সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

জুয়েল মাজহার/জুন'২০২২

 



তিন কবির তিন কবিতা
ভূমিকা ও অনুবাদ: জুয়েল মাজহার


 

  ডব্ল্যু বি ইয়েটস

দ্বিতীয়াগমন


ক্রমায়ত চক্রতে অবিরাম খেয়ে-খেয়ে পাক
শুনতে পায় না বাজ মনিবের ডাক
;
ধসে পড়ে সবকিছু
,
 কেন্দ্র পারে না আগলাতে,
নিখিল নৈরাজ্য এক আরূঢ় হয়েছে পৃথিবীতে
;
রুধির-মলিন ঢেউ ভেঙেছে অর্গল
,
 আর
সারল্যের নান্দীপাঠ ডোবে দিকে দিকে
;
শ্রেষ্ঠরা প্রতিজ্ঞাহীন আর
  নিকৃষ্টজনেরা
আতীব্র
 উল্লাসে বেসামাল বিলকুল

 

নিশ্চয় আসন্ন কোনো পুনরুন্মোচন;
নিশ্চয় আসন্ন সেই দ্বিতীয়াগমন।
দ্বিতীয়াগমন আহা! কথাগুলি বলতে-না-বলতেই
জগতের মর্মবিদারী এক মূর্তি আলিশান
,
 এক
খর মরুবালুর জঞ্জাল করে দৃষ্টিকে পীড়ন
;

সেই এক অবয়ব, দেহটা সিংহের আর মুণ্ডু মানুষের,

সূর্যের মতো সেই চাহনিটা ফাঁকা, নির্মম

চলেছে মন্থর-ধীর ঊরু টেনে টেনে,আর, তাকে ঘিরে
ক্রুদ্ধ মরুপাখিদের ছায়াগুলি অবিরাম মারছে চক্কর।
ঘনায় আঁধার ফের
, তবু আমি জেনেছি এবার
পাষাণ-নিদ্রায় মগ্ন দীর্ঘ-দীর্ঘ কুড়ি শতকেরে
দুঃস্বপ্নে করেছে তাড়িত এক দোদুল দোলনা
, আর কী যে
কদর্য সেই জানোয়ার
, শেষে তার অন্তিম মুহূর্ত সমাগত,

 

 পা হড়কে চলেছে সে বেথলেহেমে জন্ম নেবে বলে

 -------[The Second Coming  by W. B. Yeats]


কবি পরিচিতি:


উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস: (William Butler Yeats):
জন্ম ১৮৬৫ সালের ১৩ জুন। মৃত্যু ১৯৩৯ সালের ২৮ জানুারি। আইরিশ কবি, নাট্যকার এবং বিশ শতকের সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন। ১৯২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী। তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট কাজ ‘দ্য টাওয়ার’ (১৯২৮), এবং ‘দ্য উইন্ডিং স্টোর অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ (১৯২৯) এর মতো বই লিখিত হয়েছে নোবেল পুরস্কার জয়ের পর

ইয়েটসকে ঐতিহ্যগত ভাবধারার শ্রেষ্ঠতম কবি-প্রতিভাদের একজন বলে গণ্য করা হয়

১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ নিজে গীতাঞ্জলি ও সমসাময়িক আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কবিতার ইংরেজি ভাবানুবাদ ‘সং অফারিংস’ (Song Offerings) নামে প্রকাশ করেন। পরের বছর ১৯১৩ সালে ‘সং অফারিংস’- এর জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই ইংরেজি সংকলন গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন ডব্ল্যু বি ইয়েটস


----------------------

 হোর্হে লুইস বোর্হেস

 

 

দুই ভাইয়ের মিলোঙ্গা

গিটার আমাদের গল্প এনে দিক সেদিনকার
যখন ঝিলকে উঠতো চাকুগুলি,

গল্প যতোসব জুয়া ও পাশা নিয়ে,
ঘোড়ার দৌড় আর অমিত পানের

কোস্তা ব্রাভা আর গরুর বেপারি সে
বুড়োর চলাপথ নিয়ে সে কাহিনি

যারাই আসে বটে সবারই ভালো লাগে
গল্প একখানা গতকালের;

