[প্রথমেই বলে রাখি এই লেখাটি পরম্পরাগত অধ্যাত্মিক, দর্শন, বিজ্ঞান,যুক্তি,বিচার এইসব দৃষ্টিকোণ দিয়ে পাঠক যেন না পড়েন। একটি অজানা অচেনা পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যেমন পুলক ও বিস্ময় হয়,তেমনি অনুভুতি নিয়ে পড়তে অনুরোধ জানাই। মৃত্যুর সময় হৃদয় শ্বাস মস্তিষ্ক ইত্যাদি দেহের বিপাকীয় অংশগুলি বন্ধ হয়ে যাবার সাত সেকেন্ড পর মন ও প্রাণের ক্রিয়া নিয়ে কাউন্ট ডাউন কাল্পনিক গদ্য ‘নির্বাণ পথ’। মন ও প্রাণশক্তি মৃত্যুর পর কিছুক্ষন শরীরে থাকে, এই বিজ্ঞানপ্রসূত থিয়োরীর প্রেক্ষিতে এই কল্পনা। প্রথম অধ্যায়টি ‘বিচ্যুতি’। সাতটি স্তরে প্রাণশক্তি ও মনোশক্তির দেহের উপস্থ(নিম্নাংশ) থেকে উর্দ্ধমুখ দিয়ে পৃথিবীচ্যুত হয়ে মহাশূন্যে লীন। দ্বিতীয় অধ্যায়টি ‘ষুষুপ্তি’ নিদ্রা বা dormant। এই অংশে পার্থিব প্রাণশক্তির মহাপ্রাণের অথৈ সাগরে বিলীন এবং আবার অভিযোজনের জন্যে পার্থিব জৈব আধারের খোঁজ (ন্যাচারাল সিলেকশন)। তৃতীয় অধ্যায়টি ‘সংযুক্তি’ বা fusion। সেই প্রাণশক্তির দুই অংশের খোঁজ। শুক্রানু ও ডিম্বাণুতে নিষেক,মিলন ও গর্ভে স্থিত হওয়া। চতুর্থ অধ্যায়টি ‘প্রসুতি’। প্রথম অধ্যায় ‘বিচ্যুতি’র এটি চতুর্থ পর্ব।]
৪
Unstruck/হৃত্পঙ্কজ/চার সেকেন্ড
জৈব হৃদয়ের সংবেগ তো এখন চিরকালের মত স্তব্ধ কিন্তু জীবন থাকতে যখন
সেটি অহৈতুকি নিঃস্বার্থ প্রেমে আকুল ও উদ্বেল হয়ে উঠতো সেই পবিত্র হৃদয়াবেগের
আবর্তটি আসলে জৈব নির্বিশেষে একটি আকারহীনতার বোধ ও পরম প্রশান্তির সঙ্গম সেটা তার
বোধে পরিষ্কার হলো। জন্ম বিজন্ম প্রজন্ম সব এখন তার অচেনা অজ্ঞাত কিন্তু জন্মরহস্য
এখন সবুজের রেশ হয়ে অনুভবে থাকতে চাইছে। যেন এই সবুজের টান তার পরম আরাধ্য।
সম্পুর্ণ সমর্পিত হয়ে যাবার মাধ্যম। পার্থিব আকৃতির জ্ঞান আর তার বোধে নেই। সে এখন
একটি অনুজ্বল নিরাকার শক্তিশিখা। সবুজ বাদে অন্য বর্ণালী তাকে লাল ও সাদা দুটি
সর্পিল তড়িত্ রেখাতে বেঁধে দিয়ে একে একে অপসৃয়মান হয়ে যাচ্ছে। তার বোধে এখন শুদ্ধ
লাল সবুজ ও সাদা। বুঝল অনন্ত সবুজের মাঝে সে ভাসছে । সবুজ প্রেমাবেগের সমুদ্র।
অসংখ্য প্রাণ প্রবাহ তাতে ভাসছে আর তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই প্রাণস্রোতগুলি
