সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শ্রাবণী গুপ্ত সরকার


বন্ধু


দুপুরবেলা মিশাকে ঘুম পাড়িয়ে আজ আর ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো না দর্শনার। আসলে আজ উঠেছে দেরীতে। যেটুকু সময় মিশা ঘুমোয় ঐটুকুই তো অবসর। এত ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে দর্শনা, কত রকম ব্যস্ততা একা হাতে। শৌর্য তো ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত, সেই সকালে স্নান সেরে ভারী ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। মিশাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা, ওর সব দুষ্টুমিকে উপভোগ করেও সাবধানে রাখা, যাতে ব্যথা না পায় লক্ষ্য করা, নাওয়ানো, খাওয়ানোচলতেই থাকে  
ফাঁকে ফাঁকে নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম। ভাবলেই খুব অবাক লাগে দর্শনার-- কলেজে পড়ার সময় কতটা সৌন্দর্য্য সচেতন ছিল সে। প্রত্যেক মাসে বাবার কাছে আবদার করে টাকা চেয়ে নিয়ে বিউটি পার্লারে যাওয়া, নিত্য নতুন পোষাক করানো, শাড়ীর ব্লাউজের ডিজাইন নিয়ে রীতিমত গবেষণা চালানো লেগেই থাকতো। আর এখন কোনমতে স্নানটা সেরে একটু খেয়ে নেওয়া। তারপর আবার মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ততা। আসলে অনেক হতাশায় ভোগার পর বেশী বয়সে যখন হতোদ্যম হয়ে  পড়েছিল ওরা দুজনে তখনই ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতোই যোগাযোগ হল ডাক্তার শুভময় বসুর সঙ্গে। সত্যিই ঘটে গেল জীবনের শুভ ঘটনাটা। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মা হলো দর্শনা। হ্যাঁ, খুব খুব খুশি ও এখন। হয়তো হাঁপিয়ে যায় ছোটাছুটি করে, কিন্তু বিরক্ত হয় না। এই জীবনে মাডাকটা শোনার জন্য একটু না হয় শারীরিক পরিশ্রম হলোই বা। এখন মিশার চার বছর বয়স। ফুটফুটে মেয়ের কচি মুখের কথায় ঘর ভরে থাকে শৌর্য আর দর্শনার। শ্বশুরবাড়ির যৌথ ব্যবস্থায় দর্শনা অনেক সময়ই নানা কাজে ব্যস্ত থাকত। সেই কারণে বেশ কয়েকবার মেয়েটা খাট থেকে পড়ে যাওয়ায় সদ্য কেনা এই ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় ওরা চলে এসেছে। কম ফার্নিচার আর মোটা গদি পাতা মেঝেতেই শোয়ার ব্যবস্থা, তবে একা হাতে সব সামলাতে হয়। শৌর্য ফিরলে মেয়েকে বাবার জিম্মা করে দর্শনা গিয়ে ঢোকে রান্না ঘরে। সারাদিন ফাঁকা ফ্ল্যাটে মিশা অবাধে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে।
ইদানীং মেয়ে একটু বড়ো হয়েছে নিজেই বসে খেলা করে, ব্যথা পাওয়ার ভয়টাও তৈরী হয়ে গেছে ওর। তাই দর্শনা এখন একটু সময় পায় নিজের জন্য। মেয়ে তার ছানাপোনা, রান্নাবাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর কলকল করে কতই না কথা বলে। তাই অনেকদিন পরে একটা রবিবার মেয়েকে বরের কাছে রেখে ও গেল বিউটি পার্লারে। কত বছর পরে অনভ্যস্ত আরাম পেয়ে ফিরে যাচ্ছিল মনে মনে সেই অতীতের পথ বেয়ে ফেলে আসা জীবনে। সেই কলেজ, ইউনিভার্সিটি, বন্ধুবান্ধবের হুল্লোড়, ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখা বা শপিং-এর আনন্দ উপভোগ করা... 
অনেকদিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কোন যোগাযোগই নেই। তাদের কথা ভেবে একটু মনটা খারাপই হয়ে গেল দর্শনার। একসময় যাদের সঙ্গে দেখা না হলে প্রাণ উঠত হাঁপিয়ে আজ কত বছর তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগই নেই। বাড়ি ফিরে সেকথা শৌর্যকে বলতেই, শৌর্য ওকে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। বললো, “এবার একটু ধৈর্য্য ধরে বন্ধুদের নামগুলো খুঁজে দেখো তো, অনেককেই হয়তো পেয়ে যাবে। আজ দুপুরে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে ফেসবুক নিয়েই বসল ও। ভেবে ভেবে পুরোনো বন্ধুদের নাম টাইপ করে করে খুঁজতে লাগল মোটামুটি তিনজন স্কুলের বন্ধু আর একজন ইউনিভার্সিটির হদিশ পাওয়া গেল। ওদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে উঠে পড়ল এখনকার মতো। মিশাকে ফলের রস খাইয়ে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে তো।
অনেক রাতে শৌর্য আর মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর আবার ফোনের নেট অন করলো দর্শনা। খুব ভালো লাগলো দেখে যে সবাই ওর বন্ধুত্ব স্বীকার করেছে। কেউ কেউ ইনবক্সে জানতে চেয়েছে ওর খবর, কি করছে, কেমন আছে, কটা ছেলেমেয়ে এইসব ওঃ! চার বছর আগে এই প্রশ্নটা শুনলেই দর্শনার মনে উঁচু নাগরদোলনা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি জাগত। সব কিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হতো ভাগ্যিস এই ডাক্তার বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। মেয়ের খবর দিল ও খুব গর্বিত ভাবে। বিস্ময়ের ইমোজি ভেসে এল পর পর অ্যাঁ! বলিস কি? তোর মেয়ে এত ছোট?” “আমার তো বড়টা চাকরি করছে। ছোটটা কলেজে  সে কি রে! এখন মানুষ করবি কেমন করে?” এমনকি অর্ণবী, যে ওর বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল স্কুলে পড়ার সময়ে। সেও! দর্শনা উঠে পড়লওঃ! এদের যে কেন এমন কৌতুহল!  
মাস দুয়েক চলছে দর্শনার ফেসবুক। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। দুটো রবিবার কলেজ আর ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে দেখাও হয়েছে। বেশ জমজমাট আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, কিন্তু এতবছর পরে দেখা বন্ধুরা কেবল তাকে এত দেরীতে মা হওয়ার কারণটাই জিজ্ঞাসা করে কেন? কেউ বলে তোর মেটারনিটি ফ্যাট কমা খুব মুশকিল, লেটে মা হয়েছিস তো।  কি সুন্দর ছিপছিপে ছিলি কলেজে। কেউ বলে তোর মেয়েটা বড়ো হওয়ার আগেই তোর তো মাথা সাদা হয়ে চামড়া কুঁচকে যাবে রে?’ কেউ আবার খুব ঘনিষ্ঠ ভঙ্গীতে জানতে চেয়েছে হ্যাঁরে, ও কি টেস্টটিউব বেবি?’ নয়তো ওর সারোগেট মাদারকে কত দিতে হলো?’ কান গরম হয়ে, মাথা দপদপ করতে থাকে দর্শনার। কি সব প্রশ্ন! বাব্বা! এত কৌতুহল এরা কোথায় রাখে? ভীষণ মন খারাপ লাগে। সেই মিশার জন্মের আগে সবাই যখন তাগা, তাবিজ, গ্রহরত্ন ধারণের পরামর্শ দিত ঠিক তখনকার মতো।
