সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মহুয়া চৌধুরী/জুন'২০২২/অন্তিম পর্ব-

 


 অলেখা অধ্যায়-২

অন্তিম পর্ব


ত্রয়োবিংশ অধ্যায়

এখন লক্ষ্য কাম্যক বনধৃষ্টকেতুর রথ ছুটেছে দ্রুত গতিতেস্থির দৃষ্টিতে সামনের পথের দিকে তাকিয়ে আছে করেণুমতীকিন্তু সে কিছু দেখছে নাকিছু শুনছে নাবুকের কাছে ধরে রেখেছে ঘুমন্ত শিশু পুত্রটিকেবনের সীমান্তে পৌঁছে রথ থামাতে হোলবৃক্ষময় জটিল পথে রথ প্রবেশ করতে পারবে নাক্ষিপ্র পায়ে নেমে এল করেণুঅসংকোচে এগিয়ে গেল

“এত নিবিড় এ অরণ্যপথ খোঁজা সহজ কথা নয় বোন”- উদ্বিগ্ন স্বরে ধৃষ্টকেতু ভগিনীকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলেন

কঠিন হাসি ফুটল করেণুর মুখেএক অহোরাত্রের মধ্যে তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে যেন “এতগুলি মানুষ একত্রে আছেন এই স্থানেশুনেছি বহু ব্রাহ্মণ তাঁদের সঙ্গে বাস করছেনযেখানে মানুষ, সেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হবেইদূর থেকেও প্রকাশ পায় অগ্নিশিখার ঔজ্জ্বল্যতাই দেখে খুঁজে নেব তাঁদের”- এমন দৃঢ়তায় উচ্চারণ করল সে বাক্যগুলি, যেন সত্যই তার সামনে কোনো বাধা নেইআর পিছু ফিরে না তাকিয়ে নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘনসম্বদ্ধ বৃক্ষদের আড়ালে।। ধৃষ্টকেতু ও সারথি অগত্যা ক্ষিপ্র চলনে অনুসরণ করতে লাগলেন তাকেতাঁরা দেখলেন বনচারী শবরদের দু একটি গোষ্ঠী এখানে বাস করেতাদেরই একজন দিক নির্দেশ করে দিলে

অল্পক্ষণ চলার পরেই, তাঁরা শুনলেন কিছু দূর থেকে ভেসে আসছে অনেক সম্মিলিত মানুষের আলাপের ক্ষীণ গুঞ্জন ধ্বনি যেনসেই দিক লক্ষ্য করে নির্বাধে এগিয়ে চলেছিল করেণুমতীঅনভ্যস্ত পাতার স্তূপ ঢাকা সরু পথমাঝে মাঝে ছোট ছোট কাঁটা বিঁধে যাচ্ছিল তার পায়ের তলায়ভ্রূক্ষেপও করছিল না সে 

হঠাৎ এক ঘন পাতায় ঢাকা বৃক্ষের অন্তরাল থেকে তাদের ঠিক সম্মুখে বেরিয়ে এলেন একটি মানুষঅর্ধস্ফুট বিস্ময়ের শব্দ করে উঠল করেণুএক প্রিয় পরিচিত মানুষের সঙ্গে তাঁর কিছু সাদৃশ্য আছে বটে, কিন্তু বৈসাদৃশ্য অনেক বেশিতার বিগত কালের চেনা মানুষটির গাত্রবর্ণ ছিল মার্জিত তাম্র ফলকের মতোএমন মলিন নয়রুক্ষ কেশ এঁরগ্রীবা ও গন্ডে পরিচর্যাহীন অযত্নের শ্মশ্রু-গুম্ফসামান্য কৃশকঠিন গ্রীবাগাঢ় তাম্র বর্ণের নক্ষত্র তারকা দুটিআয়ত, ঈষৎ রক্তাভ নয়নে উগ্র ক্রোধকিন্তু পর মুহূর্তেই তাকে দেখে চাহনিতে ফুটে উঠল অপ্রত্যাশিত বিস্ময় আনন্দধৃষ্টকেতুর দিকে ফিরে তিনি বললেন, -“এমন ভাবে এলে? বড় কঠিন দায়িত্ব এখন তোমার উপরতোমার ভগিনী ও ভাগিনেয়কে রক্ষনাবেক্ষণের ভার, তোমাকেই নিতে হবে ঈষৎ মলিন হাসি হাসলেন নকুলধৃষ্টকেতু স্বভাবে আবেগময়রূপবান মহাবলশালী ভগ্নিপতিকে আজ এমন সহায়সম্বলহীন অবস্থায় দেখে  চোখে জল এল তাঁরঅশ্রু শাসন করতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলেন না তিনি

