ্নাদেশ অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। শ্রীনিবাস আচার্য্য হয়ে উঠল বিষ্ণুপুরবাসীর ত্রাতা, বিধাতা ও প্রাণপুরুষ। তাঁর আমলে বিষ্ণুপুরের যে বিকাশ ঘটল, তা বিগত ৫০০ বছরেও কখনো ঘটেনি।