১)
সুগতই আমাকে অপারেশানটা করাতে রাজি
করিয়েছিল। বলেছিল, “আমার জন্যে নয়। আমার কিছু যায় আসে না। তোর নিজের জন্যেই তোকে
এটা করাতে হবে। ভীষণ একটা কমপ্লেক্স তৈরি করে ফেলেছিস তুই মনের মধ্যে ওটাকে নিয়ে।
ওটা চলে গেলে দেখবি অনেক হাল্কা বোধ করবি। আমার চেনা একজন প্লাস্টিক সার্জেন আছেন,
ডাক্তার তপব্রত ব্যানার্জী। ওনার হাত খুব ভালো। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলেছি, উনি
রাজি হয়েছেন তোর সার্জারিটা করতে।”
আমি বাধা দিয়েছিলাম, “তুই কী পাগল হলি?
অত টাকা দেবে কে?”
“আরে বলছি তো উনি আমার চেনা। উনি বছরে
কয়েকটা করে কেস এমনই ফ্রিতে করেন। তোরটাও সেভাবেই করে দেবেন বলেছেন। আমার তো বাড়ি
কিনে হাত একেবারে খালি!”
“সত্যি বলছিস?”
“সত্যি নয়তো কী মিথ্যে? তোকে মিথ্যে
বলে আমার কী লাভ হবে? আমি তো আর জাহাঙ্গিরের স্বর্ণমুদ্রা পাইনি যে তোর অপারেশান
সেটা দিয়ে করিয়ে দেব?”
আমি হাসলাম। সুগত এক নম্বরের ফেলুদা
ফ্যান। তাই কথায় কথায় ফেলুদা গল্পের নাম ঢুকিয়ে দেয়!
ওর কথায় দুম করে রাজি হয়ে গেলাম। খুশি
হয়ে বাড়ি চলে গেল সুগত। আমি আঙ্গুল দিয়ে ক্ষতচিহ্নটাকে ছুঁয়ে দেখলাম। যেমনটা মাঝে
মাঝেই করি ওটা আছে কিনা চট করে দেখে নেওয়ার জন্যে। যেন কোন একদিন দুঃস্বপ্নের মতন
মিলিয়ে যেতে পারে ওটা!
আমার দিদিকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে
পারিনি। তার কারণটা ওই আমার বাঁ কপাল থেকে চোয়াল পর্যন্ত লম্বা একটা ক্ষত চিহ্ন।
যেটার জন্যে প্লাস্টিক সার্জারি দরকার হচ্ছে আমার। আমার বয়স যখন ১০ তখন দিদি ওই
ক্ষত চিহ্নটা এঁকে দিয়েছিল আমার মুখে, মার রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে। কেন
করেছিল সেটা তখনও জানতাম আর এখনও জানি। হিংসে, স্রেফ হিংসে আর রাগ। আমাকে মারাত্মক
হিংসে করত যে সে। ছোটবেলায় আমাকে ওর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর দেখতে ছিল। খুব ফর্সা
ছিলাম আমি, সেটা অবশ্য এখনও আছি। দিদির থেকে অনেক বেশি। আর তার সঙ্গে কুচকুচে কালো
ঝুমড়ো ঝুমড়ো অঢেল চুল। সবাই বলত সব মিলিয়ে আমাকে নাকি একেবারে ডল পুতুলের মতন লাগত।
আমার স্বাস্থ্যও ভালো ছিল, আর দিদি ছিল রোগা পিংলে, শ্যামলা। এমনিতে সুশ্রী কিন্তু
আমার ধারে কাছে নয়! আমি ছিলাম খোলামেলা, প্রাণোচ্ছল আর দিদি ঠিক উলটো, চুপচাপ, সব
কিছু লুকিয়ে রাখা ওর স্বভাব। ভালই চলছিল সব তারপর একদিন আমাদের বাবা দুম করে
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। সব কিছু কেমন যেন বদলে গেল। মা চাকরি নিলেন। আর
বছর দুয়েক পর বাবারই এক পিসতুত ভাই যাকে আমরা কাকু বলতাম তাকে বিয়ে করলেন। আবার সব
কিছু আগের মতন হয়ে গেল আনেকটাই। বাবটু (বাবা নং টু থেকে বাবটু হয়েছিল, আমরা কাকুকে
ওই নামেই ডাকতাম) আমাকে আর দিদিকে খুব ভালো বাসতেন কিন্তু তাও দিদি যেন কেমন হয়ে
গেল। বাবার জায়গায় অন্য কাউকে দেখতে ওর ভালো লাগত না মনে হয়। আরও কম কথা বলত, দুম
দাম রেগে যেত।
তারপর এল সেই ভয়াবহ দিনটা। সেদিন
