সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অমৃতা মিশ্র


আলো ছায়ার সকাল




সকাল থেকেই আকাশটা আজ মেঘলা। এখুনি বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু রোদ্দুরও উঠছে না। 
মাধবীলতা মোড়ানো গেট পেরিয়ে সাইকেলটা নিয়ে আস্তে আস্তে ঢুকল টিকলি। জেঠু বাগানে। মালিকে সঙ্গে নিয়ে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। 
-"বাবলু...  চন্দ্রমল্লিকার চারাগুলো ওই নতুন টবগুলোতে বসাবি।  আর বাকি কসমস, জিনিয়া আর পিটুনিয়ার চারাগুলো ওই পুরোনো টবগুলোর মাটি বদলে বসাতে হবে। "
-" এখন থেকেই লেগে পড়েছো জেঠু?
-" আরে ! তিলোত্তমা দেবী যে আপনি কখন এলেন? "
জেঠু তাকে এই নামেই ডাকে। সেই ছোট্টবেলা থেকে। আগে ওরা পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকত।এখন ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে একটু দূরে। 
হেসে ফেলল টিকলি।
" তুমি তো দেখতেই পাও নি। এত ব্যস্ত!"
-" এবারে কেমন বাগান সাজাব দেখিস একবার।
-"ভালো তো। আমাদের পাড়ার সরস্বতী পুজোর সময় তোমার তোমার ফুলগাছের টবগুলো সাজানোরি জন্যে নিয়ে যাব। 
-"ভেতরে যা.. তোর জেম্মা কি বানাচ্ছে  দেখ।"

ভেতরে ঢুকেই টিকলি সোজা রান্নাঘরে। 
"-কি করছ জেম্মা?"
-"ওমা!এত সকালে তুই?"
-"পড়তে গিয়েছিলাম। স্যারের মা হঠাৎ অসুস্থ। তাই ছুটি দিয়ে দিলেন। ভাবলাম একটু ঘুরে যাই। "
-" বেশ করেছিস ।আয়। তোর জেঠুর আজ চিঁড়ের পোলাও খাবার সখ হল । তাই বানাচ্ছি। খেয়ে যাস।" 
টুকটাক কথাবার্তা চলছে। টিকলি একটু একটু আনমনা। ঘরে এসে ছবিগুলো দেখছে।  বাবাইদার ছোটবেলার ছবি। পাশে মোনা দিদি। সাগর আর মোহনা। ওদের নামগুলো খুব সুন্দর।  স্কুলে প্রাইজ হাতে ছবি। কোনোটা আবার বন্ধুদের সাথে। মনটা একটু ভারী ভারী লাগছে। কতদিন দেখা হয় নি। শেষ দেখা হয়েছিল গতবছর পুজোর সময়। ও যখন কলেজে উঠল বাবাইদা তখন বাইরে চলে গেল গবেষণার কাজে। সবাই কী ভীষণ খুশি ছিল বাবাইদার সাফল্যে। টিকলিও খুব খুশি হয়েছিল ।কিন্তু তার সাথে মনখারাপের রোগটাও বেশ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছিল। আবার কবে দেখতে পাবে!! যদিও অন্যজন জানেই না মনে মনে তাকে নিয়ে কত ছবি আঁকা হয়ে গেছে টিকলির। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি। বাবাইদাও কখনও কোনো ইঙ্গিত দেয় নি! অপেক্ষা করছে টিকলি।  সে কী কখনই বুঝতে পারবে না!

প্রতিমা লক্ষ্য করেছিলেন টিকলিকে। আর কেউ না বুঝতে পারুক কিশোরী মনের খবর তিনি রাখেন। ছোট্টবেলা দেখছেন টিকলিকে। বাবাইয়ের প্রতি ওর মনোভাবটাও তিনি অনুভব করতে পারেন। এতদিন ভাবতেন বাবাইও হয়ত .... কিন্তু সে ভুল ভেঙে গেছে কয়েকদিন আগেই। কিন্তু টিকলিকে সেকথা জানাতে বড্ড মায়া লাগছে।
-"বাবাইদা এবছর পুজোতে এলো না জেম্মা? ভাইফোঁটাতে আসবে?"
-"না রে! মনে হয় এ বছর আসতে পারবে না। কাজের চাপ আছে।"
একটু যেন নিভে গেল মুখের আলোটা। 
-"আর মোনাদি?"
-"মোনা আসবে হয়ত কালী পুজোর সময়। টিকলি... তোকে কয়েকটা ছবি দেখাই আয়। বাবাই পাঠিয়েছে।" 
জেঠুর মোবাইলে ছবিগুলো দেখছে টিকলি। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, হোস্টেল...চারদিক সবুজের মেলা। তারপর একটা মেয়ের সাথে বাবাইদার ছবি। দুজনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় পাইন গাছের নীচে।  কেমন একটা অচেনা ভয় অনুভব  করছিল টিকলি। জেম্মার মুখের দিকে তাকাতেই ওর মনে হল ওর ভেতরটা পর্যন্ত দেখে ফেলছে কেউ। ও চোখ নামিয়ে নিল। 
-"বাবাই এর সাথে পড়ে মেয়েটা। ওর বন্ধু । প্রবাসী বাঙালি। দিল্লীতে থাকে ওরা।" 

