তৃষ্ণা
সিদ্ধান্তটা উচ্চতর
অরবিটে পৌঁছানোর আগেই একটা গোলমাল বাধার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ততক্ষণে আমি ডিসিশন
নিয়ে ফেলেছি। আমি এমনটা অবশ্যই করব। আমি এখনো অন্যের পরিবারের সন্তান,আমার উপর
বাবা-মার পর্যাপ্ত শাসনাধীন দৃষ্টি স্তম্ভাকৃতি হয়ে আছে। ভদ্রমহিলার সাথে আমার বহু
আগেই কথা হয়েছিল।তার বিড়ালটা যেদিন থেকে প্রেগন্যান্ট আমি সেদিনই তার সাথে
কনট্যাক্ট রাখা শুরু করেছিলাম। বিড়াল বংশবৃদ্ধি নিয়ে আমার ওত ধারণা নেই,কিন্তু এটা
আমি ওতদিনে ঠিকই বুঝি,একটা গ্রে কালারের বিড়ালের সাথে যদি একটা ব্রাউন কালারের
বিড়ালের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়,তাহলে যে বিড়াল ছানাগুলি জন্মাবে,তার মধ্যে
আমি নিশ্চিত,একটা বিড়ালের বাচ্চা হবেই যার শরীরের রং হবে ব্রাউন আর ওয়াইট এর
মিক্সড ফিচার। লেজের দিকের পায়ের ডিজাইন হবে সাদা কিন্তু তার মধ্যে আবার ব্রাউন
ডোরাকাটা থাকবে। লেজেও সেই একই নকশা হবে কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। লেজের চেয়ে আমাকে
পায়ের নকশা বেশি আকর্ষণ করে।
দেশি বিড়ালদের মধ্যে এই
এক নতুনত্ব যা আসলে জনহীন সমর্থনে ঘুরে বেড়ায়। সৌন্দর্যটা মুখ্য নয়,কিন্তু সেই
জনহীন নতুনত্ব যদি অন্যের টিনের চালের ফুঁটো দিয়ে পেশাব করে কিংবা ক্ষিধায় কাতর
হয়ে অতিরিক্ত খাবার চুরি করে — তখন সেটা প্রতীকী অপরাধ। তখন আলটিমেট ডিলিটেশন হয়ে
যায় মধ্যবিত্তের প্রচারিত সংবিধান।
ব্রাউন-ওয়াইট মিক্সড
ফিচারের বিড়ালটির বয়স হয়ে গেছে আড়াই মাস। এতদিনে তার খাদ্যাভ্যাস হয়েছে।পটি
ট্রেইন্ড।ভদ্রমহিলার স্বামীর লুঙ্গির কুণ্ডলীতে নেতায় শুয়ে সে কৃতজ্ঞতা দেখায়।
ভদ্রমহিলা আগে বহুবার
আমার ছোটখাটো ইন্টারভিউ নিলেও বিড়ালটাকে এডপশন দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আবার
পূর্ণাঙ্গ একটা ইন্টারভিউ নিলেন। তাকে আবার নতুন করে আমাদের বাসার বারান্দার গ্রিল
আবার ছবি তুলে দেখাতে হল।গ্রিলের চারকোনা ফাঁকাস্থানগুলো যথেষ্ট ছোট।আড়াই মাস
বয়সের বিড়ালের দেহ ওর মধ্যে ঢুকবে না। সে যতই মোলায়েম হোক।তবুও ভদ্রমহিলার মন ভরলো
না। তাকে জানলার ছবি দেখাতো হল।জানলার দরজা ঠিকমতো লাগে কিনা, জং ধরা ছিটকিনি আর
কাচের উঠে যাওয়া আঠা সংস্কার করা হয়েছে কিনা,সব দেখে ছাড়লেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে উনি
ফোনে জানতে চাইলেন — বিড়ালকে পটি করাবেন কোথায়?
আমি বললাম — আমি যতদূর
দেখেছি,বিড়ালকে বালিতেও পটি ট্রেইন করা যায়।
ভদ্রমহিলা সাথে সাথে
আঁতকে উঠে বললেন — আপনি জানেন না,বালিতে ওভাবে শেখাতে গেলে বিড়ালের লেজের দিকে ঘা
হয়?