রবিবার ছিল। মা আর বাবটু সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। দিদি কী একটা পরীক্ষার জন্যে
পড়ছিল। আমি নিজের মনে পুতুল নিয়ে খেলছিলাম। যদিও দশ বছর হয়ে গিয়েছিল তাও তখনও আমি
পুতুল খেলা ছাড়িনি। বাইরের ঘরে রেখামাসি টিভি দেখছিল। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে
আমি তিনটে পুতুল নিয়ে দিদিকে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, “দিদি বলতো ছেলে পুতুলটার বিয়ে
কোন পুতুলটার সঙ্গে দেবো? এই পুতুলটাকে বেশি সুন্দর দেখতে তাই না? এর সঙ্গেই বিয়ে
দিই তাহলে, কী বল?” বলে পুতুলগুলো ওর সামনে মেলে ধরলাম।
দিদি রেগে গিয়ে বলল, “এত বড়ো হয়ে গেছিস
কিন্তু মাথায় কিছু নেই! যা এখুনি আমার সামনে থেকে বোকা কোথাকার!”
বকুনি খেয়ে আমি মন খারাপ করে বাইরের
ঘরে রেখামাসিকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। মাসি দেখে বলল, “হ্যাঁ, ওই পুতুলটাই বেশি
সুন্দর!”
আমি মাসিকে বিয়ের জন্যে লুচি তরকারি
করে দেওয়ার জন্যে বলছিলাম।
মাসি বলল, “দাঁড়াও এই সিরিয়ালের শেষটা
দেখে নিয়ে তারপর করে দিচ্ছি।”
এমন সময় কোথা থেকে দিদি এসে হাজির। আমি
বুঝতেও পারিনি ওর মনে তখন অত রাগ। ওর হাতটা পিছনে লুকোনো ছিল আর সেই হাতে ধরা ছিল
ছুরিটা। পরের মুহূর্তেই প্রচন্ড যন্ত্রণা আর গলগল করে রক্ত। মাসির সিরিয়ালের শেষটা
আর দেখা হয়নি। পাশের বাড়ির লোকজনকে ডাকতে তারা এসে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
সেই ক্ষত সারতে বেশ কিছুদিন লেগেছিল কিন্তু ক্ষতচিহ্নটা রয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি
আর সেই হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মেয়েটি নেই। গোমড়া আর রাগি হয়ে গেছি। অনেক কিছুই
করেছি, পড়াশোনা, চাকরি কিন্তু মনটা ভেঙ্গে গেছে। ওই ঘটনাটার পর থেকে দিদিকে আমি আর
শান্তিতে কোন কিছু করতে দিইনি। পদে পদে ওর ওই ক্ষণিকের ভুলের কথা ওকে মনে করিয়েছি।
আমার মুখে ক্ষতচিহ্নটা এঁকে দেওয়ার পর ওরও আর কিছু বলার ছিল না। ভালো জামা,
খাবারের বড়ো টুকরো, ভালো উপহার সব কিছুই আমার জন্যে বরাদ্দ থাকত। দিদি অবশ্য চাইতও
না কিছু। সে চাইলে বরং তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি বেশি আনন্দ পেতাম কিন্তু
আমাকে সেই আনন্দ পেতে দেয়নি সে কোনদিন। সেটা শুধু এক ঝলক মনে হয়েছিল সুগতর
ব্যাপারে।
সুগত আসলে আমার দিদির ক্লাসমেট ছিল।
দিদিই ওকে আমাদের বাড়িতে এনেছিল। অবশ্য দিদি এনেছিল বললে ভুল হবে, সুগতই দিদির
খোঁজ করতে এসেছিল। দিদি তখন এম এস সি ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। আমি সবে বি এস সিতে
ঢুকেছি। একদিন কলেজ থেকে ফিরেছি এমন সময় দরজায় বেল। বাড়িতে আর কেউ ছিল না তাই আমিই
গিয়ে দরজা খুললাম।
সুগত দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে যেন একটু
ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি মানে ইয়ে অনুকে খুঁজছিলাম, অনু আছে বাড়িতে?”
