শূন্যপুরাণ
“নহি রেখ নহি রূপ নহি
ছিল বন্ন চিন।
রবি সসী নহি ছিল নহি
রাতি দিন।।
নহি ছিল জল খল নহি ছিল
আকাশ।
মেরু মন্দার ন ছিল ন ছিল
কৈলাস।।
নহি ছিল ছিষ্টি আর ন
ছিল চলাচল।
দেহারা দেউল নহি পরবত
সকল।।
দেবতা দেহারা ন ছিল
পূজিবাক দেহ।
মহাসূন্য মধ্যে পরভুর আর আছে
কেহ……”
শূন্যতায়
ছাওয়া এই সৃষ্টিতত্ত্ব শূন্যপুরাণে পাওয়া যায়।
দেবতারও অনস্তিত্ব বর্ণনা করা হচ্ছে। শূন্য থেকে স্বয়ম্ভু স্বনির্মাণে মগ্ন……
“বিসার উপরে পরভুর উপজিল দ
আ।
আপনি সিরজিল পরভু আপনার
কায়া।“
ঈশ্বরের
অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে প্রকাশ শূন্য পুরাণের বৈশিষ্ট্য। শূন্যপুরাণ তেরোশ, মতান্তরে চোদ্দশ শতকে রচনা হয়। রচয়িতা রামাই পন্ডিত। রামাই পন্ডিত তদানীন্তন মল্লভূমের ময়নাপুরের
বাসিন্দা ছিলেন। রামাই পন্ডিত সংস্কৃত
সাহিত্যে পন্ডিত ছিলেন। রামাই পন্ডিত রচিত শূন্য পুরাণের বৈশিষ্ট্য হোল
সৃষ্টিতত্ত্ব, ধর্মঠাকুরের
উৎপত্তি ও পূজা পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য বর্ণনা। সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায়ই শূন্যতার নিরাবয়ব উপস্থিতি।
শূন্যবাদ
বৌদ্ধধর্মেও পাওয়া যায়। এক ভিক্ষু, তাঁর নাম ছিল বোধিধর্ম, তিনি ও তাঁর শিষ্যরা বলেছেন ধর্ম মানুষের স্বভাব, তা শূন্যতার অপর নাম।
ধর্মগ্রন্থ কোন শাস্ত্রে লেখা হয় নি, মানুষের পরিবর্তনশীল স্বভাবের অনুবর্ত্তী হয়ে নিরন্তর ক্রমবিবর্তনের পথে চলেছে। জলের অবিরাম প্রবাহ, বাতাসের সুর, -সেই মহাশাস্ত্রের বাণী। প্রকৃত ধূপ
ধুনা আত্মসংযম, জ্ঞান, ধৈর্য, দয়া, দ্বিধাশূন্যতা, ভক্তি এবং অভিজ্ঞতা। শূন্যবাদরূপ পবিত্র সামগ্রীই খাঁটি সুগন্ধ, তা সমস্ত আকাশ ছেয়ে আছে…
রামাই
পন্ডিতের শূন্যবাদ কিন্তু অনাদি অনন্ত শূন্যতা নয়।
শূন্যতা আদি, সেখান থেকে
আত্মনির্মাণে মগ্ন ঈশ্বর…… আপনাকে সৃষ্টি করছেন। “আপনি সিরজিল পরভু আপনার কা আ” র পর বলছেন,
“দেহতে জনমিল পরভু নাম
নিরঞ্জন।।“
রামাই
পন্ডিতের উপাস্য ধর্মঠাকুর যাত্রাসিদ্ধি রায়। ধর্মঠাকুর মল্লভূমে অন্য বিভিন্ন নামেও পরিচিত। কূর্মমূর্তি। শূন্য
পুরাণের অবিভক্ত অংশ ধর্মঠাকুরের
পূজা পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য বর্ণন। এই প্রসঙ্গেও শূন্য পুরাণ বিশিষ্টতার দাবী করতে পারে, কারণ অন্যান্য় কবিদের লেখা ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনার অন্যান্য পুঁথি পাওয়া যায়, যেখানে সৃষ্টি তত্ত্বের ব্যাখ্যা ইত্যাদি নেই এবং কেবলমাত্র ধর্মঠাকুরের প্রতি বিশ্বাস, মাহাত্ম্য প্রচার ও পূজাপদ্ধতি পাওয়া যায় যাদের মঙ্গলকাব্য আখ্যায় ভূষিত করা হয়। ময়ূরভট্ট, রূপরাম, খেলারাম, ঘনারাম, রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও
সহদেব চক্রবর্তী এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
ধর্মঠাকুরের
মাহাত্ম্য প্রচারের কাহিনী কর্ণসেন, রঞ্জাবতী, লাউসেনকে ঘিরে।
বীরভূমের অজয় নদের তীরে কর্ণসেন নামে এক সামন্ত রাজা রাজত্ব করতেন। গৌড়ের তদানীন্তন মন্ত্রী মহানাদ সোমঘোষ নামে এক
গোপকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন। গৌড়রাজ এ
খবর জানার পর সোমঘোষকে মুক্ত করেন, কিন্তু মহামন্ত্রীর কোপ থেকে বাঁচানোর জন্য কর্ণসেনের জমিদারী ত্রিষষ্ঠীগড়ে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, সোমঘোষের পুত্র ইছাই ঘোষ
রাজা কর্ণসেনের উপর অত্যাচার আরম্ভ করে। কর্ণসেন গৌড়াধিপতির কাছে অভিযোগ জানান। মহারাজ মহামন্ত্রী মহানাদকে ত্রিষষ্ঠীগড় আক্রমণ করতে আদেশ
দেন। ইছাই ঘোষ মহা পরাক্রমে যুদ্ধ করেন।
যুদ্ধে কর্ণসেন পরাজিত হন ও তাঁর ছয় পুত্র নিহত হন। কর্ণসেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লে গৌড়রাজ নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সাথে কর্ণসেনের
বিবাহ দেন ও ময়নাগড় রাজ্য দান করে
লোকলস্করসহ সেখানে পাঠিয়ে দেন।রাজার ভয় ছিল, মহামন্ত্রী কামরূপে থাকাকালীন রাজা এই বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। রঞ্জাবতী মহামন্ত্রী
মহানাদের ভগ্নী।মহানাদ হয়ত ফিরে এসে এই
বিবাহ মেনে নিতে পারবেন না। তাই কর্ণসেন ও রঞ্জাবতী যাত্রা করলেন তাঁদের নতুন বাসভূমির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে তাঁরা রামাইএর তপস্যার কাহিনী
শুনতে শুনতে এসেছেন। রামাই ব্রাহ্মণ
পিতার সন্তান, কিন্তু শূদ্রাণী
গর্ভজাতা। ময়নাপুর গ্রামে তপঃদিঘীর তীরে মার্কন্ড মুণির আশ্রম। সেই আশ্রমে রামাই ধর্মঠাকুরের পূজায় ব্রতী।
একদিন সকালে রামাই যখন সূর্য প্রণাম
করছেন, তখন সামনে উপস্থিত
হলে কর্ণসেন ও রঞ্জাবতী। ইছাই ঘোষের হাতে ছয়পুত্র নিধন ইত্যাদি বলার পর তাঁরা প্রার্থনা করলেন যেন রানী
রঞ্জাবতির গর্ভে বীরপুত্রের জন্ম হয়। রামাই
বললেন, “ঠাকুরের যা ইচ্ছা তাই
হবে।“
রামাই গুরু
মার্কন্ডকে সব কথা জানালে তিনি বললেন ধর্মঠাকুরের
আশীর্বাদ পেতে হবে। তারজন্য গেরুরাভরণ যজ্ঞ করতে হবে ও রঞ্জাবতীকে কঠোর ব্রত পালন করতে হবে। যজ্ঞের নিয়মানুযায়ী একটি ছাগকে লুইধরের
নামে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়া হল। যজ্ঞ
আরম্ভ হল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। ঐদিন ছাগ নিজেই যজ্ঞস্থানে এসে উপস্থিত। যজ্ঞ শুরু করায় বাধা ছিল রামাইএর মাতৃ পরিচয়। গুরু রামাইকে
