কর্ণফুলী
ইস্ত্রি করা আকাশে সফেদ ধামাকা নিয়ে ক্যাটওয়াক করছে মেঘ। শিউলি মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কালো বাইক। দাগ মুছে
মাটিও বলে উঠছে , ‘ঢুঁড়তে রহে যাওগি’। এভাবেই শরৎ আসে কর্ণফুলীর। মুখভরতি ধোঁয়া ওপরে ছুঁড়তে ছুঁড়তে কর্ণফুলী বলে ‘এই নে আকাশ, তোর ফাঁকির ঠোঙায় জীবন পোড়া সত্যিকারের
ধোঁয়া।‘
লম্বা আঙুলের নিপুণ টোকায় সিগারেটের ছাই ফেলে কর্ণফুলী ভাস্বরের কাছে
সরে বসে। ওর কাঁধে হাত রাখে ভাস্বর।
‘ সিগারেটটা কি আর ছাড়বিনা তুই’ ?
‘ কেন বস,
আমাকে বউ করার ইচ্ছেটা কি আবার জাগল ?’
‘জেগে কি
লাভ ? তুই আছিস না, সব ইচ্ছেতে জল
ঢালার জন্য। চল, ওঠ। ‘
রবীন্দ্রসদনের সিঁড়ি থেকে বাইরে এসে ভাস্বর হঠাৎ
শিউলিগন্ধে ঘুরে দাঁড়ালো। কুঁচকে ছোট হয়ে আসা রংচটা ফ্রক পরে একটা অন্ধকার মুখের
মেয়ে দাঁড়িয়ে। ওর হাতের ফাটা প্লাস্টিকের বাটিতে মনমরা কিছু শিউলি। ওদের দেখে ছুটে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়ালো ‘ফুল
নেবেন?’ ভাস্বর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট মেয়েটার হাতে দিল। ওর
চোখ থেকে আলো উপচে পড়লো। এবার দু হাত পাতল ভাস্বর। মেয়েটি আধফোটা, চটকানো ফুলগুলো বাটি উপুড় করে ঢেলে দিল হাতে। যেতে যেতে ঘুরে তাকাল
বারবার। কর্ণফুলীর মুখে কোন কথা নেই। ভাস্বরও কিছু বলল না।
ওরা এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।
‘ ফুলগুলো ধরতো’।
কর্ণফুলী ওর নৈশব্দে আগুন ছড়িয়ে হাত পেতে শিউলিগুলো নেয়। আগুন নামে
শিউলির সাদায়।
‘এই তো তোর শরৎ, তাই না ভাস্বর ?
দ্যাখ ভালো করে তোর ‘অরুণ আলোর অঞ্জলিতে’
কেমন ক্ষিধে লেগে আছে।‘
কর্ণফুলী ফুলগুলো ড্যাশবোর্ডে রাখে। তারপর ফুঁসতে ফুঁসতে ফুলের দিকে
অপলক তাকিয়েই আলোর শহর সাঁতরে চলে। ভাস্বর দ্যাখে এক জলকন্যাকে, যে ভেতরে ভেতরে ফুঁপিয়ে উঠছে আর জলজ
বিস্ফোরণে টুকরো হচ্ছে ক্রমাগত। চোখের কোনে চিকচিক করছে জলকণা।
কেন এই জল ? কি তার ক্ষোভ ? সব বোঝে
ভাস্বর। । বোঝে চারদিকের দগদগে দৃশ্যদের পাল্টে না ফেলতে পারার ক্ষোভ কিভাবে কর্ণফুলীকে
কষ্ট দেয়। মিথ্যে, ভান, মুখোসের প্রতি
সবসময় সোচ্চার হতে না পারার সীমাবদ্ধতা কিভাবে
ওকে আত্মক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাও বোঝে। তাই সবসময় ওর সঙ্গে দ্বন্দ্বে যায়না। কর্ণফুলীকে ফ্ল্যাটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলে ,’ শিউলিগুলো
নিবিনা ?’
