সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

আবু রাইহান



পঞ্চাশের দশকের বাংলা ভাষার দুই বিখ্যাত  কবি ব্যক্তিত্ব শামসুর রাহমান
 ও আল মাহমুদের সম্পর্কের টানাপোড়েন


জীবনের চলার পথে ঘটনা এবং ঘটনার জেরে কখনো কখনো বন্ধু ও প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে! ব্যক্তিগত খ্যাতির নেশা, প্রতিহিংশা, ঈর্ষাকাতরতা এবং স্বার্থপরতা বন্ধুকেও শত্রু বানিয়ে তোলে! পঞ্চাশের দশকের বাংলা ভাষার দুই বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ দু’জন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আড্ডায়-আসরে আনন্দে দু’জনের উপস্থিতি সময়কে জাগিয়ে তুলত অন্যভাবে। দু’জন একসাথে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে সে অনুষ্ঠানের ভার-বন্ধন সম্পূর্ণ ভিন্নতায় জ্বলে উঠত। শ্রোতা-দর্শকের মনের আবেগ কল্লোলিত ঝরনার মতো উচ্ছল হতো। বিরাজ করত এক ধরনের অন্য রকম ছবি, দৃশ্য ও দর্শনের আবহ। কবিতার স্বাপ্নিক চৈতন্যের কারু যেন স্বচ্ছ জলের মতো বহমান। দু’জনের এক অনুষ্ঠান মানে বাংলা কবিতার আধুনিক উচ্চ মঞ্চ। অন্যরকম মর্যাদায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত অনুষ্ঠান। আকস্মিক এমন সৌন্দর্যের বুকে চলল বিভক্তির করাত। এ বিভক্তি ব্যক্তিগত রেষারেষির নয়। রাজনৈতিক রোষানল থেকে উত্থিত। দেশের প্রতিহিংসার রাজনীতি শুধু মানুষকে বিভক্ত করেনি, শিল্প-সাহিত্যে তুলে দিলো ভাগাভাগির দেয়াল। শিল্প-সাহিত্য তো মানুষের জন্য। জীবনের জন্য। যে সাহিত্য জীবনকে ভাগ করে মানুষ ভাগ করে তাকে কী বলা যায়! বিশ্বের কোথাও শিল্প-সাহিত্যে বিভক্তির কুৎসিত ঘটনা এমন করে নেই। রাজনৈতিক বারুদ যখন সাহিত্যের শরীরে আগুন ধরায়, সাহিত্যের হৃদয় নির্মমভাবে ছাই হয়ে যায় তখন।

সাহিত্য সমালোচক ফারুক সুমন তাঁর ‘বিতর্কের বৃত্তে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ’ প্রবন্ধ এ লিখেছেন,সমসাময়িক কবি হিসেবে শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ এই দুই কবিকে একধরনের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের উত্তর প্রজন্মের কবিকুল। কবি হিসেবে কে কার চেয়ে কতো বড় এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দিতে যতোটা সরব ও সোচ্চার দেখা যায়, বোধকরি স্বতন্ত্র কবি হিসেবে এই দুই কবির পৃথক মূল্যায়নে ততোটা নয়। অথচ কাব্যভাষা কিংবা কাব্যস্বরের বিবেচনায় দুজনই নিজ নিজ কাব্য-সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। মূলত রাজনৈতিক আনুকূল্যে থাকাকে কেন্দ্র করে এই দুই কবিকে দুই সামিয়ানার নিচে দাঁড় করানো হয়েছে। কবি হিসেবে তাদের সফলতাও নির্ণয় করা হয় এই রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে। অথচ কে না জানে, কবিতাকে রাজনীতিকরণ কিংবা দলীয়করণের আওতায় নিয়ে সুচিহ্নিত করার প্রয়াস মোটেও শোভনীয় নয়। এতে কবিতার নগ্ন দিকটি প্রকাশ পায়। কবিতাকে সার্বজনীন করতে গেলে প্রয়োজন কবিকে একার ইচ্ছায় একলা পথের সারণিক হওয়া। শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদ দুজনই এই জায়গায় বেখেয়ালি তবে? তা না হলে দুজনকে নিয়ে এমন পরিস্থিতির অবতারণা হয়তো হতো না। এক্ষেত্রে মূল কারণ এবং বিবেচনার বিষয় বোধকরি আদর্শগত অবস্থান। বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক মতাদর্শ দুই কবিকে দুই মেরুতে নিয়েছে। একজন সৃজনশীল মানুষকে হতে হয় শিরদাঁড়া সম্পন্ন। তবেই তার লেখায় মানবতার কথা উচ্চকিত হয় স্ফূর্তি নিয়ে। যদি ব্যক্তি এবং সৃষ্টির মাঝে বৈপরীত্য থাকে তবে কবি কিংবা শিল্পীর সৃষ্টি মেকি, অবস্থাভেদে কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়। শামসুর রাহমানের কবিতা মানেই নাগরিক জীবনের কথকতা, নগরজীবনের নিঁখুত সন্ধান। নগরজীবনের সুনিপুণ ছবি তার কবিতার উপমা, চিত্রকল্প কিংবা রূপকে দৃশ্যমান। নাগরিক কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তার কবিতা বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের অনুগামী। সমাজ ও সংস্কৃতির বিবিধ উপলক্ষ কিংবা অনুষঙ্গ কবিতার বিষয় ও উপাদানে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দেদীপ্যমান। সমকাল ও রাজনীতি সচেতন কবি বলেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির নেপথ্যের ইতিহাস তার কাব্যভাষায় প্রাণ পেয়েছে। স্বদেশের নানা দুর্দিনে তার কবিকণ্ঠ কবিতায় যেভাবে উচ্চকিত হয়েছে, সমকালে তেমনটি অন্য কবিদের কবিতায় কমই চোখে পড়ে। দেশ ও দশের কথা বলতে গিয়ে তার কবিতা কখনো স্লোগানধর্মী হয়েছে বৈকি।