শুধু তার চারপাশেই নয় একে অপরের অঙ্গাঙ্গী বিসর্পিল। অসংখ্য সেই জীবনস্রোতগুলি
দ্রুতছন্দে পর্যাবৃত্তে তাকে ঘিরে ঘুরছে। সেগুলিকে মানুষ প্রাণী উদ্ভিদ এই ভাবে
পৃথক চেনা যায় না। সবগুলির ভাব একরকম কিন্তু জীবনজ্যোতির উজ্জ্বলতা ভিন্ন। যেহেতু
ইন্দ্রিয় থেকে সে বিচ্যুত তাই শব্দের নাদ ভেদ আর তার বোধে নেই কিন্তু শব্দের
ভাববোধ এখনো স্পষ্ট। হৃতকম্পন কবে বন্ধ হয়ে গেছে। হৃদয়ের অনাহত নাদ অনুভবে আর নেই
কিন্তু জীবনস্রোতগুলির ঘূর্ণননাদ এখন ভাব হয়ে তার বোধে পর্যাবৃত্তে আঘাত করছে। সে
বুঝল তার পরিশ্রুত হয়ে যাবার এটিই একটি অপ্রাকৃতিক নিয়ম।
আর আশ্চর্য !এই কম্পনহীন নাদের ভাববোধ হুবহু অনাহত ধ্বনির সাথে মেলে।
অসংখ্য সেই জীবন ঘূর্ণনের অর্ধচক্র সাঁ আ আ আ..., বা, সো ও ও ধ্বনি এবং পরের
অর্ধচক্র ম ম ম ম...,বা, হমমম নাদ বোধ। সো ও ও ও ও ও ও ক্রমবর্ধমান উজ্জ্বলতা হম ম
ম ম ম অনুজ্জ্বল তরঙ্গ। সে নিজ অক্ষের চতুর্দিকে দ্রুত একপাক ঘুরে যেতেই তার বোধে
এলো অনন্ত শূন্যতা এবং তার মধ্যে বস্তু অবস্তু অগণিত ধরনের তেজ ও শক্তিকণা সবারই
এই একই আবর্তন। প্রতিটির আবর্তনে একই নাদ প্রবাহ। কোনো রকম অনুনাদ নেই। কোনো রকমের
বিক্রিয়া নেই। কোনো প্রতিবিম্ব প্রতিচ্ছবি প্রতিফলন কিছুই নেই সব মৌলিক অনস্তিত্ব।
কোনোকিছুই কারোর উপর আরোপিত নয়। সেইসব নাদ একইসাথে সমতরঙ্গে।
প্রবাহমান অনন্ত সবুজে অসংখ্য জীবনস্রোতের আবেগ আবর্তে তার নানারকমের
পার্থিব বোধগুলি প্রশমিত হতে লাগলো। যে নষ্টকারী ভাবগুলি তার শক্তিশিখার উপরে পরত
পরত অম্লপাপড়ির মত আষ্টেপৃষ্ঠে ঢেকে তাকে অনুজ্বল করে রেখেছিল এবং তার আত্মিক
অবনতির কারণ ছিল, সেগুলি ছিল অনুশোচনা অহংকার হীনমন্যতা বৈষম্য লালসা এবং আরও।
এইগুলি যেমন যেমন সবুজ দিয়ে ধুয়ে যেতে লাগলো তেমনি তেমনি ভিতর থেকে উজ্জ্বলতর কিছু
আবরণ বেরিয়ে আসতে লাগলো। সেই পর্দাগুলি সমবেদনা, অন্যের দুঃখে কাতর হওয়া, শান্তি,
প্রেম, অন্যের জন্যে বাঁচার প্রবণতা এইসব। জীবিতকালে এই ভাবগুলি তার ঋণাত্মক
অবগুণগুলিকে প্রশমিত করতে থাকতো।এবার সেগুলিও সবুজ স্রোতে একে একে মুছে যেতে
লাগলো। যেমন যেমন সে পরিশ্রুত হতে লাগলো তেমনি তেমনি তার নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের
তীব্রতা বাড়তে লাগলো। সুতীব্র ঘূর্ণনবোধে সে দেখল তার হৃদয়াবেগ অসংখ্য টুকরো হয়ে
তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। তার সাথে জন্ম মৃত্যুর বোধ ওতপ্রোতে সেঁটে রয়েছিল সেটিও এবার
অপসৃয়মান। শেষে সেইবোধটি পূর্ণস্রাবিত হয়ে বিলীয়মান হলো।
এবার তার ঘূর্ণন কমে আসছে। ঘুরতে ঘুরতে অনন্ত সবুজ ভাবের কেন্দ্রে
একটি অতি উজ্জ্বল হরিত্শিখা হয়ে সে স্থির হয়ে রইল। বুঝল এই হরিত্ শিখাটিই
পরমপ্রেম যা সে নিষেকলগ্নে সম্ভাবিত ভ্রূণসৃষ্টির জন্য পৃথিবীতে এসেছিল।
জীবনযাপনের কোনো অন্তরঙ্গ মূহুর্তে এক আত্মদর্শনে সমর্পিত প্রেম হয়ে তার পার্থিবশরীরের
হৃদয় কন্দরে পবিত্র উত্থানের জন্য অসীমের সাথে যোগসাধন করেছিল। কিন্তু মননে তা ধরে
রাখতে পারেনি। এই অতি উজ্জ্বল হরিত্ প্রেমশিখাটি একসময় অনন্ত সবুজে মিলিয়ে যেতেই
শুভ্র ও রক্তিম সর্পিল শিকলের মত তড়িত্ রেখাদুটি একটি অনন্তগামী সিঁড়ির মত সোজা
হয়ে গেল। এবার না রইল তার দেহ না বিদেহ। সে এখন না আলোশিখা না আলোকণা না নিরাকার
শক্তি। কেবলমাত্র আধারহীন বোধ এবং অবাধ উত্তরণ।
Divine expression/বিশুদ্ধি সংগম/তিন সেকেন্ড
তার অস্তিত্ব এখন বোধ ছাড়া কিছুই নয়। এই বোধে সে বুঝতে পারলো দিব্য
আলো সিঁড়ি থেকে নিজেকে আর আলাদা করা যাচ্ছেনা। এটিও কোনো শক্তি বা শক্তির তারতম্য
নয়,কোনো প্রায় অদৃশ্য রেখানয়,কোনো সূচক বা দিশাও নয় কেবল একমুখী গমন। দিব্য আলোটি
হয়তো সংশ্লিষ্ট সিঁড়িতে প্রতিভাসিত কিংবা নয়। সিঁড়িটিও যেন কোনো অদৃশ্য প্রভা।
সিঁড়ির অনন্ত গমনের সাথে সাথে সেটিকে ঘিরে ষোলোটি পরাবেগুনী তরঙ্গ উপবৃত্ত
সর্পিলাকারে বহমান। প্রতিটি এক বিশেষ শুদ্ধ লয়ে তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে এবং
প্রতিবার সে যেমন যেমন তরঙ্গপৃষ্ট হচ্ছে তার আত্মজ্ঞান পাওয়ার আত্মক্রন্দনের
শুদ্ধিকরণ তেমনি তেমনি অনুনাদিত হচ্ছে। এবং এইসব প্রক্রিয়া নীরবে নিরাকারে সংঘটিত
হয়ে যাচ্ছে। ষোলোটি উপবৃত্তের ষোলোরকমের অব্যক্ত নাদবোধ। সেই অব্যক্ত লয়গুলি তাকে
যেমন যেমন ছুয়ে যাচ্ছে তেমনি তেমনি সেগুলির ভিন্ন স্বরস্বাদ শেষবারের মত শুদ্ধতা
দিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু সে এখন দিব্য আলোসিঁড়ি থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতেই পারছেনা,তাই