‘না,
ওসব আদিখ্যেতা তোকেই মানায়। ‘
আসলে কর্ণফুলীকে কি মানায়, সেটা প্রায় জোর করে ও নিজেই ঠিক
করে নিয়েছে। ওকে শাড়ি মানায় না। টিপ মানায় না। ন্যাকান্যাকা প্রেম মানায় না। বিয়ে
তো ওর জন্য কখনই নয়। এসব বিশ্বাসে ও অনড়।
লম্বা চুলটাই শুধু কাটতে পারেনি। মার শেষ চাওয়া সে ফেলে দিতে পারেনি বলেই ওর
জিনসের ওপর হিসহিস করে লম্বা বিনুনি। ভাস্বর ওর কলেজ জীবনের
বন্ধু। ওর কাছেই সমস্ত অনুভুতির প্রকাশ করে কর্ণফুলী।
দরজা খুলতেই বন্ধ ঘরও যেন উগরে দিল গুমোট ক্ষোভ। কর্ণফুলী সজোরে
জানালা খোলে। সিগারেট ধরায়। সোফায় আছড়ে ফেলে শরীর। ফোনে ভাস্বর আসে।
‘এখনও নিশ্চয়ই ফুঁসছিস ? কেন এমন
করে নিজেকে কষ্ট দিস তুই ? সব বিষয় একরকম করে ভাবিস না ফুলি। একা সব কিছু পাল্টে ফেলা যায়না।‘
কর্ণফুলীর মুখ থেকে একটু একটু করে বিরক্তির রেখাগুলো মিলিয়ে যেতে
থাকে। খুব ঠাণ্ডা গলায় সে বলে, ওঠে ‘ফোন রাখ, আমি ঠিক আছি।‘
সন্ধ্যে ফুরিয়ে গ্যাছে। অন্ধকার ঘন হয়েছে অনেকক্ষন। কর্ণফুলী ভিজছে।
শাওয়ার থেকে জল ছুটছে ওর শরীরের নিভৃত গলিপথে। মাথার ভেতর জেদী ডালপালা ঝাঁকিয়ে ক্ষেপে ওঠা গাছটা
ভিজছে। শীত করছে ওর। চোখের পাতা থেকে উঁকি দেওয়া জলের ফোঁটা
ডাকছে – চোখ খোলো কর্ণফুলী। কালো বাথগাউন জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেডরুম যাচ্ছে কর্ণফুলী। ঘরে ঢুকতেই দরজার পর্দাটা
আছড়ে পড়লো ওর মুখের উপর, যেন
অপেক্ষায় ছিল বহুক্ষণ।
এ ঘর ছুটির। এ ঘর ফেরার। এখানে সিঁড়ি নেই। নেই টপকে যাওয়ার মেধা। এ
ঘরে ঘাপ্টি মেরে বসে থাকে
পূর্বরাগের মেঘ। গোলাপি বিছানায় কর্ণফুলী
ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকে। ফুলই ঢেকে দেয় ফুলের কঙ্কাল। ছাদ থেকে নীলরং টুপটাপ ঝরে
হাতের মধ্যে। মুঠো খুলতেই সেই নীল দুষ্টু চড়ুই হয়ে বসে ভাস্বরের
আঁকা ছবির মেঘে। মেঘ থেকে তরল নীল আর স্বপ্নের সাদা গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়।
ডুবছে মেয়ে। তলিয়ে যাচ্ছে। দুহাত পেতে তুলে আনছে অন্য মেয়ের আলো। সে
কর্ণফুলী নয়। বাবার আদুরে ফুলি। সন্ধেবেলার সা রে গা মা-র ফুলি। নীল চিঠির
কুয়াশামাখা ফুলি। সে এখন মামাবাড়ির বকুল গাছ ছুঁয়ে
চলে যাচ্ছে নদীর ধারে। নদীতে শুশুক মুখ উঠিয়ে আকাশ দেখে আবার ডুব দিচ্ছে।
আমবাগানের আলোছায়ায় খেজুরপাটিতে ঘুমোচ্ছে মালিদাদু। ছমছম করছে