পক্ষান্তরে, আল মাহমুদের কবিতায় উৎকীর্ণ হয়েছে লোকজ অনুষঙ্গের নানা ভাঁজ ও বৈচিত্র্য। খুব কৌশলে লোকজ শব্দের পরিশীলিত রূপ কবিতার ভাষায় ব্যবহারে তিনি বেশ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। কবি হিসেবে তার মনোভঙ্গি প্রকৃতির নিকটবর্তী। একথা বললে অত্যুক্ত হবে পল্লী কবি জসীম উদদীনের কাব্য ধারার অনুগামী হয়ে আল মাহমুদ গ্রাম-বাংলার লোকাচারকে দিয়েছেন আধুনিক কবিতার অবয়ব। ফলে বাংলা কবিতার নিজস্ব বিষয় ও স্বরের স্ফূর্তির গুণে আল মাহমুদের কবিতা হবে কালোত্তীর্ণ।

রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়া কিংবা নেওয়া দোষের কিছু নয়। পূর্বেও এ ধরনের দৃষ্টান্ত ছিলো। ইতিহাসে ‘রাজসভাকবি’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শিল্পচর্চার সমান্তরালে দুজন কবিই সফল হয়েছেন মতাদর্শ কেন্দ্রিক বিতর্কের বিস্তার ঘটাতে। দুজন কবিই রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন স্ব-স্ব সাগরেদ। যারা তাদের দুজনকে প্রতিষ্ঠিত করতে যাবতীয় উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেন। ব্যক্তিগত বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, রাহমান-মাহমুদ দুজন দুজনকে সম্মান করেন। কখনো কখনো তারা আড্ডামুখর দিন অতিবাহিত করেছেন। বাস্তবিক অর্থে দুজনেই সমকালে কাব্যহিংসায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ ধরনের কাব্যহিংসা দোষের কিছু নয়। এতে বরং শিল্প সৃষ্টির পালে হাওয়া লাগে। যৌবনের প্রথম ভাগে আল মাহমুদ সাম্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে মার্কসীয় দর্শনে বশীভূত ছিলেন। পরিণত বয়সে এসে একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে পরিচয় ও প্রকাশ করতে বেশি উৎসাহী হয়েছেন। আদর্শগতভাবে ইসলামী জীবন-যাপনে তিনি পরিতৃপ্ত হয়েছেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছন তিনি। একজন কবি হিসেবে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তাকে স্বাধীনতাবিরোধী বিশেষ একটি দলের সাথে সখ্যতা তৈরির অভিযোগ করা হয়। মূলত এখান থেকেই কবি আল মাহমুদকে আলাদাভাবে শণাক্ত করার প্রয়াস দেখা যায়। যেহেতু তিনি ইসলামী ভাবাপন্ন, সেহেতু বাংলাদেশে বিদ্যমান ইসলামী নানা সংগঠন বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তাকে আমন্ত্রণ জানায়। কবিও সাগ্রহে সে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে তার গায়ে ধর্মীয় রাজনীতির ট্যাগ লেগে যায়। যদিও এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ ব্যাপারে তার নিজস্ব অবস্থান পরিষ্কার করেছেন- ‘আমি ধর্ম করি বিশ্বাসের জায়গা থেকে। আমি কোনো ধর্মীয় রাজনীতি করি না। যেসব সভায় আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তার খবর পত্রিকায় পড়লে দেখবে বক্তৃতায় আমি আমার কথাই বলেছি। আমি কখনো ধর্মীয় রাজনীতির কথা বলি না। আজ পর্যন্ত আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। এসব কথা আমি খোলাখুলি সাক্ষাৎকারে বলেছি।
আল মাহমুদ কবি হিসেবে যতটা না আলোচিত, ধর্মবিশ্বাসের নিবিড়তা এবং বিশেষ একটি দলের সাথে তাকে ‘লেপ্টে দেওয়া’র জন্যে তিনি ততোধিক সমালোচিত। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের প্রতিদ্বন্দ্বিপূর্ণ অবস্থার চিত্র এখানে এসে কিছুটা রঙিন হয়ে ওঠে। যেহেতু শামসুর রাহমান প্রগতিশীল কবিকুলের কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা অসাম্প্রদায়িক উদারনৈতিক মনোভাবকে ব্যক্তিগতভাবে ধারণ করতেন। সেহেতু আল মাহমুদ অনুসারী ভক্তকুল তাকে ধর্মবিদ্বেষী এবং অন্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের দিকে ঠেলে দিলেন। এভাবে শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ-কেন্দ্রিক দুটি পক্ষ স্পষ্ট ভাগ হয়ে যায়। এছাড়া সমসাময়িক ছিলেন বলে দুজনের মনে কাব্যহিংসা তো ছিলোই।


‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ পুস্তকে কবি আল মাহমুদ তার কবি হয়ে ওঠার দিনগুলির কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের অনুষ্ঠানে, সওগাত অফিসে। সেখানে একটা সাহিত্যের আড্ডা হতো। এক পক্ষে একবার বা মাসে একবার, আমার ঠিক মনে নেই। সে আড্ডায় থাকতেন শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান, খালেদ চৌধুরী ।একবারের আড্ডায় খালেদ চৌধুরী আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সেখানে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। সেটা ৫০ দশকের শেষের দিকে, অথবা ৬০ দশকের প্রথমভাগে—এখন আমার ঠিক মনে নেই ভাই। ঠিক মনে পড়ছে না এর আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা। তবে শামসুর রাহমানের বিয়ের ভোজে আমি উপস্থিত ছিলাম। সওগাত অফিসের সাহিত্য আড্ডা শেষ হলে সবাই যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছিল। আমি তখন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। তাঁদের সঙ্গে ভালো করে পরিচয় হলো। তখন মার্কসীয় দর্শনের একটা প্রভাব ছিল সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে। তাঁদের সঙ্গে আলাপে আমি বুঝলাম এঁরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবির দল। আমি এঁদের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। তাঁর কর্মস্থল দৈনিক পাকিস্তান অফিসে মাঝেমধ্যে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। আমি তখন ‘কাফেলা’ নামের একটা পত্রিকায় দিনে কাজ করতাম। রাতে কাজ করতাম ইত্তেফাকে। কাফেলার অফিস ছিল ইসলামপুরে। কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদনা করতেন কাফেলা। বেতনের ঝামেলার কারণে তিনি ছেড়ে দিলেন। তখন পত্রিকার কপি দেওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে। এভাবে ‘কাফেলা’র সঙ্গে আমার ইনভলভেমন্টটা শুরু। শামসুর রাহমানরা পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের আড্ডায় যেতেন সওগাত অফিসে। তার পাশেই ছিল কাফেলা অফিস। আসতে-যেতে দেখা হয়ে যেত, আর আমিও তো যেতাম। মাঝেমধ্যে তাঁর বাসায়ও যেতাম। পুরান ঢাকায় আশেক লেনে (ইউনিভার্সেল প্রেস) বাসা ছিল তাঁর। শামসুর রাহমান ছিলেন খুবই ভালো লোক। তিনি সোজা-সরল মানুষ ছিলেন। তবে তাঁকে ঘিরে থাকত রাজনৈতিক-মনস্ক একদল কবি, সাহিত্যিক এবং আমার মনে হয় তারা তাঁকে খুব প্ররোচনা দিতেন নানা বিষয়ে। শামসুর রাহমান এদের কথায় দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বাস করতেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্কই ছিল। এ সম্পর্কটা কখনও নষ্ট হয়নি। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটা বজায় ছিল। মৃত্যুর এক মাস আগেও তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন। অনেকক্ষণ ছিলেন। চা খেতে চাইলেন। আমার স্ত্রীকে বলে দিলেন কিভাবে চা’টা বানাতে হবে।এক অসাধারণ কবি হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি লিখেছেনও প্রচুর। যদিও পুনরাবৃত্তি দোষে অনেকেই তাঁকে দায়ী করেছেন; কিন্তু এমন স্বতঃস্ফূর্ত পয়ার রচনা করতে আর কেউ পারেননি। শামসুর রাহমান ছিলেন মূলত একজন রোমান্টিক কবি। ছন্দসিদ্ধি, বিষয়বস্তুতে, শব্দে লাবণ্য সংযোজন এবং একইসঙ্গে অব্যাহত লেখার ক্ষমতা তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। সব সময়ই দেখেছি, নগরমনস্কতা তাঁর কবিতায় উল্লেখযোগ্য একটি স্থান দখল করে আছে। তিনি ইচ্ছাও করতেন ওই ধরনের লেখার, যেখানে শহর প্রাধান্য পাবে। আমার সঙ্গে তাঁর মৌলিক পার্থক্যটা এখানে যে, আমি গ্রামকে সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি এটা বলব না, আমি গ্রাম এবং শহর দু’জায়গাতেই জীবন কাটিয়েছি; গ্রাম ও শহর দু’জায়গার কথাই আমি বলতে চেয়েছি। তাঁর পয়ারে যে আশ্চর্যজনক সিদ্ধি, ভাষাকে নমনীয় করে পয়ারে তা লিখে ফেলার যে ক্ষমতা—তা আমাকে অভিভূত করত।  

আমার এ মুগ্ধতার কথা তিনি জানতেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল না। মানুষ বলত, তিনি বিশ্বাস করতেন। কোনো বৈরিতা ছিল না। শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার কোনো কাব্য-হিংসার সম্পর্ক ছিল না। তাঁর সঙ্গে আমার বয়সেরও তফাত্ খুব বেশি নয়। আমার কবিতা সম্পর্কে কখনও তিনি মুখ খোলেননি। শুধু আমার কেন, তাঁর সমসাময়িক বা তাঁর পরের কোনো কবি সম্পর্কেও তিনি কোনো কিছু লেখেননি। তাঁকে কোনো মন্তব্য করতেও দেখিনি। এটার কারণ মনে হয় তিনি সেটা সচেতনভাবেই চাইতেন না। আমার এবং শামসুর রাহমানের নাম পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। এই উচ্চারণ অনেকে করে থাকেন। এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য হলো, শামসুর রাহমানের পরে তাঁর সমসাময়িক অনেক কবির নাম উচ্চারিত হতো। আমার নাম আসত অন্তত ২০/২২ জনের পরে। কিন্তু সহসা দেখা গেল, শামসুর রাহমানের পরেই আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। সেটা শুরু করেছেন শামসুর রাহমানের নিকটজনরাই। সাহিত্যে এটা ঘটে। আমি এসব ব্যাপারে কোনো অতিরিক্ত পুলকও বোধ করি না—ক্রুদ্ধও হই না। সব সময় ভেবেছি যে, আমি স্বতন্ত্র পথের যাত্রী। শামসুর রাহমানের পথের যাত্রী আমি নই। ফলে আমি অন্যরকম কবিতা লিখতে পেরেছি; আলাদা একটা কাব্যভাষা এবং কবি-পরিমণ্ডল গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। এটা আমার বক্তব্য নয়, এটা আমার কালের সাহিত্য বিচারকদেরই মন্তব্য। আমার কথা হলো, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি—শামসুর রাহমানের গদ্য ভাষা সচ্ছল ছিল না। সম্ভবত এজন্য তিনি গদ্য খুব বেশি লেখেননি। কবিতায়ই তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল এবং প্রাণভরে তিনি কাব্যচর্চাই করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁর কবিতা পড়ে আমি কখনও অবসাদ বোধ করিনি। আমি ভবিষ্যদ্বক্তা নই। সুতরাং মহাকালের বিচারে তাঁর কবিতা কী মূল্যায়ন পাবে, তা বলতে পারি না। শামসুর রাহমানের শব্দ, ছন্দের গঠন প্রক্রিয়া এবং ভাষায় মাধুর্য তাঁকে অনেকদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখবে।আমার সবচেয়ে দুঃখ যে, শামসুর রাহমান খুব অকালে চলে গেলেন। আমার আক্ষেপ যে, তাঁর বাঁচার সাধ ছিল—সেটা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। আমাকে তিনি বলতেন তাঁর বাঁচার সাধ সম্পর্কে। 


