সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

উত্তম বিশ্বাস





লোক নির্মাণ

                               
নিজের লেখা গল্পগুলো লাইন চিরে চিরে পড়ছেন অখিল নিয়োগী। ওঁর মুখের পানে চিকন চোখে চেয়ে আছে দীঘি, পরানের বউ। ও পুতুল বানায়। ওর হাতের তালু মাখনের মতো মসৃণ। একমনে আখ্যান শোনে আর চরিত্রগুলো নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তোলে দীঘি। আগে অসীম পালের কারখানায় কাজ করত পরান। গণেশ, লাফিং বুদ্ধ, রাম, হনুমান এসব পুতুলের বায়না নিয়ে সংসার চালাত সে। কিন্তু দীঘিকে ঘরে আনার পর থেকেই ওর হাতের কাজ গেছে। অসীমের সেই একই অভিযোগ,“পরানের পুতুলগুলো আগুন থেকে তুললেই বড্ড বেশি মানুষ মানুষ দেখায়! এসব পুতুল এমনি দিলেও কেউ কিনবে না!”
অতএব পরানের কাজ গেল। কিন্তু পেট বড় বালাই! দীঘি নিজেই একদিন উঠোনে পাঁজা খুঁড়ল। অথচ ওরও ওই একঘেয়ে অথর্ব দেবদেবতা নিয়ে কাদা ছেনতে মোটেও ইচ্ছে করেনা।
শীতের রোদে গল্পের পুতুলগুলো শুকোয়। অখিল বাবু গল্প পাঠের ফাঁকে ফাঁকে শুষ্ক কণ্ঠে জানতে চান, “হ্লাদিনীতে এতটা মোরাম মেশান কি ঠিক হল দীঘি?”
-“আগুনকে দিয়ে বিশ্বাস আছে? অন্তরে একটু রস থাকলে তো চটাস করে চটে যাবে!”
অন্তরে রস থাকলে চটে যায়? এসব ভেবে এই বয়েসেও বড় আতান্তরে পড়েন অখিল বাবু,“তাহলে এখন উপায়? পোড় খেলেই তো ওর চোখেমুখে সেই লাল রঙ ফেটে পড়বে! তাছাড়া ললিত পুরের চালকলের তুষকুঁড়ো মাখা যে মনোহরের কথা বললাম, সেও তো শ্যামবর্ণ।”
দীঘি আলত হাতে জলন্যাকড়া বুলিয়ে হাসে,“চিন্তা নেই। ওকেও চেপে দেব।”

উঠোনের পাঁজায় আজ মাল উঠোবে দীঘি। শুকনো বাঁশপাতা আর আমকাঠের গুড়ি দিয়ে সেজে উঠল খোল। প্রথমে কিছু প্রদীপ যাবে, এরপর অসীম পালের কারখানা থেকে ফেরত আসা লাফিং বুদ্ধ, ধনুকভাঙা রাম, হনুমান, এর ওপর মোটা একপরল ছাই। সবশেষে শোয়ানো হবে অখিল বাবুর গল্পের চরিত্রদের।
আজ আগুন হাতে দীঘি যখন পাঁজার মুখে দাঁড়াল, অখিল বাবুর বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠল। বললেন, “আরেকটু দেরি করো দীঘি। মনে হচ্ছে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে আমাদের।’’ দীঘি থমকে দাঁড়াল। অখিল বাবু ফের একটা একটা করে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। দীঘির হাতের আগুনও একসময় অস্থির হয়ে উঠল। অশান্ত আগুনের সামনে আবারো অখিল বাবু সামবেদের মতো সুরে সুরে পড়ে যেতে লাগলেন নিজহাতে নির্মিত আসিদ্ধ জীবনের আখ্যান সমূহ। এমনসময় চারিদিক থেকে মেঘ অন্ধকার করে এল। অখিল বাবুর চোখেমুখেও কী যেন এক গভীর উদবেগের ছায়া। মুষলধারে বৃষ্টি নামল। একটানা বৃষ্টি আর বাতাসের বাড়ি খেয়ে খেয়ে দীঘির হাতের আগুন নিভে গেল। কিন্তু পুতুলগুলো একটাও তুলল না দীঘি।

উঠোনে হাঁটুজল। গল্পের চরিত্রগুলো সব ধুয়ে ধুয়ে পাশের পুকুরে নেমে যাচ্ছে। জলঝাপসা চোখে দীঘি দেখছে, একজন অস্থির লেখক আকাশের দিকে ঘনঘন জোড় হাত করছেন, আর অসংলগ্নভাবে একটা কথাই উচ্চারণ করছেন,“ওহে সুন্দর, তোমাকে সহস্র সাধুবাদ!”