সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ:ভ্রমণ:জুহু চৌপাট্টি মানবী হয়ে ওঠে সাগরচুম্বন সহবাসে

 



জুহু চৌপাট্টি মানবী হয়ে ওঠে সাগরচুম্বন সহবাসে

                       

           ছায়ামাখা রোদ্দুরের রৌণক এসে জুটল আরবসাগরের কোলে। আদুরে প্রশ্রয় নিয়ে নিতান্তই ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ ও তাদের সোহাগী পদচুম্বন। দিগন্তের ক্যানভাসে পরিপূর্ণ অপরাহ্ন একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে এ তল্লাটে। ‘জুহু চৌপাট্টি’ বা বলা যায় জুহু সৈকত, মুম্বাইকারদের প্রাণস্য প্রিয় বেলাভূমি। সামনে অথৈ সাগরজলের অনন্ত আনাগোনা। যদিও সে ঢেউ মৃদু, শান্তশ্রী। পায়ের স্রেফ পাতাটুকু ভিজিয়ে দিয়েই তারা গড়িয়ে গড়িয়ে ফিরে চলে যায়। আবারও কাছে আসে, ফিরে যায়। সাগর ঢেউয়ের চিরাচরিত চেনা মিতালি এখানেও। সময় তোয়াক্কা মানে না। হু হু কেটে যায় পড়ে পাওয়া চোদ্দয়ানা সময়গুলো

          দুর্নিবার আমোদপ্রমোদ জেগে থাকে এই জুহু সাগরতটে। আরবসাগর ঘেঁষা পথটি চলে গেছে অনেকখানি। মুম্বই মহানগরের চেনা স্বভাবসুলভ ব্যাস্ততার মাঝে অতি লোকপ্রিয় জুহু সাগর সৈকত। স্বপ্ননগরী মুম্বই। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। সদাব্যাস্ত অত্যাধুনিক জমকালো মহানগর। সাবেকি নামটি প্রথমে ছিল বোম্বাই, তারপর বম্বে, তারপর সেই কবে থেকেই নাম বদলে হয়েছে মুম্বই। সাগরঘেরা মহানগরটিতে আছে অজস্র ছোট বড় মাঝারি চৌপাট্টি। মরাঠি ভাষায় সৈকতকে বলা হয় ‘চৌপাট্টি’পশ্চিম মুলুকের মুম্বইয়ের এই জুহু বিচে যে কী পরিমান লোকারণ্যে ছেয়ে থাকে। পর্যটক তো আছেনই, ব্যাবসায়ী, দোকানদার, প্রাতঃভ্রমণ ও সান্ধ্য ভ্রমণে আসা স্থানীয় মানুষজন, ভিক্ষুজীবি, রুজিরুটির সন্ধানে আসা ভিনদেশিরাও। বিকেল থেকে সন্ধ্যে তিল ধারনের স্থান থাকে না জুহু সৈকত চত্বরে।

          আকাশকোনে অপরাহ্ন ঘনিয়ে বিকেল নেমে আসে। ভিড় বাড়ে। ভিড় বাড়তেই থাকে ক্রমশ। বিশ্বের বৃহত্তম সৈকতগুলির মধ্যেও নিজের জায়গা করে নিয়েছে জুহু। জুহুর পশ্চিম বরাবর আরবসাগরের ছলাৎছল। উত্তরে ভারসভা। পুবে ভিলে পার্লে ও সান্ত্রাকুজ। দক্ষিণে খার। আর আছে সার দিয়ে সেলেব্রিটিদের একচেটিয়া মহার্ঘ আবাস। বহুকাল পূর্বে, যখন পর্তুগিজদের বিস্তারকাল ছিল, সেসময় সমগ্র এলাকাটির নাম ছিল, ‘জুভেম’। পরবর্তীকালে লোকমুখে সেই ‘জুভেম’ হয়ে যায় ‘জুহু’। জামসেদজি টাটা ১৮৯০ সালে ১২০০ একর জমি কিনে নেন এখানে, এবং একটি বাংলো নির্মাণ করেন। মুম্বাইয়ের আলিশান ঐতিহ্য ও শহুরে স্বাচ্ছন্দ্য এ তল্লাটের রন্ধ্রে রন্ধ্রে

