পোস্টমাস্টার
১.
ভুট্টার আবাদি জমি আর অগুন্তি গবাদির দল। পাতাঝরা সার দেওয়া গাছ, চার্চের ঘণ্টা বাজছে, এই হলুদ মালভূমি পায়ে হেঁটে পারাপার করেন জাগতিক ঈশ্বর; সূর্য বা চাঁদের মতো দিনে রাতে, যারা গির্জার বাইরে প্রার্থনারত ছিলেন তাদের কালো চামড়া সূর্যের আলোতে সেদিন চিকচিক করছিল তারপর গর্জে উঠেছিল বন্দুক ! নিরীহ কালো মানুষগুলো জানে একদিন তাদের প্রিয় রাজকুমার আসবে তাদের গির্জায় আর ঈশ্বরের কাছে সকলের জন্য আবার প্রার্থনা করবে। কার্তুজের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে ওঠে দূরবীনের কাঁচ। রাজকুমার কাঁদছেন; দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। ঈশ্বর হাসছেন দূরবীনের ওপার থেকে । তিনি জানেন প্রতিটি অন্ধকারের পিছনে কতগুলো রুপোলী স্রোত থাকে, অবিকল ধাতুর মত চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। বাজনা বাজছে, গড়িয়ে নামছে ছিমছাম সন্ধ্যা; এই সময় আকাশ দিয়ে উড়োজাহাজ যায় তাতে স্বপ্ন ভরা থাকে আর একদল কচিকাঁচা উড়োজাহাজের পেছনে ছোটে। মুখোশ পরা মানুষের দল দাঁড়িয়ে আছে এবড়োখেবড়ো ত্রিভুজ পাহাড়ের গা বেয়ে হাতে একাধিক যন্ত্র, রুপোলী ধাতুর উপর মরচে ধরে কেমন নোংরাধরা দাঁতগুলোর মতো দেখায়। ওদের মুখগুলি অভুক্ত, নিরীহ, দীর্ঘদিনের অত্যাচারে পাংশুটে তাই হিংস্র মুখোশ পড়ে ওরা; জঙ্গলের ওপারের সমঝোতা করা মানুষ ওদের ভয় পায়। মুখোশধারি লোক সন্ধ্যা হলে সদলবলে বন থেকে বেরিয়ে পাথরের উপর উঠে এসে বসে তারপর খানিকটা ঝিঁঝিঁর ডাক, সব চুপচাপ, গর্জে ওঠে যন্ত্র , ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তে ভিজিয়ে দেয় গাছের গোঁড়া , শাস্তির দস্তুর আছে বনে । এ বনের গাছগুলি শতাব্দীকাল ধরে শুষে নিচ্ছে রক্তের স্রোত কেবল কিছু ছাপ পুরনো পানের পিকদানীতে লুকিয়ে আছে, লুকিয়ে গাছের শেকড়ে, কাপড়ে চোপড়ে বা পরিত্যক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুপড়ির অন্দরমহলে। এ ফোড় ও ফোড় হওয়া শরীর লাঠিতে-শেকড়ে বাঁধা, কাঁধের ঝাকুনি আর লাঠির দোলনে লুটোচ্ছে হাতজোড়া, চোখে মুখে লেগে আছে খামার বাড়ি , গভীর ক্যাসেলের খসখসে প্রাচীর , নিভু আঁচে নেমে আসা সন্ধ্যে আর ছেলেবেলার বন্ধুরা, পড়ে আছে হাতের রুপোলী তলোয়ার।
পোস্টমাস্টার ফিরবে না, চিঠিগুলি অপেক্ষা করতে করতে গাছের পাতার মতো
শুকিয়ে যাবে, শব্দেরা নির্বাক ছবির মত কাগজের খোলায় ভেসে পৌঁছে যাবে নদীর অতলে
