দুপুরটা মাত্র আড়মোড়া ভাঙছে। তখনও রোদের ঝাঁঝ বেশ তীব্র। শাহানা
তখনও বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেক্সিটা হাঁটুর কাছে উঠে এসেছে। মাথার বালিশটা দু’হাঁটুর
ভাঁজে রেখে আর একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
কাল রাতে খুব ধকল গেছে। একসাথে দু’জন ঘরে এসেছিলো। এসেই বললো,
- এই মাগী,
আমরা দু’জন, কত নিবি?
- দু’জন
নিমু না। একজন আহেন।
- না, দু’জনই
লওন লাগবো।
- কইলাম তো একজনের বেশি নিমু না।
এসময় সর্দারনী এসে জোর করে ওদের ঘরে তুলে দিয়েছে। এ জন্য ওরা
সর্দারনীকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছে। দু’জনেই এমন খচ্চর, ওকে রীতিমতো ছিঁড়ে খেয়েছে। ওরা
যাওয়ার পর আর বিছানা থেকে উঠতে পারে নি। শুয়ে শুয়ে সাদউল্লাহ’র বাঁশি শুনছে। আর বারবার চোখদু’টো ভিজে উঠছে। সাদউল্লাহ’র বাঁশি শুনলে এমনিতেই কান্না পায়। আজ আরো
বেশি কান্না পাচ্ছে।
বেশ ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর বাবা যখন ওকে দেখাশুনার কথা
বলে নতুন মাকে নিয়ে এলো তখনও সে কেঁদেছিলো। রান্নাঘরের এক কোণে শুয়ে চুপ চুপ করে কাঁদছিলো।
নতুন মা আসাতে ওর ঠাঁই হলো রান্নাঘরের এক কোণে। ওদের একটাই ঘর, সেখানে নতুন মাকে নিয়ে
বাবা থাকে। নতুন মা আসার পর থেকে ওদের বাড়িতে তার কোন এক ভাই এর আসা যাওয়া শুরু হলো।
শাহানা খেতে বসলে পাশের বাড়ির বেড়ালটা ওর ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে থাকতো। ওর থালা থেকে
মাছ নিয়ে পালাবার সুযোগ খুঁজতো। নতুন মা’র ভাইও শাহানার দিকে সেভাবেই
তাকিয়ে থাকতো। তারপর কোন রাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই
নিজেকে এ পাড়াতে আবিষ্কার
করলো।
তারপরের স্মৃতি আরো ভয়াবহ। ওকে লায়েক করে তোলার কাজ শুরু হলো।
প্রতিদিন ওকে গরু মোটাতাজার করার ঔষধ খেতে হচ্ছে। এর মধ্যেই ওর ঘরে লোক বসানো শুরু
হলো। সে এক কঠিন দিন, তখন সে কাঁদতেও ভয় পেতো। ইটকাঠের
শহরে ওকে যখন বড় করে তোলার কাজ চলছিলো তখন সাদউল্লাহ’র বাঁশী ওকে বেঁচে থাকার খোরাক
দিচ্ছিলো। কান পেতে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তো, আবার বাঁশীর সুরে ঘুম ভাঙত। বার
বার মন ছুটে যেতে চায় সাদউল্লাহ’র কাছে।
কিন্তু ওদের পাড়ার সর্দারনী সাদউল্লাহকে একদমই পছন্দ করে না। মন চাইলেই
ওকে হিজড়ে বলে গালগালাজ করে। প্রতিদিন
একবার করে সাদউল্লাহকে গালিগালাজ না করলে যেন ভালো লাগে না। যার ওপরই
রাগ উঠুক শেষ হয় সাদউল্লাহকে গালি দেয়ার মাধ্যমে। এটা নিয়ে
অনেকেই হাসাহাসি করে।
গালি খেয়ে সাদউল্লাহ আরো বেশি করে হাসে আর বাঁশী বাজায়।
শাহানা চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখছে। খুব ইচ্ছে করছে সাদউল্লাহকে
নিয়ে অনেক দূরে চলে। সেখানে একটা নদী থাকবে, নদীর চর থাকবে। সে চরে বসে সাদউল্লাহ বাঁশী
বাজাবে আর শাহানা নাচবে। দুলে দুলে নাচবে। কখনো কখনো মাঝরাতে সাদউল্লাহ’র বাঁশী শুনে ঘুম
ভেঙ্গে যায়, তখনি সে নিজের চারপাশে জোছনা দেখতে পায়। নুপূরের
শব্দে কেঁপে কেপে শাহানার মন , তখনই ইচ্ছে করে পালিয়ে
যেতে। সাদউল্লাহ’র হাত ধরে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
এক পাড়াতে আসার পর থেকে অনেক পুরুষরুপী হায়েনা দেখেছে। একমাত্র
সাদউল্লাহকেই কখনো কোন মেয়ের ঘরে ঢুকতে দেখেনি কেউ। সারাদিন
বাঁশী বাজিয়েই যাচ্ছে। পাড়ার
বাইরে একটা লম্বা টুলে শুয়ে থাকে। পাড়ার
মেয়েরা কিছু দিলে খুশি মনে খেয়ে নেয়। না দিলে কারো কাছে চায় না।
বাঁশী শুনতে শুনতে শাহানা আবার ঘুমিয়ে পড়লো। নিজেকে
বেশ হালকা লাগছে। ওজনশূন্য হয়ে উড়ে
যাচ্ছে, গাছপালা,বাড়িঘর, পাহাড় সমুদ্র পার হয়ে চলে যাচ্ছে অনেক
দূরে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই,
হঠাত মনে হলো কেউ ওর হাত ধরেছে। পাশ ফিরতেই দেখলো সাদউল্লাহ, সাদউল্লাহ ওর হাত ধরে
পাশাপাশি উড়ে যাচ্ছে। শাহানার মনটা
আরো ভালো হয়ে গেলো। উড়ছে তো উড়ছেই, চেনা পরিবেশ ছেড়ে ক্রমশ অচেনা পরিবেশে চলে যাচ্ছে।
মনে হলো কেউ যেন ডাকছে ওকে, বার বার। প্রচন্ড শব্দ, অস্থির
লাগছে। শাহানা যেন পড়ে যাচ্ছে, আর উড়তে পারছে না। পড়তে পড়তে চোখ খুলে দেখে ও নিজের
বিছানায় শুয়ে আছে।
আর পাশের ঘরের মালেকা ওকে ধাক্কা দিচ্ছে।
- শাহানি
,ওঠ, ওঠ,কত ঘুমাস?