নাটমন্দির। সামনে দাদুর পুরনো বাড়ি। ভুমিকম্পে এক তলা মাটির নিচে বসে গেছে। ভূগর্ভ
রহস্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে দোতলার ঘর। দেয়ালে নিবিড় শ্যাওলা।
দরজা জানালা জাপটে ধরেছে বটের আঠালো হাত।
কর্ণফুলী ছোটবেলায় মামাবাড়ির ঐ জঙ্গলে মড়া ঘরগুলো থেকে হাঁউমাঁউখাঁউ
শুনতে পেত। কি এক মায়াবী উন্মাদনায় টানতো বাড়িটা। আজও আনমনে দেয়ালের ঐ নক্সাগুলো
এঁকে ফেলে ওর অবশ আঙুল।
কর্ণফুলীর আঙুলে এখন কালো হয়ে আসা শিউলি। ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগে আটকে ছিল দুটো ফুল। জেদী স্নায়ুতন্ত্র ডুবে যাচ্ছে সেই নরম স্নিগ্ধতায়। ভাস্বর লেগে আছে ঐ ফুলে।
লেপটে আছে ওর মনে আর বোধে। ভাস্বরের
ঝিমধরা চোখ ও ঠোঁটের ব্যারিকেডে ঢুকে পড়ছে
কর্ণফুলীর বরফ শরীর। ওর প্ররোচিত আঙুল ফোন হাতড়ে
চলে। সংখ্যার কাটাকুটি শেষে সুদূরের
কুয়াশা পেরিয়ে ভেসে আসে এক ভেজা ভেজা গলা। ভাস্বরের গলা। আলো গুলে গুলে জন্ম নেয়
স্বর।
‘কিচ্ছু বলিস না। আমি তোকে বুঝি। ঘুমিয়ে পড়। আমি জেগে আছি।
ছুঁয়ে আছি তোকে।‘
এসময় ফোন বন্ধ করেনা কর্ণফুলী। কথাও বলেনা। ওর প্রতিটি অনুতে ভাস্বর
দানা বাঁধে। ভাস্বরের করতল হয়ে যায় ছোট্ট ডিঙি। সে ডিঙির একমাত্র যাত্রী হয়ে
দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়ে ফুলি। বাবার আদুরে ফুলি। টলটলে মুখের ফুলি।
দুই
কাকের গর্জন। শহরের কুহুডাক। রেডিও জকি কর্ণফুলী
সেন লেবুজল হাতে ভোরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।
এরমধ্যেই প্রতিটি ছাদের সিমেন্ট নির্লজ্জের মত শুষে নিয়েছে শিশির। খুলে যাচ্ছে বন্ধ জানালা। সব কটি আমিষ বিছানা ধুয়ে দিচ্ছে সকালের পদাবলী।
কর্ণফুলী এবার ফ্ল্যাট মাথায় করবে। দশ হাতে
রাতের সংক্রমণ ছিঁড়ে ফেলবে। প্রবাহে,
গতিতে, স্পষ্টতায় সেরে ফেলবে সব কাজ।
নিয়মমতই কর্ণফুলী সব কাজ শেষ করে রাস্তায় হাঁটছে। কালো জিনস, ছাই রং কুর্তি, মেঘ মেঘ চোখের কর্ণফুলী এবার ট্যাক্সিতে। সে শহরের জেগে ওঠা রং দেখছে। কিছুটা হোমওয়ার্ক
করছেও মনে মনে। ফুটপাথের ঘুম ভেঙেছে ভোরবেলায়। দোকানের সিঁড়িতে হলুদ শাড়ির পৃথুল
শরীর আড়মোড়া ভাঙছে। হয়ত কোন ছাদ ডেকেছিল রাতে। ভোরবেলা নখদাগ ও চটচটে ব্যথা নিয়ে
আবার এসে ঘুমিয়েছিল উদোম আকশের নিচে। এখন সমস্ত ঘুমজনিত জড়তা নিংড়ে দিচ্ছে
দিনের শহরকে।