নিয়তি নিয়ে কোনো চলে না দরাদরি,
গলতি-দোষ ওর খোঁজাই
 অনুচিত—

এখন আসে ছুটে আজকে রাত্রে
কতো না স্মৃতিরাশি দক্ষিণের

শুনুন জনাবেরা, ইবেরা ভাইদের নিয়ে সে গল্পটা:
সবার আগে ওরা বিপদে দিতো ঝাঁপ

প্রেমিক মর্দ এবং যোদ্ধা,

চাকুর খেলা যতো ছিলো না জুড়ি কোনো,
তারাই আজ
 , হায়,  ছ-ফুট নিচে শুয়ে

লালসা অহমিকা এমত যতো কিছু
গভীর রসাতলে সতত টেনে নেয়;

সাহস সে-ও, জেনো, ধরায় ঘেন্না
মাতলে একে নিয়ে দিবস,
 রাত

দুইটি ভাই তারা, ওদের ছোটোটির
অনেক ভারী ছিল খুনের পাল্লা

হুয়ান ইবেরা যখনই দেখল
ছোটোটি তাকে ঠিক দিয়েছে টেক্কা,
তখন আর ওর পরানে সইলো না,
পাতলো ফাঁদ এক,
 যাতে ও ধরা দ্যায়

কোস্তা ব্রাভাতীরে একটা বুলেটেই
ওকে সে মারল

তাই তো আজ আমি সত্যনিষ্ঠায়
বলেছি এ-কাহিনি আদ্যোপান্ত;

কাবিল, যাকে নিয়ে রচিত এ-কাহিনি
সতত সে তো খুন করছে কাবিলেরে

[Milonga of Two Brothers by Jorge Luis Borges]

 

 

 

 

 

কবি পরিচিতি:


হোর্হে লুইস বোর্হেস (Jorge  Luis Borges):

বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের একজন। তাঁকে বলা হয়, লেখকদের লেখক। জন্ম আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেসে,  ১৮৯৯ সালে। বোর্হেস একাধারে কবিতা, প্রবন্ধ ও সাহিত্যসমালোচনা লিখে গেছেন।  সফল অনুবাদকও ছিলেন। লাতিন আমেরিকার প্রায় সব উত্তরসূরি দিকপাল লেখকই কোনো না কোনোভাবে বোর্হেস-প্রভাবিত; যে কোনো মানদণ্ডে স্প্যানিশ ভাষার সবেচেয়ে প্রভাবশালী লেখক; যিনি নিজেই এক জগতের নির্মাতা, যাকে বলে বোর্হেসের জগৎ

গত শতাব্দীর বিশ্বসাহিত্যে প্রধান কুললক্ষণ যদি হয় কাফকার দিকে ঝুঁকে পড়া, তবে কাফকা-পরবর্তী বিশ্বসাহিত্যের প্রধান কুললক্ষণ হচ্ছে বোর্হেসের দিকে ঝুঁকে পড়া

শুধু স্প্যানিশ সাহিত্যেই নন, গোটা বিশ্বসাহিত্যে  অনন্যসাধারণ আর বিপুল প্রভাববিস্তারক এক অধিবিদ্যক জগতের নির্মাতা বোর্হেস। অবিরাম গোলকধাঁধা ও  হেঁয়ালিঘেরা সেই জগৎ সবর্দা প্রশ্নশীল;  

বংশানুক্রমে পাওয়া এক রোগ যা ধীরে ধীরে তাঁর দৃষ্টির আলো নিবিয়ে দ্যায় চিরতরে। অথচ বুয়েনোস আইরেসে আর্হেন্তিনার ন্যাশনাল লাইব্রেরির কিউরেটর বোর্হেসের চারপাশে তখন শুধু সংখ্যাহীন বই; অথচ তিনি  অন্ধ!  বোর্হেসকে তাই বলতে শুনি :
O God, who with such splendid  irony

Granted   me books and blindness with one touch.