ভেবে দেখলাম,এটা
সম্পূর্ণ ঠিক কথা।বিড়াল পালবো কিন্তু ঠিকমতো কেয়ার করব না — এটা খুবই জঘন্য হবে।
ভদ্রমহিলা বললেন —
লিটারে বাথরুম করাবেন।ওটাই বেশি নিরাপদ।আপনার সব ক্লিন করতেও বেশি সমস্যা হবে
না।আর বিড়ালের লেজে, পায়ে যাতে ময়লা না লাগে সেজন্য প্রতিদিন পরিষ্কার করবেন।
সুন্দর যুক্তি,আমার
পছন্দ হল।আমি দ্বিমত হলাম না।ভদ্রমহিলা এবার তুললেন, বিড়ালটাকে তিনি এই আড়াই মাস
মাছ খেতে দেননি।বয়েলড চিকেন আর ক্যাটফুড খাইয়ে বড় করেছেন।এটা শুনে আমার একটু
প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করলো।সে বিড়াল অথচ সে জন্মের পর থেকে কখনো মাছ খায়নি এটা
শিক্ষিত কেউই সমর্থন করবে না।বিড়াল মাছ খাবে এটা সর্বজন স্বীকৃত এবং এটা আদি
সংস্কৃতি। তবে আমি কিছু বললাম না। কারণ আমি ভেবে নিয়েছি এই বিড়াল আমি আনার পর
ক্যাটফুড ওত খাওয়াবো না। নিজ হাতে তাকে মাছ খাবার অভ্যাস করব। ভদ্রমহিলা যখন
দেখলেন আমি সব মেনে নিচ্ছি এবার তিনি ইমোশনাল হয়ে গেলেন।তাড়াতাড়ি তিনি আমাকে কিছু
ছবি পাঠালেন। অধিকাংশই বিড়ালটা টিভির সামনে বসে আছে, তাঁর স্বামীর লুঙ্গির
কুণ্ডলীতে জট পাকিয়ে শুয়ে আছে এমন সব ছবি। এসব হল ফ্রি বিনোদন। আমার খারাপ লাগল
না।
ভদ্রমহিলা এবার বললেন —
ভাই, আপনি নিজে এসে নিয়ে যান লুচিকে।
আমার সামান্য রাগ হল।
তার কথামতো ওকে লুচি ডাকতে হবে নাকি? আমার খুব শখ এমন ব্রাউন-ওয়াইট মিক্সড কালারের
বিড়ালকে আমি ডাকব ব্রাউনি বলে। ভদ্রমহিলা হয়ত কানে তুলেননি। অবশ্য আমিও যে মেনে
নিয়েছি তাতো না। সমস্যা হল যাতায়াত নিয়ে। মতিঝিল থেকে মিরপুর চাইলে অন্য সবসময়ে
বাসে যাওয়া যায়। কিন্তু এই সময়ে সেটা সম্ভব না। সোশ্যাল ডিসটেন্স মানতে হলে অবশ্যই
আমি বাসে করে যেতে পারি না। তবে সিএনজি বা উবারে গেলে ভাড়াটা বেশি পড়বে। আমি হয়ত
বাহনটা বাছাই করতে পারি কিন্তু অর্থের পরিমাণ আমার নাগালের বাইরে। ভদ্রমহিলাকে
সেটা বুঝানো গেল না। উনি নিজ হাতে আমার হাতে বিড়ালটি তুলে দিতে চান। আমাকে একবার
সামনাসামনি দেখতে চান। এক পর্যায়ে ভদ্রমহিলা কেঁদে ফেললেন ফোনে। জিজ্ঞাসা করতে
ইচ্ছা করলো, তাঁর সন্তান আছে কিনা। আমি আবার বললাম — আপনি কেরিয়ার দিয়ে পাঠান। ওর
কোনো ক্ষতি হবে না।
আমার কথাটা তিনি
অনিশ্চিত দূরত্বের দিকে নিয়ে গেলেন।আমি তার বিশ্বাসকে আবার ছুঁতে পারছিলাম না।যে
করেই হোক তা আবার আমাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।বহুদিন পর এমন বিড়াল পেয়েছি।সেটাকে আর
হারাতে চাই না।আমি আর কোনো উপায় না পেয়ে রাজি হলাম।আমি নিজে গিয়ে বিড়ালটি নিয়ে
আসব।ভদ্রমহিলাকে তখনই আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলাম।উনি সেগুলো দিয়ে লিটার আর
ক্যাটফুড কিনে আনবেন।আর আমি বের হয়ে গেলাম কিছু খেলনা আর একটা ঢাকনাসহ বাকেট কেনার
জন্য।প্রথম দিকে দোকানদারকে বুঝাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।আমি বহু চেষ্টা করে বিড়াল
