সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বনানী চক্রবর্তী

                                    


শামীম রেজার কবিতার নকশি কাঁথা





“ও পরাণী দেখেছো কি?মথুরার মাঠে বসে তুমি নির্জন

সাঁকোর শরীর এলিয়ে আমি

                                   কলমি শাবক”

সাঁকোর শরীর এলিয়ে কলমি শাবক হয়ে গ্রাম বাংলার একেবারেই বুনো গন্ধ নিয়ে নব্বই দশকে আত্ম প্রকাশ ঘটেছিলো এক তরুণ কবির,যাঁর ঐতিহ্যে বরিশাল হলেও বরিশাল বলতে যাঁর কথা মনে পড়ে যায়,তাঁর প্রভাব মুক্ত হয়েই।হ্যাঁ, তরুণ কবি পূর্বসূরীর কিছু শব্দবন্ধ কারুকাজ ধার করে প্রথম যৌবনের উৎসব প্রাঙ্গণে সব কবিই যান,যেতে হয়, তবুও খুব সামন্যতই ,বরং নিজস্ব কথন ভঙ্গিমায়, শব্দ নির্মাণে প্রেম,আঘাত,সমাজ বাস্তবতা ইতিহাস পুরাণ প্রকৃতিকে নিজের মতো করে মাটি,জল, গাছ লতাপাতার আলপনায় নতুন বিশ্ব রচনা করলেন।সে বিশ্বে কবি জসীম উদ্দিন,শামসুর রাহমান,জীবনানন্দ দাশ কিংবা বিনয় মজুমদার উঁকি দিলো বুঝি ভাববার আগেই “আমরা বেড়েছি স্যাঁতসেঁতে পিছলা আস্তিনের কচুরিপানা জলে”আমাদের অন্য এক ভুবনে নিয়ে যায় ।আমরা হাত ধরে ফেলি আরেক ভূমিস্বর্গের কবি শামীম রেজার।

    সচেতন, গোছানো শব্দ কেটে জুড়ে,বাক্যবন্ধ কেটে জুড়ে জোড়কলম করা,কিংবা ছন্দের স্রোতে হালকাভাবে ভেসে যাওয়া,কেয়ারী করা ফুলের বাগান তার কাব্যকে কখনোই করে তোলেননি শামীম,বরং প্রকৃতির রূপ রস গন্ধকে তাজা ফুলের ঘ্রাণ করে তুলেছেন।প্রকৃতি,ইতিহাস,পুরাণ, সমাজ দর্শনকে সরাসরি স্বাদ গন্ধ পেতে দিয়েছেন তাঁর কাব্যে।তাই অগণিত কবির অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের ভিড়ে চিনে নিতে অসুবিধা হয়না “প্রতিভা সন্তরণ,এমন রাত্তির শেওলি চোখ”।১৯৯০ থেকে ২০০১সালের অনুভূতিমালা নিয়ে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পাথর চিত্রের নদীকথা”শামীমকে চিনিয়ে দিলো একজন স্বতন্ত্র কবি হিসেবে।যে বুনতে পারে অনন্ত অতৃপ্ত প্রেমের নকশি কাঁথা।সে কাঁথায় উঠে আসে বহু গ্রাম বহু জনপদ,বধূসরা নদী।তাঁর সেই একান্ত নদীর ঘ্রাণ পাবার আশায় আশায় এভাবেই বহু নদীর কাছেই নিয়ে গেছেন আমাদের,নিয়ে গেছেন হাসুনা দ্বীপের বিজল্প পল্লীতে।যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন হাত দক্ষিণ চরের শরীরে ঘুমিয়ে গেছে বরফ নদী।অনন্ত আকাঙ্খায় প্রেমিকার ভেসে থাকা,ডুবে যাওয়া ভবিতব্যের মাঝখানে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।‘তিনশত রসের গৃহ,সাড়ে হাত অনন্ত দ্বীপ;তারপরও ঝাউকাউ তিয়েন পাহাড়’হয়তো তাকে লুকিয়ে রেখেছে।নদী ও নারীকে আবিষ্কারের আগ্রহ নিয়ে পাহাড় ও গুহাচিত্রে বুঁদ হয়ে আমরাও তাঁর সঙ্গে বলে উঠেছি-

    “মালগার গুহাচিত্র হতে উঠে

আসা বলগা হরিণ,অনূড়া সবুজ কোষে ভোরের রোদ্দুর ফেলে

ভারত সাগরতলে কীভাবে হারায়”

এই হারানো দিনের হারানো নস্টালজিয়ার মতো তার মানসী ও তাঁর আকন্ঠ অনুভূত প্রকৃতি তাঁকে স্মৃতি আক্রান্ত করে,মোহমুগ্ধ মন নিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে “ও পরাণী নকশি কাঁথা থেকে উঠে আসো তুমি”।ক্ষনিকের বিচ্ছিন্নতা,মান অভিমান দূরে সরিয়ে যেন আমাদেরই উচ্চারণ হয়ে ওঠে-

   “রেখার আড়ালে জলদাহে উঁইয়ের ঢিবি পুড়ে গেলে

    অভিমান আর ঈর্ষারা হলুদ মেঘ হয়ে গলে পড়ে, আমার

     ভিতরে আমার বানানো নদীর ঘোলাটে জল...”