আধুনিক বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ। মৌলিক কাব্যচিন্তা ও উপস্থাপনায় অনবদ্য ছন্দ ও চিত্রকল্পে তিনি কবিতায় নিজস্ব স্বর ও ভুবন তৈরি করেন। বাংলা কবিতার আরেক প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সাথে ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধুত্ব। এক পর্যায়ে দুই কবির মধ্যে মতাদর্শিক দূরত্ব তৈরি হলেও, পূর্বাপর শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ ছিলেন পরস্পরের নিকটজন। শামসুর রাহমানকে লেখা আল মাহমুদের অগ্রন্থিত এই পত্রে সেই সম্পর্কসূত্র ও ইতিহাসের পথরেখা পাওয়া যায়।

 আল মাহমুদের চিঠি শামসুর রাহমানকে লেখা----
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আমার সালাম জানবেন। আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ আমি ফজল(
কবি ফজল শাহাবুদ্দীন) ও শহীদের(কবি শহীদ কাদরী) নামে উৎসর্গ করবো। আর 'সোনালি কাবিন' নামে একটি সনেট সংকলন আপনার নামে। এ তিনজনের সাথেই আমার সম্পর্ক সহোদরের মতো। বন্ধুত্ব, ঈর্ষা, মনোমালিন্য ও ঐকমত্য যদি প্রগাঢ়ভাবে কারও সাথে জীবনব্যাপী বিনিময় করা যায় তাহলে সে লোক তো আপনারাই, কোনো রক্তসম্পর্কের আত্মীয়-কুটুমের সাথেও আমার এ ধরনের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি। আমার মনে হয় শিল্পীদের তা কোনোদিন হয়ও না। 'সোনালি কাবিন' নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে তার কিছু অংশ অর্থাৎ প্রথম সাতটি সনেট এ সংখ্যা সমকালে বেরুবে। 'সমকাল' অফিসে কবিতার ফর্মাটা দেখলাম। ছাপার কিছু কিছু ভুল থেকে গেছে যেমন ১ নং সনেটে যেখানে হবে অনায সেখানে অনার্য, ২নং সনেটে প্রাচীন-এর জায়গায় প্রাচীর, ৭নং সনেটে শলা-এর জায়গায় শালা ছাপা হয়েছে। আরও কিছু কিছু ছাপার ভুল আছে হয়তো যা এ মুহূর্তে আমার নজরে পড়েনি। আপনার প্রতি আমার অনুরোধ কবিতাগুলো আপনার কেমন লাগলো আমাকে পরবর্তী চিঠিতে জানাবেন। এখনও সমকাল বেরিয়ে না থাকলে আপনি তো সমকাল অফিসে যান, এক ফাঁকে জাফর ভাইকে বলে দেখে নিতে পারেন। এর পরের সংখ্যায় আরও সনেট ছাপা হবে যার কিছু অংশ ইতিমধ্যেই জাফর ভাইয়ের হস্তগত হয়েছে।পরে এই রচনাগুলো গ্রথিত করে ছাপার ব্যাপারে আমার একটা পরিকল্পনা আছে। হয়তো এ কথা আপনাকে বলেছিলামও। পঁচিশটি সনেট দিয়ে একটি বই করবো। প্রতিটি রচনার বাম পাশের পৃষ্ঠায় থাকবে একটি করে রেখাচিত্র। চিত্রগুলো আঁকবেন এখনকার প্রবীণ ও নবীন চিত্রকরেরা। আমি এ ব্যাপারেই আসলে ঢাকায় গিয়েছিলাম এবং হাশেম খানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপও করে এসেছি। তিনি কথা দিয়েছেন, তার সাধ্যমতো করবেন এবং সমকালীন পঁচিশজন    চিত্রকরের রচনা আদায় করে দেবেন।