প্রসঙ্গ তুলতে চাচ্ছিলাম না।কিন্তু শেষে তুলতেই হল আর বিড়াল আনব শুনে দোকানদার
দ্রুত সেই জুতসই বাকেট এনে দিল।
বাসায় ফেরবার সময়ে
নিচতলার ইকন ভাইয়ের সাথে দেখা।ভদ্রলোক কেমন মানুষ আমি জানি না,কিন্তু আমি যখন
কলেজে যেতাম, তাকে প্রত্যেক সময়ে কানে মোবাইল লাগিয়ে বাসার সামনের গাছের নিচে বসে
থাকতে দেখেছি।তার সব কথা হয়ত শুনিনি কিন্তু মাঝে মাঝে মৃদু শুনেছি — তুমি চিন্তা
কইরো না,আমার চাকরি হয়ে যাবে।তোমার সাথে যদি কারোর বিয়ে হয় তাহলে আমার সাথেই হবে।
দেড় বছরেও তার চাকরি
হয়নি।তার মোবাইল সেট পাল্টেছে অবশ্য।কিন্তু তাকে আর ওভাবে বসে কথা বলতে দেখিনা।
উনি আমাকে দেখেই বললেন
— এই বাকেট দিয়ে করবা কী?
আমি বললাম — বিড়াল
আনবো।
ইকন ভাই এবার হেসে
বললেন — তোমার বোন তো তোমাকে মারবে।সেদিনের কথা মনে নাই?রাত দুইটার সময়ে কী
হয়েছিল?
তার এই কথাটা আমার
চেতনায় স্ফুলিঙ্গ তৈরি করলো।একটা বৈরী ঝাপটা।আমারও ইচ্ছা হল বলি — আপনার জানকে তো
কথা দিয়েছিলেন বিয়ে করবেন, বিয়ে করেছেন?
ইকন ভাই তার খালি গায়ে
তার হাতের গামছাটা জড়িয়ে নিলেন।এটাও খুব কুৎসিত।সামান্য দূরেই স্কুল।স্কুল যদিও
এখন বন্ধ,কিন্তু মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাচ্চা এসে তাদের স্কুলে বেড়াতে আসে।তারা যদি
এসে এরকম অর্ধনগ্ন ভুঁড়িওয়ালা এক মানুষকে এভাবে ছেঁড়া লুঙ্গিসহ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,তাহলে
কেমন লাগবে?
আমি আর কথা বাড়ালাম
না।বিল্ডিংয়ের তিনতলায় উঠে গেলাম।
বহুভাবে লুকিয়ে রাখার
পরেও মা অফিস থেকে এসে ঠিকই বাকেটটা খুঁজে বের করলেন।আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এটা
দিয়ে কী করব?আবার জানতে চাইলেন টাকা কই পেয়েছি?দ্বিতীয় কথাটার উত্তর আমি দিতে পারি
না।কারণ আমি আসলে টাকা চুরি করি বাবার মানিব্যাগ থেকে।আমি চতুর্ভুজাকৃতি স্টাইলে
টাকা সরাই।কিন্তু টাকা নিয়ে ওভাবে কিছু করি না।এইসব টাকার অধিকাংশই যায় বইয়ের
পিছনে।সাধারণ সাহিত্য পড়ে আমার আর ভালো লাগে না।সাহিত্য আমার কাছে আর নিতান্ত
পুঁথিগত বিনোদন নয়।যেভাবে সিনেমা আমার কাছে আর অবসরের বিনোদন নয়।বহু সিনেমাখোরকে
আমি খালি অভিনয় আর প্লট নিয়ে প্রাচীন আনন্দ প্রকাশ করতে দেখেছি।কিন্তু আমি এখন
সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রতি বেশি আগ্রহী।সিনেমার লোকেশন,ক্যামেরার এঙ্গেল,
মুভমেন্ট অফ ক্যারেক্টারস,আবহসঙ্গীতের রুটস — এসব আমাকে এখন বেশি উত্তেজিত করে।
মাকে আমি বিড়ালের
ছবিগুলো দেখালাম।বিড়ালটা লুঙ্গির কুণ্ডলীতে শুয়ে আছে — এই ছবিটা বেশি করে
দেখালাম।বহুভাবে বিড়ালটার পায়ের ডোরাকাটা নকশা দেখালাম।মা কিছুতেই রাজি হলেন না।মা
যে আমাকে একসময়ে কথা দিয়েছিলেন সেটা তুললাম।আমি গম্ভীর গলায় বললাম — আমি এখন
ইন্টার পাশ।
মা সাথে সাথে হেসে
দিলেন।আমি ইন্টার পাশ এটা এখন লোকালভাবে স্বীকৃত।সরকারিভাবে এখনো স্বীকৃতি
পাইনি।তাও আবার এই জাতীয় হেলথে হ্যাজার্ডের সময়ে আমাদের অটোপাশ দেওয়া হয়েছে।অর্থাৎ