অভিমান দূরে সরে গেলে ‘চালতাপাতা ভোর’ উঁকি দেয়।রক্তিম সূর্য নদীর জলে আবির গুলে দেয়।স্বপ্ন সন্ধানী হয়ে আবিষ্কার করতে ইচ্ছে করে তাকে-

     “সেই মেয়েটি ইচ্ছামতি দূরের পাড়ায় থাকে,ভেসেছিলো

      নিমের ছায়ায় খেয়ালি এক রাতে,কন্ঠে তার ছয় ঋতু ঢেউয়ের

      মুদ্রাজানা”...

তাকে,সেই দোলনচাঁপা চোখের সঙ্গিনীকে কবি সুমেরু নদী অতিক্রম করতে সঙ্গী করতে চেয়েছেন।কোনো এক ধ্যানী নদী যে স্বপ্ন সমুদ্রের মোহন মোহনায় পৌঁছবে একদিন।এখানে পৌঁছতে চাঁদকপালী নদী কীর্তনখোলা নদী,শিবসা নদীর জলধারায় আমাদের মিলিয়ে মিশিয়ে অচিরেই ভুলিয়ে দিয়েছেন বাস্তব কল্পনার নদীনামার সীমারেখা।এখানেই এই কবির মুন্সিয়ানা।কোন পথে,কোন বাঁধাধরা পথে চলেছিলাম আমরা অচিরেই ভুলে গিয়ে ‘কাজরী সুরের মেয়ে’র ‘শাপলা সিঁদুর ঠোঁটের’ রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।হাঁটতে চেয়েছি নিভৃত নিকুঞ্জ সাজানো সরস পল্লীর মায়াময় পথে,হাত ধরে।কিন্তু হায়, তখনই দৃষ্টিপাতে জেগে উঠেছে আরেক দিগন্ত-

“এ অর্যমাকালে সমস্ত পথ এঁটেছে সরযূ নদীর

কাছে দুর্গম দূর্গ প্রান্তর...”

সে পথে ‘সেই কবে থেকে বুদ্ধের অঞ্জলি আত্মার আঁতুর ঘরে কাঁদে একা/আঁচলে আকাশ মেঘের কেয়া পরাগ মেখে’ ঘুরি।সেই ঘূর্ণায়ন হয়ত স্বপ্নের বিভ্রমের।তবু সে পথ থেকে সরে আসতে মন সায় দেয় না।‘যেখানে দীর্ঘ সময়ের স্তব্ধ অন্ধকার ধুয়ে মুছে কইতর রঙে’রঙিন হয়ে আছে।‘ “ফিবাসীয় বংশী কন্ঠের অলৌকিক জাদুর মহুয়া সুরে’ মাতাল মন মুগ্ধতার ‘কেয়া পরাগ’ মেখে নিয়েছে-

    “ভিজে ভিজে যেখানে ভাসবে আমরণ

     শান্তির কেওড়া জল,সরযূ নদীর জলে...”

গেরুয়া মাটির ঘুমন্ত অঙ্কুরে আমরা মেখে ফেলি শ্রীরাধার জরায়ু জল।অচিরেই আবিষ্কার করি আমাদের হৃদয়ের ঝিঁঝিঁপুর গ্রাম।

      প্রথম কাব্যগ্রন্থের যাত্ৰার নিজস্ব পদভঙ্গিমায় শামীম যে বলিষ্ঠ চলার অঙ্গীকার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন “নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে”(২০০৪),”যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণ নগরে”(২০০৬),”ব্রহ্মাণ্ডের ইস্কুল”(২০০৯),”শামীম রেজার কবিতা”(২০১২),”হৃদয় লিপি”(২০১৪)বা “দেশহীন মানুষের দেশ”(২০১৮)-এও সে পথেই হেঁটেছেন তিনি।

    মসলিন রোদ্দুরে গা ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমরাও তাঁর পাশেপাশে  তাঁর কাব্য ভুবনে হেঁটে চলেছি।ঘুঘুডাক মায়াবী আদরে পুরুষ হৃদয়কে যেমন বন্ধন করেছে,আমরা পাঠক,কখনো পুরুষ কখনো নারী সত্তার অনুভূতিমালা নিয়ে শরীরের রুগ্ন অমাবস্যা চাঁদে আলো ফুটিয়েছি।আমাদের রক্তে নৃত্য করে উঠেছে সন্ধ্যানদীর জল, নীরবতার নির্মম সঙ্গীত।আমরাও কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলেছি-

    “বর্ষার মাটি ঘর চুইয়ে বিন্দু বিন্দু পলল রেণু পড়ে আমাদের শরীরে

     চতুর্দিকে ছাইরঙা অবসন্ন সময়, বাসক পাতার ঘ্রাণের তন্ময়তায়

     স্বপ্নকে কোলে বসিয়ে ভাবছি আমরা...