নকুলই তখন আবার বললেন,-“উত্তর দিকের ওই শাল্মলী গাছের সারি লক্ষ্য করে আরো এক চতুর্থাংশ ক্রোশ পথ গেলে আমাদের নূতন আবাস দেখতে পাবে”- 

ধৃষ্টকেতু ও সারথি, সে স্থান ত্যাগ করার পর, নকুল পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন করেণুমতীর কোলের ঘুমন্ত শিশুর দিকেধীরে ধীরে মুখের কঠিন রেখাগুলি কমনীয় হোলআবিষ্ট হোল চাহনিহাত বাড়িয়ে পত্নীর কোল থেকে নিলেন তাকেতার শিশু শরীরের ঘ্রাণ নিলেনতাঁর প্রতিরূপ যেন এই শিশুআরো কতকাল তিনি দেখবেন না একে

“জন্ম সংবাদ পেয়ে, সেই মহা বিপর্যয়ের মুহূর্তেও, জ্যেষ্ঠ বড় আনন্দিত হয়েছিলেন”- নকুল বললেন

কিন্তু যুধিষ্ঠিরের উল্লেখ মাত্র ক্ষোভে কুঞ্চিত হয় করেণুর সুন্দর ভ্রূ জোড়া “জ্যেষ্ঠ, কত দায়িত্বজ্ঞানশূন্য মানুষ ভাবি শুধুসর্বস্ব হারাবার পরেও ভ্রাতাদের, আপন পত্নীকে পণ রাখে কোন উন্মাদ!”

“জান করেণু, ভ্রাতাদের মধ্যে প্রথম পণ রেখেছিলেন তিনি আমাকেইকেন? বিমাতার সন্তান বলে কি? অথচ মনে হোত আপন ভ্রাতাদের তুল্যই স্নেহ করেন আমাদেরও

“তিনি কাউকে স্নেহ করেন না, শ্রদ্ধা করেন নাঅন্তরে নিষ্ঠুর তিনিআপনি---আপনারা চারটি ভ্রাতা তাঁর পাদপীঠ শুধুযেখানে অবস্থান করে নিজের যশ গাথা প্রচার করবেন তিনি দিকে দিকে”- ক্রুদ্ধ মুখে বলে করেণুশুধুই বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে কেউ শ্রদ্ধেয় হতে পারে না, এই বিশ্বাস তার অন্তরে দৃঢ়তর হয়ে উঠেছে

তার দীর্ঘক্ষণের সঞ্চিত ক্রোধের উষ্ণ অশ্রু এবার অবশে বয়ে যায়তার স্বামী, পরম সুন্দর এই জ্যোতির্ময় পুরুষ আজ নিঃস্বপরাজিতকি কঠিন এ জীবন “আমি সুক্তিমতীর প্রাসাদে যেতে চাই নাআপনার সঙ্গে অরণ্যবাসেই আমার শান্তি”- উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের আবেগে ভেঙে ভেঙে যায় তার কণ্ঠস্বর

জটিল বনপথের দিকে তাকিয়ে থাকেন নকুল “যত্ন প্রয়োজন এ শিশুরপ্রয়োজন শিক্ষারওএই দুর্গম অরণ্যে কেমন করে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব তাকেঅনেকগুলি ব্রাহ্মণ আমাদের প্রতি প্রীতিবশত স্বেচ্ছায় দুঃসহ অরণ্যবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেনসকলের ক্ষুন্নিবৃত্তির আয়োজনেই সময় চলে যাবেএ সুকুমার শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন! আর মাত্র ত্রয়োদশ বছরের পরেই সকল দুর্ভোগ শেষ হয়ে যাবে ভেব নামহাসর্বনাশের খাঁড়া উদ্যত হয়ে থাকবে, মাথার উপরেস্বাভাবিকভাবেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আসন্নঅবধারিত লোকক্ষয়দ্রৌপদীর অবর্ণনীয় সেই লাঞ্ছনা যদি দেখতে নিজের চোখেতার কাতর আর্তনাদ আমার কানে ভেসে আসে এখনওভীষণ ক্রোধে সমগ্র পৃথিবী ছারখার করে দেবার বাসনা জন্মায়ত্রয়োদশ বর্ষ পরে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী তাই, জেনে রেখ