বলতে গেলে,প্রচলিত কোনো দামই নেই এই পাশের।
মা বিভিন্ন এঙ্গেলে
বুঝাতে চেষ্টা করলেন তিনতলায় বিড়াল পালা কত ঝুঁকিপূর্ণ।বিড়ালের জন্য একটা
প্রাকৃতিকস্বাদের বাসা যে দরকার সেটা তিনি তুললেন না।বরং উদাহরণ দিলেন বিড়ালের
বাথরুম সমস্যা নিয়ে।আমিও তখন বললাম — বিড়াল যদি বাইরে গিয়ে ওভাবে বাথরুম করে
আসতো,তাও তুমি ঝামেলা করতে।বলতে এই বিড়াল কোথার থেকে তার পাছা মুছ্র এসেছে,সেই
পাছা দিয়েই আবার খাটে, চেয়ারে বসবে।
একদম টার্গেট পয়েন্টে
আঘাত।ততক্ষণে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।বৃষ্টির কলতানের সাথে আমাদের ঝগড়া
চলছে।মাও মানে না,আমিও মানি না।আমাদের মাঝে নিমজ্জিত ডিবেট চলছে।অবশ্য আমি জানি মা
কিছুক্ষণ পর চুপ হয়ে যাবেন।তিনি অফিস থেকে এসেছেন,ক্ষিধায় তার চোখে সন্ধ্যা
নামছে।সেটাই হল।মা শেষে মুখ ফিরিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
সন্ধ্যা থেকে আমাকে
আমার বিভিন্ন আত্মীয় ফোন দিতে লাগল।তারা বিভিন্নভাবে বুঝাচ্ছে,মার কষ্ট
হবে।এমনিতেই বুয়া আসে না।ঘরের সব গৃহধর্মী কাজ তাকে করতে হয়।এর মধ্যে আলাদা একটা
বোঝা ছাপানো উচিত না।
এসব আত্মীয়-স্বজনদের
আমার কখনই ভালো লাগেনি।বাবার সাইডের আত্মীয়দের সাথে আমার তেমন ভাব নেই।আমার
চাইল্ডহুড নষ্টের পিছনে তাদের একটা হাত আছে।মার সাইডের আত্মীয়দের সাথে আমার সাথে
কারোর কারোর ভাব আছে।খালামণি গতমাসেই আমাকে একটা ওয়েবসাইট কেনার টাকা দিয়ে খুশি
করেছেন।কিন্তু তাও মনে হয়,আমাকে শাসন করার অধিকার তাদের নেই।একান্নবর্তী পরিবার
উঠে গেলেও এর প্রাচীন সংস্কৃতির প্রভাব এত নিখুঁত সেটা বুঝাই যায়।
বাবা অফিস থেকে ফিরে
এসে সব শুনলেও আমাকে কিছু বললেন না।টিভির সামনে বসে গেলেন।গত সপ্তাহে নতুন শাওমি
ফোন কিনেছেন।সেখানেও কীসব নিহত কমেডির নাটক ছেড়ে দেখতে লাগলেন।ছোটবোন বিদেশের
বড়বোনকে ফোন দিয়ে একগাদা অভিযোগ পেশ করতে লাগল আমাকে নিয়ে।তাদের মধ্যে কীসব কথা
হচ্ছে আমি জানি না,কিন্তু আমি আমার রুমে এসে কল্পনায় ডুবে গেলাম।বিড়াল হোক,বিড়ালটা
তখনও বাচ্চা।আমি তার বাবা হব।বিড়াল যখন বুঝে যাবে আমি তার বাবা,তখন তার মুখ আমার
গালে ঘষে ভালোবাসা প্রকাশ করবে।তাকে মাঝে মাঝে আদর করতে গেলে নখ বের করে আমাকে
খামচাবে,আঙ্গুল কামড়িয়ে দুষ্টুমি করবে।সব বিড়ালের বাচ্চা তার নিজস্ব সার্বভৌমত্বে
এক গ্রামীণ অপু।
রাত দুটোর দিকে মা
আলাদা বিছানায় শুয়ে পড়লেন।বাবার সাথে ঘুমাবেন না।বাবাকে দেখলাম বাসায় ঘুরঘুর করতে।
শেষে আমি গিয়ে দেখলাম
বাবা মায়ের কাছে বসা।এই সময়ে আমার একটা সাপোর্ট দরকার ছিল।ছোটবোনের সাথে ভাব থাকলে
সে হয়ত সাপোর্ট করতো,কিন্তু ঐরাতের ঘটনার পর থেকে আমাদের সামগ্রিক সম্পর্ক পুরো
ভেঙে গেছে।কেউ কারোর দিকে খেয়াল রাখি না।মাঝে মাঝে ভাবলে খারাপ লাগে।যে বোন আমার
মাথা ফেটে যাবার পর দুনিয়ার লোকজন ডেকে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল,যে বোন আমার