[Trans. by Alestair Reid]

 

স্প্যানিশ সাহিত্যে ‘দোন কিহোতে’-র (DON QUIXOTE) লেখক সের্বান্তেসের- এর পর কেউ-ই বোধ করি, বোর্হেসের মতো এমন বিপুল মৌলিকতা নিয়ে হাজির হননি। মূলত তাঁর মাধ্যমেই আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্য সত্যিকার-অর্থে হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক

 

তাঁর গল্পগুলোর কিছু কমন থিম  হচ্ছে স্বপ্ন, গোলকধাঁধা, পাঠাগার, আয়না, অলীক, কল্পিত লেখকেরা, দর্শন আর ধর্ম

প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী বোর্হেস তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তা, লেখালেখি ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সকল মানব-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত, যুক্ত ও সক্রিয় ছিলেন। নানান প্রচল ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বোর্হেস জন্ম দিয়েছেন নতুন ধারণা ও চিন্তার। সেইসঙ্গে চিন্তা-পদ্ধতিও দিয়েছেন বদলে। বোর্হেসের পরিচয় তার সামগ্রিকতার মধ্যে; বিশেষ কোনো খণ্ডিত উদ্ভাসের মধ্যে নয়

-----------------------------------------------------------------

  টম গান্

 

যিশু ও তার মা


সবেধন পুত্র মোর, আমার চেয়েও বেশি ঈশ্বরের তুই!
থেকে যা এখানে এই নাশপাতি গাছের বাগানে

সুপ্রচুর ফলভারে এইখানে গাছেরা আনত
তৃপ্ত আর পরিমিত রঙের বাহারে উদ্ভাসিত;

বার্ধক্যপীড়িত হয়ে  তারা যেই কাঁদে নোনাজল
নয় কোনো
 , সুমধুর অলস সিরাপে অশ্রু ঝরে

 

আমার নিজের আমি;  তবু আমি থাকি না নিজের”

 

তাকে দেখে মনে হতো বেগানা নাগর,
পদ্মডাঁটা হাতে নিয়ে সে-বিদেশি চুপিসারে
এসেছিল আমার দুয়ারে
;


ঈশ্বরের চোখজোড়া,
 ইউসুফেরও চোখের অধিক জ্বলজ্বল
তার চোখে চোখ রেখে
 কী হলো আমার--- আমি কী করে বোঝাই?


ছিলাম নিজের;
  তবু, এরপর থাকিনি নিজের

আর এই জনাবারো শ্রমরত লোক এরা কারা?
তোর কথা মাথামুণ্ডু
 কিছুই বুঝি না:

আমি তোকে শিখিয়েছি বুলি, আমি রেখেছি পাখির নামগুলি
যে-কোনো শিশুর মতো তুই
দেখাতি
 পাখিকে যারা দীর্ঘ পরিযায়ী
----ভিড় থেকে দূরে গিয়ে তুই ফের হয়ে যা
 রে চুপ

 

আমার নিজের আমি আর আমি থাকি না নিজের”

 

আমি যেই কথা বলি মুখভার কেন তোর বাপ?
এই তোর মালামাল,
 চাকু ও করাত
আর এই হাতুড়িটা রইল তবে বেঞ্চির ওপরে

দিনে দিনে হয় মাপা এইখানে তোর এ-জীবন
মাপজোক নিয়ে তুই আসবাব বানাস যেমন;

আর আমি পত্নী হেন তোকে দেবো পাঠ;
---আমার নিজের হবো আর হবো কেবল আমার

 

ইচ্ছেমতো যথাতথা বয়ে চলে বেয়াড়া বাতাস
দিলখোশ না হলে কি কেউ চলে এর অনুরূপ?

আজও মনে পড়ে তুই গিয়েছিলি আলাপ জমাতে
পশমের আলখাল্লাধারী যতো পণ্ডিতের সাথে

কানে এলো শহরের তীব্র হট্টগোল;
এ-অশুভ হাতিয়ার কে বয়ে বেড়ায়?

