সারা দেশে যখন লকডাউন চলছে, তখন ঘরে বসে থেকে থেকে যেন হাত
পা লক হওয়ার জোগাড়। তবে, একটা কথা কী জানেন, এই লকডাউনের সময় কারও বউই কিন্তু এ
কথা অন্তত বলতে পারবে না যে, তার হাজবেন্ড তাকে বাড়িতে একটু সময় দেয় না। কিন্তু এ
কথা হয়তো আপনারা সকলেই মানবেন যে, সবকিছুর একটা সাইড এফেক্ট আছে। ঠিক কিনা বলেন। লক
ডাউনে বউরা সারাক্ষণ স্বামীদের বাড়িতে পেল বলেই একটা কিন্তু সমস্যার দেখা দিল।
মানে, একটা সাইড এফেক্ট দেখা দিল। অর্থাৎ, খোলতাই করে বলতে গেলে বলতে হয়, সাতপাকে
ঘোরা বর বউ সারাক্ষণ বাড়তি থাকল বলে পদে পদে একটা যুদ্ধের আবহ তৈরি হল।
‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ এ নিয়ে রচনা পড়তে পড়তে আশাকরি
সকলেরই হাড় পেকে গেছে। অনেকের হাড়ে হয়তো দুব্বা ঘাসও গজিয়ে গেছে। মানুষ একে একে দুই
দুইটা বিশ্বযুদ্ধ ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে। আপনারা নিজেরাও জানেন সে যুদ্ধের বীভৎসতার
কথা। জানেন তার ধ্বংসলীলার কথাও। তবে,
এখন যা চলছে, তা আদতে এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ একটা ছোট্ট ভাইরাসের সঙ্গে।
হাজার হাজার মানুষ মরছে প্রতিদিন। গোটা বিশ্ব
যেন মৃত্যুনগরীতে পরিণত হয়েছে। কেউ বলছে, চীন নাকি গোটা বিশ্বে নিজের কতৃত্ব কায়েম
করার জন্য জৈব অস্ত্র হিসেবে এই ভাইরাসকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। কেউ আবার বলছে
অন্য কথা। এসব আপনারা জানেন, এ নিয়ে আমার আর কথা না বাড়ানোই ভালো, কি
বলেন? আমি আপনাদের বলবো অন্য এক যুদ্ধের কথা। যে যুদ্ধ শুরু হয় ছাদনাতলায় সাতপাক
ঘোরার পর। মানে, লাড্ডু খাওয়ার হ্যাংওভারটা কাটার পর। যাকে আপনারা বিবাহিতের
গৃহযুদ্ধ বলতে পারেন। এ যুদ্ধে সামিল হওয়াটা এখন মনুষ্য
জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। এ যুদ্ধে যথেচ্ছ পরিমাণ গোলা বারুদের ব্যবহার হয়ে থাকে।
ব্যবহার হয় অত্যাধুনিক শান দেওয়া সব অস্ত্রশস্ত্র। এ যুদ্ধে সামিল হয় না, এমন
মানুষ বোধহয় এ জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই যেমন সেদিনের কথাই ধরুন না। আমার পাশের বাড়ির ভুতুবউদির
(মানে ভূতনাথ দাসের বউ আরকি) সঙ্গে শুরু হল দাদার তুমুল যুদ্ধ। ভূতনাথ দাসকে অবশ্য
পাড়ার সবাই ভুতুদা বলেই ডাকে। আমিও তাই ডাকি। সে যাইহোক, যুদ্ধ বেঁধেছে। দুই তরফ
থেকেই একটার পর একটা শেল নিক্ষেপ হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে। কখনো
ভুতুবউদি তো কখনো ভূতুদার তরফ থেকে এক একটা শেলগুলি যেন আঁচড়ে পড়ছে। একটাও
লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে না। একেবারে সঠিক নিশানায় গিয়ে আঘাত হানছে। সে কী বিষাক্ত শেল