ডেঙ্গুর সময়ে পুরো একা আমার সেবা করেছে,সেই বোন এখন তার বন্ধুদের বলে — আমার এক
বড়বোন আছে।সে অস্ট্রেলিয়ায় আইসিটির উপর মাস্টার্স করছে।
বাবা কিছু বলতে যেতেই
মা বলে উঠলেন — তুমি আমার বাবার মৃত্যুর সময়ে আমাকে যেতে দাও নাই।
এটা এখন কোটেশন পর্যায়ে
চলে গেছে।আমার নানা যখন মৃত্যুর তীরে ভিড় জমানোর মুহূর্তে, মা তখন প্রায়ই গিয়ে
হসপিটালে বসে থাকতেন।মা তখন বোধশক্তিহীনা ছিলেন।নিজেই নিজের ক্ষতি করছিলেন।ঘরে
তিনটা সন্তান।এইসব ভেবেই বাবা আর মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে এই কথাটা
বলেছিলেন।রাগান্বিত মানুষের উক্তি কখনো আমলে নেওয়া ঠিক না,কিন্তু তাও মা সব
সাংসারিক ঝগড়ায় এই কোটেশন ইউজ করেন।বাবা তখন ৫০% হেরে যান আগেই।
বাবা মার এই কথাটায়
বলতে লাগলেন — জানো,আজ কর্ণফুলী মার্কেটে গিয়েছিলাম।যেয়ে দেখি সব দোকান বন্ধ।
সবজায়গায় টুলেট লাগানো।শেষে এক দোকান খোলা পেলাম।দোকানদার নামায পড়ছিল।সেই অবস্থায়
সে আমাকে দেখে নামায ছেড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আমি বললাম না,আগে আপনি নামায
পড়েন,আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।দোকানদার সাথে সাথে কেঁদে দিল।এই বিপর্যের সময়ে তাদের
ট্যাক্স উলটা বেড়েছে।ব্যবসা একদম নাই।কীযে কষ্ট।
বলেই বাবা আমার দিকে
তাকালেন।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।কী বলব।
শেষে দুইজন আমাকে
যথেষ্ট বুঝালো।কিন্তু যতই বুঝায় আমি সব শুনে স্মারক উচ্চতায় বলি — বেশ,তাহলে সেই কথাই
থাকল,কাল বিড়াল আনছি।
ওমনি বাবা-মা নিভে যান।
বাবা তখন মার সাথে
সমগ্র আড্ডা জুড়ে দিলেন।এবার তুললেন রাহাত সাহেবের কথা।রাহাত সাহেব বাংলাদেশ
ডেন্টাল হসপিটালের হেড ছিলেন।বহু মানুষের দাঁত নষ্ট করেছেন।মার মাড়ির দাঁতও উনি
নষ্ট করেছেন।বাবার ছোটবোনের ছেলে আদিবের সামনের দাঁতগুলোও সে ফাঁকা করে দিয়েছে
পুরা।পরে তারা অভিযোগ করতে গেলে রাহাত সাহেব ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রমিজ
করেছিলেন।কিন্তু ক্ষতিপূরণ আনতে গেলে ফুফাকে গুণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে বের করে দেন।
আজ বাবার অফিসের
মিটিংয়ে তিনি এসেছিলেন।অফিস ডিজি তার কর্মচারীদের সুলভ খরচে দাঁতের চিকিৎসার
ব্যবস্থা করতে চান।রাহাত সাহেব ডিজির বন্ধু।অন্যসময়ে হয়ত তিনি আসতেন না,কিন্তু এখন
রাহাত সাহেব সবজায়গায় যান।ট্যাক্স ফ্রড কেসের জন্য তার চাকরি চলে গেছে।তার
সারাজীবনের সঞ্চয় দুদক নিয়ে গেছে।বাবাকে দেখেই বলে রাহাত সাহেব "বন্ধু,
বন্ধু" বলে জড়িয়ে ধরেছেন অফিসে।
এরকম বহু গল্পগুজবের পর
বাবা-মা একসাথে শুতে গেলেন।
বাবা সকালে অফিসে গেলেন
না।যখন বিড়াল আনতে যাব,বাবা তখন যেয়ে এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে গেলেন।চিৎকার করে বলতে
লাগলেন — তুই জানোস তোর মা কাঁদতে কাঁদতে অফিসে গেসে?তারপরও এমন করবি?পড়ালেখা
নাই?সামনে না তোর ভার্সিটির এডমিশন?...........