এখন কথা হলো, আমার তৃতীয় বইয়ের নাম বোধহয় পরিবর্তন করতে হবে। আমি আমার একটি কবিতার নামে নাম রাখবো ভেবেছিলাম- 'অবগাহনের শব্দ'। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী টেলিফোনে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানালেন নামটা তার মনোমতো নয়। আমি জানি তিনি আমার কবিতার অনুরাগী পাঠক। প্রায়ই এ কথা আমায় বলে থাকেন। আমিও তার অনেক চিত্রে আমার মনের সমর্থন খুঁজে পাই। তাই ভাবছি আমি আমার মত পাল্টাবো। অন্য কেউ এ কথা বললে আমার বিরক্ত লাগতো কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরীর অনুরোধে একটি বইয়ের নাম পাল্টাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।  'সোনালি কাবিন'-এর জন্য আমার একজন প্রকাশক দরকার। 'বইঘর'-এর সাথে এ ব্যাপারে যেচে আলাপ করতে আমার ইচ্ছা নেই। আর ছোটদের কবিতাগুলি দিয়ে এরা আমার একটা বই ছাপাবে বলে আমি আর এদের অন্য কোনো কবিতার বই দিতে চাই না। এ ব্যাপারে মওলা ব্রাদার্সের সাথে একটা যোগাযোগ ঘটাতে পারলে ভালো হতো। আপনি কি আমার হয়ে তাদের সাথে একটু আলাপ করবেন? আমার মনে হয় আপনি আলোচনা করলে আমার বইটি নিখুঁত হয়ে বেরুবে। এ সম্বন্ধে আপনার চিঠিতে কিছু উল্লেখ করবেন। আমার কবিতা সম্বন্ধে আপনার মতামত কোনোদিন স্পষ্ট জানতে পারিনি। যদিও আমার লেখা আপনার ভালো লাগে, এ ধরনের আশ্বাস বহুবার আপনার কাছ থেকে পেয়েছি। আমাকে ও শহীদকে আপনি অত্যন্ত ভালোবাসেন, এটা আমরা উভয়েই জানি। আপনার সাথে শহীদের যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে এটা সাময়িক। শহীদ তার নিজের জালে আটকা পড়েছে। অত্যন্ত অভিমানী ছেলে, কিন্তু মুখ সামলে কথা বলতে জানে না। আমার সম্বন্ধে তো মাঝে মাঝে যা তা বলে। সেদিন তো একটা ব্যাপার আপনাকেই বললাম। দেখুন, কী কাণ্ড! এটা হতো না যদি আমি ঢাকা থাকতাম। আমার অনুপস্থিতির ফাঁকটা সে যাদের দিয়ে পূরণ করেছে তারা কেউ কবি নয়। অনবরত শহীদ তাদের কাছ থেকে প্রশংসা আদায় করে নকল স্বর্গে আরোহণ করছে আর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। শহীদ যাদের সাথে এখন মেশে তারা কেউ জ্ঞানে, বুদ্ধিতে ও প্রতিভায় শহীদের সমকক্ষ নয়। তাদের সাথে সমীহ করে কথা বলবার তার কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু আমরা যখন একত্র ছিলাম তখন আমাদের অজ্ঞাতেই ভারসাম্য রক্ষিত হতো। ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ যা শহীদ অহরহ তার সঙ্গে নিয়ে ফিরতো তাও ছিল আনন্দদায়ক। যা হোক, শহীদের ওপর আপনি নির্দয় হবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি শহীদ আপনাকে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করে। একটা জিনিস মনে রাখবেন, একদল লোক সব সময় আমাদের সৌহার্দে ফাটল ধরিয়ে স্বার্থসিদ্ধির তালে আছে। আজ দশ বছর সাহিত্য প্রয়াসের পর যখন এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে পূর্ববাংলার- শুধু পূর্ববাংলা কেন, মোটামুটি বাংলা ভাষার প্রবহমান কাব্যধারার কারা প্রতিনিধিত্ব করেন তখন প্রগতিশীল খেতাবপ্রাপ্ত একদল লোক যারা ১৯৫২ সালের ভাষা বিক্ষোভের সময় এ দেশে আঁতেলেকচুয়াল বলে নিজেদের জাহির করার অবাঞ্ছিত সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল তাদের গাত্রদাহ আরম্ভ হয়েছে। সত্যমূল্য না দিয়ে যারা সাহিত্যের খ্যাতি চুরি করে তাদের ধস নামা কেউ ঠেকাতে পারবে না। ঢাকায় হম্বিতম্বি করলেও সারা প্রদেশে তাদের সুনাম ক্রমান্বয়ে অবসিত হচ্ছে। প্রদেশের কথা বললাম এ জন্যে যে, এ সম্বন্ধে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে।বিশেষ আর কী লিখবো। সমকালে প্রকাশিতব্য লেখার ওপর আপনার মতামতের জন্যে অধীর অপেক্ষায় থাকবো। আমার আগ্রহ দেখে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন সনেটগুলোতে আমি বোধহয় নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। তা করিনি। আমি অন্যান্য কবিতায় যা করি এগুলোতেও তাই করেছি। কিছু মনোরম আঞ্চলিক শব্দ সংস্কৃত তৎসম শব্দের পাশে আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব নিপুণতার সাথে গেঁথে দিয়েছি। এভাবে আমার কবিতার জন্যে আমি একটি ভাষা সৃষ্টি করতে চাই। বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছি প্রাচীন ইতিহাস, প্রেম ও স্বাজাত্যবোধ। এই স্বাজাত্যবোধ উগ্র জাতীয়তাবাদের নামান্তর নয়। সমাজ সম্বন্ধে আমার ধারণাও এতে অতি সরলভাবে বিবৃত হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। যেটুকু জাতীয়তাবাদী মনোভাব কবির না থাকলে চলে না ঠিক ততটুকু আমার অন্যান্য কবিতাতেও আপনি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন। 
ইতি-
আপনার স্নেহসিক্ত আল মাহমুদ।। 
২৮-১১-৬৮
‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ পুস্তকে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন,… “মানুষ তার আয়তনের চেয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্খা যদি অতিশয় উধ্বর্গামী হয় তাহলে হতাশার মেঘ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। আমি কোনো উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে ঢাকায় আসিনি। এসেছিলাম শুধু কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। একটু স্থান, কোথাও অনেকের ফাঁকে নিজের নাম ছাপা হয়েছে এতেই আমি তুষ্ট থাকতাম। কিন্তু ব্যর্থ কবির দল সবসময় প্রকৃত কবিকে চিনে ফেলে। তাকে আর মাথা তুলতে দেয়না। সবাই শুধু মাথায় আঘাত করতে চায়। আর তাদের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারিত হয়, যেমন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী – তারা আমার সঙ্গী ছিলেন বটে। কিন্তু বন্ধু ছিলেন না। ছিলেন কঠোর ও নির্মম প্রতিদ্বন্দ্বী। সামান্যতম ছাড় তারা আমাকে দেননি। তবে আমি গ্রাম্য লোক বলেই অনেক বিষয়ে কারো পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকিনি॥”