স্বপ্নের সন্তরণে অতঃপর কি তুহিন শূন্যতার ভেতরে হেঁটে যেতে পারবো! ছায়াপথের কেন্দ্রবিন্দুর কালো গহ্বরে লুকোনো অদৃশ্য মেঘ কখনো আমার হবে কি!

      দূরে মোলায়েম শব্দ মিলায়ে যাচ্ছে

      এ এক অদ্ভুত পারিজাত বন!চতুর্দিকে ছায়াপথের ছায়া প্রবাহ...”

“চিতা চোখের সাবধানী দৃষ্টি এড়ায়ে যতবার আমাদের স্বপ্নপরানীরা ছুটেছে অনন্ত লোকে...”ততবারইতো দীর্ঘশ্বাসের বিষাক্ত শয্যায় তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

    ফলে,থানকুনির শরীর ছুঁয়ে চোখ আর জ্বলেনা, জ্বলেনা প্রতীতি পুরাণ।“মানু চাষার ডুবে যাওয়া এক টুকরো আবাদি জমি/গেয়ে চলে ভাঙ্গনের গান.../কচুরিফুলের বেগুনি সৌরভ পাতিহাঁসের পালকে/স্পর্শ আবেশ মাখেনা দীঘল জল”। হাওয়ায় ভাসে’ভাঙা ঘাসী নাওয়ের গলুই’।আমরা উজান গাঙের জল স্রোত ঠেলে কোন আগামীর দিকে তাকিয়ে থাকি।নিমশ্বাস নিয়ে স্বপ্ন দেখি কত সময় পার হলে মানুষ মানুষ হবে।মানুষের সহজাত আশা আ

কাঙ্খাগুলো প্রণয়ী পাখির মতো ওম ও আদরে ভরিয়ে তুলতে পারবে।

      প্রকৃতপ্রস্তাবে ওম ও আদরকে এই পৃথিবী,এ সময় আর ছাড়পত্র দেয়না।‘পাঁজরের সিঁড়ি ভেঙে যে কৃষক’ তার লাঙল নিয়ে আদিগন্তকাল হেঁটে চলেছে,তারও হৃদয়ের গভীরে’সর্পিল সময় ও শরীর’এক অতিক্রমহীন ভয় ও শঙ্কা দিয়েছে-

    “অনিচ্ছার গালিচা পাতা শরীর প্রতিদিন উদ্বেগে নির্ঘুম...ক্লান্তিহীন...ফোঁপায়ে কাঁদে  

     রাত্রি উল্লাসিত দিন যায় দহন তৃষ্ণায়, তারপরও চলে অবিরাম,পকেটে অজস্র 

     ক্রোধ,ক্লান্তির পীড়নে নিরব কান্নায় ভাঙে হৃদয়...গোপনে কয়লার বদ্ধ দেয়ালে

     হানে আঘাত...প্রতিঘাত হয়ে শরীর ও মন,সময় সর্পিল ফণা তোলে,

     নিয়তি অলস হাসি হাসে...জুতোর জিহ্বা লেহন করতে হয়, পুনর্বার ইচ্ছা-

     অনিচ্ছায়”

এই অপমান,এই আপোষ,এই মেনে নেওয়া কতদিন!কতদিন!কতদিন!প্রথম দিনের সূর্যের মতো যার গর্ভের থেকে আত্মপ্রকাশ করেছি আমরা,তার কাছেও কিভাবে এই ম্লানিমা প্রকাশিত হবে!মাযের কাছে অনন্ত আকুতি নিয়ে আমাদের পারা না পারা নিয়ে আধভেজা  চোখ বুজে যেন সমর্পণ করেন কবি শামীম রেজা।বলেন তাঁর সাফল্যের ব্যর্থতার কথা-   

    “জন্মনাভি থেকে মা তোর রক্তের স্বাদ নিয়ে এই আমি

     এতটুকু খোকা,পাপসুখ স্পর্শে বাঁচা ঝড়ের বাবুই

     বুদবুদ চোখের উচ্চারণ দেখে বলেছিলো অহল্যা মা-

     সূর্যায়ু হবে তুমি পূর্ণ কবিতা সমান,এখন গ্রহণ দিনে

     মা শেলেটে আঁকিবুকি অহোরাত্রি মেঘের বসন

     শূন্যবোধে অন্ধকার ঘোর দরজায় একা...”

অন্ধকারে লেখা জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে ঘোর আঁধারকালে কবি শামীম হারিয়ে যাননি কখনো,শরীর ও মনে আদ্যন্ত ইতিবাচক দর্শনকেই লালন করেন তিনি।ঝড়ের বাবুই পাখি বাসা হারানোর হতাশায় ডুবে নিজেকে পরাজিত সৈনিক করে তোলেন নি।আবার নতুন করে বাসা রচনার উপকরণ সন্ধানী মন নিয়ে পৃথিবীকে ছুঁয়ে ছেনে দেখেছেন,ভালোবসেছেন।আবার নতুন করে জামদানি জ্যোৎস্নায় ভেসেছেন।

       শামীম রেজা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