কাব্যে রহস্যবোধ ও আশ্চর্য মনোভূমি
মহান ভাবনা ও শুদ্ধতম সত্তার একত্রতার নামই সাবলাইম। তাকেই আমন্ত্রণ করতে হয় কাব্যে ,কবিতায়।কবির মনোভূমিতে আলো আঁধারের একটা অনৈসর্গিক খেলা রয়ে গেছে । সেখানে অদ্ভুত অন্তর্লোকটি আংশিক অনাবৃত।একমাত্র কবির excellence of expression তাকে অবিনাশী গৌরব দিতে পারে।তাই আবৃতকে অপসারিত করে লেখক ও কবিকে লাভ করতে হয় একটা স্রষ্টা-শোভন অহম-বোধ। এইই নন্দনচেতনা।যেখানে কাব্যকবিতা আংশিক আবৃত সেখানে এক হিরণ্ময় আবরণই আড়াল ক'রে রাখে সত্যকে। এরই চারপাশে ঘিরে আবর্ত রচনা করে সৃষ্টিরা। সেই সব সত্যই মুক্তি খোঁজে মিষ্টিক কবিমনে। মিস্টিক দের রচনায় তাই সাবলাইম কে ছোঁয়ার আকাঙ্খা প্রবল হয়। সেই সময় অর্থাৎ সৃষ্টিলগ্নে শব্দেরা ভিড় ক'রে আসে নিঃশব্দে। চারদিক ঘিরে সন্তর্পনে বিছিয়ে দেয় রহস্য-রোমান্সের ইন্দ্রজাল। আত্মমগ্ন সৌভিক-কবিহৃদয় নিজেরই অজান্তে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যায় সেই রহস্যলোকে..... !টেনে আনে কাব্যসত্যের উদ্ভাস ―― কাগজে, কলমে, অক্ষরে।এভাবেই মিষ্টিক অনুভবের ভ্রূণে জন্ম নেয় Occult Poetry.....রূপে, রসে, বর্ণে , বিলাসে কাব্যময় হ'য়ে ওঠে শুভাত্মিক ভাবজগৎ (Psychic) ......এরই আকর্ষণ ছড়িয়ে যায় মাটিতে, ঘাসেতে, ফুলেতে, মানুষে...।তাদের অনুভব, অনুরাগকে রহস্যের গাঢ় রঙীন মখমলে মুড়ে ঋষি কবিরা তৈরী করে দেন ঐশী ও মানুষী চেতনার পূণ্য মিলন-ভূমি।সেই মর্মজ্ঞান উন্মুক্তি পেলে, সে পথেই চলে।মরমীয়া সাধনার ক্রমপ্রসারণ একেই বলছি। তা চলে প্রকৃতি থেকে অপ্রাকৃতে, মন থেকে মনাতীতে, ধর্ম থেকে বিশ্ব-বন্দনায় এবং তারও ওপারে।ঐ রহস্যলোক থেকে ভেসে আসে গোপন জগতের চিরনতুন উদ্ভাস, সুর বেজে ওঠে বেদে, বেদান্তেঃ―
"ন তত্র সূর্যোভাতি ন চন্দ্রতারকম নেমা
বিদ্যুতোভান্তি কুতোহয়মগ্নি : তমেব ভান্তিমনুবাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং
বিভাতি"-―
―সূর্য নয়, চন্দ্র নয়, নয় তারকারাজি
নেই বিদ্যুৎদীপ্ত আলোক,
নেই অগ্নিরও ইশারা......।
সে জ্বলে, তাই সকলেই জ্বলে,
তারি আলোকে সব আলোময়।"
(ভাবানুবাদ)
মিষ্টিক কবিতার শ্রেষ্ঠ বাণীলিখন এখানে
পূর্ণ-স্বাগত।
মনাতীতের বাণী বহনকারী ঋষিকবিরা সৃষ্টি করেন মন্ময় অথচ বিশ্বাতীত চেতনার প্রহরায় এক আধ্যাত্ম-বরভূমি। মানুষের ধারণা-শক্তির মধ্যে সচেতনে বা অবচেতনে যা ধরা পড়ে তাই-ই সত্য হ'য়ে নামে, ধর্মে, বিজ্ঞানে, কাব্যে, সাহিত্যে ও জীবনে। বস্তুত , অনন্ত এই মিষ্টিক খেয়াল ভারতের নিজস্ব সম্পদ।
কেল্টিক স্পন্দমান রহস্যতরঙ্গ অদ্ভুত সব শব্দযোজনা করে, লক্ষ্যের দ্বি-খাত পথে তারা শুধু আসে আর শুধু চলে যায়, আর রেখে যায় অর্ধ আবিষ্কৃত এক আলোআঁধারি জগতের প্রত্যন্ত ইশারা। আধ্যাত্ম শীর্ষ স্পর্শ করেও তাই ঐসব তরঙ্গগুলো পুনঃ মিশে যায় মৃত্তিকার লোনা স্বাদে সুখ-দুঃখময় মানুষী জীবনের পরিণতিতে। মিষ্টিকতা তো এ জগতের উত্তরাধিকার।এখানেই ধর্মের মৌল অনুভবে এসেছে বিপাশনা।যদিও স্ফূর্তির রেখা, তরতম স্তর ছুঁয়ে গেছে।তন্ত্র, বেদ, পুরাণ, চর্যা, বিষ্ণুগীতি, মঙ্গলকাব্য, রামায়ণ, মহাভারতের জগৎ থেকে আধুনিক কাব্যজগতে পর্যন্ত ছেয়ে আছে ঐ মিষ্টিক চেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ।