ঘুমন্ত নাবিকদের ঠিকানায়। পোস্টমাস্টার এমন জীবন সর্বস্বতা বা অতিমেয়তা নিয়ে
দ্বিধাবিভক্ত , বিস্তৃত ঘাসের চারণভূমিতে দাঁড়িয়ে দুটি পৃথক জীবনদর্শন তাঁকে ক্রমশ
আশ্চর্য করে তুলছে। পৃথিবীর সমস্ত জীবনবোধ কি কেবল অন্তর্নিহিত না কি বাহ্যিক
জীবনদর্শন জানিয়ে দেয় যাবতীয় বেঁচে থাকবার রসদ। সন্ধ্যে ফুরিয়ে আসলে পাথরের উপর
থরে থরে বসানো পাথরগুলি মানুষ হয়ে যায়, সেখানে হাওয়ায় ধাক্কা খেয়ে তৈরি হয় শব্দ,
নৈশব্দের মধ্যে বেঁচে থাকে পাথুরে মানুষ, সারিসারি বুনো গাছ ঝাঁকরা চুলো দেখায়
কতদিন যেন পড়েনি সভ্যতার ছাপ। সভ্যতা আধুনিকতার পরিপূরক কিনা নদী বলতে পারবে। অনন্তকাল ধরে নদীর এই বহমানতা জন্ম দিয়েছে একাধিক সভ্যতার ।
পর্যায়ক্রমে সভ্যতার নানাবিধ বিবর্তন জন্ম দিয়েছে আধুনিকতার। পাথরের গায়ে আকিবুকি আঁচড়, জলের বুকে আশটানি
গন্ধ, নখের উপর হলুদ ছোপ, নর-নারীর উলঙ্গ শরীর, শরীর জুড়ে ধাতব অলংকার , শিকারের
সরঞ্জাম, অশক্ত ঘরবাড়ি নির্জন বালিয়াড়ি আর বেঁচে থাকার আনন্দ। কত মৃত্যুশোক, জীবন
মানে তবু যেন বেঁচে থাকা। ছায়াপথ জুড়ে অন্ধকার প্রাসাদও আজ রুপোলী জলে মিশেছে কখনো
উঠে আসছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর ছোট ছোট পাড় একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে জলের সাথে, জল
ভেঙ্গে বয়ে চলেছে রুপোলী চাঁদ। সময়ের নিরিখে উজাড় করা প্রাচুর্য যা আজীবন চাপা পড়ে
থাকবে ভেঙ্গে পড়া মাস্তুল আর জাহাজের বুকে
। এমনি করে কতদিন আটকে রাখা
যাবে জীবনের সেই সব প্রিয়জনদের , কত চিঠি লেখালেখি হল, কত বার্তা পৌঁছল আবার কতকটা
পৌঁছয় না যেমনটি এই চিঠিগুলির মত, মনে পড়ে সেই সৈনিক আর তার মা এর কথা- যে সৈনিক
একদিন স্বপ্ন দেখত যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরে গিয়ে সারাদিন কবিতা লিখবে তাঁর সেই
সুখী গৃহকোণে বসে, বলে সে তার মা কে একটি চিঠি দিয়েছিল আর যুদ্ধের ধূসর দিনগুলিতে
বাঙ্কারে বসে পড়ত একের পর এক তাঁর প্রিয় কবির কবিতা। কিন্তু যুদ্ধ তাঁকে গ্রাস করে
নিল, আর তার অসমাপ্ত জীবনের কথা কবির কাছে পৌঁছে দিল তাঁর মা, যদিও কবি তাঁর
প্রেক্ষিতে আজীবন রয়ে গিয়েছেন চুপচাপ। রাত বাড়ছে, পোস্টমাস্টার কখন যেন চিত হয়ে
শুয়ে হলুদ ঘাসের গালিচায়, অজস্র তারারা ঝিঁঝিঁর ডাকে তাঁকে জাগিয়ে রেখছে, মনের
ভিতর ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে । নদীর নীচে নীল ঘুমে ডুব দিল পোস্টমাস্টার ।
0 মন্তব্যসমূহ