আবার একটি সাক্ষাৎকারে কবি আল মাহমুদ, কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ে বলেছেন, ‘অনেকে মনে করে যে শামসুর রাহমানের সাথে আমার বোধহয় কোন দ্বন্দ্ব ছিলো। এসব কিছুই ছিলো না। খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম। শামসুর রাহমান চুপচাপ ছিলো। আমার বাসায় নীরব একটি জায়গায় চুপচাপ বসতো। আমি বলতাম, কী ব্যাপার? বলতেন, আমি বসছি, ভালো লাগছে না। উনি তো আবার সিগারেট খেতেন না। আমি সিগারেট ধরিয়ে কাছে বসতাম। চোখ বন্ধ করে বসে থাকতেন। কী যেন ভাবতেন। আমার জানা ছিলো যে শামসুর রাহমানের ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব ছিলো। এটা হলো তার বিশ্বাসের ব্যপার’।

সাহিত্যিক জাকির আবু জাফর কবি শামসুর রহমান এবং কবি আল মাহমুদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়ে ‘যেমন দেখেছি তাকে’ প্রবন্ধে লিখেছেন,আল মাহমুদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল শামসুর রাহমানের। শুরুটা রাহমান ভাইয়ের তরফ থেকেই হয়েছে। কোনো অনুষ্ঠানে অথবা কবিতার আসরে আল মাহমুদ থাকবেন জানলে অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন না শামসুর রাহমান। দাওয়াত নিয়ে কেউ গেলে জিজ্ঞেস করতেন কে কে থাকবে? যখন উচ্চারিত হতো আল মাহমুদের নাম, বলতেন আমি যাবো না। কিন্তু আল মাহমুদ কখনো এমন গোঁ ধরেননি; বরং অংশগ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন দ্বিধাহীন। এভাবে দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ হতে থাকল বিভক্তির রেখা। পরবর্তী কবিদের মধ্যেও দাগ টেনে দিলো এ বিভক্তির খঞ্জর। একদিন জিজ্ঞেস করলাম আল মাহমুদকে, সাহিত্যে এ বিভাজন কি আদর্শিক নাকি রাজনৈতিক। মুহূর্ত দেরি না করেই জবাব দিলেন এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। বললেন, এ দেশে কেউ আদর্শিক লড়াই করে না। কেউ না। ডান-বাম-মধ্যপন্থী সবার পাঁজরে ঝুলছে স্বার্থের ঝোলা। সবার চোখেই ক্ষমতার চশমা আঁটা। সব কিছুর বিচার অনুগত দাসানুদাসের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে সাহিত্যের বিচার চলে না। এ কারণে আমাদের সাহিত্যে চিহ্নিত করার কোনো রীতি নেই। থামলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, শামসুর রাহমান একদা বন্ধু ছিলেন আপনার, তার বিষয়ে কী বলবেন? আল মাহমুদের জবাব, তার ব্যাপারে আমার কোনো অনুযোগ নেই। অভিযোগও নেই। তার যা ভালো লাগে তাই তিনি করবেন। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। যে অনুষ্ঠানে আপনি থাকেন, শামসুর রাহমান সেখানে থাকেন না। যেতে অস্বীকার করেন, কেন? এটি একান্ত তার ব্যাপার। এ নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। কে এলো আর কে এলো না, এ নিয়ে আমার ভাবান্তর নেই। আমি জানি, একজন কবিকে তার কবিতা নিয়েই দাঁড়াতে হয়। কালের অক্ষর লিখতে হয় কবিকে। কোনো জমায়েত অথবা বাহবার ওপর কবির সাফল্য নির্ভর করে না। আরো বললেন দেখো, এক সময় কবিদের তালিকায় এক নম্বরে ছিল শামসুর রাহমান। আমার নাম ছিল তেত্রিশ নম্বরে। ধীরে ধীরে মধ্যখানের সংখ্যাগুলো ঝরতে লাগল। আর উপরে উঠতে থাকল আমার নাম। এখন দেখো, শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ হয়ে গেল। আমি জানি, এটি কোনো দৈব ঘটনা নয়। আকস্মিকও নয়। আমি মনে করি, এটি কবিতার শক্তি। না, কোনোভাবেই ব্যক্তি শামসুর রাহমানের বিপক্ষে কোনো কথা বললেন না আল মাহমুদ। শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাসায় একদিন বিকেলে তাকে জিজ্ঞেস করেছি, আল মাহমুদ যে অনুষ্ঠানে থাকেন সে অনুষ্ঠান বয়কট করেন কেন? খুব ছোট জবাব ছিল তার, এটি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।ব্য ক্তিগতভাবে রাহমান ভাই ছিলেন বেশ নম্র স্বভাবের। মিষ্টিকথার মানুষ। হাস্যোজ্জ্বল মুখ। কাউকে রাগ করে কথা বলতেন না। কবির সৌন্দর্য ছিল তার অবয়বে ব্যবহারে।এটি বেশ লক্ষণীয় তারা দু’জন কেউ কারো বিরুদ্ধে কথা বলেননি। ব্যক্তিগত আক্রমণও ছিল না কারো বিরুদ্ধে। মাহমুদ ভাই চোখে তখন খুব কম দেখতেন। রাহমান ভাইও কম দেখার দলের। আল মাহমুদ তার কবিতার বই উড়াল কাব্যে একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘এই শহরে দুইটি কানা/মাহমুদ কানা শামসু কানা’।দু’জন কানা হলেও হৃদয় উন্মুক্ত ছিল দু’জনেরই। ফলে পরবর্তী সময়ে আবার মিলে গেলেন দুই বন্ধু। একই মঞ্চে দু’জনকে দেখা গেল পাশাপাশি। আহা, কী সুন্দর ছিল এমনদৃশ্য! দু’জন মিলে যাওয়ার পেছনে একজন ব্যক্তির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বর্ষীয়ান কবি এবং প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান। নেপথ্য নায়কের ভূমিকা নিতে হয়েছিল তাকে। একদিন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদকে যেতে বললেন তাঁর বাসায়। বললেন, কথা আছে। মুখোমুখি বলব। ঠিক সন্ধ্যায় হাজির হলেন আল মাহমুদ। আমাকেও নিয়ে তোলেন সঙ্গে। আলী আহসান স্যারের বাসা উত্তর ধানমন্ডি, কলাবাগান বশির উদ্দিন রোড। লাল ফকিরের মাজারের কাছাকাছি। নিচতলা বাসা। দরজায় নক করলে কেউ একজন খুলে দিলো দরজা। বাসার মাঝখানে একটি কক্ষ, যা ড্রয়িংরুম নয়। এক ধরনের বৈঠকখানা। কেউ এলে এই কক্ষে সাক্ষাৎ দিতেন আলী আহসান স্যার। এ কক্ষেই মাঝে মাঝে বসত সাহিত্য আড্ডা কবিতার আসর। কক্ষটির একটিই জানালা। প্রায়ই খোলা থাকত এটি। জানালার মুখে ছিল একটি হাসনাহেনার ঝোপ। বেশ ঝাঁপানো ঝোপ থেকে মিহি বাতাসে ঢুকত ফুলের সৌরভ। মায়াবী ঘ্রাণে মুখর হতো কক্ষটি। কী যে ভালো লাগার অনুভূতি, শিরশির ছড়িয়ে যেত সারা শরীরময়। 

আমরা কক্ষে ঢুকতেই দেখি লাঠির মাথায় এক হাত আরেক হাতের ওপর রেখে বসে আছেন স্যার। এমন করে নির্মোহ একা বসে থাকতে দেখিনি তাকে। বললেন, আসুন আল মাহমুদ। আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। স্যারের ডান পাশের সোফাটায় বসলেন মাহমুদ ভাই। বাম পাশে আমি।কোনো ভূমিকা ছাড়াই আল মাহমুদকে লক্ষ করে বললেন মনে কোনো বিদ্বেষ রাখা ভালো নয়। বিদ্বেষ মনের ভেতর প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। আর প্রতিহিংসা মানুষকে বিবেকহীন করে তোলে। বিবেকরুদ্ধ কোনো কাজই মানুষের জন্য শুভ নয়। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না মাহমুদ ভাই। স্যার হঠাৎ কেন এমন কথাগুলো উচ্চারণ করছেন। স্যারের মুখের দিকে দু’চোখ তুলে চেয়ে থাকলেন আল মাহমুদ।স্যার বললেন মনের দিক থেকে স্বচ্ছতা প্রকাশ করেন যিনি, জগতে তার মূল্য বেশি। তাকে সুনজরে রাখে মানুষ। তার প্রতি বিশ্বস্ত হয় সবাই। বিবাদ-বিসম্বাদ কল্যাণকর নয় কোনো অর্থেই। বরং মনের দুষ্কৃতি উগড়ে দিলে মন হয়ে ওঠে ঝকঝকে আয়নার মতো।আল মাহমুদ তখনো চুপ। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করছেন, কেন এসব কথার অবতারণা। কী বলতে ডেকেছেন এই মনীষী, দুই হাতে লাঠিটি তেমন করেই ধরা স্যারের। খানিকটা শ্বাস নিয়ে বললেন কাল শামসুর রাহমান এসেছিল। এসেছিল তার একটি কাজে। এ কথাগুলো বলেছি তাকেও। অনুরোধ করেছি, আল মাহমুদের সাথে সম্পর্কের অবনতি মিটিয়ে নিতে। কী বলেছেন শামসুর রাহমান? জিজ্ঞেস করলেন আল মাহমুদ। স্যার বললেন শামসুর রাহমান বলেছেন, তার কোনো আপত্তি নেই মিলে যেতে। বলেছেন, বিরোধ বিরোধকেই উসকে দেয়। আল মাহমুদের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো রেষারেষি নেই। আমরা সবাই সময় ও পরিস্থিতির শিকার।নড়েচড়ে বসলেন আল মাহমুদ। বললেন, স্যার কারো প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। প্রতিহিংসা নেই। শুধু আক্রান্ত হলে তার প্রতিবাদ করি এবং সেটিও কলম দিয়েই করি। পরহিংসায় কাতর হওয়ার স্বভাব আমার নেই। আমি বরাবর কবিতায় অসুন্দরের বিরুদ্ধে শব্দ নির্মাণ করেছি এবং করে যাবো শেষ দিন পর্যন্ত।সৈয়দ আলী আহসান বললেন, সে কথা আমি জানি আল মাহমুদ। কিন্তু আমি চাইছি শামসুর রহমান আল মাহমুদ এক টেবিলে বসুক। এতে বাংলা কবিতার বাগান নন্দিত হবে। অনেক ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাবে বাংলা কবিতা।