এর মধ্যেই একদিন ফেসবুকে একটা গল্প পড়ে ভালো লাগল দর্শনার। যিনি লিখেছেন নামটাও যেন একটু চেনা। সাহস করে একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দিল শ্রীপর্ণা মল্লিককে। ইনবক্সে প্রশ্ন এল আমার সেই কলেজের বন্ধু দর্শনা কি?’ দর্শনা তো খুব খুশি হয়ে উঠলো সেদিন। প্রায়ই ফেসবুকে এই বন্ধুর লেখা বিভিন্ন বিষয় পড়ে, মনটা খুব ফুরফুরে থাকে সারাদিন। একদিন একটা ছোটবেলার স্মৃতি মনে এল দর্শনার। তাই খুব ইচ্ছে হল শ্রীপর্ণার সঙ্গে একটু কথা বলতে। ইনবক্সে ফোন নাম্বার চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা কথা হল দুজনের। মিশা হওয়ার পর আর তেমন বেরোনোই হয় না তো। একদিন   দেখা করলেও মন্দ হবে না। কিন্তু কিন্তু করে দর্শনা বলেই ফেলল শ্রীপর্ণাকে। শ্রীপর্ণাও খুব খুশি হয়েই রাজি হলো একটা রবিবার দেখা করতে। আসলে সে বেচারি সারাসপ্তাহ অফিস করে তো, আর দর্শনারও সুবিধা হবে শৌর্য বাড়িতে থাকলে মেয়েকে রেখে যেতে
যদিও বাড়ির খুব কাছেই একটা শপিং মলকিন্তু দর্শনা একদম না বেড়োনোর ফলে ঠিকঠাক চেনেই না জায়গাটা কাজেই ওর বাড়ির কাছাকাছি শ্রীপর্ণাকে আসতে বলে মনের আনন্দে সাজগোজ করে তৈরী হয়ে নিলো ও। শ্রীপর্ণার ফোন বাজতেই বেড়িয়ে পড়লো। মনে হয় প্রায় পঁচিশ বছর পর দেখা হল দুই বন্ধুর। শ্রীপর্ণা কলেজে যেমন ছোট্ট চেহারার ছিল তেমনিই আছে, কেবল একটা চমৎকার ব্যক্তিত্ব যোগ হয়ে ওকে খুব ঝকঝকে আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। কলেজের সেই দুই বিনুনি বাঁধা সাদামাটা মেয়েটার কোথাও যেন একটা বড়সড় পরিবর্তনও হয়েছে।  
দুজনে মিলে ঐ শপিং মলটায় গেল। শ্রীপর্ণা ওকে চিনিয়ে দিল যত্ন করে। আবার ওরা এখানেই দেখা করবে। বাচ্চা রেখে বেশী দূর না যাওয়াই ভালো। একটু খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা হলো। গল্প তো চলছিলোই, কিছুক্ষণ পরে দর্শনা আর বিস্ময় না চাপতে পেরে বলেই উঠলো, “হ্যাঁরে, তুই তো একবারও জানতে চাইলি না আমার মেয়ে এত ছোটো কেন?” “কারণ নিশ্চয়ই কিছু সমস্যা ছিল।  তাই না? তুই মা হয়েছিস সব অসুবিধা কাটিয়ে এটাই আমার কাছে যথেষ্ট রে কিন্তু জানিস সবাই আমার কাছে এটাই জানতে চায়। আমার খুব অবাক লাগলো যে তোর এ বিষয়ে কোনো  কৌতুহল নেইআমার কৌতুহল ভীষণ কম। আমার নিজেরও সেটা অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু  কাউকে আঘাত করে তার গোপন কথা জানতে আমি খুব অনাগ্রহী। দর্শনার মনে হলো আরো আগে কেন শ্রীপর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ হয় নি? কেনই বা কলেজে তত ঘনিষ্ঠতা ছিল না। এমন  মনের মানুষই তো ওর ভালো লাগে। একবারও মিশার জন্মের বৃত্তান্ত জানতে চায় নি। অথচ একটা সুন্দর খেলনা নিয়ে এসেছে মিশার জন্য। স্বপ্নের মতো সময়টা কেটে গেল। আবার দেখা করবো  হ্যাঁ। ভালো থাকিস। আর ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে যোগাযোগ রাখিস। বাজে কৌতুহলকে প্রশ্রয় দিস না। মেয়ের সঙ্গে তুইও ছোটো হয়ে যা। খুব উপভোগ কর জীবনটা। দর্শনার মনে হল এই মেয়েটা কি করে বুঝে ফেলল ওর মনটাকে এইটুকু সময়ের মধ্যে!
এখন দর্শনা প্রায়ই কথা বলে আর নিয়মিত যোগাযোগ রাখে শ্রীপর্ণার সঙ্গে। সত্যিই অতিরিক্ত কৌতুহল না দেখিয়ে অন্যের আনন্দে আনন্দিত হওয়াই আসল শান্তির সন্ধান দেয় সেটা দর্শনা একদম মনপ্রাণ দিয়ে বুঝেছে। ও হ্যাঁ আজকাল শৌর্যও বেশ মনোযোগ দিয়ে শ্রীপর্ণার লেখাগুলো পড়ছে আর দর্শনাকে আবার নিজের মতো করে সময় কাটাতে বলছে দর্শনা ভাবছে মিশা আরেকটু বড় হলেই ও আবার আগের মত বাড়িতে প্রাইভেট টিউশানি শুরু করবে। সত্যিই তো মেয়ের জন্যই ওকে মনের বয়স কমাতে হবে, হবেই। 


 শ্রাবণী গুপ্ত সরকার