“আমি অনুভব করতে পারছি হে স্বামীন, তাঁর সেই অবমাননাআহ্‌আহ্‌”- আহত পশুর মতো আর্তনাদ করে করেণু “নারীর কি চরম অসম্মানসে কথা ভেবে যন্ত্রণায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে আর্যপুত্ররক্তলিপ্ত একবসনা রাজ্ঞীকে কেশাকর্ষণ করে, প্রকাশ্য সভায় নিয়ে এসেছিল নরাধম দুঃশাসনদুর্যোধন ঊরু দেখিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করেছিলকর্ণ কুৎসিত উল্লাসে হাসছিল  বেশ্যা’ ‘বেশ্যা বলেনরকের কীট ওরাআমি বলছি আর্যপুত্র, চরম যন্ত্রণাময় মৃত্যু নির্ধারিত হোক ওদের জন্য”- দৃপ্ত ক্রোধে করেণুর মুখ রক্তাভ হয়ে ওঠেঅগ্নিবর্ষী দুই চোখ

শিশুটি এবার ঘুমের ঘোরে উসখুস করেতারপর চোখ খুলে তাকায়চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সেমুহূর্তের মধ্যে কোমল হয়ে যায় তার মুখের ভাবআহা ক্ষুধা পেয়েছে ওরকতক্ষণ দুগ্ধ পান করেনিঘুমের মধ্যে কত সময় কেটে গেছেসে একটি বৃক্ষ কান্ডে পিঠ রেখে ভূমিতে বসেশিশুকে যত্নে কোলে নিয়ে উন্মুক্ত করে বক্ষের নিচোল  দুগ্ধভারাবনত দুটি জননী স্তন প্রকট হয় নকুলের সামনেশ্যামবৃন্ত, নিটোল, পূর্ণদুগ্ধ পানের তৃপ্তিতে শিশুর চোখে আবার ঘুম নেমে আসেমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন নকুলপ্রথম দেখলেন এ দৃশ্যনির্জন এই ছায়াময় অরণ্যে পিতৃত্বের অনুভবে প্লাবিত হন নকুলপুত্রের মাথায় আলতো করে হাত রেখে মৃদু স্বরে কত কি যে কথা বলে যানঅর্থহীন সব কথা, নির্ঝরিণীর মতো নিম্নগামী অপরূপ স্নেহের উদ্ভাস 

কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটি স্মৃতি মনে পড়ে নকুলেরউদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মুখ

“মনে পড়ে করেণু, এক রাত্রে নিদ্রার আবেশে শুনেছিলাম যেন তুমি বার বার আমাকে কত কি প্রশ্ন করছিলেখুব উত্তেজিত মনে হয়েছিল তোমাকেতুমি একটি নাম উচ্চারণ করছিলে কতবারনিরমিত্র’ ‘নিরমিত্রমনে পড়ে?”

অব্যক্ত আর্তনাদ ঝড় তোলে তখনই করেণুমতীর প্রতিটি রক্তকণায়ওষ্ঠাধর ব্যদিত হয়বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে শুধুনকুল লক্ষ্য করেন না

“এ শিশুর জন্মবার্তা এসে পৌঁছাল যখন, আমরা বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত তখনতবু আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম সকলেবংশধারা তো নদীস্রোতের মতোকুলনামকে বহন করে নিয়ে যায় কাল থেকে কালান্তরেঅর্জুন বলেছিলেন, এ পুত্রের নাম হোক নিরমিত্রজান শুনেই করেণু আমার মনে হয়েছিল কবে যেন তোমার মুখে শুনেছিলাম এই নাম

বিস্মিত মুখে নকুল দেখেন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে করেণুজড়িত স্বরে বলে,-“আর্যপুত্র, যুদ্ধ কি অবধারিত?”