শুধু ভারতবর্ষেই নয়, এই প্রাণিক-সম্পদ স্পর্শ করেছে সারা পৃথিবীকে। পৃথিবীর মহামানবদের... কবি ও সাহিত্যিকদের।এতবড় ক্যানভাসে যার বিস্তৃতি তাকে বিপরীত অনুবীক্ষণে দেখার নামই কাব্যে রহস্য চেতনার দিগন্ত উন্মোচন।মিষ্টিকতা আধুনিক কবিমনের একটি পূর্ণকল্প সিদ্ধধারণা যার উত্তরাধিকার সৃষ্টির রহস্যে আজও থেকে গেছে বলে মনে হয়।বাংলার চর্যাগীতিতে, তার লিখিত প্রকাশেই প্রথম দেখি মিষ্টিক কবিদের শ্রেষ্ঠ পদসঞ্চার।ধর্মই মূলতঃ আবেদন রেখেছে এসব কবিতায়, তবু এগুলিই তাপস-কবিদের মনোধর্মে জারিত হয়ে , মিষ্টিক হয়ে, ধরা পড়েছে সহৃদয়-সমাজের কাছে।দোঁহাও এই শ্রেণীভুক্ত রচনা। চোখ রাখলেই দেখা যায় এই ধর্মীয় ভাবনার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই জীবন, যেখানে চণ্ডালী ও শবর-রমণীর রূপের আড়ালে কিম্বা ডোম্বী রমণীর চোখের পাতা ছুঁয়ে যাওয়া করঞ্জার ফুলে অথবা তারই গলার গুঞ্জমালায় উপচে পড়েছে উন্মত্ত শবরের উষ্ণ-নিঃশ্বাস। এই গভীর মর্ত্য-সম্পৃক্তির মধ্যেই চর্যার কবিরা ধরে রেখেছেন তাঁদের মিষ্টিক চেতনার সূর্য-ফসল।
এর অনেক পরে বিষ্ণুকথার ধারায় এসেছে বৈষ্ণব পদাবলীর স্রোত চৈতন্য রেনেসাঁসের হাত ধরে....কী আশ্চর্য আধুনিক মিষ্টিকতা সেখানে।বৈষ্ণবকবিরা সেই ধর্মভাবনার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে রাধাভাবে ভাবিত তাপস কবি বলে ওঠেন : " শীতের উড়নি পিয়া। গীরিষের বা"......
সেই ডোর এল।এল আধুনিক চিন্তাজগতের দুর্মর প্রকাশক্ষণ।চূড়ান্ত মিষ্টিক কবিভাবনায় বিহারীলালের ত্রিবিধ সরস্বতী কল্পনা উন্মোচিত করল নব মায়ালোক (সারদামঙ্গল) হয়ত বা কিছু আগে আর পরে.....!!
"And blackening clouds in Thunder, speaks of
God!"
'বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি সে কি সহজ গান।'
একটা অতিসারী কেল্টিক জগৎ রহস্যই এখানে ইঙ্গিতীত।
এভাবেই মিষ্টিক প্রকাশ চুঁয়ে পড়তে পড়তে বাণীমূর্তি
লাভ করেছে রবীন্দ্রনাথে-―
"আমি সেই পথের পথিক
যে পথ দেখায়ে চলে দক্ষিণে বাতাসে;
পাখির ইশারা যায় যে পথের অলক্ষ্য আকাশে।'
"অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার তরু সারে সারে
মন হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে"
(রবীন্দ্রনাথ)
রবীন্দ্রনাথেই দেখি 'প্রথম দিনের সূর্য' প্রশ্নের উত্তর পায়নি, অস্তকালেও পায়নি উত্তর কোনো,
তবু সেই নিরুত্তর নির্বাক স্থিতি ছিল আলোকময়।
এই আলোই ঝরণাধারা হয়ে বর্ষিত হয়েছে ঐশী অনুভবে।――
"আমার নইলে ত্রিভুবনেশ্বর
তোমার প্রেম হত যে মিছে"
― অর্থাৎ ভগবৎ সম্পৃক্তির বহিপ্রকাশে কবির
মনে হয়েছে আমি আছি তাই তুমি আছ। তুমি আছ আমার চেতনায়, concept-এ, রহস্যমাধুর্যে, মিষ্টিক
ভুবনে।
একেবারে আধুনিক, আত্মনিমগ্ন, এক
মিষ্টিক কবি, কবি অগ্নি বসু ভিন্নসুরে, ভিন্নস্বাদে ঐ কথাই বলেছেন:
"সারাটা প্রহর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছ,
এ পাড়া থেকে ও পাড়া, মাঠ থেকে বনান্ত।
এখন, এই সন্ধেবেলায়,
আমার আঙিনায় এসে বসেছো।"
―কীইই গভীর একাত্মতায় কবি বলেই চলেছেন সেই এক অদৃশ্য সত্তার
সঙ্গে কথার পর কথা...
"কাছে গিয়ে বললাম,
শুনছ, যাও কুয়োতলা গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এস, প্রসাদটুকু দিই তোমায়।"
―অথবা নিবিড় নৈকট্য বোধে আত্মলীন কবি বলেছেন ::
"এস আসন পেতে দিই"। প্রাণের সাযুজ্য যেখানে এক, কবিমন সেখানে এক
সুরেই বাজে।
কবিকৃতির
তরতম সে তো শুধু আমাদের মত সাধারণ মানুষের মনে যা এখনও ভেদতত্ত্ব মেনে চলে রন্ধ্রে
রন্ধ্রে।
মিষ্টিকের অবিচ্ছিন্ন ধারায় খণ্ডকালের চেতনাই পৃথক
বলে মনে হয়।
বিপ্লবে, মধুরে দহনে,
উপশমে কবিদের মিষ্টিক মন শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে অখণ্ড প্রবাহটিকে
চৈতন্যের সাযুজ্যে (Stream of consciousness)।
এখানেই এক নিশ্চেতনার কবিও একদিন ছিপ ফেলে বসে
ছিলেন অ-বোধ বিস্ময়ে। মাথার ওপর হলদে-নীল রহস্যময় শামিয়ানা ঢেকে। সে কবি জীবনানন্দ
দাশ।
সৌন্দর্য-তনু প্রেমের পরীরা তাঁকে জ্যোৎস্নারাতে
ধানক্ষেতের উপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেত এক অতীন্দ্রিয় রহস্যলোকে...... তারই দৃশ্যপট
কবি স্বয়ং বুনেছেন আলো আঁধারি ভাষায় :--------
"ঘাসের ভিতর ঘাস হ'য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদু অন্ধকার থেকে
নেমে।"
এ স্বাদ মরমী কবির সুধাপাত্রে রাখা আছে বিস্তর, সমাদর চায় তারা
মরমী প্রাণে। প্রেমবোধেও গভীরভাবে মিষ্টিক কবি আত্মমগ্ন। এ প্রেম যদি কোন মর্ত্য
মানবীর মনপ্রদীপের শিখা হয়ে জ্বলে তবু তা হয়ে যায় ঊর্ধ্বচারী, বিমূর্ত, রহস্যঘন।
এ প্রেম শুধু বিপ্রলম্ভের মধুরতা পায়, পায় ঐশী স্পর্শ।
মনে হয় মিলনে প্রিয়াই
থাকে বিশ্বকে আড়াল ক'রে আর বিরহে ত্রিভুবন একাকার হ'য়ে যায়।
এই ভাবাবেশ বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়, সম্পূর্ণ
মিষ্টিক।
কবির স্বপ্নসুন্দরী অপাঙ্গে ডাক দেয় কিন্তু তা
অপার্থিব লোকে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় এই নিছক তন্ময়তাই ঘুরে
ফিরে এসেছে―"ভ্রূপল্লবে
ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে।"
কবি জীবনানন্দ প্রেমের অতীন্দ্রিয় সাধনায় মগ্ন থেকে
বিরহী ছায়াসঙ্গিনীকে নিত্য আহ্বান করেছেন―
"নিরালায় সুর সাধি ―বাঁধি মোর মানসীর বেণী
মানুষ দেখেনি মোরে কোনোদিন, আমারে
চেনেনি।"
আধুনিক কালে কবি উৎপল বসু নিভৃতে সেধেছেন রহস্যঘন
এমনি একটি সুর, যার জৈব উষ্ণতা ছাড়িয়ে গেছে দেহান্তরে কিম্বা তারও ওপারে। প্রেমের
উত্তুঙ্গ শীর্ষ ছুঁয়ে কবি বলেছেন ::―
"আমি তোমার স্বপ্নে পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকার।"
প্রকৃতির মধ্যে প্রেমের ভরাডুবি হ'লে কবি জয়
গোস্বামীও বলেন ::
"অন্ধ যখন বৃষ্টি আসে আলোয়
সঙ্গে এলো বাংলাদেশের নদী
বললো, 'তুমি কোন সময়ে থাকো?
গিয়ে তোমায় ঘরে না পাই যদি?"
― অন্তশ্চেতনার অধিবাস সেরে কবি জয় যেন নতুন
বাসর রচনা করেছেন
প্রশ্নের পরে প্রশ্ন সাজিয়ে, উদ্ভাসিত এক
মিষ্টিক মায়ালোকে। এই অদ্ভুত মায়ালোক সৃষ্টিতে কবি অগ্নি বসুও তুলনা-বিরল
কবিব্যক্তিত্ব। কবির স্বপ্ননারী প্রকৃতির অনুষঙ্গে প্রিয় অনুরাগের সিঁদুর-লেখাটি
নিয়ে ভেসে যায় ::
"অথৈ আবীর দিগন্তের
কে দিয়েছে সীমন্তে?"
বিশ্বমুখী বিস্তারের পথে ভেসে যেতে যেতে প্রকৃতির কৌণিক রেখায়, যেখানে আকাশ আর
মাটীতে কানাকানি চলে, হয় ফিসফিসিয়ে আলাপ, সেখানে কবিচিত্তের বিচিত্র দ্বন্দ্ব দেখি― একজন পথিক,
অন্যজন প্রেমিক, একজন বাউল আর অন্যজন গৃহস্থ।
তাই
কবির মিষ্টিক প্রেম বিদেহী-স্নিগ্ধতায় সিঁদুর পরে লুটিয়ে থাকে দিগন্তের মাটীতে-―গার্হস্থ্য পাতবার আকুলতায়।
জীবনানন্দের স্বতোস্পন্দিত আবেগই যেন এসে মিশেছে
এইসব উত্তরসূরী কবিদের প্রাণে। জীবনানন্দের কাব্য মায়ার আবেশে তাই পৃথিবী তাকিয়ে
থাকে মুগ্ধ বিস্ময়ে ::
"সমস্তদিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল"
অথবা―
"পাখির নীড়ের মত চোখ" তুলে কবিরই
কল্পপ্রিয়ারা সবাই, বনলতা সেনের আশ্রয়-ময় দুটি চোখে অরূপের
আহ্বান আনে মিষ্টিক প্রেম-বিহ্বলতায়।
এর থেকে বেশী কিছু চাইলে মৃত্যু আসে প্রেমকে ঢেকে
দিয়ে, হাতড়াতে হয়, লাশকাটা ঘর ::―
"কালরাতে ফাগুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ'ল তার সাধ।"
―কবির অভিমত এই যে সব পাওয়া শেষ
হলে, "আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে।"
জগতকে
সর্বৈব দেখতে চাওয়ার যে আলো কিম্বা যে আঁধার থেকে যায় মানুষের মনে, তারি প্রচ্ছন্ন
প্রতিভাস এ কবিতার কোণে কোণে রয়েছে। সদ্যমরণের লোনা, কটু
স্বাদ যায়নি এখনো যার মুখ থেকে, অন্তিম আকাঙ্ক্ষায় লাশকাটা
ঘরে শুয়ে শুয়ে সেই এক কবিও ভেবেছিল ::―
"কে তাকে দিয়েছিল, নীলবিষ
অপাঙ্গে সোহাগে'
― মিষ্টিক জীবনবোধের
অনালোকিত জুগুলার কবি প্রমোদ বসু এই morbid
ছবি এঁকেছিল, জীবনকে কবোষ্ণভাবে পাবে বলেই।
বুদ্ধির সঙ্গে সদ্যজাগা অন্তরাত্মার একটা অনতিস্ফুট
দৃষ্টি ও চেতনা মিশিয়ে নিয়ে কবি বিষ্ণু দে ও তাঁর অনুগামী হরপ্রসাদ মিত্র তৈরী
করেছেন তাঁদের মিষ্টিক জগৎ―― যা ছিল মূলত তাঁদের তত্ত্ব ও আদর্শজ্ঞাপক পটভূমি, কিম্বা
হয়তো শুধু তা নয়, তারই ভেতরে থেকে গেছে রহস্যময় কবিচেতনার
মনোলোক ::―
"কাল কত রাত জানিনা তখনো
আকাশগঙ্গা ধারার নীচে
মনে হল যেন, হংসবলাকা,
হংসবলাকা কথাটা মিছে
উদার জোনাকি আহরণ শেষ
মাঠ ছেড়ে যায় অন্য মাঠে
নিজের মনের গভীরে শুনেছি
কে যেন কোথায় পাথর কাটে।"
-―এখানে কবি হরপ্রসাদ মিত্র
মিষ্টিকতাকে দিয়েছেন সম্পূর্ণ অন্যমাত্রা।
শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসে দেখেছি , যাযাবরী ইতিহাস
ছড়িয়ে যায় দেশান্তরে, বুঝি গ্রহান্তরেও, যুগকে পরপর ডিঙিয়ে । তা সীমাবদ্ধ থাকে না কিছুতেই। তাই মনের গভীরে
"যে পাথর কাটে" তার
ডাক কবি শুনতে পান..... মন থেকে অন্যমনের অভিভ্রমণে
(Capitalistic
Theory / Lenin)।
ঠিক এমনটাই প্রায় বিষ্ণুদের কবিতাতেও শোনা যায় ::―
"চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি
কোথায় ঘোড় সওয়ার"
―ঘোড়সওয়ার সেই বিপ্লবের প্রতীকি
দ্যোতনা যা আসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে,
হয়ত কখনও সখনও শান্তির পথ ধ'রেও।
ঘোড়ার উল্লম্ফন (উল্লম্ফন তত্ত্ব/ মার্কস) ও
ঘোড়সওয়ারের এগিয়ে যাওয়ার গতিশক্তি উক্ত তত্ত্বেরই মিষ্টিক ছাপ রেখে যায়।
মিষ্টিক জগতেও চলেছে বিপ্লব, এসেছে পরিবর্তন,
দেশে দেশান্তরে, চেতনায়, অধিচেতনায়...।
তাই বিদেশী কবিদেরও মিষ্টিক সুরটি প্রাণে বেজে ওঠে
একই হৃদয়বেদ্য আস্বাদনায়।
ফরাসী কবি আরাঁগ-এর কবিতাতেও তাই পাই মিষ্টিক
অনুরাগ ::―
"La unit trade a venir alccses riolons
Les longs soirs a nouveau cueillent La violette"
"জানো, রাত্রির
দেরী হয় কেন?
কেন আসে ত্রস্তপদে বীণাকারেরা,
একে একে জড়ো হয়; দল বাঁধে তবু রয়ে যায় দীর্ঘ সন্ধ্যা;
যেন ঐ 'ভায়োলেট' ফুলসব
কাহাদের সংগ্রহে থাকে।।' (ভাবানুবাদ লেখিকার)
――আশ্চর্য মিষ্টিকতা জড়িয়ে আছে এইসব
কাহাদের 'ভায়োলেট' সংগ্রহের অনুপম অ-বোধ্য ভাবনায়।
আসলে দেশকালপাত্র নির্বিশেষে সার্থক কাব্য হাতছানি
দিয়ে ডাকে অজানা কাব্যসত্যকে, স্বকীয়ছন্দের 'সুপথ-যান'
-এ....(দেবযান অর্থে। ছান্দোগ্য)
স্বপ্নজগতেই কবিসত্তারা বিশ্বাতীতের কথা শুনতে
পায় আর মনে ভেসে ওঠে মিস্টিক উদ্ভাস::― "মন্ত্রলাগে তারাময় ভোরে" (অমিয়
চক্রবর্তী)।
এ মন্ত্র কানে কানে ভাসে........ সেসব জগৎ থেকেই
কবিরা বহন করে আনে চেতনাবাহী শব্দের মিছিল।
তারা নেমে আসে কবিপ্রাণে ইচ্ছার দোসর হ'য়ে আর সম্পূর্ণ হ'লে সেসব ইচ্ছার পাহাড়, শব্দ যোজনে অসিধার-বাক্যেরা
মানুষী হৃদয় করে দেয় তোলপাড়। ছুঁয়ে ছেনে দ্যাখে বিভুঁই হৃদয় যত অনাগত অদৃশ্য
ইশারায়। এ পথেই প্রেম আসে সিংহ ভাগ ঈশ্বরীয়-আকাশ জুড়ে, দেহজ
অস্তিত্বের উতলাপারে কিম্বা মাটীর প্রদীপে জ্বলে ওঠা গগনপ্রসারী এক
পূত-আকাশচারিতায়।
কবি নেলী স্যাক্স (ইহুদি সাহিত্যে ১৯৬৬-তে নোবেল
পুরস্কার প্রাপ্ত) ―এর
কবিতায় জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকের সুর ছাড়িয়ে ধ্বনিত হয়েছে জীবনের পরম আশ্বাস...
আশাবাদেই তাঁর উত্তরণ হয়েছে, তবুও তাকেও ঘুরে
ঘুরে ছুঁয়ে যেতে হয়েছে আলোর বিপরীতে এক মিস্টিক পর্দায় ঠেস দেওয়া বিপন্ন বিদেহ
মনকে , একান্ত আত্মমগ্নতায়
::――
"DIESE NACHT
Ging Ich eine dunkle Nebenstrafse
Um die Ecke
Da Lagte sich me in Schatten
In meincer Arm."
"নিশুতি নিশিথে, অন্ধবর্ণ
গলি আমি একা প্রবেশাধিকার পাই,
আর অবাক বিস্ময়ে দেখি কে ওই
এলিয়ে পড়েছে আমারি বাহু ডোরে;
আমারি দেহের ছায়া পাখি? উড়ে যেতে যেতে
শুধু এইটুকু ছোঁয়া ছিল বাকি?' (ভাবানুবাদ)
―কবির টিউটন প্রতিভা এখানে স্থির
হয়েছে কেল্টিক সৌভিক নিমগ্নতায়।
নির্জন গলিতে দেখা হয়েছে কবিরই দেহ আর ছায়াতে, অ-ধূমক আলোর
গোলার্ধে যেন।
জীবনের চোখে চোখ রেখে কবি বিশ্রাম চেয়েছেন মিস্টিক
অনুভবের জগতে।
এই ঘুম আর ঘুম নেই -―এর মধ্যবর্তী রহস্য জগতের ইশারা আধুনিক এক
কবিভাবনার কবিতাদেহেও আঁকা হয়েছে অনাস্বাদিত তবু আদৃত এক মিস্টিক অভীপ্সায় :: ―
এই নীরব শান্ত কবিই, অগ্নি বসু , A star that
dwelt apart.......
অনুভবের প্রগাঢ়তায় কবি লিখেছেন ::―
"ভোরের আকাশে, উন্মুখ
নীল মেঘে,
আমারও ডানার শব্দ রয়েছে লেগে,
সারাটা জীবন শুধু জেগে শুধু জেগে―
এবার তাহলে, একটু ঘুমিয়ে থাকি?'
(নৌকো ভেসেছে জলে / অগ্নি বসু)
―এ শুধু ক্লান্তিতে জেগে থাকা
ব্যথিত কবির কথা নয়,
সান্দ্র ঘুমেল এক্টোপ্লাজম্-এ কবি ঢেলেছেন শীতল মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন
ভাবনা।
তবুও কিন্তু বলব, অধ্যাত্ম চেতনার কবি ঐ ঘুমকে
দেখেছেন রূপান্তর হিসেবে, তাই তা হয়েছে আদরনীয়।
এই দুই কবির জীবন ও রচনার প্রেক্ষাপটের দূরত্ব অনেক
তবু মর্মটানটি যেন একই সুরে বেজেছে।
চিরবিশ্রামের এই মিস্টিক আবেশ কবি বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাতেও সুনিরীক্ষ্য ::―
"ফ্যানি ব্রাউনের চোখের পাতায়
কালো দিঘিজল মৃত্যু ঘনায়"
কিম্বা
"কবরে আমার ফুটবে ফুল,
সে ফুলে লাগবে ফ্যানি ব্রাউনের শিশির সিক্ত মাথার
চুল"―-
কবির মিস্টিকতা ছড়িয়ে পড়েছে বর্তমানের বাইরে, ভবিষ্যতের ফুলে,
যেখানে আজকের প্রেয়সীর শিশির সিক্ত চুলের আমেজ পাবেন কবি, কোন এক বিস্ময়কর ভবিষ্যে।
এ প্রসঙ্গে কবি অগ্নি বসুর ক'টি বিশ্লিষ্ট ছত্র
ভেঙে দেখতে পারি ::―
"আমি এক দিঘি হ'য়ে
আছি, হৃদয়ের কুল টলোটলো,
সে এসে মুকুরে দ্যাখে মুখ ডেকে বলে, 'সময় কি হ'লো?"
―যে মুকুরে মুখ দ্যাখে আর ডাক দিয়ে
সময়-এর কথা বলে, তার চেতনার মর্মসুরটি মিশে যায় ফ্যানি ব্রাউনের মৃত্যুর প্রশস্ততায় ও
মিস্টিক অনুভবের সাযুজ্যে।
এখানেই কবিদের মিষ্টিকযাত্রা থামেনা। যাযাবরী
চেতনায় 'রবি'র বীণাটি তোলে সুরঃ―
"হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।" স্বপ্নসব ভেসে যায় দিগন্তরে, অসীম
ও সসীম মায়ায়। তাই এইসব গোলাপী স্বপ্নেরা উড়ে যায় আকাশে বাতাসে অনন্তে এবং শেষ
পর্যন্ত ঈশ্বরীক ভেলায়।
কবি জয় গোস্বামীর কবিতাতে উঠে এসেছে ওই চিরন্তন
খোঁজ, গোলাপী প্রেমের সাধনায় ::― "দশক শতক ধ'রে ধ'রে
ঘরে, পথে, লোকালয়ে,
স্রোতে জলস্রোতে
আমাকে কি একাই খুঁজেছ তুমি?
আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?" ―কবির এই মিষ্টিক প্রেমের অবকাশ
অবশেষে থমকে দাঁড়িয়ে দেখেছে আপন হৃদয়ের নীল পরিব্যাপ্ত প্রেমকেই।
ঠিক এইভাবেই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গভীর সংযুক্ত
প্রেম -― মনাতীত-লোকে
খুঁজেছে কি যেন সে চায় ::―
"তুমি ছিলেনা, তবুও
যেন
তোমার কাছে বেড়াতে আসা"
-―যদি প্রশ্ন করি তুমি কোথায় ছিলেনা, কিম্বা তবে কেন
তোমার কাছেই আসা?― এর উত্তর এক রহস্য-গভীর মিস্টিক জগতের দিকে নির্দেশিত।
চেতনার পাড় ধ'রে যেতে যেতে একদিন কবি আনন্দ বাগচীও হঠাৎ
ভেবেছিলেন ::―
"ছড়িয়ে যেতে বিশ্বময়
কে যেন মনে হয় রয়েছে কাছে।"
-―এই মনে হওয়া, কিংবা মানে পড়াটি
কবি অগ্নির একটি কবিতায় সুন্দরভাবে
ধরা আছেঃ―
"এখন, এই
সন্ধেবেলায়, আমার আঙিনায় এসে বসেছ।
হঠাৎ করেই মনে পড়ল,
ছ্যাঁৎ করে
উঠল বুকের ভেতর।"
-― এই যে রয়ে গেছে মনের একেবারে কাছটিতে, তাকে মনে পড়েই
বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে কেন?
মিস্টিকের এই তো ইশারা.... প্রাণের একতারাতে হঠাৎই
এমন প্রেম হ'য়ে বাজে তা... মানুষ থেকে ঈশ্বরে.......
কবি আনন্দ
বাগচীর মিস্টিকতা সুররিয়্যালিজম্-এ পথ খুঁজে পেয়েছে তখন, যখন তিনি দেখেছেন――
"শেষ ধাপে নেমে আসা
কাঠ বিড়ালীর মুখের মত থমথমে এই রোদ।"
সুররিয়ালিজম্ আর মিস্টিক ভাবনা কবি অগ্নির কবিতাকেও
আলোময় ক'রে দিয়েছে, দিয়েছে উত্তরণের ডানা, দিয়েছে পাড়ি দেবার দিক নির্দেশ ::―
"তোমার চতুর্দিকে আলোর উৎসব
বনকুসুমের বিভা'"
অথবা-―
"'অবাক হ'য়ে
দেখলাম
তোমার মত আমিও
ছোট একখানি নৌকো হ'য়ে গেছি।"
অথবা―
অন্যত্র রয়েছে বৈপরীত্যের স্টাইলে কবির
সুররিয়ালিজমের ছটা―
"সকল কুসুমে যত আলো
সব তোমাকে দিলাম, তুমি নাও।"
-―কুসুমের গন্ধেই এল আলোর প্রতিভাস
যেমন আনন্দ বাগচী দেখেছিলেন কাঠবিড়ালীর থমথমে মুখ আর রোদের থমথমে শিহরণ।
এই মিস্টিকতাই কবিদের অন্তর্মুখীন করে রাখে....
তাদের চিনে নিতে হয়। বুঝে নিতে হয়। দুর্বোধ্য বলে দায় এড়ানো চলে না মোটেই। অগ্নির
দুটি কবিতাতেই এক মিস্টিক crossover-এ শিল্পী, শিল্প ও বিশ্বশিল্পী মিলেমিশে গেছে।
অগ্নিপ্রতিভার (অগ্নি বসু) ত্রিতন্ত্রী মানসে কখনও ধরা দিয়েছে Instinct-এর জৈব-উষ্ণতা, প্রকৃতির personification-এর গহনে, বোধকরি মিষ্টিক রহস্যেও, কখন বা কবির স-স্মিত মানসের জাগ্রতধী প্রকাশ করেছে অতিমনের ছায়াকে অসংবেদ্য ধারণায়, আবার কখনও বা হৃদয়ের অকৃত্রিম আবেগ পূর্ণবেগে চলতে চলতে ছিটকে গেছে গ্রহান্তরে তখন কবি উন্মোচিত করেছেন নিজেকে মিস্টিক মাত্রায় ::―
"ঘুমিয়ে থাকি আঁধার ছায়ায়, মধ্যযামে
পাহাড়-চুড়োয় তখন নাকি বৃষ্টি নামে" (নৌকো
ভেসেছে জলে)
-― এখানেই যেন বিশ্বপ্রকৃতির মর্মমূলে চেতনার বিবর্তন অবধারিত হয়ে উঠেছে এবং নিখুঁত তিলোত্তমা-অনুভব পৌঁছে গেছে শাশ্বত উপলব্ধির জগতে। এরপরে কবি অগ্নির সুরে বেজেছে বাউলের উদাসী তান। বাগেশ্রী কামোদ কিম্বা পটমঞ্জরীর ছুটি হ'য়ে গেছে...