এক একটি। কান ফেটে যেন রক্ত বেরনোর জোগাড়। পাড়ার কেউই কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
কে আর খামকা নিজের প্রাণটাকে হারাতে চায় বলুন। কিন্তু কী আশ্চর্য! খানিকবাদে আবার
কী হল জানেন? খানিকবাদেই সে গোলাবর্ষণের আওয়াজ টাওয়াজ যেন একেবারেই কমে এল। এক সময়
তা আর বিশেষ শোনাও গেল না। আমার ধারণা, বোধহয় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়েছে। আর নয়তো,
যুদ্ধ কৌশলই পাল্টে ফেলেছে উভয় পক্ষ। হয়তো গেরিলা
কায়দায় আক্রমণ শানানোর জন্য উভয় পক্ষই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। আমার অনুমান আবার মিথ্যে হয়
না, বুঝলেন। এটাকে আবার আপনারা আমার অহংকার ভাববেন না। কিন্তু এটাই সত্যি। তো
যাইহোক, যা বলছিল আরকি। ভূতুদা এক সময় অতর্কিতে আক্রমণ করতে গেছে ভুতুবউদিকে। মানে
যাকে বলে একেবারে সারজিক্যাল স্ট্রাইক। অর্থাৎ অতর্কিতে শত্রুর ডেরায় গিয়ে শত্রুকে
নিকেশ করা। কিন্তু শেষপর্যন্ত কি হল জানেন? ভুতুবউদি কী ভাবে যেন ভুতুদার
প্ল্যানটা বুঝতে পেরে গেছে। আর তা বুঝতে পেরেই, রীতিমতো রুখে দাঁড়াল ভুতুবউদি। আকাশ
বাতাস কাঁপিয়ে একটা হাইড্রজেন বোমার মতো একটা বোমা নিক্ষেপ করে বসল। তার সে কী
গর্জন! কী গর্জন! ভুতুবউদি গর্জন করে উঠল, ‘ডোন্ট টাচ মি’। ব্যাস। আর যাবে কোথায়।
ভূতুদার প্রসারিত দু’হাতের আঙুলগুলো যে উৎসাহে এগোতে যাচ্ছিল, হঠাতই এক হুঙ্কারে
সেসব যেন একেবারে কুঁকড়ে গেল। সেসব আর সোজাই হল না। থমকে দাঁড়াল ভুতুদা। আর এক পাও
আগাতে সাহস পেল না। এক বোমাতেই কাজ হল। ভুতুবউদির ভাণ্ডারে আরও যে সব বিষাক্ত
অস্ত্রশস্ত্র আছে, যেমন ধরুন, ‘এই থাকল সব পড়ে, আমি চললাম বাপের বাড়ি’ ইত্যাদির
মতো অস্ত্রগুলিকে আর প্রয়োগই করতে হল না। এ সব অস্ত্র প্রয়োগ করলে তো প্রতিপক্ষ
প্রায় পায়ে এসে পড়ার জোগাড় হয়। ছোটখাটো অস্ত্রে কাজ হলে, কে আর শেষ শক্তিশালী
অস্ত্র প্রয়োগ করে বলুন। ভুতুবউদিও করল না। ওই এক বোমার আঘাতেই ভুতুদার সারজিক্যাল
স্ট্রাইক একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল।
আমার হঠাতই যেন অন্য এক খেয়াল হল। গোটা বিশ্ব জুড়ে কোভিড-19 (মানের করোনার আদুরে নাম) যখন গেয়ে বেরাচ্ছে, ‘টাচ মি টাচ
মি টাচ মি, জারা জারা টাচ মি টাচ মি টাচ মি’ সে সময় ভুতুবউদি হুঙ্কার ছাড়ছে,
‘ডোন্ট টাচ মি’। কি অস্ত্র রে বাবা! একেবারে সরাসরি শত্রুর হৃদয়ে আক্রমণ? ভুতুবউদি
এতটাই নির্দয়? শত্রু বলে কি তার সাথে এতটাই নির্দয় নিষ্ঠুর হতে হবে? পাকিস্তান তো
