আত্মার কাছে
দুপুরে খেয়েদেয়ে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে সামনের
দিকে তাকিয়েই বসেছিলেন রমেনবাবু।খানিকক্ষণের মধ্যেই ওদের আসবার কথা।যদিও আসার
খবরটা ওরা কেউ জানায়নি,নীতার কাছ
থেকে জানতে পেরেছেন।
এই চারমাস ধরে প্রতিমূহুর্তে আশার অভাব বুঝতে
পারছেন। বুড়ো বয়সে বৌ না থাকলে যে কি হাল হয় সেটা রমেনবাবু হাড়েহাড়ে টের
পাচ্ছেন।দুই ছেলে,কুশল আর
কুনাল,দুজনেই থাকে দেশের বাইরে,আমেরিকায়। চল্লিশ
বছরের কুশল পাঁচবছর আগে চাকরিসূত্রে ওখানে যায়। আশা পছন্দ করে নীতাকে বড় বৌ করে
বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আশার জহুরী চোখ জহর চিনতে ভুল করেনি। নীতার মামী ছিল আশার
বান্ধবী,বাপ মা মরা মেয়েটাকে ভালোবেসে নিজের মেয়ের সাথে
একসাথেই বড় করে তুলেছিল মীরা। ফোনে দুই বন্ধুর যোগাযোগ ছিল।বাংলায় এম এ পাশ করা,শ্যামলা,একঢাল কোমরছাপানো চুল আর দীঘল দুই মায়াবী চোখের
নীতা স্বভাবগুণেই রমেন আর আশার মন জয় করে নিয়েছিল।কুশল আমেরিকা যেতে তাকেও এক
বছরের ছেলে নিয়ে সেখানে যেতে হয়। কুশল প্রতিবছর না আসলেও নীতা ছেলে নিয়ে ঠিক
আসতো। শীতের লম্বা ছুটিটা মামাবাড়ি আর শ্বশুরবাড়িতে ভাগ করে দিতো।
----
বাবা,আপনার ছেলেকে এখানে ফিরে আসতে বলুন না!!!
আমার ওখানে ভাল্লাগে না।সব এতো নিয়মে চলে!! জন্ম থেকে ধুলোবালি খেয়ে মানুষ,ওতো টিপটাপ আমার পোষায়?মনখারাপ নিয়েই ফিরে যেতো।বৌমা
থেকে কখন যে মেয়ে হয়ে উঠেছিল কেউ বুঝতেই পারেনি।সময় করে দিনে একবার ফোন করবেই,অল্প সময়ের জন্য হলেও।
বছর বত্রিশের কুনাল দাদার ভরসাতেই ওখানে যায়। কলেজে
পড়তেই রীনার সাথে প্রেম,গতবছরেই
আশার চাপে বিয়েটা করে নেয়।
এখানে রমেনবাবু আর আশা অপেক্ষায় থাকতেন ওদের ঘরে
ফেরার প্রতীক্ষায়। নাতিটাও সারা বাড়ি ছুটে বেড়াতো। ঘরগুলো যেন হেসে উঠতো।
আশার আচমকা হার্টফেলে মৃত্যুতে কুনাল,কুশল,রীনা সঙ্গেসঙ্গে আসতে
পারেনি। নীতা ঠিক টিকিট ম্যানেজ করে তিনদিনের মধ্যেই চলে এসেছিল,ওরা এক সপ্তাহ পরে।সবকিছু সামলে রমেনকে নিয়ে গিয়েছিল নিজের সাথে,কিন্তু একমাসের মধ্যেই মামার মৃত্যুতে আবার ফিরে আসতে হলো।
রমেনবাবুও এসেছিলেন,আর যেতে চাননি।
------
আমায় ছেড়ে দে মা,নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও
স্বচ্ছন্দ হতে পারবো না,এখনো তো অথর্ব হয়ে পড়িনি!!
----
ঠিক আছে,কিন্তু মালামাসিকে রান্না করতে বলে
যাব। শরীর খারাপ হলে তিন্নিকে ফোনে জানাতে একদম দ্বিধা করবেন না।
তিন্নি নীতার মামাতো বোন,কাছেই থাকে,ট্যাক্সিতে আধঘণ্টার রাস্তা।
এভাবেই চলছিল। রমেনের ভোর শুরু হতো মর্নিং ওয়াক দিয়ে,তারপর ঘরে ফিরে ব্রেকফাস্ট করে কাগজপত্তর পড়ে বাড়ির
সামনের খানিকটা জায়গায় মরসুমি ফুলের যত্নআত্তি করা,দুপুরে
স্নান,খাওয়াদাওয়া। তারপরে একটু বিছানাতে গড়ানো,বিকেলে বাড়ির সামনে পায়চারি করে ঘরে টিভির সামনে,কখনওবা
বই,গানশোনা।রাতের রুটি মালা করে দিয়ে চলে গেলে গেটে চাবি
দিয়ে দিতো।
মালা এবাড়িতে আছে ত্রিশবছর ধরে,পঁচিশ- ছাব্বিশের মালা এবাড়িতে বাসনমাজার কাজ নিয়ে
ঢোকে,প্রতিরাতে মাতাল বরের মার খেতো আর সকালে আশার কাছে এসে
দু:খ করতো। তারপর একদিন জানালো তার বর আরেক মেয়ের সাথে পালিয়েছে। ছবছরের ছেলে নিয়ে
রমেনের পায়ে এসে পরেছিল।
-----
আরে কি করছিস কি!
----
দাদাবাবু,আমি আপনার বাড়িতে ছেলেটারে রেখে
পাঁচবাড়ি কাজে যাবো,আমার বিশুরে একটু আপনার বাড়িতে ঠাঁই
দেবেন!!