‘হ্যালো বন্ধুরা, ‘এসো ভালো থাকি’র সকালে তোমাদের চায়ের সঙ্গী হতে হাজির আমি কর্ণফুলী। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুম জড়তা কাটিয়ে নতুন দিনের প্রস্তুতি শুরু
হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, কি বলছো ? এখনও বিছানায়? চটপট উঠে পড় বন্ধু। এই সকাল যে
অঙ্গীকার করার সকাল। ভালো থাকার অঙ্গীকার। হ্যালো, কে বলছো ? বর্ধমান থেকে শ্রীতমা ? গুড মর্নিং । ভালো আছো তো? কি বলছো ? তুমি হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাও
? সব ভেঙে নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করে ? কক্ষনো ভালো থাকনা ? সমস্যা তো অনেক গভীরে বন্ধু। এটুকু বলতে পারি
নিজেকে খুব ভালবাসো, ভালোলাগাগুলোকে প্রশ্রয় দাও। চারপাশ পাল্টানোর দায়
নিজের কাঁধে নিয়ে নিজেকে কষ্ট দিওনা। পজিটিভ ভাবো। একটু করে হলেও যে বদল তুমি চাইছ তা কিন্তু আসছে। তাই ধৈর্য হারিও না। এসো আমরা সেই দিশেহারা মুহূর্তগুলোকে রামধনু রং দিয়ে সাজিয়ে দিই। এখন এই
গানটা তোমার জন্য – ‘ম্যায়নে তেরে লিয়ে হি সাত রং কা স্বপ্নে
চুনি...’
‘ভোকাট্টা মনখারাপ। এসো খুশির ঘুড়ি উড়িয়ে দিই এই
সকালে। আমি কর্ণফুলী আছি তোমাদের সঙ্গে। ফোনে কে আছ বন্ধু ? ...
এক ঘণ্টার বকবকম শেষ। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এক কাপ
কফিতে চাঙ্গা হয়ে, অফিসের কিছু জরুরি কাজ সেরে কর্ণফুলী
রোদ্দুরে নামলো। শরৎে এমন তীব্র রোদ, তাও এই
সকালে ভাবাই যায়না। কর্ণফুলী মনে করে
এসব ব্যাতিক্রমই আসলে আমাদের পাওয়া। তাই ওর কোন হাহুতাশ নেই। এই
‘নেই’-টাই ওর মধ্যে বারুদ হয়ে জমতে থাকে। রাস্তায় নেমে একটা সিগারেট ধরিয়েই রোদ মেপে নিয়েছে
সে। উপরে তাকিয়ে বলেছে – ঠিক হ্যায় বস, সঙ্গে চলো। এর মধ্যেই ভেবে নিয়েছে তৃণার বাড়ি যাবে। দশটা বাজতে পনেরো মিনিট
বাঁকি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই ওর বর বেরিয়ে গিয়েছে।
কর্ণফুলী প্রায় চমকে দিয়েই তৃণার সামনে দাঁড়ায় । ওকে দেখেই ঝরঝরিয়ে
উঠলো তৃণা।
‘ অনেকদিন পর এলিরে। সকালেই তোর অনুষ্ঠান শুনছিলাম।
ভাবছিলাম ফোন করবো কিনা।‘
‘কক্ষনো না, ওখানে একদম ফোন
করবিনা। ওসব বানান বানানো কথার খেলা তোর সঙ্গে খেলতে পারবোনা। তৃণা, তোর মেয়ের কোন ক্লাস হল রে ?’
‘ক্লাস ফাইভ। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হল বন্ধু। কত বয়স
হলো বলতো আমাদের ?’