“অবশ্যইনিরুপায় আমরাভেবেছ কি যে, ধার্তরাষ্ট্রগণ ত্রয়োদশ বর্ষের পরেও সুশীল বালকের মতো আমাদের হাতে ফিরিয়ে দেবে সকল সম্পদ? আর নারীত্বের সে লাঞ্ছনার প্রতিশোধ যদি না নিতে পারি, তবে বৃথা এ জীবনবৃথা যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমি সত্য, কিন্তু এ যুদ্ধে যদি অংশ গ্রহণ না করি, তবে ধিক আমাকে”- পরুষ কণ্ঠে বলেন নকুলকরেণুর মুখভাব দেখে সহসা অসহিষ্ণু হয়েছেন তিনি “তুমি কি ভীত?”

কয়েক মুহূর্ত আনত নয়নে বসে থাকে করেণুমতীখুব দ্রুত কত কি ভাঙা গড়া চলে তার মধ্যেতারপর শিশুকে বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়স্থির এখন সেআর কোনো আশঙ্কা নাইআপন লক্ষ্যে অবিচলতার মুখে ঔদ্ধত্য নাই, শুধু দৃঢ়তাস্পষ্ট উচ্চারণে বলে,-“হ্যাঁ আর্যপুত্রসত্যের আলোক সহসা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে তীক্ষ্ণ এক বল্লম হয়েবিদ্ধ করেছে আমার হৃদয়কেআমি জেনেছিআমি জেনেছি মঙ্গল কি? অমঙ্গলই বা কি? তাই আমি ভীতএ ভয়ে অগৌরব নাইআমার সর্বশক্তি দিয়ে রোধ করতে চাই যুদ্ধের মহা সর্বনাশকে

চকিতে মনে পড়ে নকুলের মাত্র কয়েক দিন পূর্বে বিদুরকে বলা অগ্রজের কথাগুলি

এগিয়ে চলে করেণু, উত্তর দিকের শাল্মলী বৃক্ষসারির পথ ধরে  আর পিছন ফিরে তাকায় নানকুল বিমূঢ় ভাবে অনুসরণ করেন তাকে

চতুর্বিংশ অধ্যায়

অরণ্যের যে অংশে পান্ডবদের পর্ণকুটির, করেণুমতী পৌঁছায় সেখানেকুটিরের চারিদিকের কিছু স্থান পরিষ্কৃত করা হয়েছেসে দেখে বহু মানুষের সমাগম হয়েছে এখনরয়েছেন দ্বারকার যাদবাধিপতি কৃষ্ণওপান্ডবসখাতার পিতৃহন্তাআগে যতবার দেখেছে সে তাঁকে, নীরব বিদ্বেষ স্রোত প্রবাহিত হয়েছে তার অন্তরেকিন্তু এই মুহূর্তে, তা আর অনুভব করছে না সেতার দিগন্ত রেখা বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশদূর থেকে আরো দূরে 

সে কুটিরের সামনে দ্রৌপদীকে বসে থাকতে দেখেঅপমান, অগ্নিশিখার মতো আজও প্রজ্বলিত তাঁর সর্বাঙ্গেরুক্ষ কেশরাশি ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর মুখে, কাঁধেঅনবদ্য দেহলতা আবৃত সামান্য বসনেপ্রসাধনের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নাইসম্পূর্ণ নিরলঙ্কারঅল্প কৃশ হয়েছেন তিনিকঠিন গ্রীবাআয়ত, ঘন পল্লবের ছায়া পড়া দু চোখের মণিতে অপার্থিব জ্বালাতবু কি অপরূপ এই সৌন্দর্য! যেন অগ্নিগর্ভ বৃক্ষ এক!

সেই জনসমাবেশে তার পরিচিতেরাও ছিলেন অনেকেইভোজ, অন্ধক, বৃষ্ণিবংশীয় প্রধানগণ, কুরু কুলের সম্পর্কিত আত্মীয় ও জ্ঞাতি, বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন নৃপ। বহু ব্রাহ্মণও উপস্থিত সেখানেআর ছিলেন পান্ডব ভ্রাতাদের অপর পত্নীরাসুভদ্রা ও তার পুত্র অভিমন্যুও ছিলসপুত্র করেণুকে বিশেষ কেউ লক্ষ্য করে নাসে শোনে কৃষ্ণ যুধিষ্টিরকে সম্বোধন করে দৃপ্ত স্বরে বলছেন,-“আপনাদের এ দুর্গতি এক ক্ষণিক অবস্থা শুধুআমি অনুভব করছি, ভারত ভূমি আজ তৃষ্ণার্তদুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি ও কর্ণের রক্ত পান না করে তৃষ্ণা মিটবে না ধরিত্রীরআরো রক্তআরো রক্তঐ দুরাত্মাদের অনুগত যারা, তাদের শোণিতও পান করবেন মাতা পৃথিবীঘৃণিত ব্যক্তির অনুগামী যারা, তারাও ঘৃণিতকারণ তারা বিশ্বের অশুভ শক্তি বৃদ্ধি করে” ভীষণ ক্রোধে তাঁর দুই নয়নের শ্বেত অংশ রক্তিম হয়ে উঠেছেমুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণ করতলযেন সম্মুখে দেখতে পাচ্ছেন যূথবদ্ধ শত্রুকেএখনই সংহারে উদ্যত হবেন  

