সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অনামিকা দে






 উড়ান 



বাবা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। এক্ষুনি জয় গাড়ি নিয়ে চলে আসবে। মিষ্টুর তাড়াতে সৌরভ তাড়াতাড়ি দুধসাদা রঙের পাঞ্জাবিটা মাথার ভেতর দিয়ে গলাল। মিষ্টুর সাথে সৌরভ কিছুদিনের জন্য চলে যাচ্ছে তার এই যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাট ছেড়ে মিষ্টুর বাড়িতে। গতকাল নন্দিনীর শেষকৃ্ত্য সম্পন্ন হয়েছে। মিষ্টু ঝটপট করে সৌরভের আলমারি থেকে পরপর সাজানো কয়েকটা জামা সুটকেসে ভরতে লাগল। মিষ্টুর বাবার প্রতি ভালোবাসার পাল্লাটা বরাবরই মায়ের থেকে একটু বেশিই ছিল। বিশেষতঃ মিষ্টু এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বৃদ্ধ বয়সে বাবাকে অকারণে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে মার দাদুর বাড়িতে চলে যাওয়া। মার কারনেই তো বাবাকে দীর্ঘ দশবছর এক বিস্বাদ জীবন কাটাতে হয়েছে। "বাবা তোমার কি কিছু ফাইল নেবার আছে?" এটা কি ! ফাইলের ভেতরে একটা ডায়েরি রাখা। ডায়েরির ওপরে তো মোটা মোটা অক্ষরে মায়ের হাতের লেখা "নন্দিনীর দিনলিপি"। মিষ্টু কিছুটা কৌতূহল বশতঃ ডায়েরিটা নিজের ব‍্যাগে ঢুকিয়ে নিল।




১৮ই জুলাই, ১৯৯৬




বন্ধু অনেকদিন পর আবার তোমার কাছে এলাম। তোমার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল প্রায় ছয়মাস আগে(৬ই জানুয়ারি, ১৯৯৬ সাল)। কেন জানিনা আজ তোমাকে আমার খুব আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে। হ‍্যাঁ , সত্যি কথা স্বীকার ক‍রে নিচ্ছি এই ছয়মাসে কিন্তু আমার তোমার কথা একবারও মনে হয়নি। কি জানি আমরা মানুষেরা হয়তো একটু বেশিই স্বার্থপর হই। যখন সবকিছু কোন বাধা না পেয়ে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে তখন তোমাকে অবহেলায় বই এর র‍্যাকের এক কোণে ধূলোয় ফেলে রাখি। তুমি তো নীরব, প্রানহীন তাই তো আমাদের রক্ত মাংসের মানুষদের মতো প্রতিবাদ করতে জানোনা। যাক্ এবার আমার কথায় আসি। জানোতো আজ সকাল থেকেই মনটা কেমন খুশি খুশি হয়ে ছিল। এই অজানা খুশির কারণটা আমি নিজেও ঠিক  বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক সেইরকম খুশি যেদিন কলেজ ক্যান্টিনে সৌরভ আমাকে ওর ভালোবাসার কথা জানালো। সেদিন আনন্দে, খুশিতে আমার ভেতরে এক চাপা উত্তেজনা যেমন শুরু হয়েছিল ঠিক সেইরকম।