‘কি হবে হিসেব করে ? ভাবিস না,
তোকে এখনো কুড়িই লাগে। কিছু খেতে দিবি ‘?
‘খুব ক্ষিদে
পেয়েছে নারে ? দাঁড়া, এখুনি দিচ্ছি।‘
তৃণা ঊঠে যায়। সোফায় বসে যতদূর দেখা যায়, চোখ বুলিয়ে নেয় কর্ণফুলী। সারা
বাড়িতে একটা সুখী সুখী গন্ধ। গন্ধ নিতে নিতে ও রান্নাঘরেই পৌঁছে যায়।
‘ এখানে চলে এলি ? ভাত খাবি ? তোর প্রিয় পমপ্লেট আছে। খা না।‘ চেয়ারটা টেনে দেয় তৃণা। ভাত খেতে খেতে
কর্ণফুলী বলে, ‘এভাবে
সত্যি ভাল থাকা যায় তৃণা ‘?
‘যায় তো। ভাস্বরকে
তুই বিয়ে কর কর্ণফুলী। বাবামাকে হারিয়ে জীবনের
অনেক অন্ধকার বাঁক তোকে চুরমার করে
দিয়েছে জানিরে। তবে কোন কিছুই অনিবার্য নয় এ তো তুই জানিস।
তোকে আর কি বঝাবো বল, তবু বলছি তুই আর একা থাকিস না’।
‘বিয়ে আমার জন্য নয়রে। জানিস তো তোদের মত মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আমার নেই। আর ভাস্বর, আমাকে বিয়ে করলে
নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে।‘
‘তুই আর শোধরাবি না। ‘
‘কেন শোধরাবো বল ? শুধু আপোষ আর
অভিনয়, এই জীবন ? সত্যি বলে
কিছু থাকতে নেই ?’
বেডরুমে ঢুকেই কর্ণফুলী বলে ,
‘সে কি রে ? তোকে তো বিউটিশিয়ানরা প্রাইজ
দেবে।‘
‘ তবে কি তোর মত পাগলী হয়ে থাকবো আর আমার বর পালিয়ে
যাবে ?’
‘ও এভাবেই বুঝি আগলাতে হয় ? তবে
তো আরও বিয়ে করবো না। এই তো দিব্যি চলে যাচ্ছে। তোরা আছিস। আমার কথার খেলা আছে। কাজ করতে করতে কিছু কথা খুব কাছে চলে আসে,
কত মানুষের অনুভূতিও তো ছুঁতে পারি। তবে ঐ সাজানো ব্যাপারগুলো সামনে
এলেই আর সামলাতে পারিনা নিজেকে। জানি, কিছু করার নেই। শুধু
মেনে নেওয়া আর বিক্রি হয়ে যাওয়া। ক্রমশ আমরা সবাই প্রোডাক্ট হয়ে যাচ্ছি। কেন রে
তৃনা, কেন বলতো ? তুই ঘরে
থাকিস তো, তাই বেশ শান্তিতে আছিস।‘
‘তুই ও থাক না। বিয়ে কর
না ভাস্বরকে।‘
‘বিয়ে করলেও হাত যে পাততে পারবো না সোনা। যাকগে চাপ নিস না। এবার তুই ঠিক কেঁদে ফেলবি। দে লাইটারটা দে। ওই যে
টেবিলে রাখলাম।‘
সিগারেট শেষ করেই কর্ণফুলী বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। তৃণা ওর মাথাটা
কোলে তুলে নেয়। কর্ণফুলীর চুলে খেলা করে ওর আঙুল।
‘ কবিতাটা ছেড়েই দিলি ‘?