অনুভবে বোধ হোলো তার একমুখী অনন্ত প্রান্তের কোথাও এক অদৃশ্য বিন্দুচক্র থেকে
ফোঁটা ফোঁটা অব্যক্ত অনাহত শাব্দিক অমৃত তরঙ্গ ঝরে পড়ছে সিঁড়ির গা বেয়ে। সেই অরূপ
অমৃত তরঙ্গ সিঁড়ির গায়ে ওতপ্রোতে থাকা তার উপর পড়ছে ও তাকে পর্যাবৃত্তে মাখিয়ে
দিচ্ছে ষোলোটি উপবৃত্ত। এভাবেই তার অনস্তিত্ব বোধ এই অমৃতনাদে ধুয়ে যেতে লাগলো।
ষোলো রকমের বিশুদ্ধতা তাকে আনন্দসঙ্গীতময় পার্থিব প্রকৃতির ষোলো রকমের আনন্দ ভাব
মুর্ছনা আবার নতুনকরে চিনিয়ে দিল। যখন সে পার্থিব জীবজগতে ছিল,ষোলো রকমের বিশুদ্ধ
তরঙ্গ তার জীবন সঙ্গীতময় করে তোলার জন্য সবসময় তাকে ঘিরে থাকতো। কিন্তু অবস্থা বিশেষে
ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তার পরিবেশ ও স্থিতি বিষময় হয়ে উঠতে এই বিশুদ্ধতা
বিকারগ্রস্ত হয়ে যেত। তাই তার জীবন দুঃখময় ও আত্মজ্ঞানহীন হয়ে পড়ত। আবার এমনও হতো।
কখনো কখনো এই মিশ্র আনন্দ লহরে ভাসতে ভাসতে নিজের অস্তিত্ব ভুলে বাহ্যজ্ঞান শূন্য
হয়ে পড়ত ও ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও তার আত্মজ্ঞান হয়ে যেত। এক অমৃতময় সুরের গিমিকে
সে শরীর ও মন থেকে আলাদা হয়ে সম্পুর্ণ বিশুদ্ধ আত্মারাম হয়ে যেতো। কিন্তু সেটি
ক্ষণিকের জন্য। তার শরীর ও মন জুড়ে আবার দুর্দশাগুলি তক্ষুনি ঘিরে আসতো। এখন কালের
গর্ভ নামের অপ্রতিরোধ্য মহাজাগতিয় মাত্রাটি থেকে সম্পুর্ণ ছিন্ন হওয়ার ফলে তার এখন
পবিত্রতা মাত্রাটি ছাড়া কোনো টান নেই। ষোলোটি পবিত্র আনন্দ ধ্বনিধারা একসময় এক এক
করে বন্ধ হলেই সে অন্তর্জগত থেকেও বিমুক্ত হয়ে যাবে। এই উপলব্ধিতে সে এক অনন্য
ভিন্ন আনন্দ আবেগে রূপান্তরিত হতে লাগলো। এ এক অজানা অমহাজাগতিক সত্ত্বায়
রূপান্তরন। অনন্ত যাত্রা পথে সে অনন্ত অব্যক্ত স্নিগ্ধ ধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো
অসীম থেকে ভিন্ন অসীমতায়।
যেমন যেমন সে রূপান্তরনে পূর্ণতা প্রাপ্ত হতে চলল তার অব্যক্ত
অস্ত্বিত্বের আবেগ অনন্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ষোলো রকমের পবিত্রতাগুলি অন্তর্হিত।
পূর্ণ মৃত্যু বা অনন্ত শূন্যতা প্রাপ্তির ঠিক আগে দেখা গেল সে একটি প্রায় শূন্য
বিন্দুর মত তেজ জ্যোতি রূপ ধারণ করেছে। সেই জ্যোতিটি অগোচর নিখিলের অনুশাসন।
(ক্রমশঃ)
0 মন্তব্যসমূহ