          শান্ত জলস্রোত। ম্লান ঢেউ। অখন্ড অবসর হাতে নিয়ে সাগরের মায়াবী মুগ্ধতায় কেটে যায় আহামরি অনেকখানি সময়।  যেকোন সাগরপাড়ে কাটালেই অবশ্য এমনটা বোধ হয়। দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার বিস্তৃত রূপোলী বালিয়াড়ি। স্নিগ্ধ সাগরবেলায় ধীর লয়ে আছড়ে পড়ে নিরবিছিন্ন ঢেউ। তবে বর্ষায়ে অন্য গল্প। ভারি বর্ষায় এখানে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে খুব উঁচু উঁচু ঢেউ পাড়ে এসে ছাপিয়ে যেতে থাকে। সাংঘাতিক হলেও ভরা বর্ষা মরসুমে সেটিও দ্রষ্টব্য তো বটেই। বছরভর জুহু এমনিতেই বেশ জমজমাট। জলোচ্ছ্বাসের সময় কিঞ্চিত সজাগ থাকতে হয়। কোষ্টাল পুলিশও যথেষ্ট সতর্ক থাকে কড়া নজরদারি নিয়ে। স্থানীয় অনেকেই ভরা বর্ষার রূপকে দেখতে চলে আসেন জুহু।

          সৈকত লাগোয়া দোকানিরা জেগে উঠলে, জুহুর প্রকৃতি যেন মানবী হয়ে ওঠে। চওড়া বেলাভুমি। প্রাতঃভ্রমণ ও সান্ধ্যভ্রমণের পক্ষে ভারি মনোরম। গান্ধিজিও মুম্বইয়ের এই জুহু বিচে এসেছেন এবং হেঁটেও ছিলেন। তাঁর একটি মূর্তিও আছে এখানে, সেই স্মৃতিতে। এবং জুহুর উত্তরদিক থেকে গান্ধিগ্রাম রোড নামের পথটিও সৈকত পর্যন্ত এসেছে। জুহু সৈকত লাগোয়া আভিজাত্যপূর্ণ বসতবাড়ি ওঁ জাঁকালো এই অঞ্চলটিকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে তুলনা করে, বলিউডের ‘বেভারলি হিল’ নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তবে অতি উৎসাহীদের এই নাম বিশেষণ কিন্তু একেবারেই অতিরঞ্জিত নয়। অঞ্চলটির ঠাটবাট থেকে মোটেও অত্যুক্তি মনে হয় না


          ভোর সকালই হোক কী সূর্য ডোবা বিকেল অথবা সন্ধ্যে, সব সময়ই জমজমাট জুহু। হরেক বিনোদিনী পসরায় সেজে থাকে সৈকতভুমি। নানান শিশু উপযোগী ‘জয় রাইড’ যেমন উট, ঘোড়া, এক্কাগাড়ি, নাগরদোলা, চলন্ত ঘূর্ণি, এসব তো আছেই। আরও আছে ‘মুম্বইয়া স্টাইল’ রকমারি মুখরোচক খাবারদাবারের এলাহি হাতছানি। জম্পেশ সব জলখাবারের হাজার একটা স্টল। পাপড়িচাট, পানিপুরি, দহিপুরি, সেওপুরি, পাওভাজি, ভেলপুরি, গোলা, মশলাচাট, মিসাল পাও, বড়া পাও, ভুনা পনির ইত্যাদি। এছাড়াও মকাইদানা, রোস্টেড এবং বাটার মশালা বয়েলড কর্ণ। রয়েছে শিংদানা (বাদাম) সেদ্ধ, ঝাল ঝাল মশলা জরানো। আরও কত কী যে খাবার ও পানীয়ের সম্ভার আছে সেখানে। সমস্ত রকম তাজা সুস্বাদু ফলের রস, বহু ধরনের ফলের মিল্কসেক, চকোলেট মিল্কসেক, ভ্যানিলা মিল্কসেক ইত্যাদি। রয়েছে কুলফি, ফালুদা, ক্যারামেল কাস্টারড, স্টবেরি মিল্কসেক, ভ্যানিলা আইস্ক্রিম, হট চকোলেট। কত কত যে লোভনীয় ককটেল। এছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় নানা পদ, ইডলি, ধোসা, মশালা ধোসা, আপ্পাম, রাওয়া উপমা, বাটারমিল্ক সম্বর, উত্তপম, দহি রাইস ও মরাঠি জলখাবার কান্দা পোহা, সাবুদানা খিচরি, পুরণপোলি ইত্যাদি। জুহু বিচে খাবারের দোকানগুলোর কাটতি বেজায়। রমরম করে চলে খাবারের স্টলগুলো।