পরে আমি আমার খুশির কারণটা বুঝতে পারলাম। আসলে সৌরভ আমার পছন্দ করা নীল রঙের শার্টটা পড়ে আজ অফিসে গিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বন্ধু আমার মনটা এখন  কেমন উচাটন হয়ে আছে। আর তাই তো তোমার কাছে এলাম। আজ আমি যখন দুপুর বেলায় মিষ্টু, বাবানের জামা কিনতে গড়িয়াহাটে যাচ্ছিলাম, সিগ্ন্যাল না পেয়ে আমার গাড়িটা কালিঘাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তখনই তো গাড়ির ভেতর থেকে মনে হল দেখলাম সৌরভকে। একটা রেস্তোরাঁর ভেতরে বসে আছে সুচেতার সঙ্গে। ও! বন্ধু, তুমি তো সুচেতার কথা জানোনা। ও আমার সেজ মাসির মেয়ে, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। বুঝতে পারছি না ভুল দেখলাম কিনা? তুমি ভাবছো আমি হয়তো সন্দেহ বাতিক। কিন্তু আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম আমার পছন্দ করা নীল শার্ট পড়ে, লম্বা, সুদর্শন  আমার সৌরভকে। ধূর্, কিসব আজেবাজে কথা তোমায় বলছি। এখন আমি বাড়িতে একা। একটু পরেই স্কুল থেকে মিষ্টু , বাবান ফিরবে। ঐ যে বেল বাজছে , ওরা নিশ্চয়ই চলে এসেছে। আজ যাই বন্ধু, আবার খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।




১৯শে জুলাই, ১৯৯৬




কথা দিয়েছিলাম বন্ধু খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। আজ আমার মনের অবস্থাটা এইরকম - পরীক্ষায়  অঙ্কে ফেল করব ভেবেছিলাম কিন্তু রেজাল্ট হাতে পেয়ে দেখলাম পাশতো করে গেছি । সকাল থেকেই  আমার এত আনন্দ হচ্ছে শুধু মনে হচ্ছিল  কখন আমার সব লুকানো কথা তোমাকে উজাড় করে দেব। এই তো সৌরভ একটু আগেই বেরিয়ে গেল, ওদের ব্যাঙ্কে এখন খুব চাপ চলছে।  তোমাকে কালকে আমার সন্দেহের  কথা বলেছিলাম, সত্যি কি ছোটই না হয়ে গেছি আমি আমার নিজের কাছেই। আমাদের দশ বছরের প্রেমের বিয়ে কি এতই ঠুনকো যে তাতে মাকড়সা জাল বুনবে। তোমাকে বলতে আমার একটু লজ্জা করছে বন্ধু, কিন্ত্ত তোমাকে যে আমার এই আনন্দের খবরটা দিতেও ইচ্ছে করছে। জানো, কাল রাতে সৌরভ ওর আদরে আদরে আমাকে ভিজিয়ে দিল, আমিও পরম তৃপ্তিতে ওর আদরে ভিজতে ভিজতে স্নান করলাম। ঠিক যেমন এক পরগাছা একটা খুঁটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।  আর হ্যাঁ! আরেকটা কথাও তোমাকে বলে আমি আমার লেখা শেষ করছি। অনেক দিন পর আজ আমার হারমোনিয়ামটার কথাও মনে পড়ল। একটু পরেই তাতে আমি আমার ভালোবাসার সুর তুলব-
"প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও, দাও, দাও।
ভুলিব ভাবনা, পেছনে চাব না
পাল তুলে দাও, দাও, দাও, দাও"।




২৪শে জুলাই, ১৯৯৬




বন্ধু এই চারদিন তোমার কাছে আসতে পারিনি। মনটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে আমার সৌরভ আস্তে আস্তে আমার থেকে বহুদূর চলে যাচ্ছে। ওকে আমার খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওর তো আমার জন্য কোন সময় নেই। চেনা সৌরভকে এই চারদিনই যেন অনেক অচেনা  লাগছে। আমি তো রান্নাঘর থেকে স্পষ্ট শুনলাম সৌরভ চাপা গলায় ফোনে বলল "সুচেতা আমি পরে তোমায় ফোন করছি।" এটাও কি আমার মনগড়া সন্দেহ?  খুব কান্না পাচ্ছে। জানো বন্ধু আমি শুধু সৌরভের মুখটাকে ভালো করে খোঁজার চেষ্টা করছি, না কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। একেবারে বুদ্ধের মত শান্ত, নির্লিপ্ত , ধীর, স্থির মুখ। ওতো একই রকম ভাবে অফিসে বেরোনোর আগে আমার হাতের জলটাও খেল। তবে কেন এক অজানা আশঙ্কা আমায় ঘিরে ধরেছে?




