এই 'সান্ধ্যবৈঠক'- এ সত্যিই আমি
একজন অগায়ক মাত্র। কিন্তু এখানে সাদা পাতায় ধুম
লেগেছে গানের মহড়ার। একজন কবি শব্দ, সুর এবং রঙের বিশ্ব নিয়ে
ধ্যানের আসন পেতেছেন। নৈবেদ্য হিসাবে সামনে ষোড়শোপচারে সাজিয়ে নিয়ে বসেছেন
অসামান্য সব উপাদান। আসনটি রাখা হয়েছে এমন এক অবস্থানে, বলা যায় এই সেই তন্ত্রমাঠ, যেন নৈঃশব্দ্যের তিল, তুলসি, তামা, সুর, তান ভরা এক একটি আশ্রয়। দৃশ্যবলয়ে আড়ালরহস্য। পাঠক সামনে এসে দাঁড়ালেন কিছুটা শ্রোতা, কিছুটা দর্শক হয়ে। কিন্তু আমাদের পাঠ অভিভূত
হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় দেখি না। প্রতিটি অক্ষর থেকে যে তাপ, যে দ্যুতি, তাকে কোনও
ব্যাখ্যাতেই হয়তো স্পষ্ট করা যাবে না। তবু
জড়িয়ে থাকতে হয় শিরা-উপশিরা, শাখা-প্রশাখা, রক্ত-মাংস, হাড়-পাঁজর নিয়ে। এ যেন ক্ষুধা নিবৃত্তির অন্য এক আহার। আসলে শব্দের
ক্ষুধা কখনও মেটে না। পাঠক কখনও কখনও
প্রতিটি অক্ষরকে স্পর্শের মাধ্যমে অনুভব করতে চান, কখনও কখনও চোখ থেকে চোখের বাইরে। এই চাওয়ার মধ্যে যতটুকু নিবিড়তা সেখানে প্রধান হলো
বোধ। ভেতর দরজায় বারবার কড়া নাড়ে সেই বোধের শব্দরা। এই তার পরম সঞ্চয়।
কবিতার
পাঠ এমন এক প্রক্রিয়া, প্রতিবারই যেন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে বসতে হয়। প্রতিটি পাঠ ভিন্ন ভিন্ন দিশা দেখাতে পারে।
প্রতিবার ব্যর্থতার গা থেকে সা নি রে…, এভাবে সাত সুর সাত বায়ু আর যে বাজায় তার কণ্ঠ মিলে এক
অখণ্ড পরমায়ুর মধ্যে অশ্রুত, অব্যক্ত ধ্বনির সমারোহে নিরবয়ব একটি মুখের আদল ভেসে ওঠে। এ তো শুধু গান নয়, কারণ এর কোনও প্রহর নেই, খণ্ড খণ্ড
মুহূর্তের কালচেতনা। যেখানে কোনও কোলাহল নেই অথচ বেজে চলেছে পল পল। আমরা পলে পলে মুহূর্তগুলো গুণছি।
এই 'সান্ধ্যবৈঠক' নিয়ে এভাবে
হয়তো কিছুটা শুরু করা গেলো কিন্তু এমন কিছু কবিতা থাকে, তার কোনও শব্দই নির্দিষ্ট কোনও
দিকের কথা বলে না। অর্থাৎ প্রতিটি পাঠ ফিরে ফিরে
নতুন পাঠের আভাস দেয়। প্রতিটি ডাক হয়ে ওঠে নামহীন। এর মধ্যেও আমরা একটা ডাকনাম
খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে খুলে বসি ভেজ পাতার ঘর-বারান্দা। যেখানে হয়তো আলো করে সন্ধ্যা নামছে। জমে উঠছে
সরগম। গানের নিশীথে অপরূপ ঝরনার প্রবাহ। আমরাও নামছি যেন অতলের দিকে। তখনই
অন্ধকারের পায়ে পায়ে নেচে ওঠে মৃত ইস্কুলগুলো এবং হাবডুব। বলছেন– "চক-ডাস্টার সহ কাটা পাঞ্জা"। অবাক যেন আর ফুরোয় না। গলছে অফুরন্ত। গলে গলে ছড়িয়ে পড়ছে "মরচে সাইকেল ঠেলে অফুরন্ত বিনুনির লাল"। কাটা পাঞ্জা কাটা মুণ্ডগুলো নৈঃশব্দ্যের ঘোর ভেঙে