কবিতার বাতাসে বেজেছে তাই মেঠো সুর ::―
"অনেক দিন অ-নেক দিন
স্বপ্নহীন স্বপ্নহীন
ঈশান কোণে, নৈঋতে
তুমিই আমায় ডাক দিতে"
------এই ডাকটিই যাতায়াত করেছে বারবার
কবিজীবনে... রাখালের সুর থেকে ভাগবতী সাধনার স্রোতে।
সন্ন্যাসী কবি ঋতানন্দের কবিতায় এমন মিস্টিক সুর তো
বাজবেই :; ―
"সেই কবে থেকেই কী জানি, কী খুঁজছি'"
হয়ত কবি
খুঁজছেন ব্যক্তিক জীবনের ব্রতে অতীন্দ্রিয়ের স্বর্ণফসল।
জ্যোৎস্নামাখা ঠোঁটের পাখিটি কবি মলয় গোস্বামীর
মিস্টিক ছন্দে ও শব্দে পেয়েছে ওড়ার সমগ্রতা..... যদিও তা দৈব প্রেরিত বলেই কবি মনে
করেছেন।
কবি তিলোত্তমা মজুমদারের একটি কবিতাতে দেখি মিস্টিক
পরিবেশ তৈরী হয়েছে গভীর,
মাটীর আকর্ষণে ::―
"ওপরে আকাশ ছিল, দূরে
ছিল কৌতূহলী নদী।
আড়াল ছিল না কোনও; সেখানে আড়াল অপরাধ
আমূল খুঁড়েই নিলে ঘাসে ঢাকা মৃত্তিকার স্বাদ,
মাটী শুধু বলেছিল : সোনা কেউ এসে পড়ে যদি।"
―এই ভয়তরাসে বিদেহী ভালো লাগা দেহজ
কামনাকে পার হয়ে মরমীয়া অন্তর্লোকের সম্পদ হয়ে উঠেছে।
সচেতন উচ্চতর সাহিত্যের বাইরেও একটি চিরকালীন মেঠো
সুর ফিরেছে লোকে লোকান্তরে,
সাধনায় সাধনায়, গূঢ় প্রাণের এষণায় দেশে কিম্বা
দেশান্তরে।
বৌদ্ধিক জগৎ যেমন ক'রে মিস্টিককে পায় ঠিক তেমন করে নয়,
বাউল সুফী প্রাণ এমনি এমনিই, সহজ জীবনের মধ্যে
খুঁজে ফেরে মনের মানুষ... পেয়েও যায়...... আবার সন্ধান চলে।
খাঁচার ভেতরে অচিন পাখির সন্ধান করে তারা, আর নিবিষ্ট
চিত্তে দ্যাখে ::―
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে
যায়।"
এই শাশ্বতের সাধনা করতে গিয়ে মানুষ বুঝেছে― "আমিই
নিত্য"।
বিষ্ণু দে
বৌদ্ধিক পথ পার হয়েও খুঁজেছেন নিজেকে.... মনে হয়েছে তাঁর, "আজও চেনা
হলনা নিজেকে" (সংবাদ মূলতঃ)।
এই অচেনা থেকে যাওয়াটাই তো রহস্য, মিস্টিকের
ক্ষেত্র ভূমি।
সম্পূর্ণ
যা তা আজও অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেছে...... এখানেই তো প্রোথিত আছে মিস্টিক চেতনার
শেকড়।
কবি আবদুস শুকুরের কবিতাতেও জেগে রয়েছে এমন একটি
আত্মমগ্ন বাউল হৃদয়,
যে সুরে সুরে বলে ওঠে ::―
"এ জীবন বাউলের একতারায় মধুর গান
এ-জীবন নিমগ্ন চিতার গভীরে,
নিজেকে করেছে দান---"
(প্রেমপদাবলী)
এভাবেই কবিতারাজ্যে চলেছে অতীন্দ্রিয়ের নিয়ত চংক্রমণ-বিলাস।
অবারিত। অনুক্ষণ।
লৌকিক প্রেমই ছুঁয়েছে গভীর অলৌকিক ঈশ্বরীয় প্রেমকে।
যে খোঁজ চলেছে, তা মনন-জাত জিজ্ঞাসার কার্য-কারণ অনুসন্ধান-এর নয়,
তা খুঁজেছে স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যু ও আনন্দ বিষাদ।
নিশ্চিত অস্তির খোঁজে যুগান্তরের কবিরা চলেছেন সার বেঁধে-------
হাতে শত রুদ্রাক্ষের জপমালা..... কালযাপনের
ইতিবৃত্ত রচনার আস্পৃহা তাঁদেরই অতীন্দ্রিয় নিভৃতিতে সুপ্ত।
বিশ্বজগতের প্রেমজ-ধূলো ধূসরিত কোন অভিরূপ না এঁকে, মরমীয়া কবিরা,
কবি-সাধকেরা, সাধনার ছলে ডিঙিয়ে চলেছেন
পার্থিব সিঁড়ি সব এক এক ক'রে........ চলেছেন দীর্ঘ কিন্তু
স্পষ্ট এক যন্ত্রণাহীন কল্যাণী স্থিতিতে, জীবনের সে এক
অপূর্ব বরাভয়ে !!!!
0 মন্তব্যসমূহ