সেই উন্মাদনা প্রবল বন্যার মতো প্লাবিত করে উপস্থিত জনতাকেসমস্বরে জয়ধ্বনি করে ওঠে তারা

কলরব স্তিমিত হলে দ্রৌপদী উঠে দাঁড়ালেনদীর্ঘ আলুলায়িত কেশ স্পর্শ করেছে তাঁর জঙ্ঘাগাছের ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির রেখা এসে পড়েছে তাঁর মুখেনারীর সহজাত সৌন্দর্যে ভাস্বর এই নিরাভরণা নারীসমুদ্রোত্থিতা লক্ষ্মীর উপাখ্যান মনে পড়ে তাঁকে দেখেভীম ও অর্জুন দাঁড়ান তাঁর দুপাশে দুটি সুউচ্চ স্তম্ভের মতোদ্রৌপদী বলেন,-“হে সমাগত মাননীয়গণ, জানি পান্ডুপুত্রদের প্রতি প্রীতিবশত আজ এই গহন অরণ্যে আপনাদের আগমন ঘটেছেতবু, তাঁদের বক্তব্য প্রকাশের পূর্বে, এই সামান্যা নারীর বেদনা কাহিনী নিবেদিত হোক আপনাদের সম্মুখে”- তাঁর তীব্র মধুর কণ্ঠস্বর অনুরণিত হয় বনান্তেমোহাবিষ্ট জনতা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এই অলৌকিক রমণীর দিকেকারোর মনে পড়ে কত কাল আগে, সেই স্বয়ম্বর সভার কথারক্তাম্বরা, রত্নালঙ্কারশোভিতা কুমারীকন্যা তখনসলাজনয়না, অনিন্দ্যসুন্দরী বটে, কিন্তু আরো কয়েকটি সৌর বর্ষ যেন আরো সূর্যালোক, আরো নক্ষত্রের প্রভায় অভিসিক্ত করে আজ তাঁকে অলৌকিক জ্যোতির্ময়ী করে তুলেছেপৃথিবীর ভূমি ও আকাশ এমন রূপ কি দেখেছে আগে? দ্রৌপদী বলেন, তাঁর চরম লাঞ্ছনা কথারোদনের বেগে কখনও জড়িত হয়ে যায় তাঁর কণ্ঠকখনও ক্ষুধিত ব্যাঘ্রিণীর গর্জন হয়ে ছিন্ন করে ফেলতে চায় ত্রিলোককেঅবশেষে তিনি তীব্র মর্মভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন সুদূর নীল শূন্যের দিকেবলেন তাঁর গভীর নিঃসহায়তার কথা, কেউ নাই তাঁরস্বামী নাই, পুত্র নাই, পিতা, ভ্রাতা, সখা কেউ নাইনীলকমলের মতো দুটি করতলে নিজের মুখ ঢাকেন তিনিঅবিরল ধারায় অশ্রু নামে, তাঁর গন্ড, কণ্ঠদেশ পেরিয়ে অতিক্রম করে সুজাত দুটি স্তনের উচ্চাবচ রেখা

জম্বুদ্বীপের বীরশ্রেষ্ঠ পুরুষেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকেনঐ নারীর অবমাননার কারণে আজ নিজেদের হীনবীর্য মনে হয়ওই অশ্রুধারা মোছাতে প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারলে, তবেই যেন জীবনের সার্থকতাপাপাচারীদের আঘাত হানতে, তাঁদের ধমনীতে প্রবাহিত রক্তস্রোত উদ্দাম হয়ে উঠেছেঅসংখ্য ক্রুদ্ধ পতঙ্গের গুঞ্জনের মতো শোনায় তাদের  ক্ষোভ ও আক্ষেপের উত্তেজিত বাক্যগুলি

কৃষ্ণ তখন শান্ত হতে আহ্বান করেন জনতাকেদ্রৌপদীকে সম্বোধন করে বলেন,-“হে ভামিনি, যাদের উপর তুমি ক্রুদ্ধ হয়েছ, মহাকাল তাদের গ্রাস করতে উদ্যতআজ তুমি যেমন কাঁদছ  তাদের পত্নীগণও আপন আপন পতির রক্তাক্ত মৃতদেহের উপর লুটিয়ে পড়ে, তোমারই মতো আকুল কান্না কাঁদবেসেই দিন আসন্নসে অনাগত দিনকে আমি দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনেযেদিন তুমি এই আসমুদ্র হিমাচল বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের একচ্ছত্র রাজমহিষীযদি আকাশ পতিত, হিমাচল ক্ষয়ীভূত হয়, যদি সমুদ্র শুকিয়ে যায়, ভূমন্ডল যদি খন্ড বিখন্ড হয়, তবু নিশ্চিত জেনো, আমার বাক্যের অন্যথা হবে না এত কঠিন ও প্রত্যয়ী তাঁর কণ্ঠস্বর, উপস্থিত জনতা কেমন ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল 

আর দ্রৌপদী পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকেসেই সদ্যোবিবাহিত জীবনের শুরুতে সখা বলে সম্বোধন করেছিলেন যে তেজোময় সুন্দর পুরুষটিকেকত কৌতুকালাপ, কত প্রীতিময় মুহূর্তের স্মৃতি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলকত দিন পরেও আজও সেই স্নেহ-প্রীতির বন্ধন অক্ষুন্ন রয়েছে তবেহৃদয়ের গভীরে স্নিগ্ধ স্পর্শ পেলেন যেন দ্রুপদনন্দিনীএই ভীষণ বিধ্বস্ত সময়ে, নিদ্রাহীন রাত্রে গাঢ় অভিমানে বার বার মনে হয়েছিল তিনি বুঝি অনাথাআজ বিগত কয়েক দিনের দগ্‌দগে সেই ক্ষতে প্রলেপ পড়ল

করেণুমতী নিবিষ্ট মনে শুনছিল কথোপকথনপ্রত্যেক উচ্চারিত শব্দের গভীরে প্রবেশ করে যাচ্ছিল নিজেরই অজান্তেবাক্যগুলি সুস্পষ্ট চিত্রকল্প তৈরি করছিল তার মানস দৃষ্টির সামনেতাই দ্রৌপদীর মুখে এমন স্বস্তির ছাপ দেখে শিহরিত হোল সে

পঞ্চবিংশ অধ্যায়

সূর্যাস্ত হয়েছেএখনই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবেঅরণ্য বাতাসে নীড়গামী পাখিদের কোলাহলকৃষ্ণ ফিরে গেছেন ভগিনী সুভদ্রা ও তাঁর পুত্রকে নিয়েআগামী ত্রয়োদশ বর্ষ তাঁরা দ্বারকাতেই বাস করবেনফিরে গেছেন অন্যান্য পান্ডবপত্নীরা যে যার পিত্রালয়েবিভিন্ন দেশের রাজাগণওপান্ডবভ্রাতারা কিছু দূরে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের উপকরণ গুছিয়ে রাখছেনকরেণুর ভ্রাতা ধৃষ্টকেতুও তাঁদেরই সঙ্গে

অরণ্যের বাতাস শীতল হচ্ছে ক্রমশকরেণুমতী এখনও কুটির প্রান্তে বসে আছেসে তার পুত্রটিকে বসনে আবৃত করে দেয় সযত্নেদ্রৌপদী একটি দুটি কথা বলেছেন তার সঙ্গেইন্দ্রপ্রস্থের রাজেন্দ্রাণী, সেই নারী, এখন প্রায় নির্বাক

করেণু এই নির্জনতার অপেক্ষা করছিলসে এসে বসে দ্রৌপদীর পদপ্রান্তেনিজের বোধকে শব্দে অনূদিত করতে হবে এখনইঅনেক দেরি হয়ে যাবার আগেই

“যাও ভগিনী, গৃহপথে ফিরে যাও এবারসন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছেকত না বিষাক্ত কীট, পতঙ্গের উপদ্রব শুরু হবে এবার, এই অরণ্যভূমে নিশাচর প্রেতের গল্পও বলে আদিম উপজাতিরাজানি না কি সত্য! কিন্তু সুকুমার শিশুর পক্ষে উপযোগী নয় এ স্থান”- শান্ত বিষাদপূর্ণ ভাবে দ্রৌপদী বললেন

“আর্যা, ত্রয়োদশ বর্ষ পরে আপনি কি যুদ্ধ চান?”