এক অন্যরকম শুশ্রূষায় ডাকে। প্রতিটি ডাকের মধ্যে আশ্চর্য সুর লয় তাল। গা থেকে সা পেরিয়ে সা সা গা গা মা-এর কোমলে একটা আকাশ মুচড়ে তোলে।
সূর্যাস্তের মুহূর্ত পেরিয়ে যখন
একটু একটু করে রাত্রি নেমে আসে ঘাটে তখন এক ছায়ানট। এই নাট্যে প্রতিটি চরিত্রই ছায়া ছায়া।
আর প্রতিটি ছায়ার সংলাপ গান গান। দেখা যাচ্ছে –"ডুবে যাওয়া গানের হাঁসফাঁস/উপড়ে ফেলছে ঢেউ"। আমরা গানের শ্বাসের মধ্যে ঝিনুক খুঁজতে বসি, আর ঝিনুকের
মধ্যে মুক্তোমাধুরি। এই গান অনেকটা অতলে ডুবুরি
নামানোর মতো। এদিকে "গান গুঁজে মা এক
তারাকে শোয়াচ্ছে"। এই দৃশ্যের মহড়ায় দুটো পথ যেন
দুদিক থেকে এলো। শিশুতারা মায়ের বুকে ঘুমের দেশে আলোর পথ খুঁজছে। আর আমরা একটি
তারা থেকে একতারায় তার বেজে ওঠা দেখছি। জিভ তখন সুরের ফিনিক। আহা ভেঙে প্রতিটি
অণুর মধ্যে অণু অণু, কণা কণা মহা তরঙ্গ। তামার
বরফে গান, স্তনেও গান, সে এক কুহুতান যেন। নৌকো হয়ে
ওঠে গানের সাঁই। আরও একটি পরম দৃশ্যের অবতারণা। গানের ওপারে জীবন বাইছে আরশিনগরের
সুরের বৈঠা।
অনুভবের সুরে রঙ
মেলাতে বসে দেখা গেলো কখনও সে সুরবাহার, আবার কখনও রঙবাহার। কোথাও ধাতব মাংসে চাঁদের শীত মাখো মাখো। একটা কল্পের ঘাট দেখা যায়। আমাদের
নৌকোখানি সেই শীত জড়িয়ে একটু ঘাটে এসে দাঁড়াতে চায় কিন্তু পাগল পাগল হাওয়ার উচাটন
ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। স্বরও বইছে। প্রবাহিত স্বর ঘুমন্ত পাণ্ডুলিপিকে জাগাতে চাইছে।
এক বিভোর রাতের মূর্ছনা। এর মধ্যেই সেই মহাযাম আসে। কাপালিক ধ্যান গূঢ় নৈঃশব্দ্যকে
ধরতে চায়। কুকুরের থাবায় রক্তাক্ত হচ্ছে রাত্রির নিভৃতি। কে যেন গনগন করে ওঠে।
সুরের জখম লাগে রাত্রির গায়ে। সুন্দর ও অসুন্দর পাশাপাশি বসে। বৈপরীত্যের রঙ নিয়ে
সুর নিয়ে খেলা করে। গানের দোনালায় ছলাৎ ছলাৎ। শব্দে শব্দে পাখি ওড়া দেখি। দেখি "হাড়ের সারস/আধপোড়া গোধূলি চাখছে"। দেখি মনোরম মাংসের ভেতর জেগে
উঠছে 'মেরুন রঙের শীত'।
দৃশ্যের পর
দৃশ্য এভাবে কখনও
অসীমকে ছুঁতে চায়, কখনও নৈকট্যের বাঁধনে এক এক ঘাটে এক এক রঙের পাল তুলে নৌকো ভাসায়। গানের প্রলাপে ফরফর করে উড়ছে কেউ। তবে একে ঠিক
প্রলাপ বলা যাবে না, কারণ যে গানে ময়ূর রঙের দিদিমণি বসে, যেখানে প্রেয়ার লাইনে পুঁতে রাখা
হয়েছে বয়সবালক, সেখানে আলাপের ঝংকারই প্রধান হয়ে ওঠে। মাধুর্যের রঙ সুর নিয়ে বসে শব্দের তারে তারে।