‘ ওসব বোকা বোকা বয়স আর নেই রে তৃণা। কবিতা এখন ছুটিতে।‘
‘তাহলে ছুটি শেষের একটা সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।‘
‘জানিনা, তুই বড্ড মা’র কথা মনে করিয়ে দিস। চলিরে ।‘
আচমকা তৃণা কে অবাক করে চলে যায়
কর্ণফুলী। দুপুরে ভাস্বরের সাথে একটা সিনেমা দেখে। তারপরে একচোট ঝগড়া এবং তারপর
বাসে করে ফ্ল্যাটে ফেরে। কিছুক্ষণ অন্ধকারে বসে নিজেকে খুঁড়তে থাকে।
তৃণা দুপুরে কবিতার কথা মনে করিয়ে দেবার পর থেকেই খিঁচ ধরেছিল মনের
মধ্যে। কবিতার ডানাতেই তো কর্ণফুলী একদিন নিজের কাছে ফিরে ফিরে আসতো। সে এক অন্য নিজের কাছে। সেখানে শুধু ভোর
জড়িয়ে থাকতো। কবিতাকে মনে হত মামাবাড়ির পুকুরে বাঁধা সেই ছোট্ট
ডিঙিনৌকো। দুপুরে ছোটমামা সেই
ডিঙিতে চড়ে পানিফল তুলে আনত। জলে পা ডুবিয়ে সেই পানিফল ছুঁয়ে থাকার ঠাণ্ডা মুহূর্ত
মিশে যেত ভালোলাগা কবিতায়। অদ্ভুত ভাললাগায় কবিতাকে আবিষ্কার
করত কর্ণফুলী। প্রশ্রয় ছিল বাবার ।
শুধু ভৌগলিক সীমা আর কাঁটাতার যে রাষ্ট্রবোধের জন্ম দেয়, সেই বোধেই সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয় মানুষ। কর্ণফুলীর বাবাও সেই আক্রান্ত মানুষদের একজন যাকে নিরাপত্তার কারণে ছেড়ে
যেতে হয় দেশ। বাবার কাছেই কর্ণফুলী শুনেছে কিভাবে ধর্ম এসে চিরচেনা পাশের মানুষটিকে ভ্যানিশ করে দেয়। কিভাবে সাজানো কথার ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে দখলের থাবা। কিন্তু বাবার কবিতায় কর্ণফুলী
কক্ষনো কোন হননকালের ছায়া দেখেনি। বরং সে কবিতা অনেক বেশী জলের সারল্যে
ধোওয়া। গভীর জীবনবোধে স্বচ্ছ, যার নীচ পর্যন্ত দেখতে পেত
কর্ণফুলী।
বাবাই তো তাকে প্রথম সফল কবি নিবিড় গুপ্তের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
কবিতার নির্মান শিখেছিল সে। কিন্তু ওদিকে আর
একটা নির্মাণ শুরু হয়েছিল বোঝেনি। আগ্রাসী
মুগ্ধতায় কর্ণফুলী যেন কবিকে গিলতো। উথলে ওঠা কর্ণফুলীর কথা বলা শরীর নিপুণ দক্ষতায় কবিতার মত বুনছিলেন কবি।
প্রকাশের দক্ষতায় কর্ণফুলী তখন থৈ থৈ। কর্ণফুলী অসাড়। কর্ণফুলীর জমি বতর হয়ে উঠেছে। এমন এক প্রস্তুত
মুহূর্তের দুপুরে প্রেমিক কবি তার
কিশোরী শরীরকে ভাগ করে নিয়েছিল তার প্রকাশক বন্ধুর সাথে। কি সব কথার শিহরণ।
‘দ্যাখ সুমিত, কর্ণফুলী কেমন
আশরীর কবিতা হয়ে উঠেছে। এ মেয়ে একদিন বাংলা কবিতায় জোয়ার আনবে। ওর ঢেউগুলো খুলে খুলে দ্যাখ।‘