“অবশ্যই”- কষাঘাতের মতো বাতাসে আস্ফালিত হয় এবার দ্রৌপদীর স্বর “কেন অন্য কোন্‌ পথ খোলা আছে মনে কর?”

“আর্যা, কৃষ্ণ শুভ ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছেন বটেকিন্তু

“হ্যাঁ বলেছেন তিনি, আমি এই জম্বুদ্বীপের অধিশ্বরী হব”- দর্পিত কণ্ঠে বলেন দ্রৌপদী “কিন্তু এ কথা যদি তিনি উচ্চারণ না করতেন, তবু যুদ্ধ নিশ্চিতসিংহিণী আহত হলে সে কি ঘাতকের পথ ছেড়ে দেয়? নাকি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আপ্রাণ শক্তিতে নখে, দাঁতে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় তাকে?”

“পশুর বিবেচনা নাই, পশুর বৃহত্তর কোনো পরিমন্ডল নাইভবিষ্যৎ কাল ও জীবনের প্রতি দায়িত্ব নাই তার

“তোমাকে কখনও নারীর চরম অসম্মান সহ্য করতে হয়েছে করেণুমতী? রক্তলিপ্ত বসনে কেশাকর্ষণ করে কোনো দুরাত্মা প্রকাশ্য সভায় নিয়ে এসেছে তোমাকে? আগে সেই ভূমিকায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করতবেই বুঝবে প্রতিহিংসার ভাবনা কোন পরিস্থিতিতে উন্মাদ করে দেয় নারীকে--

“এ জীবন বহু বিস্তীর্ণ দেবী, তুচ্ছ প্রতিহিংসা---

“তুমি না ক্ষত্রিয় কন্যাক্ষত্রিয় বধূতবু এমন বিপরীত চিন্তা তোমার? তবে শত ধিক্‌তোমাকে---”

“আপনার লাঞ্ছনা, সকল নারীরই লাঞ্ছনা স্বরূপ দেবীজম্বুদ্বীপের আকাশ, বাতাস এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে ঐ নরাধমদের নিন্দাবাদেকিন্তু যুদ্ধ যে চেতনাহীনতার অন্ধ শক্তি উন্মত্ত ঝড়ের মতো, ভূকম্পনের মতো, আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভা স্রোতের মতোপ্রবল ক্ষুধায় গ্রাস করে যা সামনে পায়অপরাধী, নিরপরাধী বিচার করে নাপ্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্তরের যে লোভ ও ঈর্ষা, তাই শেষে মহাযুদ্ধের রূপ নেয়আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় শত সহস্র সাধারণ বৃত্তিভোগী মানুষ, নির্বোধের মতো পরষ্পরকে আক্রমণ করে প্রবল জিঘাংসায়যুদ্ধ যে কত বলি নেয়! কত পুত্র, কত স্বামী, কত ভ্রাতা নিহত হয় প্রতিদিনআর যুদ্ধ শান্ত হবার পরেও কালচক্র থেমে যায় নাসূর্যোদয় হয়, সূর্যাস্ত হয়অমোঘ নিয়মে সময় প্রবাহিত হয়অতীতের যুদ্ধক্ষেত্র তখন এক মহাশ্মশানপড়ে থাকে শুধু অগণিত মৃতদেহ আর হাহাকার

“মহাকাল সকলই গ্রাস করেনক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগেই গৌরবতা পরিতাপের বিষয় নয়

“আপনি তবে কোন বিজিত ভূমির সাম্রাজ্ঞী হবেন? আপনার পতি, পুত্রগণ, পিতা, ভ্রাতা, স্বজন, তাঁরাও কি নিরাপদ এই হননভূমিতে?” 