আমাদের শত্রু। ঠিক কিনা বলেন? প্রায় সারা বছরই তো পাকসীমান্তে গোলা গুলি চলে। তাই
বলে কি ওয়াঘা সীমান্তে দু’দেশের তরফে প্রতি বছর মিষ্টি বিতরণ হয় না? পাকিস্তানি
লাড্ডুগুলোকে নিয়ে এ দেশ কি ফেলে দেয়? ভুতুদাও না হয় যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে একটু
লাড্ডু খেতেই গেছিল, তাই বলে ওভাবে তাড়িয়ে দিল ভুতুবউদি? শুধুই কি তাড়ানো? তাড়িয়ে
একেবারে কাঁটাতারের ওপার করে দিল? ভুতুবউদি এটা বোধহয় ঠিক করল না। আপনারা কী বলবেন
জানি না।
ভুতুদা আসলে একটু নরম সরম প্রকৃতির মানুষ, বুঝলেন। নিষ্ঠুর
নয়। হৃদয়ে তার প্রেম ভালোবাসা বলে একটা বস্তু আছে। অতিবড় শত্রুকেও সব সময় সে শত্রু
ভাবে না। ভুতুদার বিশ্বাস, শত্রুও মিত্র হয়ে উঠতে পারে। সে জন্য ভুতুদা মাঝে
মধ্যেই নিজের খেয়ালে গেয়ে ওঠে, ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা বলি’ কিংবা ধরুন ওই,
‘আরও কাছাকাছি, আরও কাছে এসো’ এই সব আরকি। কিন্তু ভুতুবউদি সে সব গানের অর্থ বুঝলে
তো। পান থেকে একটু চুন খসলেই ভুতুবউদির ফাটা বাঁশের গলা থেকে যেন বেরিয়ে আসে,
‘ওপারে থাকবে তুমি, আমি রইব এ পারে’ কিংবা ধরুন, ‘তারে বলে দিও সে যেন আসে না আমার
দ্বারে’। মানে, ভুতুবউদির দ্বার পুরোপুরি বন্ধ। অর্থাৎ যাকে বলে একেবারে লকডাউন।
সে লকডাউন কবে খুলবে ভুতুদা তো দূরের কথা, মদনের বাপও জানে না।
শুধু এইখানেই থেমে থাকে না ভুতুবউদি, জানেন। রীতিমতো সোশ্যাল ডিসটেন্সের ফতোয়া
কঠোর ভাবে বলবত করে বসে।
লকডাউনের কথাই যখন উঠল, তখন এ বিষয়ে দুটি কথা বলি। সেদিন,
মানে ওই যুদ্ধের কয়েকদিন পরই ভুতুবউদি ভুতুদাকে বলল, হ্যাঁ গো, শোন না, লকডাউনে তো
বাইরে কোথাও যাওয়া টাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে চলো না এক কাজ করি, লকআপে ঘুরে আসি কিছু
দিন। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। ঘরে থেকে
থেকে একেবারে বোর হয়ে গেছি। ভুতুদা শুনে তো বেশ মজাই লুটল। ভুতুদা
আবারও একবার বুঝল যে, তার বউ বড় যোদ্ধা হলেও মাথায় একটা গোবরের ডালি আছে। যদিও সে
কথা বলার সাহস আর দেখাতে পারল না ভুতুদা। ভুতুদা কেবল বলল, লক আপে তুমি তো যেতেই
পারতে যদি সেদিন তোমার ছোড়া সাঁড়াশিটা দরজায় না লেগে, সরাসরি আমার মাথায় এসে লাগত।
ভুতুবউদি খানিকটা গদগদ হয়ে বলল, কী সব যে বল না তুমি। আমি কি তোমাকে প্রাণে মারতে
চাই বল? অত নিষ্ঠুর আমি নই গো। ভুতুদা
কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটাকে হালকা নাড়ালো।
মনে মনে এ কথা বলল কিনা কে জানে, যে, সারাবছর তোমার সাথে যুদ্ধ করে মরার থেকে,
আমার একবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো।