বিরোধী পক্ষ
একজন রোগী ও তাঁর শুশ্রূষাকারিণী পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করে আছে। রক্তমাংস ভেদ করে সময় ছুটে চলেছে পিছনের দিকে।
গত পরশু বিকেলে অফিসের ছুটির পর রমা
তখন ব্যাগ গুছিয়ে বের হবার মুখে। জলের বোতলের শেষটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে সামান্য চেঁচিয়ে, মানে যতটুকু গলা তুললে পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে যথেষ্ট মান্যিগণ্যি
করা হয়, সেরকমভাবেই বলল, “মিতুদি, একটু জলভরে দাও, না! একটু চটপট দাও, প্লিজ!” মৃদু হেসে স্টিলের ছোট জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়েছিল।
মিতুদি হলো ওদের এই শিক্ষাদপ্তরের
অফিসের দু’জন নন ক্যটিগরি কর্মীর একজন। আসলে সে সুইপার হলেও, চা-জল-খাবারের জোগান দেবার সাথে সাথে টুকটাক খাতাপত্র এ টেবিল ও টেবিলে
আদান প্রদানের ফাইফরমাসটাও খাটে।
ছ’টার ট্রেনটা না পেলে বাড়ি যেতে যথেষ্ট দেরি হবে। রান্নাদিদি তিনদিনের ছুটি নিয়ে তার অসুস্থ দিদিকে দেখতে
ব্যান্ডেল, না মগরা কোথায় যেন গিয়ে বসে আছে। পাঁচ
পাঁচদিন হয়ে গেল, তার ফেরার নামটি নেই। খুব সম্ভব তিনি এ
সপ্তাহে আর আসছেন না। এদিকে রমার পক্ষে আর
পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না, ফলত তাকে গ্যাটিস
দেওয়ার চিরকালীন রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অনুসারী হতে হয়েছে। তথাপি এবম্বিধ ছোটাছুটি করেও কে কার কবে মন জয় করতে পেরেছে
পৃথিবীতে? সুতরাং তার
ফলশ্রুতিতে দাবী ও অধিকারের লম্বা ফিরিস্তি ঝুলে থাকে মহাশূন্যে।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাবিন বলেছিল, “মা! আজ ফেরার পথে আমার জন্য দুটো খাতা কিনে এনো, প্লিজ! মোটে ক’টা পাতা
বাকি আছে,
আজ না আনলে আমি প্র্যাকটিস করতে পারব না”।
বাবিন তাদের একমাত্র সন্তান, এই
সেপ্টেম্বরে বারো বছর পূর্ণ হলো। লেখাপড়ায়
বাবিন একেবারে তুখোড়। নিজের পড়াশুনা সে
নিজে করে নেয়, লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন। ওর পড়াশুনা নিয়ে ওকে কখনও যে ভাবতে হয় না, রমার পক্ষে সেটা আশীর্বাদ স্বরূপ।
অপরেশ তো কখনই সংসার নিয়ে মাথা
ঘামায়নি,
আজও ঘামায় না। তার নিজের চাকরি, ব্যবসা আর
যৌথপরিবার নিয়েই চিরকাল মগ্ন।তার ভাড়াবাড়ির
সংসারটির প্রতি প্রথমাবধি সে বিমুখ। তাই একা
মা-ছেলের সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পালন করতে গিয়েরমা অনেক সময়
হাঁপিয়ে পড়ে।
এরকম অবস্থায় ছেলে যদি তার লেখাপড়ায়
দড়ো না হতো তাহলে সে হতো আর একটা উৎকট ঝামেলা। এমনিতেই যা দিনকাল, রমা ভাবে, তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে
লেখাপড়াটুকুকে পারানির কড়ি না করে উপায় নেই। সংসার সমুদ্র পাড়ি দিতে ছেলের ক্ষেত্রে আর এক উপায় অবশ্য
আছে,
তাহলো তাদের পারিবারিক ব্যবসায় যোগদান। যদিও কনস্ট্রাকশন ব্যবসাটা তাদের মা-ছেলের একেবারেই
না-পসন্দ,
তবু বিদেশ গমন কিংবা নিদেন একটা ভালো চাকরি
না পেলে ওই অপছন্দের ব্যবসাকে তখন পারিবারিক ঐতিহ্য নাম দিয়ে তাতেই যোগদান করতে
হবে।
চাকরির যা বাজার – কয়েক বছর যাবৎ কোথাও
কোনো নিয়োগ নেই,এমনকি চাকরির কোনো পরীক্ষাও নেই। যদিও বা দু-একটা পরীক্ষা হয়েছে, তার ফল বেরোলে দেখা গেলো কারা যেন ইনজাংশন দেবার জন্য
প্রস্তুত হয়ে থেকে সরকারকে বাঁচিয়ে দিলো। নাহলেই তো আবার নিয়োগ দাও রে, তবিল থেকে বেতন
বাঁটো রে! অনেক ঝক্কি! বাবিন যখন চাকরি করার বয়সে পৌঁছবে তখন এ দেশ ও সমাজ-পরিবেশ
যে কী রূপ ধারণ করবে তা রমার কাছে স্পষ্ট না হলেও,সে যে এযাবতের চেনাজানার বাইরে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ভয়াবহ রূপ হবে সে বিষয়ে
কোনো সন্দেহ তার নেই। প্রতিদিন যেভাবে
চেনা অভিজ্ঞতাগুলো পাল্টে যাচ্ছে , তাতে তার এরকমই মনে হয়। এইসব সাত সতেরো মুহূর্তের হাবিজাবি ভাবনা আগমনের
ভেতরেই স্মরণ করে নিলো অন্যান্য আশু কর্তব্য।
টয়লেট থেকে ফিরে এসে দেখল মিতুদি তার
ব্যাগের কাছে জলের বোতল রেখে গেছে।
ফরিদা বলল, রমাদি, তোমার ফোন বাজছিল
-!
এখন আবার কে!– বলতে বলতে বোতলটা
ব্যাগে ঢুকিয়ে ফরিদাকে বলল, “তোমার দেরি হবে? আমি কি এগোব?”
তুমি এগোও, আমারও হয়ে গেছে, তোমায় ধরে নেব।
ওর কথা শুনতে শুনতে ঘাড় নেড়ে সিঁড়ির
দিকে এগোয় রমা। ব্যাগ হাঁটকে ফোনটা
বের করতেই আবার বেজে উঠল। অপরেশ ফোন
করেছে। আগের কলও ওরই।একটু চিন্তান্বিত হয়েই ও কল রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগায়, “কী ব্যাপার? বারবার ফোন করছ? সব ঠিক আছে তো?”
হ্যাঁ ! এমনি সব ঠিকই আছে! তবে –
রমার আর তর সয় না, সব ঠিকই আছে তো,
এতবার করে ফোন কেন? তাই “তবে”র মাঝখানেই
বলে, “তবে-?”
“বাবার ভীষণ জ্বর, হাই টেম্পারেচার। গতকাল দুপুর থেকে। ভেবেছিলাম হয়তো কোনো অনিয়ম করার কারণে জ্বর এসেছে, ও কমে যাবে! না কমলে একটা জ্বরের ট্যাবলেট খাওয়ালেই হবে। কিন্তু বাবা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। আড়াইএর নীচে জ্বর নামছেই না। বাবা জ্বরের ঘোরে তোমার কথা বলছেন বারবার”।
“আমার কথা!” রমার বিস্ময় তার কন্ঠে প্রকাশ পায়।
এরপর শ্বশুরমশাইএর জ্বর সংক্রান্ত বিষয়ে আরও দু-একটা কথা
হয়। ফোন রাখার আগে রমা জানায়, “আমি কাল শনিবার বিকেলে, অথবা রবিবার বাবাকে দেখতে যাব। এরমধ্যে কেমন থাকেন জানিও, আমি তো ফোন করবই”।
রমা ও অপরেশের বিয়ের পনের বছর হয়ে
গেছে। ইদানীং ঘটা করে
বিবাহবার্ষিকী পালন করে। আগ্রহটা রমারই এ ব্যাপারে বেশি থাকে, যদিও একসময় এসব “নাটুকে ঢং”-এর সে বিরোধী ছিল।একসময় তার প্রতি বাড়ির কেউ কোনো কর্তব্য করেননি। হাতে তুলে কোনোদিন একটা একটাকার কয়েনও কেউ দ্যাননি, এমনকি শ্বশুরমশাইও। যেহেতু সে চাকুরিরতা,তাই সে পার্থিব সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে বলে বাড়ির সকলে
মনে করতেন সম্ভবত। ইদানীং ছবিটা যে
বদলে গেছে, তাও অবশ্য নয়।
কিন্তু বাবা তাকে খুঁজছেন কেন? তারপ্রতি এত ভালোবাসা,এত স্নেহ আছে বলেতো কখনও তার মনে হয়নি! সত্যি বলতে কি, পুত্রবধূর মর্যাদা তেমন করে রমা এবাড়ি
থেকে পায়নি এযাবৎ। তাইঅবস্থা যখন
এমন,
তখন প্রায় বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত শ্বশুরমশাই তাঁর কথা বলছেন এতে অবাক হবে নাসে? কিন্তু তাঁর এই বৈকল্যের কারণ কী? শেষ সময় আগত,
এমন ভাবছেন নাকি বাবা? তাই কি কর্তব্য ঘাটতির অনুশোচনা হলো? যেহেতু “বৌমা”নিজের
দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে চলেছে? নিঃস্বার্থভাবে করছে
কিনা সে ব্যাপারে অবশ্য রমা নিজেও নিঃসংশয় নয়।
তাদের বিয়ের অনেক আগে থেকে সে অপরেশদের বিরাট ব্যবসা, অনেক বোলবোলাওএর কথা শুনে এসেছিল। পড়াশুনাতেও ভালো ছিল অপরেশ, চাকরি একটা পাবেই বলে রমা বিশ্বাস করত। দেখতে-শুনতেও সে ভালো।সুতরাং এর থেকে ভালো পাত্র হয়? খানিকটা গায়ে পড়েই সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরেশের সঙ্গে। অথচ বিয়ের পর দেখল সব ভোঁভোঁ।
শ্বশুরমশায় অফিস ঘর খুলে গনেশকে ফুলজল দিয়ে দিয়ে জপাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু গনেশজী ও লক্ষ্মীদেবিকে বিপুল ভাবে পরাজিত করে নির্বাচন দেবতা দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। বিশেষ রাজনৈতিক পার্টির ভক্ত ছিল সাহা পরিবার। কোনো কিছুতে ঘাড় কাত করে না, তাই তকমা জুটেছিল “বিরোধী পক্ষ” বলে। এক একটা নির্বাচন হয় ,আর জয়ী পক্ষের উচ্ছ্বাস ও রোষের ঢেউ আছড়ে পড়ে সাহাদের ব্যবসা ও পরিবারের উপর। হয়তো সেই জয়ে সাহাদেরও অংশগ্রহণ আছে, তবু তারা যে চির বিরোধীপক্ষ! যে দলই জয়ী হোক – এমনকি নিজেদের পছন্দের দলও, বিরোধী পক্ষের শিলমোহর তাদের কপাল থেকে মোছে না। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাহাবাড়ি অদৃশ্য “রোমথা” লেখা উল্কি কপালে নিয়ে ঘুরছে যেন!
কোমড় সোজা করে ব্যবসাটাকে আর দাঁড় করানো যাচ্ছিল না। অপরেশের দাদা শেষ মেষ সবকিছুর ভোল পালটে ফেলল। আদর্শকে গুলি মেরে উড়িয়ে জায়গা মতো উপঢৌকনের বান ডাকাল। অপরেশ ব্যাঙ্কের চাকরির সুবাদে যখন লোন নিলো বড়ো করে, কোথাও থেকে কোনো প্রশ্ন উঠল না। ব্যবসাবুদ্ধি আর নেতাদের নেকনজরের সুবাদে সাহাবাড়ির ভাঙা
গেটে সিংহমূর্তি বসল এরপর।
রমাও বাড়িতে বিরোধীপক্ষ ত্যাগ করে, তার প্রতি যাবতীয় বিরোধীতা ভুলে, সমস্ত তিতো কথা
অমৃতের সরবৎ করে খেয়ে ফেলে বাড়ির সিংদরজা ঘনঘন এপার ওপার করতে লাগল।
তাদের বিয়ের পনের বছরেরমধ্যে
শ্বশুরমশাইএর কখনও জ্বর হয়েছে বলেও রমা শোনেনি। অথচ ওনার যা বয়স তাতে সুগার না হোক, নিদেন কোলেস্টেরল বিপি-টিপি গ্যাস-অম্বল বাতের ব্যথা-ট্যথা
হবার কথা ছিল। কিন্তু শত্তুরের
মুখে ছাই দিয়ে উনি দিব্যি সময় কাটাচ্ছিলেন। সাইক্লিং করছিলেন, সকাল-সন্ধ্যা হেঁটে বাজার যাওয়া ছাড়াও বাগান করতেন নিজেই মাটি কুপিয়ে সারজল
দিয়ে। সেই মানুষের হঠাৎ
করে এমন ধূম জ্বর হওয়ায় রমার বেশ চিন্তাই হচ্ছিল। বাবা শরীরের ব্যাপারে খুব বেশি “নিয়মতান্ত্রিক” তো কোনোদিনই
নন,
যে হঠাৎ করে অঘোর অনিয়ম করে আড়াই-তিন জ্বর বাধাবেন! অনিয়মে কারও কখনও
ঠান্ডা লাগে না, যদি না শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি
দুর্বল হয়। সুতরাং অনিয়মের
জ্বর তত্ত্ব সামনে এলেও বড়জোর শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি হতে পারে! কিন্তু এত
টেম্পারেচার-!
শনিবার বিকেল পর্যন্ত আর অপেক্ষা করা
গেল না,
সকালেই বাবিনকে নিয়ে এবাড়িতে চলে আসতে হয়েছে। চারদিন হলো ওর এবাড়ি আসার। মানুষটিকে ছুঁয়ে তাঁর শরীরের রোগতপ্ততা অনুভব করে রমা। বাবা
ম্যানিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, একদম ছেলেমানুষের মতো আচরণ করছেন। রমাকে মায়ের মতো আঁকড়ে ধরেছেন তিনি। খাওয়ায় একদম রুচি নেই, তবু যতটুকুও মুখে তুলছেন, তা রমার হাতেই। যদিও খাবার মুখে নিয়ে বাচ্চাদের মতো থু থু করে ফেলেও
দিচ্ছেন। মাথা ধুয়ে দেওয়া, গা স্পঞ্জ করে দেওয়া, হাত-পা টিপে দেওয়া সব রমাকে করে দিতে হবে। ওষুধ তো মোটেই খেতে চাইছেন না, রমা যখন অনুরোধ করে আদুরে গলায় বলছে, “ও বাবা! ওষুধটা খেয়ে নাও তো!”
অমনি মুখ হাঁ। অথচ তাঁর ছেলে
খাওয়াতে গেলেও হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে রাখছেন। কখনও বা রমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকছেন গুটিসুটি হয়ে। বাবার এই অবস্থান্তর দেখে রমার চোখে কোত্থেকে যে হু হু করে
জল চলে আসছে, কে জানে!
খুব বেশিদিন একছাদের তলায় শ্বশুরবাড়িতে সবার
সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়নি তার। কাজের
জায়গায় পৌঁছতে অসুবিধার কারণে ও ছোট ফ্ল্যাটটা লোনের টাকায় কিনে নিয়ে চলে এসেছিলো
মধ্যমগ্রামে। সেই আসা নিয়ে
অপরেশের সঙ্গে অশ্ব-গজ লড়াই, তার অসুবিধা, শরীর খারাপ– অফিস কামাই, সময়ে অফিসে পৌঁছতে না পারা– এগুলো নিয়ম হয়ে উঠছিল! অফিসে নিত্য মাথা হেঁট! নিজের সুবিধা অসুবিধা দিয়ে অন্যের অবস্থা
বিচার করাই তো নিয়ম। জার্ণি করে করেও যে মজা নদী হয়ে উঠছে, তা কারও চোখেই পড়েনি! অপরেশ আর বাড়ির
মানুষগুলোকে মন স্বার্থপরের মতো আচরণ করেছিলেন তার সঙ্গে! নাকি ভালোবাসার জায়গাথেকেই
বাচ্চাকে নিয়ে তার বাড়ি ছেড়ে যাওয়াতে বাধা দিয়েছিলেন---!এটা অবশ্য
ও বিশ্বাস করতে পারে নি।
এদিকে রমা অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল,ওদিকে ফ্যামিলি নিয়ে বাড়ির বড়োছেলে অন্য বাড়িতে থাকেন। সেইসময় শাশুড়ির উপর সাংসারিক কাজের চাপ পড়ল স্বাভাবিকভাবেই। বাড়িতে নিত্য অশান্তি। সবকিছু মিলিয়ে বাধ্য হয়ে সবার অমতেই রমার মধ্যমগ্রাম চলে যাওয়া।
অপরেশের তখন কোনো স্থায়ী
উপার্জন নেই। শ্বশুরমশায় রমার কাছ থেকে নিজে কখনও টাকাপয়সা
চাননি,
সে অপরেশকে যতটুকু দিত তার থেকেই অপরেশ বাবাকে দিত সংসার
চালাতে।
বাবিন তখন পাঁচ বছর বয়স পার করেছে। এখানে এসেই স্কুলে ভর্তি করল রমা। অপরেশ সপ্তাহান্তে আসে, আর ঝগড়া করে বাড়ি ফিরে যায়। বাবিনের সঙ্গেও দেখা হয় না তার অনেক সময়, সে হয়তো তখন স্কুলে আছে।
বাবা অস্ফুটে কিছু বললেন, অন্যমনস্ক রমা
থেমে যাওয়া হাত দিয়ে আবার বাবার পা টিপতে শুরু করল। তাঁর মুখের দিকে কান এগিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করল, “বাবা,কিছু বলছেন?একটু জল খাবেন”?
ঘোরের মধ্যে কিছু একটা বলে তিনি চুপ
করে গেলেন। একটু পরে দুর্বল
নাকিসুরে, কিন্তু অনেকখানি স্পষ্টস্বরে বললেন, “আমার খুব খিদে পেয়েছে,বৌমা! তুমি খেতে দিলে না? দুপুরে অতিথিকে কেউ
অভুক্ত রাখে?”
রমা চমকে উঠল। বাবা কি তাকে বলছেন? বাবা কি তবে সজ্ঞান? ডাকল, “বাবা? –বাবা?–”
কোনো সাড়া নেই। ভুল বকছেন! কিন্তু কী কথা বললেন তিনি! যেকথা সে প্রায় ভুলে
গিয়েছিল,
বাবা কি সেদিকেই টান দিলেন?
রমার বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাবার মন পড়তে চেষ্টা করে সে, তাঁকে ছুঁয়ে তাঁর চিন্তাতরঙ্গ থেকে কী ভাবছেন তা টেনে আনতে চায় বুঝি।
কা কা করে একটা কাক তখন থেকে ডেকে চলেছে, থেমে থাকা সমস্ত কিছু চলকে চলকে উঠছে, চমকে উঠছে। আমগাছের কোন ডালে বসে আছে, কে জানে! মাথার ভেতরেই থাকছে নাকি! ক্লান্ত দুপুরে জগৎ সংসারে এক ওই কাক, রমা আর জ্বরাক্রান্ত বাবা। এই ছবির ভেতর ফুটে উঠছে আর এক অবয়ব নিয়ে আর এক ছবি। কিছুটা ঝাপসা, কিছু জায়গার রেখা হয়তো বা বদলে গেছে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে।
পায়ে হাত রেখে মনে মনে
ক্ষমাপ্রার্থনার উচ্চারণ রাখে, অন্যায় করেছি ---
অনেক বড়ো অপরাধ ঘটেছে। লোভ, রাগ আর ক্রোধ ভুল করিয়েছে জীবনে --- একের পর এক ---! যে শাস্তি অপরেশের প্রাপ্য ছিল তা বাবার উপর
এসে পড়েছিল সেবার। বাবার প্রতি অপরাধ
ওই একবারই-!
নীলাব্জ বাসাবাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে কোথাও যাবার পথে এসে
পড়েছিল। ছুটির দিনে দুপুরে বেল বাজলে রমা
ভাবল অপরেশ হবে। আসন্ন ঝঞ্ঝা কল্পনা
করে বিরস মুখে দরজা খুলে নীলাব্জকে দেখে অবাক হয় সে। বাবিনের ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে বারান্দায় বসে টুকটাক কথা বলছিল, এমন সময় আবার বেল বাজতে “এবার নিশ্চিত অপরেশ” বলে উঠে গিয়ে
দরজা খুলে দিতে দ্বিতীয়বার অবাক হবার পালা। শ্বশুরমশায়!
তখন ওবাড়ির কারও প্রতি সে সদয় নয়। কতদিন বাড়ি যায়নি! তবু
শাশুড়িমার বাক্যবান এসে বুকের ভেতর স্যাট করে বিঁধে যায় ঠিকই, অপরেশ তো কচুকাটা করে যুদ্ধজয়ের আনন্দে বাড়ি ফিরে গিয়ে নতুন
নতুন স্মারক স্তম্ভ, মিনার-টিনার গড়ে
তোলে বোধহয়!
অপরেশের
চাকরি ও ব্যবসায় অল্পবিস্তর সময় দেওয়া আরও কিছু পরের দিকে। সেসব ফিরিস্তিও রমার কাছে আসত, মাঝেমধ্যে বাড়ি গেলেও শুনত কিছু কিছু। তবে সেসবে রমার কী লাভ? কী-ই বা যায় আসে? দেশই তো চলে ব্যক্তিগত লাভালাভের হিসেবে। যদিও
দেশ চলে না,অর্থাৎ মা প্রতিদিন খোঁড়া হন। কোনো কোনো নৈরাশ্যবাদীর চোখে তিনি “মা” বটে! তারা ভাবে,“মা কী ছিলেন, আর কী হইয়াছেন!” আদতে তিনি
চিরদিনই ছাগলের তৃতীয় ছানার মা।
বাবার আগমনে তাই ক্ষীণ খুশির রেখা
মিলিয়ে গিয়ে ধূসর রঙে ক্যানভাস ঢেকে যায়। বাবাকে কেবল একগ্লাস জলে আপ্যায়িত করে সে বাকি সময়টা অস্বীকারে ভরিয়ে দেয়। নির্জন দুপুরে, নির্জন বাসাবাড়িতে অচেনা যুবকটি পাড়ার কোনো দুপুর-ঠাকুরপো বলে ভেবেছিলেন কিনা
কে জানে! রমা কেয়ারও করেনি। নীলাব্জর সহপাঠী পরিচয় জানায়নি বাবাকে। তার পরিবর্তে যে নীলাব্জকে সে তত পছন্দ করে না, তার সঙ্গে জনমের গল্পে মেতে উঠেছিল। একসময় বাবা বলেন, আসি,
বৌমা!
বাবা যে কেন এসেছিলেন তা জানা হয় না, তিনি ক্ষুধার্ত কিনা সে খবর নিয়ে খাবারের পাত্র তাঁর সামনে
রাখা হয় না। বাবা চলে গেলেন।
দরজা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর শুকনো মুখ মনে
করে বুকের ভেতর কান্না উথলে ওঠে যত, তত সে উল্টোপাল্টা অবান্তর বকতে থাকে
নীলাব্জর সঙ্গে। অসহ্য লাগতে শুরু করলে সে নীলাব্জকে বলে, “তুমি এসো এবার! আমার কাজ আছে”।
দরজা বন্ধ করে এসে বারান্দায় বসে থাকে কান্নাকে আটকে। নির্জন দুপুর ভর্ৎসনার মতো চমকায়, ফিসফিস করে, কাক ডাকে কা কা , কা কা! অসহ্য!
বাবিনের পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। বাবা তাঁর প্রতি অবহেলা দেখে হয়তো লজ্জায়, অপমানে আর কোনো কথা বলবার শক্তি অর্জন করতে পারেননি, নাতিকে দেখতে চাননি।
বাড়ির সম্পদ বাড়তে লাগল, আর বাড়ির সঙ্গে
রমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে লাগল। একটু একটু
করে। বাবা সেদিনের কথা কাউকে বলেননি। কারণ বাড়ির অন্যরা জানলে তা নিয়ে তুলকালাম করত নিশ্চয়।রমা ধরে নিয়েছিল বাবা সে ঘটনার কথা ভুলে গেছেন। নিশ্চিন্ত হয়েছিল সে।তবে কখনও কখনও মনে মনে নিজেকে শাসন করেছে।একসময় অপরাধটি ভুলেও গেল। স্বকৃত অপরাধ মানুষ ভুলে যেতেইতো
চায়!
আজ বাবা তাকে আবার মনে পড়ালেন। মনে পড়াবেন বলেই কি “বৌমা”কে অসুস্থতার ঘোরে, নাকি ছলে ডাক পাঠালেন? রমার চোখ জ্বালা
জ্বালা করে ওঠে।
বিকেলের দিকে সদ্যজেতা স্থানীয় কাউন্সিলার সপার্ষদ ফলটল
নিয়ে প্রথমবার সাহাবাড়ির সিংদরজা পেরিয়ে অসুস্থ মানুষটিকে দেখতে এলো। ঘরে তখন বাড়ির
সবাই উপস্থিত এবং উপর উপর দেখাল তাঁরা আসায় সবাই কত খুশি। বাবা পশ্চিমের জানলা দিয়ে আকাশের কমলা রঙের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কারও সঙ্গেই কোনো কথা বললেন না, অসুস্থতার কারণে খুব একটা বলছেনও না অবশ্য। যতটুকু বলেন অধিকাংশই ঘোরের ভেতর। লোকগুলো আসার একটু পরে অপরেশের দাদার দিকে তাকিয়ে শুধু
বললেন,
আমার কিছু ভালো লাগছে না।
তারা চলে গেলে বাবা বললেন, “শুতে হবে”।
বাবাকে শুইয়ে দিয়ে ঘর ফের ফাঁকা হয়ে
গেল। রমা একইভাবে পাশে বসে বাবার হাতে-পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। তিনি চোখ
বন্ধ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ফের সজ্ঞান হলেন কি? অস্ফুটে কাকে বললেন কে জানে -বললেন,“বাড়ি তো তোমাদেরই”!
রমা কেবল বুঝল, হিসাব বরাব্বর হয়ে গেল। বুকের ভেতর চেপে বসে থাকা পাথরটা এই স্বীকৃতিতে সরে গেল। সব পক্ষ মিলে মিশে একাকার এখন।
যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা
2 মন্তব্যসমূহ
ভাল লাগল
উত্তরমুছুনবিরোধীপক্ষ ভালো লাগলো। কোমর টা মুদ্রণ প্রমাদে কোমড় হয়ে গেছে।
উত্তরমুছুন