আমি অবুঝের মতো বলে
ফেললাম — হয় বিড়াল আনতে দাও,নাইলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাব।
— তুই থাক,বরং আমি বের
হয়ে যাই।
বলে তিনি তার ছোট ভাইকে
ফোন দিলেন।
— হ্যালো,সুমন?তোর
বাসায় দুইদিন থাকা যাবে?.....আরে বলিস না শরীফ যা শুরু করসে……..
এই লাইন শোনার পরেও আমি
থাকলাম না।দ্রুত বের হয়ে চুরি করা টাকা দিয়ে দুই প্যাকেট সিগারেট কিনে আনলাম।খালি
পেটে স্মোক করছি দেখে প্রচণ্ড কাশি আসতে লাগল।প্রতিটা টান একটন কাশির উপহার
দেয়।ঝাঁঝালো গন্ধে বুকে ব্যথা উঠে গেল।
দুপুর পর্যন্তু কিছু
মুখে দিলাম না।ঘরে তখনও অশান্তি।ডাল গরম করার গন্ধ পেতে লাগলাম।বাবা
যাননি,বোধহয়,লাঞ্চ রেডি করেছেন।
বিকালের দিকে বাবা এসে
আমাকে বুঝাতে লাগলেন।আমি তখন ছাড়লাম না।ছোটবেলায় বাবা আমার প্রতি কী কী অবিচার
করেছেন সব বলতে লাগলাম।বাবা শুনে যাচ্ছেন,কম্পিত চোখে সিগারেট গন্ধের ফাঁকে আমাকে
খুঁজচ্ছেন।শেষে বাবা মোবাইল বের করে আমাকে দেখালেন — এই দ্যাখ,কল্যাণপুরের জমির
ছবি।আমরা যখন এই সরকারি বাসা থেকে চলে যাব,তখন ঐখানে বাড়ি করব।কাজ শুরু হয়ে
গেছে,এই দ্যাখ,কলাগাছের বাগান করেছি………..
বলে তার নিজস্ব বাড়ির
স্বপ্ন তুলে ধরতে লাগলেন।কথাগুলো আমাকেও নাড়া দিল।বাবার বাড়ি এতো কম কথা না।সরকারি
বাসা থেকে আমাদের উঠিয়ে দেওয়ার জন্য এমনিতেই প্রতিনিয়ত হুমকি ধামকি দেওয়া
হচ্ছে।বাবার চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেও বাসা ত্যাগের অর্ডার এসেছে।
তবুও আমি খেতে চাইলাম
না।শেষে বাবা বললেন — বিনিময়ে কী চাস?
আমি বললাম — ড.রামেশ্বর
স এর গ্রামার বই কিনে দিবা।আর পরের মাসে বন্ধুদের সাথে ট্রিপে যাব।ওর টাকা দিবা।
বাবা রাজি হয়ে
গেলেন।তার ছোটভাই তখন ফোন দিচ্ছেন।তিনি আসবেন কিনা,একটা ঘরও গুছিয়ে ফেলেছেন।এটাও
বললেন,আমি যদি আরও অশান্তির সৃষ্টি করি,উনি নিজেই এসে আমাকে শাসন করবেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর ভদ্রমহিলা
ফোন দিয়ে বললেন — ভাই, আপনি বিড়াল নিতে আসবেন না?
0 মন্তব্যসমূহ