 

সে তার নিজের; তবু নয় সে নিজের”

 

মাড়িয়ে সবুজ আর দ্রুত-তৃণ গালিচা মাড়িয়ে
দেখি এক আজগুবি ছায়া এসে পড়ে;

ও মানিক, এই পেটে তোকে আমি ধরেছি রে একা!
ছিলো না নিকটে কোনো কবিরাজ নাড়ি কাটবার;


তোকে আমি প্রভু বলে ডাকবো না,
 ডাকবো না ওরে
---সবেধন পুত্র মোর,
 দে আমায় সাড়া!

আমার নিজের আমি তবু আমি নই তো নিজের।”

-----[Jesus And His Mother by Tom Gunn]

 

 

 

 

 

 

 

 

কবি পরিচিতি:

টম গান্ (Thom Gunn):


পুরো নাম টমসন উইলিয়াম গান্।  জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ আগস্ট, ইংল্যান্ডের কেন্ট অঞ্চলের গ্রেইভসেন্ড-এ। মৃত্যু ২০০৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন সাংবাদিক। টম যখন ১৫ বছরে পা রাখলেন, তখন আত্মঘাতী হন তাঁর মা। মহিলা ছিলেন যাকে বলে সাহিত্য-শিল্পকলার উঁচুদরের সমঝদার

১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ফাইটিং টার্ম’। বোদ্ধা পাঠক-সমালোচক মহলে দারুণ সাড়া জাগায় তা। প্রখ্যাত সমালোচক জন প্রেস লেখেন, ‘এই বই যুদ্ধোত্তরকালে প্রকাশিত হাতেগোনা বইগুলোর একটি যা প্রত্যেক সিরিয়াস পাঠকের সংগ্রহে রেখে পড়া চাই।’

পরে প্রকাশিত তাঁর কবিতাবইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : দ্য সেন্স অব মুভমেন্ট (১৯৫৭), মাই স্যাড ক্যাপ্টেনস (১৯৬৯), টাচ্ (১৯৬৭), মোলি (১৯৭১), টু দ্য এয়ার (১৯৭৪), জ্যাক স্ট্র’জ ক্যাসল্ (১৯৭৬), সিলেকটেড পোয়েমস ১৯৫০-১৯৭৫ (১৯৭৯), দ্য প্যাসেজেস অব জয় (১৯৮৩), ম্যান উইথ দ্য নাইট সোয়েটস (১৯৯২), সিলেকটেড পোয়েমস অব টম গান্ অ্যান্ড টেড হিউজ (১৯৬২)

১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে টমের কবিতা আবর্তিত হতে থাকে তাঁর ঝড়ো ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা, ড্রাগাসক্তি, সমকাম আর এইডস-এর মতো আপাত বিসদৃশ বিষয়কে ঘিরে।  ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ম্যান উইথ দ্য নাইট সোয়েটস তাঁর এইডস-আক্রান্ত বন্ধুদের নিয়ে লেখা এক আধুনিক শোকগাথা। এই বই আধুনিক ইংরেজি কবিতার একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত

প্রচলিত বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে টম গান এমন এমন বিষয়কে কবিতার উপজীব্য করেছেন এক কথায় যেগুলোকে বলা যায় বিসদৃশ আর অভাবিতপূর্ব। কখনো কখনো সেগুলো খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক বিশ্বাসের পায়ে কুড়াল হেনেছে অবলীলায়

 

সমালোচকদের ভাষায় যেগুলো Ôdaring subject matterÕ  কিন্তু আপাতবিসদৃশ বিষয়বস্তুকেও তিনি করে তোলেন শিল্প। এই কবি বরাবরই ছিলেন পুরনো আঙ্গিকপ্রেমী। ছন্দ ছিলো তার ব্যসন ও আনন্দ। কালেভদ্রে মুক্তছন্দের পথে পা বাড়ালেও চিরকাল প্রচলিত ছন্দো-সৌষ্ঠবেই সমর্পিত থেকেছেন

  

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