১লা জানুয়ারি, ১৯৯৭




আবার অনেকদিন পর তোমার কাছে এলাম । তুমি জানো না এই ছয়মাসে আমি ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষত বিক্ষত হতে হতে নিজেকে পালটে ফেলেছি। হ্যাঁ অনেকটাই বদলে ফেলেছি। আগের মত এখন সৌরভের অফিস থেকে ফেরার সময় হলে ব্যকুল হয়ে পড়ি না। ওকে কাছে পেতে আমার ঘৃণা হয়, ওর চোখের দিকে চোখ পড়লে ক্ষমার দৃষ্টিতে নাকি আক্রোশে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি ঠিক জানি না। আমার সন্দেহটা মিথ্যা নয়। সুচেতা একদিন আমার বাড়িতে এসেছিল। আমি স্নানে গিয়েছিলাম। আচমকা বাথরুম থেকে বেরিয়ে সৌরভ ও সুচেতাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলি। কিন্তু ওরা আমাকে দেখেনি। আমি নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলাম। বুঝতে পারি না আমার দেখতে পাওয়াটা আমার না ওদের লজ্জার। সৌরভ জানতেও পারল না যে আমি ওদের সম্পর্কটা জেনে ফেলেছি। সৌরভ কিন্ত্ত কোনওদিন ওর কোন কর্তব্যে অবহেলা করেনি, এখনো করছে না।  কি আশ্চর্য - তাই না! আমার এই ভালোবাসার বাড়িটা আছে, ভালোবাসার সন্তানরা আছে, ভালোবাসার স্মৃতি চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, ভালোবাসার মানুষটিও আছে শুধু ভালোবাসাটাই  নেই।

২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০




কতবছর বছর পরে বন্ধু তোমার কাছে এলাম। আমার কথা কি  তোমার মনে আছে? তুমি আমার মতই তো কেমন পাল্টে গেছ। কেমন বিবর্ণ, হলদেটে। তোমার বাইরের আবরণটাও অনেক ধূসর হয়ে গেছে। অনেক বেশি বয়সের ছাপ, আমার মতোই। তোমার কথা কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে পড়ত। কিন্ত ভয় লাগতো তোমার কাছে আসতে। কেন জানি না মানুষ খুব কাছের জনকে যাকে সে খুব আপন করে নেয় তাকে নিজের কষ্টের ঠিকানা বারবার দিতে চায় না। আজ কিন্তু তুমি খুশি হবে। এই দীর্ঘ তেইশ বছরে একটা বড়ো সুখবর আগে দিই। আমার বাবন আজ ডাক্তারি পাশ করল। মিষ্টুও এখন অন্যের ঘরণী। তোমার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে আমি কি এখনও সৌরভের সাথে থাকি? হ‍্যাঁ এতদিন পর্যন্ত রয়েছি, শুধু বাবান আর মিষ্টুর  ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মহাদেবের মত সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমান কন্ঠে আটকে রেখে বয়ে চলছি এই দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে। আজ আমি খাঁচার বন্দীদশা থেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতোই স্বাধীন। কোন দায় নেই, দায়বদ্ধতা নেই, পিছুটান নেই শুধু নিজের খুশিতে উড়ে চলব। আমি জানি আমার এই বিশ্বস্ত কাছের বন্ধুটি যতই বুকে আঘাত পাকনা কেন কখনোই সে তার নন্দিনীকে ভুলবে না।