তা ছাড়া জীবন তো ক্ষুদ্র। এ ক্ষুদ্র জীবনে কী হবে এত ভেদের রেখা টেনে?আল মাহমুদ বললেন, আমি তো বলেছি এ সমস্যা আমার দিক থেকে শুরু হয়নি। এর শেষও আমার হাতে নেই। তবে এটুকু বলি, স্যার একজন কবি হিসেবে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য খোলা আমার মন। খুশিই হলেন সৈয়দ আলী আহসান। বললেন, আশা করি একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রচিত হবে বাংলা কবিতার। স্যারের এ উদ্যোগ এত ভালো লাগল, ভেতরটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার। কল্পনা করছিলাম বসে বসে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ আবার এক মঞ্চে। বাংলা কবিতার ভুবন নতুন হয়ে উঠবে! মাহমুদ ভাইকে কখনো ব্যক্তি কুৎসা রটনায় অথবা চর্চায় দেখিনি। কারো প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ-আক্রোশ প্রকাশ করতেও নয়। সাহিত্যাঙ্গনে ভাগাভাগি যা-ই হোক, তিনি তার কবিতার ক্ষেত্রে আপস করেননি। তবে তার আক্ষেপ ছিল বেশ। এসব বিষয়ে কথা তুললে বলতেন'   আমি এমন একটি সমাজে আছি, যে সমাজ আমার চিন্তার অনুকূল নয়। যে সমাজ বুঝতেই পারেনি আমাকে। কেবল বৈরিতা, কেবল প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে আজীবন। আলী আহসান স্যারের সাথে আলোচনা কিংবা যে কারণেই হোক শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ এক মঞ্চে পাশাপাশি হলেন। বসলেন দু’জন দু’জনের পাঁজর ঘেঁষে। অনুষ্ঠানটি ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে। দোতলায়, এখন কনফারেন্স রুম। তখন ভিআইপি রুম ছিল। কবি বিপ্লব ফারুকের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আমিও একজন আলোচক ছিলাম। দীর্ঘ দিনের বরফ গলল। একজন আরেকজনের হাত ধরে কুশলবিনিময় করলেন। এরপর আরো বেশ কিছু অনুষ্ঠানে দু’জন একসাথে ছিলেন। অনুষ্ঠানের বাইরেও যোগাযোগ ছিল দু’জনের। শামসুর রাহমানের মৃত্যুর কিছু দিন আগের কথা। আল মাহমুদ তখন গুলশানের বাসায় বসবাস করেন। একদিন শেষ বিকেলে গেলাম তার বাসায়। ঠিক লিফটের গোড়ায় দেখি দাঁড়িয়ে আছেন রাহমান ভাই। অপেক্ষা করছেন লিফট নামার। কী আনন্দ! সালাম দিলাম। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। হ্যান্ডশেক করে বললেন, চলো একসাথেই ওঠা যাক। তোমরা তো টগবগে ইয়াং। আমাদের মতো বৃদ্ধদের চলাফেরায় আছে বেশ হেপা। আপনি তো চিরতরুণ রাহমান ভাই বললাম আমি। মন ইয়াং হলেও শরীর কি আর মানে! মানুষের জীবনে বার্ধক্য এলে মনের সাথে শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করে। শরীর যখন মনের বিপরীতে ছোটে, কিছুই করার থাকে না রে।বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেলাম মাহমুদ ভাইয়ের ড্রয়িংরুমে। রাহমান ভাই আসবেন এটি জানতেন মাহমুদ ভাই। ফলে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। খানিকটা কেতাদুরস্ত হয়ে ছিলেন। আমরা ড্রয়িংরুমে ঢোকার সাথে সাথে তিনিও ঢুকলেন। কী যে অমায়িক দৃশ্য ছিল সেটি। দু’জন দু’জনকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বসলেন পাশাপাশি। বসেই রাহমান ভাই মাহমুদ ভাইয়ের দু’টি হাত নিজের হাতে নিলেন। হাত ধরে বেশখানিকক্ষণ চেয়ে থাকলেন আল মাহমুদের দিকে। মুখে ছিল না কোনো ভাষা। কিন্তু দেখলাম, এক তীব্র অভিব্যক্তি ভাষার ঊর্ধ্বের কোনো রঙ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল শামসুর রাহমানের গোটা মুখে। বেশ কিছু সময় কেটে গেল এভাবে। যেন দু’জন দু’জনকে অনুভব করছেন অন্তরের গহিন রহস্য দিয়ে। বাংলা ভাষার দু’জন শ্রেষ্ঠ কবির নির্বাক মুহূর্তের এমন চিত্র সময় তার ক্যামেরায় তুলে নিয়েছে হয়তো। আর তুলে নিলো আমার বিস্মিত মনের চোখ। যে চিত্র জীবন্ত আমার মনের আরশিতে। মাঝে মাঝে অকারণ ভেসে ওঠে এসব দুর্লভ মুহূর্তের ছবি।




আবু রাইহান