বলা হচ্ছে –"বারান্দার সূর্যাস্ত/হয়তো বারান্দাকেই মুছে ফেলবে/একদিন"। – দৃশ্যটি
কল্পনাকে দূরপ্রসারী করে। যেকোনও একটি বারান্দা এবং সূর্যাস্তের রঙ। দীর্ঘ হতে হতে
হারিয়ে যাওয়ার ডাক আসে। এ খেলায়ও রঙই প্রধান। শেষ পর্যন্ত রচিত হয় দীর্ঘ নীরবতা।
এখানে তিন পংক্তির মধ্যে নীরবতা একটিই দৃশ্য রচনা করলো। আবার যেমন "ময়মনসিংহে গানই
পুঁতেছিলাম/লম্বা করাতকল/উপড়ে নিচ্ছে লালবনের পাঁজর"। পড়ার পর এবার মনে হলো আলাদা আলাদা তিনটি দৃশ্য তৈরি হয়েছে এই তিন পংক্তিতে।
এদের মধ্যে আপাত কোনও সংযোগ হয়তো নজরে পড়বে না, কিন্তু দীর্ঘ সূত্রতায় একজন কবিকে
যেতে হয় দুটি সত্তার সাঁকো পেরিয়ে।
ব্যক্তিসত্তা এবং কবিসত্তা। এই দুই সত্তার যখন মিলন ঘটে তখন শব্দ ও দৃশ্যের মধ্যেও
সংযোগ একটা থেকেই যায়। তবে তিন পংক্তির কবিতা মানেই 'হাইকু' হয়ে উঠবে, এমনটা আমরা
কখনোই বলতে চাই না।
প্রসঙ্গত বলে
নেওয়া ভালো, কবিতার ফর্ম যা-ই হোক খুলি-মাংস-ছিন্ননলি ইত্যাদির যে ব্যবহার, তার মধ্যে মধ্যে একধরনের ঘোর যেমন কাজ করে তেমনি অমারাত্রির
নৈঃশব্দ্য রচনার কথাও মনে আসে। শব্দের
শরীরে তারই ধ্যান, তারই লগ্নতা। আর সঙ্গে রয়েছে ধাতব ধ্বনির
আশ্চর্য ব্যঞ্জনা। এই ধাতব বিশ্বে তারও কিছু সুর আছে, রঙ আছে। কবিতার ভুবনে এসে এইসব ধ্বনি কোথাও নদীর ব্রোঞ্জ, কোথাও লোহার সাঁতার হয়ে উঠছে। এই আপন রচিত সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাচ্ছে অসম্ভবের
অনেক অনেক সম্ভাবনা নিয়ে।
এখানে এই
সান্ধ্যবৈঠকে রাখা হয়েছে একশো গানের তালিম। তিন তাল তিন লয়ে যেমন এক ও একাধিক দৃশ্য রচনার চেষ্টা হয়েছে, তেমনি রয়েছে
একটিই দুই পংক্তির কবিতা –"গান রুদ্ধশ্বাস/হত্যার
জ্যোৎস্নার বালিয়াড়ি"। অসম্ভব দ্যুতিময় এবং
দ্যোতনাবাহী এই দুই পংক্তি। রুদ্ধশ্বাসের শ্বাস পেরিয়ে হননের পথে জ্যোৎস্না যদি
এমনই একটি বালিয়াড়ি গড়ে তোলে সেখানে মন অভ্র জড়িয়ে বাঁচে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে
অশেষের ঠিকানা। তার নীরব যাত্রাধ্বনি। বেজে ওঠে রাতের আকাশে একটি তারার বুকে। সেও এক একতারার ধুন।
কখনও
কখনও মনে হয় পাঠক অভ্যাস বোধে কবিতার ভেতরবাড়ির আলোছায়ার মধ্যে শুধু জড়িয়ে পড়তে
চান, তখন
কবিতার কাঠামো নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা থাকে না। পাঠক তো আক্রান্ত হতে চাইছেন। আমরা এখানে ঠিক সেরকমই ছোট ছোট পংক্তির