আমি বললাম, “কোন অনু? দিদি অনুপমা আর
আমি অনুমিতা। আপনি কাকে খুঁজছেন?”
সুগত হেসে ফেলেছিল, বলেছিল, “আমি
অনুপমাকেই খুঁজছিলাম, আমরা একসঙ্গে এম এস সি তে পড়ি।”
“দিদি এখনও বাড়ি ফেরেনি। আপনি চাইলে
ভিতরে এসে বসতে পারেন।”
ভিতরে এসেছিল সুগত আর সেদিন প্রচুর
গল্প করেছিলেম আমরা। ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে সেটা বুঝেছিলাম। অন্য ছেলেরা
যেমন আমার ক্ষতচিহ্নটাকে দেখে হাঁ করে থাকে বা ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয় সেই রকম
কিছুই করেনি সে। একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছিল। ওই চিহ্নটার জন্যে আমাকে
অর্ধেক বা না-মানবী মনে করেনি সে।
ঘন্টাখানেক পর দিদি ফিরে আমাকে সুগতর
সঙ্গে গল্প করতে দেখে ওর মুখটা কী সত্যিই কালো হয়ে গিয়েছিল না আমার কল্পনা বলতে
পারব না। কিন্তু তারপর থেকে আমার প্রায় রোজই সুগতর সঙ্গে দেখা হত। আপনি থেকে তুমি
তারপর তুই – হুহু করে নিবিড় হয়ে উঠেছিল সম্পর্ক। একেকবার আমার মনে হয়েছিল দিদির
বুঝি বা সুগতকে পছন্দ ছিল কিন্তু মুখে কিছু বলে উঠতে পারেনি। যা, পারেনি তো
পারেনি! আমার লাভ! দিদির মুখের সামনে থেকে খাবার ছিনিয়ে নিতে আমার বরাবরই ভালো
লাগে।
এম এস সি শেষ করে দিদি জি আর ই দিয়ে
অ্যামেরিকাতে পি এইচ ডি করতে চলে গেল। আর ফিরল না। বাবটু মারা গেলেন তাও এল না।
এখন শুনি সে নাকি পি এইচ ডি শেষ করে কোন একটা কলেজে পড়াচ্ছে। ফেসবুকে বন্ধু আছে
আমার সঙ্গে তাই মাঝে মাঝে এটা সেটা দেখি। যদিও ও একেবারেই অ্যাকটিভ নয় কিন্তু অন্য
লোকজন ওকে ট্যাগ করে তাই দেখতে পাই। আমার সঙ্গে কথা প্রায় নেই বললেই চলে। মাকেও
ফোন টোন করে না। যার কাছে মাঝে মাঝে ওর খবর পাই সে হল রেখামাসি! মাসির ছেলেটা
ভালোই দাঁড়িয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে একটা সফটওয়্যার কম্পানিতে চাকরিও করছে তাই
মাসিকে আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হয় না। দিদি মাঝে মধ্যে রেখামাসিকে ফোন করে
নাকি।
সুগত আমাকে প্রোপোজ করেছে সেই খবরটা
জানাতে মা ওকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন বিয়ের ডেটটা ওর আসার সুবিধা মতন ঠিক করা
হবে। তাতে নাকি দিদি বলেছিল, “ওদের বলো যে কোন দিন বিয়ে করে নিতে। আমি যেতে পারব
না।”
তা বিয়ে আগাস্ট মাসে ঠিক হয়েছে। এখনও
মাস ছয়েক বাকি তাই সুগত সার্জারিটা করিয়ে নিতে জোর দিয়ে বলতে শেষমেশ রাজি হয়ে গেলাম। ডাক্তার
ব্যানার্জীর নাম অনেক দিন থেকেই শুনছিলাম। উনি রাজি হয়েছেন অপারেশানটা করতে তাই
শুনেই আরও খুশি হয়ে হ্যাঁ বলেছিলাম। এতদিন ধরে আমি যেন কিছুটা ইচ্ছে করেই
ক্ষতচিহ্নটা রেখে দিয়েছিলাম দিদিকে পদে পদে মনে করাবার জন্যে।
(২)
তবে একটা সার্জারিতে হল না। চারটে
অপারেশান লাগল। তারপর আমার মুখ দেখে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কোথায়
দাগ কোথায় কিছু, সব মিলিয়ে গেছে। একেবারে আগের মতন না হলেও অনেকটাই কাছাকাছি।
বিয়ের এক সপ্তা আগে হঠাৎ একদিন রাতে
সুগত আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। রাত মানে রাত এগারোটা। মা তখন খেয়ে দেয়ে শুয়ে
পড়েছেন। আমি নিশাচর প্রাণী, রাত ১২-১টার আগে ঘুমোতে যাই না তাই জেগে ছিলাম। ওকে
দেখে বললাম, “কিরে এত রাতে? ভিতরে আয়!”
সুগত কিন্তু আমার ঘরে যেতে রাজি হল না।
বাইরের ঘরেই বসল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বল তো?
কিছু বলবি?”
লজ্জিত মুখে সে বলল, “অনেকদিন ধরেই
একটা কথা বলব বলব ভাবছি কিন্তু বলতে পারছি না। আমি মিথ্যেবাদী নই তাই মিথ্যে বলতে
বিবেকে খচখচ করে বাধছে! তাই আজ মনে হল অত বড়ো মিথ্যে নিয়ে তোকে বিয়ে করাটা ঠিক হবে
না আমার!”
আমার বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠল। গুম
গুম করে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে আর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কী
মিথ্যে কথা বলেছে সুগত আমায় রে বাবা? এমনিতেই অনেক কষ্ট করে মানুষকে বিশ্বাস করতে
শিখেছি আর এখন যদি। তাও মন শক্ত করে বললাম, “কী মিথ্যে কথা বলেছিস আমাকে?”
সুগত বলল, “ডক্টর ব্যানার্জী বিনি
পয়সায় তোর অপারেশানটা করেননি। সত্যি বলতে কী ওনার মতন ডাক্তারকে ওই কথা বলাও যায়
না। তুই ওটা বিশ্বাস করলি কী করে আমি জানি না। ওনার বিল হয়েছিল...।”
টাকার অঙ্কটা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম।
সুগত নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে। বিয়ের পর আমরা সেখানে গিয়ে থাকব। ওর পক্ষে তো এখুনি অত
টাকা দেওয়া সম্ভবই নয় আমি জানতাম।
“অত টাকা কে দিল?” আমি ভয়ে কাঠ হয়ে
জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরটা আমি জানতাম তাও প্রশ্নটা করলাম।
মাথা নীচু করে সুগত বলল, “অনু মানে
অনুপমা,” ও আমাকে বরাবর মিতা বলেই ডাকে আর দিদিকে অনু।
“অনু আমাকে বলেছিল তোকে জোর করে
সার্জারিটা করিয়ে নিতে। তোর যা রাগ অনু পয়সা দিয়েছে শুনলে তুই কোনদিন অপারেশানটা
করাতে রাজি হতিস না আমি জানি!”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। খুব রাগ
হচ্ছিল সুগতর ওপর। ও কেন আমাকে দিয়ে কাজটা করালো? ঋণী করে রাখল আমাকে? আমি প্রচন্ড
চিৎকার করলাম সুগতর ওপর। বিয়ে ভেঙ্গে দেবো ইত্যাদিও বললাম। একটা কাচের প্লেট ছিল
হাতের কাছে সেটা ছুঁড়ে মারলাম। খুব বাজে টিপ বলে ওর গায়ে লাগল না, মাটিতে পড়ে
ভেঙ্গে গেল সেটা আলাদা কথা। তবে ও চুপ করে সব শুনল। কোন প্রতিবাদ করল না। ভাগ্যিস
মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন তাই কিছু শুনতে পেলেন না।
আমার রাগের ঝড় কিছুটা শান্ত হতে আমি
সোফার ওপর নেতিয়ে পড়লাম।
“এবার আমি যাই। তবে তুই ভুল করছিস
মিতা! কোনদিন তোর সময় হলে রেখামাসিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করিস,” বলে সুগত চলে গেল।
আমি গুম হয়ে বসে রইলাম। সুগতর শেষ
কথাটার মানে কী?
(৩)
আমি কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সকাল
হতেই রেখামাসির বাড়িতে ছুটে গেলাম অফিস কামাই করে।
মাসি আমাকে দেখে খুব খুশি, বলল, “তোমার
বরও তো এসেছিল গো দিদি সেদিন। খুব ভালো ছেলে। সে নাছোড়বন্দা। তাকে সব কিছু বলতেই
হবে!”
আমার বুকের ভিতর ট্রেন চলতে শুরু করল,
“কী বলতে হবে?” আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“তোমাদের বাড়ির সব কথা গো। আমাকে কেউ
কিছু বলেনি কিন্তু আমি সব বুঝেছিলাম। আসলে আমরা যারা বাড়িতে বাড়িতে কাজ করি তারা
অনেক কিছুই জেনে যাই সবার অজান্তেই!”
রেখামাসি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মহিলা আমি
জানতাম। গ্রামে অভাবের সংসারে মানুষ তাই পড়াশোনা করার সুযোগ পায়নি। তাছাড়া খুব কম
বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে আর বরের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়, তাই বাড়ি বাড়ি কাজ করতে
হয়েছে। এখন ছেলে দাঁড়িয়েছে বলে নিশ্চিন্ত।
“কী জানো তুমি? কী আন্দাজ করেছো?”
রেখামাসি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তোমার মা তোমার ওই কাকুকে বিয়ে করে বাড়িতে এনে খুব ভুল করেছিলেন। অনুদিদি তখন বড়ো
হয়ে উঠছে। তার দিকে কুনজর দিতে থাকে ওই লোকটা। ওর গায়ে হাত দিতে আমি নিজে দেখেছি
কয়েকবার!”
রেখামাসির কথা শুনে আমার শরীর অবশ হয়ে
গেল। থর থর করে কাঁপতে লাগলাম আমি। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মনে পড়ে গেল দিদির
সেই চুপ করে যাওয়া অসহায় মুখ।
“মাকে বলেনি কেন দিদি?”
“বলেছিল বা বলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু
তোমার মা বিশ্বাস করেননি। ও মিথ্যে কথা বলছে বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কেউ মরে গেলে
তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে নেই কিন্তু আসলে ওই লোকটা খুব শয়তান ছিল। তোমার মার
সামনে তার অভিনয় একেবারে অন্য রকম ছিল আর তোমার মা যখন বাড়িতে থাকতেন না তখন তার
অন্য মূর্তি ছিল!”
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলার মতন
পেলাম না।
রেখামাসি এবার কেঁদে ফেলে বলল, “তোমার
সুন্দর মুখটা নষ্ট করা ছাড়া তোমাকে বাঁচাবার আর কোন উপায় সে খুঁজে পায়নি গো দিদি।
সেও তো তখন ছোট। তবে ওতেই কাজ হয়েছিল, খুঁত আছে বলে তোমাকে রেহাই দিয়েছিল অসুরটা।”
আমার ঝপ করে মনে পড়ে গেল যে আমি দুটো
পুতুল নিয়ে ওর কাছে গিয়েছিলাম ছেলে পুতুলটার সঙ্গে কার বিয়ে দেব জিজ্ঞেস করতে! আর
বলেওছিলাম সুন্দর পুতুলটার সঙ্গেই বিয়ে দি।
বাইরে যখন বেরলাম তখন অঝোরে বৃষ্টি
পড়ছে। রেখামাসি ছাতা দিচ্ছিল কিন্তু আমি নিলাম না, বললাম ছাতাতে কিছু হবে না এই
তুমুল বৃষ্টিতে। চোখের জল আর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কোন রকমে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়ি ফিরে দিদিকে ফোন করলাম আমি। রেখামাসির
কাছ থেকেই ওর ফোন নম্বরটা নিয়েছি। ও ফোন ধরল না তাও আমি কাঁদতে কাঁদতে মেসেজ
ছাড়লাম, “তোকে আমাদের বিয়েতে আসতেই হবে দিদি! আমি জানি তুই আমাকে কত ভালোবাসিস।
দেখি কী করে দূরে থাকিস তুই!”
অনন্যা দাশ