প্লেটের ওপর চামচটা নাড়াচাড়া করছিল টিকলি। বুকের ভেরতটা খালি খালি লাগছে। 
-"কী রে ভালো হয়নি পোলাওটা?"
-"খুব ভালো হয়েছে।"
-"তাহলে খাচ্ছিস না কেন?"
-"এই তো খাচ্ছি। সকালে তো কর্ণফ্লেক্স খেয়ে বেরিয়েছি। এখনও খিদে পায় নি।"
প্রতিমারও কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার জন্য। কিন্তু কিছু তো করার নেই। আজ নয় কাল এই সত্যিটার মুখোমুখি হতেই হত। বরং যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো।

দোতলার বারান্দায় এসে বসেছে ওরা। দোলনাটায় টিকলি দুলছে অল্প অল্প। বাইরের দিকে দৃষ্টি। অথচ দেখছে না কিছুই। 
-"আমি যখন স্কুলে পড়তাম.. তখন একজনকে খুব ভালো লাগত জানিস!"
চমকে তাকাল টিকলি। কী বলতে চাইছে জেম্মা!  
-"আমার দাদার এক বন্ধু। আমাদের বাড়িতে ও আসত। আমরাও যেতাম। ওদের বাড়িতে খুব বড় করে সরস্বতী পুজো হত। কখন যে ভালবেসে ফেলেছিলাম বুঝতে পারি নি। যখন রেলে  চাকরি পেয়ে অনেক দূরে চলে গেল তখন বুঝলাম।যাবার আগে মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। আমি নলেন গুড়ের রসগোল্লা খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু সে মিষ্টি আর আমার গলা দিয়ে নামেনি।
-"তারপর?"
-" তারপর আর কী! প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ লাগত। কিছুই ভালো লাগত না। শুধু ওর কথাই মনে পড়ত। অপেক্ষা করতাম। একদিন ওর বিয়ের খবর পেলাম। খুব কষ্ট হল। তারপর এক সময় মনে হল যেন একটু ভারমুক্ত হলাম। অপেক্ষা তো শেষ হল।ধীরে ধীরে ও আমার আমার কাছে একটা পুরনো বই মতো রয়ে গেল । পাতা উল্টে দেখলে মনে পড়ে। না হলে বইটা যে আমার কাছে আছে তাই ভুলে যাই।"
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। 
-"আসলে কি জানিস টিকলি। আমরা এত কাছ থেকে জীবনটাকে দেখি যে ছোট ছোট ভাললাগা খারাপলাগাগুলো আমাদের কাছে খুব বড় করে দেখায়। যদি একটু দূর থেকে দেখতে পারতাম তাহলে দেখতাম আজ যেটা নিয়ে এত ভাবছি কাল হয়ত সেটা অনেক ফিকে হয়ে যাবে । আবার পরশু হয়ত আরও আবছা। সময় মানুষকে ধীরে ধীরে পরিণত করে। একটা একটা করে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে আমরা উপরে উঠে যাই । আর তখন এই ছোট ছোট জিনিসগুলো আর চোখেই পড়ে না।" 
-" শুধু অনুভবটা থেকে যায় ...তাই না?" 
-"ওটাই তো আমদের সব। একটা ঘটনা কি ঘটল সেটা বড় কথা নয়....বড় কথা হল তুই সেটা কি ভাবে অনুভব করলি। আধ গ্লাস জল.... ভর্তি ভাবলে ভর্তি.... খালি ভাবলে খালি।"

মেঘটা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। রোদ উঠছে আবার। প্রতিবার যাবার সময় একটা করে লজেন্স দেয় জেঠু। এখনও। এবারে আর বলল না টিকলি... 'আমি তো বড় হয়ে গেছি জেঠু !!' মনে হল কোথাও কোথাও ছোট হয়ে থাকতেই ভালো লাগে।
গেটের বাইরে এসে পিছন ফিরে তাকাল। জেম্মা এখনও দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। হাত নাড়ল। 
-" আবার আসিস কিন্তু।"
 -"আসব।"
সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাল টিকলি। আসার সময় জেম্মাকে একটু আনমনা দেখাল।  সত্যিই কী কষ্টগুলো সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়! আচ্ছা! অনেক অনেক দিন পরে ওর কাছেও কি এরকম হঠাৎ করে খুলে যাবে.... যত্ন করে তুলে রাখা কোনো  পুরোনো বই এর পাতাগুলো!!


অমৃতা মিশ্র