- কি হলো,
এতো ডাকছ ক্যান?
- তুই ঘুমাইয়া
ক্যাদা হইয়া রইছোস, এ দিকে কি অইছে জানছ?
- কি হইছে?
- বাইরা
আইসা দেইখা যা,
বলেই মালেকা ছুটে বাইরে চলে গেলো। হতভম্ব শাহানাও বিছানা থেকে
উঠে ম্যাক্সি সামলাতে সামলাতে মালেকার পেছনে পেছনে বাইরে এলো।
সব ঘরের মেয়েরা এখন সর্দারনীর ঘরের সামনে বসে কত কল্পনা জল্পনা
করছে। শাহানা সর্দারনীর ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো, সেখানে কেউ নেই।
খেন্তি মাসি সবার মাঝখানে বসে খনখনে গলায় কত কথা যে বলে যাচ্ছে।
এর মধ্যে শাহানা যা শুনলো তার মধ্য থেকে যা উদ্ধার করতে পারলো তাহলো,
সর্দারনী আর সাদউল্লাহ শেষ রাতের দিকে কোথায় যেন চলে গেছে।
কমলার বারান্দায় শুয়ে ছিলো খেন্তি মাসি, ক’দিন ধরে কাশিটা বেড়ে যাওয়াতে ঘুম হচ্ছিলো
না ঠিক মতো। হঠাত মনে হলো কেউ হেঁটে যাচ্ছে। মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে দেখলো সর্দারনী
বেশ বড় একটা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের
হলো আর সাদউল্লাহ এগিয়ে
গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিলো। কাশির তোড় সামলাতে সামলাতে খেন্তি মাসি কাঁথা দিয়ে মাথা ঢেকে
নিলো, একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
পাড়ার পাহারাদার সকালে দেখলো সর্দারনীর ঘরের দরজা খোলা কিন্তু সে কোথাও
নেই। সকাল থেকে সাদউল্লাহকেও দেখা যাচ্ছে না। সাদউল্লাহ নেই, এই কথাটা শাহানার বুকে
শেলের মতো বিদ্ধ হলো। কিছু ভালো লাগছে না। পিছু হটে নিজের ঘরে ফিরে যেতে যেতে শুনলো,
সর্দারনীর নাম ময়না। ময়না যখন এ পাড়াতে প্রথম এসেছিলো তার কিছুদিন
পর থেকে সাদউল্লাহ এসে এপাড়াতে গেড়ে বসলো। খেন্তি মাসির তখন যুবতী বয়স, তখন থেকে দেখছে
সাদউল্লাহ সবসময় ময়নার কাছাকাছি থাকতো। পরম মমতায় আগলে রাখতো, আর ময়না সবসময় ওর ওপর
ক্ষেপে থাকতো। খেন্তি মাসির ধারণা এ পাড়া তে আসার আগে থেকেই ময়নার
সাথে সাদউল্লাহ’র পরিচয়। তাই সাদউল্লাহও এ পাড়াতে চলে এসেছে।
খেন্তি মাসি ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বললো,
- যাউক
, সাদউল্লাহ’র বাঁশি তইলে শেষমেশ ময়নারে খাঁচার বাইর কইরাই ছাড়লো।
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
- দেরি
কইরাও হউক, হ্যারা যহন মিলছে, হ্যারারে মিলাইয়াই রাইখো রাব্বি।
সবার অগোচরে আরো একজন মানুষ এ পাড়া থেকে বের হয়ে গেলো। ছোট্ট
একটা কাপড়ের পোটলা হাতে শাহানা শহরের অনেক মানুষের মধ্যে মিশে গেলো।
----------------------------------------
0 মন্তব্যসমূহ