          জুহু সৈকতের আয়নায় ধরা পরে কত কী মায়ার খেলা। সূর্যের সোনাগলা রশ্মি বিম্বিত হয়ে শোনায় মুগ্ধকথা।  নির্মল খুশিতে এখানকার নরম বালুকাবেলায় ধরে জলরেখা বরাবর ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনেকটা পথ ভিজে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় বেখেয়ালে। চটি জোড়া হাতে নিয়ে মনের আনন্দে পা ভিজিয়ে কতবার যে হেঁটেছি এ পথে। ঢেউগুলো জলচুম্বন করে যায় পায়ের পাতায়। এও তো খানিক মুক্তি অথবা হারিয়ে যাওয়া। কয়েকবার একদম ভোর সকালে চলে গিয়েছি জুহু সৈকতে। হ্যাঁ, স্রেফ ঘুরে বেড়াবো বলেই চলে গিয়েছি আমার নভি মুম্বইয়ের আস্তানা থেকে জুহু বিচের দূরত্ব কম বেশি ২৮ কিলোমিটার মতো। ভোরের দিকে ফাঁকা রাস্তায় সময় লাগে আধ ঘণ্টা কী চল্লিশ মিনিট মতো। আকাশ তখন একটু একটু করে অন্ধকার মুছতে থাকে, কমলা-লাল রঙের মারকাটারি খেল শুরু হতে থাকে আকাশকোনে। ভোরের এই সময়টা জুহু থাকে স্থানীয়দের জগিং, প্রাণায়াম, কসরত, ব্যায়াম, লাফিং ক্লাব, বিচ ভলিবল এইসবের দখলে। জুহু সৈকত স্নানের উপযুক্ত হলেও জল কিন্তু কিঞ্চিত অপরিস্কার। বেলাভূমিতে ঢেউয়ের কাছে পা এলিয়ে বসে থাকা যায় অবসরের আলস্যে। ঢেউগুলোও প্রশ্রয় পেয়ে খুনসুটি করে দেয় দেদার। সামান্য বেলা গড়াতেই শুরু হয়ে যায় পর্যটকদের আনাগোনা।


          শীতের রোদ্দুর মিঠে মেখেও বেশ জমে যায় জুহু ভ্রমণ পর্ব। তবে মুম্বইয়ে শীত ঋতু আর কোথায়। পরজতক বারো মাসই ভিড় জমিয়ে রাখেন এই তল্লাটে। বালির প্যালেটে যত্নে সাজানো আরবসাগরের গহীন নীল সীমানা। কত মায়া যে রাখা থাকে জুহু সাগরতটে। বালির বুকে ছোট্ট নম্র ঢেউয়ের খোলস ভাঙতে ভাঙতে বালুতট ছেড়ে স্বেচ্ছায় ফিরে যায় দুধেল ফেনা। তারপর যখন বিকেল ম্লান হয়ে আসে, সৈকতে মনখারাপের কুচি ছড়িয়ে যায়। তবু হই হুল্লোড়ে মেতে থাকে জুহুর চত্বর। সমুদ্দুরের বিনোদিনী উচ্ছ্বাস ক্রমশ চেনা হয়ে গেলেই খুশি নিয়েই আবার ফিরে আসি মহানগরের হাইরাইজ টাওয়ারের সাত তলার কুঠুরিতে। যেখানে সদরদরজা বন্ধ করলেই সমস্ত দুনিয়াদারি শেষ।

 

          মধুছন্দা  মিত্র  ঘোষ

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