প্রজ্জ্বলিত চোখে তার দিকে তাকান দ্রৌপদীএই দুর্বিনীতা বালিকার এমন স্পর্ধা হোল কি করে যে তাঁকে ঔচিত্যবোধের শিক্ষা দিচ্ছেকিন্তু সাধারণী নারীর মতো কলহে লিপ্ত হতে ঘৃণা হয় তাঁরউপেক্ষাই শ্রেয়তাঁর রক্তিম ওষ্ঠাধরে নিমেষের জন্য বিদ্রূপের তিক্ত হাসি ফুটে ওঠেতিনি দুই হাত বাড়িয়ে করেণুমতীর কোল থেকে সযত্নে গ্রহণ করেন শিশুপুত্রটিকেতার সুন্দর মুখ চুম্বন করে বলেন,-“হে বৎস, কুরুকুলের নূতন মানুষটি, আজ অবোধ শিশু তুমিকিন্তু ত্রয়োদশ বর্ষ পরে আবার তোমাকে দেখব যখন, তখন তুমি হয়ে উঠবে শাল্মলী তরুর মতো উজ্জ্বল এক কিশোরতুমি ততদিনে জানবে তোমার এই দুর্ভাগিনী দ্রৌপদী মায়ের অবমাননার কথাসেদিন তোমার ক্ষত্ররক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, জননীর অমর্যাদার প্রতিশোধ কামনায়কারণ প্রকৃত পুরুষ কখনও নারীর অমর্যাদা সহ্য করেন নাশত্রুকে পিষ্ট করে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটবে তোমার বিজয় রথশত্রুরক্তে ললাটে পরবে তিলকযুগে যুগে তোমার কীর্তি বন্দনা গান হয়ে ভাসবে জম্বুদ্বীপের আকাশেচিরবিজয়ী হবে তুমি” দ্রৌপদী নবজাতককে আবার প্রত্যপর্ণ করলেন স্তম্ভিত করেণুমতীর ক্রোড়েকোমল কণ্ঠে বললেন,-“আর বিলম্ব কোর না ভগিনীদূরের পথ

---------------------------

করেণুমতী জানে না কত পথ হেঁটে এসেছে সেযুগে যুগে পথপ্রদর্শকেরা এই পথেই এসেছেনতাঁদের নাম নাই, লিঙ্গ নাই, কুল নাই, জাতি নাইনাই দেশ ও কালশুধু অন্তরে প্রজ্জ্বলিত সত্যের অনুভব দীপখানিকেউ তাঁদের অনুগমন করেছেকেউ করেনিনির্লিপ্ত কাল লিখে রেখেছে তাঁদের চেতনার ইতিহাসলিখে চলেছে প্রতিনিয়তকিন্তু নাম লেখেনি সব সময়ে

রথ চলছে শুক্তিমতীর দিকেরাত্রি নিবিড় হয়েছে এখনকরেণুমতীর কোলে নিদ্রাতুর শিশুঅন্ধকারে দৃষ্টি চলে নাতবু করেণু দেখতে পায় এই শিশুর মধ্যে মিলে গেছে বিপুলা পৃথিবীর লক্ষ কোটি শিশুআসন্ন কালের প্রতিনিধি যতজননী রক্ষা করতে চেষ্টা করেন শিশুকেপ্রয়াসই জীবনের ইতিকথাসাফল্য নির্ধারণের ভার বৃহত্তর কোনো অজ্ঞাত শক্তির হাতেকরেণু দেহ দিয়ে, প্রাণ, মেধা, মমতা দিয়ে সে ইতিকথা রচনা করে চলে

সে শুনেছে আচার্য বীতিহোত্র সুক্তিমতী ত্যাগ করে চলে গেছেন সুদূর উত্তরেতাঁর সংবাদ কারোর জানা নাইরথের চাকার ঘর্ঘর ধ্বনির সঙ্গে মিলে যায় পথের দুপাশে, ক্ষুধার্ত  শিবাকুলের উল্লসিত ডাকমাথার উপরে মাংসাশী নিশাচর পাখীদের ডাকঅন্ধকার রজনীতে দিকভ্রম হোল কি সারথির? কোথায় চলেছে এ রথ? যুদ্ধ শেষের কোন মৃতের ভূমিতে বুঝি? জননীর দল মশাল হাতে যেখানে খোঁজে আত্মজের শব? খুব মৃদু, প্রায় অস্ফুট স্বরে করেণুমতী ডাকে, -আচার্যদেব কোথায় আপনি? সে ভূমিতে কি এখন সূর্যোদয় হচ্ছে? কোথাও কি এখন সূর্যোদয় হচ্ছে?  


সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