তাম্রদীক্ষা দিলেন, তামার বালা পরে রামাই ধর্মঠাকুরের যজ্ঞ করার অধিকার পেলেন। পরবর্তীকালে
তামার বালা পরে শূদ্রজাতি ধর্মপূজার
অধিকার অর্জন করেন। “শ্রী ধর্ম পুরাণে” উল্লেখ পাওয়া যায়……
“হাড়ি মুচি ডোম কলু
চন্ডাল প্রভৃতি।
মাজি বাগদী মেটে নাহি
ভেদ জাতি।।
স্বর্ণকার সুবর্ণবণিক
কর্মকার।
সূত্রধর গন্ধবেনে ধীবর
পোদ্দার।।
ক্ষত্রিয় বারুই বৈদ্য পোদ
পাকমারা
পরিল তাম্রের বালা
কায়স্থ কেওড়া।।“
রামাই তাম্রদীক্ষার
পর রামাই পন্ডিত নামে খ্যাত হন।
রামাই
পন্ডিত ধর্মঠাকুরের যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ শেষ হল বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন। লুইধর ছাগবলি হল। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বিষ্ণুর
দ্বিতীয় অবতার কূর্মের আবির্ভাব
দিবস। যজ্ঞের দিন রামাই পন্ডিত ধর্মের মাহাত্ম্যগান গেয়ে শোনালেন। রাণী রঞ্জাবতী বাণফোঁড়ায় মৃতপ্রায় হয়ে পড়লেন। তখন ধর্মঠাকুর
একটি কুকুরের বেশে উপস্থিত হয়ে
রঞ্জাবতীকে স্পর্শ করতেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। যজ্ঞ সম্পূর্ণ হল। রানী ধর্মের কৃপায় লাউসেন ও কর্পূর সেন নামে দুই বলশালী পুত্রের জননী
হলেন। লাউসেন বড় হয়ে ইছাই ঘোষের সাথে
যুদ্ধ করে তাঁকে পরাস্ত করেন ও ধর্মপূজার ব্যাপক প্রচলন করেন।
শূন্যপুরাণের
আর একটি দিক বিশেষবভাবে উল্লেখ্য। শূন্যপুরাণ
রচনাকালে বৌদ্ধধর্ম বিবর্তিত হতে হতে বজ্রযানমতে পরিণত হয় যায় আচারক্রিয়াদি সাধারণ মানুষের বীতরাগের কারণ হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধ ও
জৈনধর্ম নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধ পরিকর হন এবং
বৌদ্ধ ও জৈনদের উপর অত্যাচার শুরু করেন।
“দুষ্টমতাবলম্বিনঃ বৌদ্ধান জৈনান অসংখ্যাতান
রাজমুখ্যাননেবকবিদ্যা-প্রসঙ্গভেদৈর্নির্জিত্য তেষাং শিরাংসি পরশুভিশ্ছিত্ত্বা বহুষু উদুখলেষু নিক্ষিপ্য
কঠভ্রমণৈশ্চূর্ণীকৃত্য চৈবং দুষ্টমতধ্বংসমাচরন নির্ভয়ো বর্ত্ততে।“
বৌদ্ধদের
উপর এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তারা কাতর প্রার্থনা করল। তাদের কাতর প্রার্থনায় ধর্ম যবনরূপে আবির্ভূত হয়ে ব্রাহ্মণদের
সংহারে মত্ত হলেন। শূন্য পুরাণের “নিরঞ্জনের
রুষ্মা” নামক পরিচ্ছেদে পাওয়া যায়,
“নিরঞ্জন নিরাকার
হইল ভেস্ত অবতার
মুখেতে বলয়ে দম্বদার।
যতেক দেবতাগণ
সভে হৈয়া একমন
আনন্দেতে পরিল ইজার।
ব্রহ্মা হইল মহম্মদ
বিষ্ণু হইল পেগাম্বর
আদম হইল শূলপাণি।
গণেশ হইল কাজী
কার্তিক হইল গাজী
ফকির হইল যত মুণি।।
……”
শূন্য পুরাণ
কালের দলিল, যে কাল ধরে রেখেছে
ঈশ্বরের দার্শনিক প্রকাশ
থেকে উৎপীড়িতের রক্ষার প্রায়োগিক প্রয়োজনীয়তা।
0 মন্তব্যসমূহ