আশার কথাতেই বিশু এবাড়িতে থাকতে শুরু করে,স্কুলেও ভর্তি হয়।গ্র্যাজুয়েশন করে কোটায় চাকরি
পায়।কিন্তু বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে,মালার সেখানে জায়গা
হয়নি। সে আজও তার ঝুপড়িতেই থাকে।
রমেন আশার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে বলতো," কিরকম ছেলে মানুষ করেছো, বাপের কথা মনেই রাখেনা!!"
আশার ছবি বুঝি কথা বলে,"
নাকের বদলে নরুন তো পেয়েছো!"
-----
মানে!
----
নীতার মতো মেয়ে পেয়েছো,মালার মতো কাজের
বিশ্বস্ত লোক পেয়েছো। দিব্যি আছো,খাচ্ছো,দাচ্ছো,ঘুমোচ্ছো!!!
-----
খোঁটা দিচ্ছ!! দাও,তোমার অভাব প্রতিপদে টের
পাচ্ছি।
----
দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম কে আর বোঝে!!মালাকে এখানেই থাকতে বলো।ওরও তো
শরীর ধুঁকছে।
একদিন মালা কাজে এলোনা,কোনরকমভাবে রমেনবাবু স্বপাকের ব্যবস্থা করলেন,দশমিনিটের
হাঁটা রাস্তায় মালার ঝুপড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখলেন,মালা
জ্বরে কাতরাচ্ছে।আর কিছু ভাবেননি,মালাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে
এসেছিলেন।
সেরাতে স্ত্রীর ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,"তোমার কথাই শুনলাম।"
সেইথেকে মালা এবাড়িতেই, রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট গুদোমঘরটা পরিষ্কার করে
আবাসযোগ্য করে নিয়েছে।
মালার এবাড়িতে থাকাটা রমেনবাবু শুধুমাত্র নীতাকেই জানিয়েছিলেন। নীতা
শুনে খুব খুশী হয়েছিল।কিন্তু বাকি কেউ মেনে নিতে পারেনি,তাদের মতে,এটা বেশি
বাড়াবাড়ি!!!!
এব্যাপারে এবার দুইভাই আর রীনার এবাড়িতে পদার্পণ, নীতাই গতকাল তাকে ফোনে জানিয়েছে।কুনালরা গতকালই
রীনার বাপেরবাড়িতে এসেছে।
গেটের আওয়াজে চোখ তুলে চাইতেই দেখলেন,ওরা তিনজনে ঢুকছে।
----
কি ব্যাপার,তোরা!!!রমেনবাবুও কম যাননা।
----
ওই ভাবলাম একা আছো,তাই------কুশল কিন্তুকিন্তু
করে।
-----
এতো খরচ করে এলি আর একটা ফোন করে জানাতে পারলিনা!!!দুপুরের খাওয়া তো
শেষ,দাঁড়া,মালাকে ডাকি। মালা,একটু এদিকে আয় তো।
----
মালামাসি এখনো ওর ঘরে যায়নি? রীনা ইচ্ছাকৃত
কৌতূহলী।
----
ওমা,তোমরা জানোনা মালা তো চারমাস ধরে এখানেই
থাকছে।
------
দাদাবাবুদের আর ছোটবৌদির খাবার টেবিলে দিয়েছি। মালা নি:শব্দে এসে
দাঁড়ায়।
---
যা,খেয়ে নে।তারপরে কথা হবে।
ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে ভাত,ডাল,আলুপোস্ত,বাটামাছের ঝাল আর
কচি আমড়ার অম্বল,দই দেখে সবাই খেতে বসে গেলো। বুঝে গেলো বাবা
তাদের আচমকা আগমনের কারণ জানেন।
রমেনবাবু নিজের ঘরে অপেক্ষা করছিলেন।
------
বাবা,সবই ঠিক আছে কিন্তু মালামাসি কি এখানে
বরাবরের জন্য থাকবে?
-----
বোকার মতো প্রশ্ন কোরোনা!! আমি যদ্দিন বেঁচে আছি,তদ্দিন তো বটেই,তারপরেও যাতে থাকতে পারে সেইজন্য
সামান্য হাতখরচের ব্যবস্থা করে দিয়েছি,ওরও তো আমার দশা,ছেলে থেকেও নেই।অসুখবিসুখ হলে দেখারও কেউ নেই। তোরা কি এরমধ্যে দেশে ফিরে
আসবি?
----
আমার ফিরতে আরো চারবছর লাগবে,নীতা বোধহয় আগামী
কয়েকমাসের মধ্যেই ফিরে আসবে।কুনালরা আসছেনা।ওরা ওখানেই সেটেল্ড হবে।
------
বাইরের একজন কাজের লোককে প্রপার্টি দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? রীনা প্লাক করা ভ্রু তুলে জিজ্ঞ্যেস করে।
------
তোমরা নিজেদের ব্যাপারে আমাকে না জানিয়ে ডিশিসান নিতে পারো,আর আমি নিজের উপার্জনে করা বাড়িতে কাকে রাখবো সেটুকু ডিশিসন নিতে পারিনা?কথা না বাড়িয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও,আর হ্যা
কবে যাবে জানিয়ে দিও।
রাত্রে খাওয়াদাওয়া শেষে নিজের ঘরে ঢুকে আশার ফটোর
সামনে দাঁড়িয়ে রমেনবাবু বললেন,"গিন্নি,কেমন দিলাম!,বড়টাকে
ফিরতেই হবে নীতার জন্য। ছোটটা যে আসবেনা জানতাম।ভাগ্যিস তোমার কথা শুনেছিলাম!"
দরজার আড়ালে মালা দাদাবাবুর কাণ্ড দেখে আঁচলে দুচোখ মোছে।
মনিভা সাধু