দেখেছিল ওরা । কর্ণফুলীকে শিখিয়েছিল কিভাবে শরীরে জমানো কবিতা ফুটিয়ে তুলতে হয়। বাবাকে বলতে পারেনি সেই ফুলজীবনের কথা। ঘোর লাগা শব্দ
জাদুতে শিখেছে কিভাবে সমস্ত রুদ্ধদলকে মুক্ত করতে হয়। কিভাবে ছন্দের মাত্রায় লেগে
থাকে মাধুর্যের দোলা। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কবির সমস্ত বাক চাতুর্যের মধ্যে থেকে, প্রকাশকের দক্ষ খেলার মধ্যে থেকে গড়িয়ে নামা অদৃশ্য বিষটুকু তুলে নিয়েছিল কর্ণফুলী। নিবিড়
গুপ্তের কাব্য সংকলন ঘটা করে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই থেকে কর্ণফুলীর চেনা জগতে অপ্রকাশিত কিছু অন্ধকার ছোপ ফেলে গেছে। প্রতিটি দৃশ্যের ভেতর সে দেখতে পায় সাজানো চাতুরির পেখম। এদিকে জীবন
দিয়েছে নিখুঁত প্রেজেন্টেশনের শিক্ষা। এই দুই এর মধ্যে চাপতে চাপতে কর্ণফুলী ক্রমশ জীবন্ত জীবাশ্ম হয়ে গেছে। অপছন্দের যাপন তাকে আত্মধ্বংসী
করে তুলেছে।
অতীত খুঁড়তে খুঁড়তে এই কর্ণফুলী এখন শুনতে পাচ্ছে তার প্রেমিক
পুরুষের কাব্যভাষার হিস হিস। শুনতে পাচ্ছে তাকে গপ করে গিলে ফেলার শব্দ। শুনতে শুনতে কর্ণফুলী আগুন হয়।
অ্যাশট্রে ভরে ওঠে, কিন্তু ভাস্বরের ফোন আসেনা। ঘরে আলো জ্বেলে সে স্নানে যায়। ওর কালো
বাথগাউন এক অফুরান জলতেষ্টা পুষে রাখে । অপেক্ষায় থাকে। কর্ণফুলী এবার শোবার ঘরে ঢুকছে। অপেক্ষায় ছিল ঘরের পর্দাটাও । কার্পেটে হোঁচট খেয়ে পর্দায় আছড়ে পড়লো কর্ণফুলী। পর্দাটা একটু বেশী সময় পেয়ে গেল কর্ণফুলীকে। ভাস্বরের দেওয়া কাশের গুচ্ছ ফ্যানের হাওয়ায় দুলছে। জানলা খুলে দিতেই শরৎ এলো ঘরে। আলোর
বোতাম টিপে জোর করে ফিরিয়ে দেওয়া দিনের কথাগুলো ফিরে আসছে। কর্ণফুলীর চিবুকে আদর রাখছে নরম অন্ধকার। যেন পাথরকে জড়িয়ে ধরছে নিবিড় শ্যাওলা। কালো বাথগাউন
পড়ে আছে মেঝের সাদাকে চমকে দিয়ে। ওর ত্বক থেকেও খুলে পড়ছে নিহিত আব্রু। এভাবে প্রতিরাতে নিজের ঘরে কর্ণফুলী ফুলি হয়ে যাচ্ছে। ভাস্বর আসছে তুমুল স্রোতে। থেকে যাচ্ছে নিভৃত গহ্বরে।
বলা হচ্ছেনা সেকথা। প্রতিরাতে এক
অসম্পূর্ণ বৃত্তকে জোড়া লাগাচ্ছে। সকাল হতেই দুটো সমান্তরাল সরলরেখা হাঁটছে।
ছুটছে। দেখা হচ্ছেনা তাদের। সময় লাফিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে মুছে দেওয়া শব্দের মনুমেন্ট।
শুধু সব ঠিকানা বদল দেখছে সেই পর্দাটা। দেখতে
দেখতে, ছুঁতে ছুঁতে সে একদিন মুখোশ হয়ে গেল। একটা জীবনের মুখোশ। মুখোশের ভেতর লুকিয়ে রইলো কর্ণফুলী নামে এক রাতপাখির মুখ।
অরণ্যা সরকার