অভিঘাতে তার ব্যাপ্ত চরাচরে যেমন জড়িয়ে পড়ছি তেমনি আক্রান্তও হচ্ছি। আমরা রক্ত
মাংসের মানুষ, আমাদের সামান্য বোধ নিয়ে মাংসের অনেক নীচে বিবাহের ধাতুচুর মাখতে
মাখতে সুরের বরফে জমে উঠতে পারাটাই আমাদের
সক্ষমতা। তারপর রঙের তাপ লেগে আবার গলতে
থাকি।
গানজ্যোৎস্নায়
রাত্রি আসে চরাচরের অবাক নিয়ে। বিস্ময়
তার রূপের গহনা। তাতে গান যখন শূন্য তখনও গান। আবার গানের শূন্যে পারাপারের এক
উঠোন। তখন হয়তো "সন্ধে পেরেকের/গান
ঠুকে জ্যোৎস্না নামবে", আর নামতে নামতে অতলের ডুব আমাদের টেনে তুলবে সেই উঠোনের
মাঝখানে। কেউ বড়ি দিচ্ছে সেখানে। সাদা
বউঠান। সে কি গলিত রাত্রির কোনও আভা ! হতে
পারে। কী আবছায়া আলোময় রূপ তার ! দৃশ্যের গভীরে দৃশ্যাতীত সৌন্দর্যের ইশারা কল্পবিশ্বকে
আরও দূর বিস্তারের পথ দেখায়। এপথেই
গানবাড়িটার জানলায় ছায়া পড়ছে। তাকে পেরিয়ে এখন আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। চলাচল চলছে। আর এই চলাচলের মধ্যে "অনন্তে আমরা পোড়া গান লিখি/পোড়া পৃষ্ঠা উল্টে যায়/অনন্ত স্বয়ং"। পোড়া গান, পোড়া পৃষ্ঠা এবং অনন্তও যেখানে
স্বয়ং পুড়ছে এই দহন আমাদের ভেতরকেও পোড়ায়। কিছুটা আত্মদহনও হয়। ঠিক এভাবে এবং
এভাবেই 'রাত্রিপেটা ধ্বনির আরক' আমাদের ভেতরে জেগে থাকে অনন্তকাল। দগ্ধ অথচ জাগ্রত। অস্তহীন গোধূলির ডালে ঝুলে পড়ে চাঁদের বয়স। মিটিমিটি হাসি
খুলে এমন ডাক যে উপেক্ষাই করা যায় না।
সান্ধ্যবৈঠকের প্রহর গড়াতে গড়াতে
নৈঃশব্দ্যের রাত্রি নামে কাপালিক থানে। তারার
গা থেকে ঝুরি বেয়ে এই মায়া। বিগলিত জাহ্নবীর মতো তরল নিমগ্নতা। একটা মৃদু সিম্ফনি
বেয়ে মূর্ছনা। চাঁদের নৌকো হয়ে। আমরা নেমে যাবো না আবার চড়ে বসবো সেটাই ভাবছি। এর
বেশি আর কি বলার থাকতে পারে ! একজন অগায়কের অন্ধ ও বোবা কান
পেতে থাকা। এরপরও আমাদের "মন যা
বোলাচ্ছে/ততদূরই/গানের তরাই"। পেরোতে
হবে অব্যক্তের ধুলো ও অসীমের নৈঃশব্দ্য মেখে। যে পথে আদিগন্ত সোনারোদ। হাত বাড়ালেই 'ধুলো মুঠি সোনা'…।
কাব্যগ্রন্থঃ সান্ধ্যবৈঠক ।। সমীরণ ঘোষ।। আলোপৃথিবী।। কাটোয়া।। পূর্ব-বর্ধমান।। ১২০.০০।।
5 মন্তব্যসমূহ
অপূর্ব আলোচনা...প্রিয় কবির কবিতা আলোচনা করেছে আর এক প্রিয় কবি...অপূর্ব বুনুনি শব্দ মায়ার
উত্তরমুছুনঅসম্ভব ভাল আলোচনা
উত্তরমুছুনঅসামান্য আলোচনা।
উত্তরমুছুনশাশ্বতী মিত্র : সমীরণদার সান্ধ্যবৈঠক সব কবির পড়া উচিত, একটা শব্দর পর যখন আরেকটি বসান তখন তার ভিতর দিয়ে যেন বয়ে যায় কালনদী।
উত্তরমুছুনsundar...
উত্তরমুছুন