৩রা মার্চ, ২০১০




আজ দুপুরে সৌরভ আমার পাঠানো কোর্টের নোটিশটা পেল। সৌরভ তো কিছুতেই মানতে পারছে না যে আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চলেছি। আসলে সৌরভ জানতো আমি ওকে কতটা ভালোবাসি, আমার প্রানের চেয়েও। মানুষ হয়তো তার ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার চেয়েও, যার থেকে সে ভালোবাসা পেয়েছে বলে জানত তার থেকে ভালোবাসার আঘাতটা সহজে মেনে নিতে পারেনা। আমি তোমাকে ওর হাতে তুলে দিলাম। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর উদ্ভ্রান্তের মতো একটার পর একটা পাতা গিলতে লাগল। এরপর ধরা পড়ে যাওয়া আসামির মত আত্মসমর্পণ করে আমার হাত দুটো চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। আমার চোখের দিকে চোখ না রেখে ওকে ক্ষমা করে দিতে বলল পরপর তিনবার। কিন্ত্ত বন্ধু ও বড্ড দেরি করে ফেলল, বড্ড দেরি। আমি তো সৌরভের কাছে বারবার ছুটে গিয়েছিলাম, ওকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্ত্ত তখন তো ওর কাছে আমি ছিলাম  ঘরের অন্যান্য পড়ে থাকা আসবাবপত্রের মত। সৌরভ আমার ভালোবাসাকে নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ঠকিয়েছে আমাকে দিনের পর দিন।




৪ঠা মার্চ, ২০২০




বন্ধু, কাল সকালেই আমি আমার বাবার কাছে চলে যাচ্ছি। এখন অনেক রাত। প্রায় দেড়টা বাজে। পাশের ঘরে সৌরভ ঘুমিয়ে পড়েছে। জানো, আজ সন্ধ্যায় আমি সৌরভের সাথে ওর কলিগ সুশান্তদার ছেলে প্রদীপ্তর বিয়েতে গিয়েছিলাম। না গিয়ে উপায় ছিল না। আসলে সুশান্ত দাকে কথা দিয়েছিলাম যে যাব। মনে হল প্রায় দুইযুগ পরে আমি আর সৌরভ পাশাপাশি বসে আছি। সৌরভের মুখটা একইরকম ধীর, স্থির, শান্ত। প্রদীপ্তর হাতে মিতালীর হাত রেখে ঠাকুরমশাই মন্ত্র উচ্চারণ করছেন-"যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম"। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই যুবক সৌরভ যে টকটকে লাল বেনারসি শাড়িতে সজ্জিত, উপচেপড়া খুশিতে উজ্জ্বল যুবতী নন্দিনীর হাতে হাত রেখে চিৎকার করে বলছিল -" যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম"। তোমার কাছে আসার আগে অনেকদিন পর আজ অনেকক্ষণ  কাঁদলাম। অনেকক্ষণ কাঁদবার পরে যে শরীরে একটা আরাম অনুভূত হয়, তা আজ টের পেলাম। এই বাড়িতেই আসার পর সৌরভ তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, তাই আমি তোমাকে সৌরভের কাছে এখানেই রেখে গেলাম। আর কোনওদিন তোমার সাথে দেখা হবে না। ভালো থেকো বন্ধু - নন্দিনী।




ডাইরির লেখাটা পুরো শেষ করে মিষ্টু দুহাতে ডাইরিটাকে বুকে জড়িয়ে পাথরের মত বসে রইল। আজকে মাকে এখুনি, এই মুহুর্তে খুব, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মিষ্টু বাড়ি থেকে নিজের অজান্তেই বেড়িয়ে পড়ল। যোধপুর পার্কের তালা দেওয়া ফ্ল্যাটটার চাবি খুলে প্রথমেই নন্দিনীর ঘরে ঢুকল। একঝটকায় জানলার পর্দা সরিয়ে দিল। চারিপাশে ধুলো, দেওয়ালের এককোণে মাকড়সা জাল। দেওয়ালে টাঙানো ছোট্টবেলার পুজোর সময় তোলা বাবা, মা, বাবান, মিষ্টুর ফটোটা হাতে নিয়ে মিষ্টু আঙুল দিয়ে ধুলো সরিয়ে দিল। এই তো এবার মাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আবছা হয়ে যাওয়া মা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মিষ্টুর চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে এল। ধীরে ধীরে নন্দিনীও আবার অস্পষ্ট হয়ে গেল।




অনামিকা দে