সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

রুখসানা কাজল




বিষমপদী


 

গড়াই নদে পা ডুবিয়ে বসেছিল অন্তরা। রোদ খলবল করছে জলে। নতুন কেনা অর্গ্যান্ডি শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউয়ের আদরে। শাড়ি তুলে প্রায়হাঁটুর কাছে নিয়ে এসেছে অন্তরা। তবু অবাধ্য জলের দুরন্ত স্রোত মৃদুমন্দ উচ্ছ্বাসেকখনো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর শাড়ি।  রুমকি হাসানঅন্তরা। আবৃত্তিকার। শব্দ উচ্চারণে নিজস্ব শৈলী এনেছে আবৃত্তি্র ক্ষেত্রে। আজকালবেশ নামডাক হয়েছে। ভক্তও জুটেছে কম নয়। রাজধানী থেকে মফঃস্বলের অনেকেই ওকে চেনে.জানে। মঞ্চে ওঠা মাত্র অডিয়েন্স স্তব্দ হয়ে থাকে ওর আবৃত্তি শোনার আগ্রহে। সেই অন্তরা গড়াইয়ের জলে আধাআধি জলডুবি হয়ে বসে আছে। মনে মনে ছবি আঁকছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর। বালিকা ভবতারিণী কিভাবে মৃণালিনী হয়ে উঠল তার ধারাবাহিক জলচিত্র।  দক্ষিণডিহি গ্রামের বালিকা ভবতারিণী মাটির কলস কাঁখে জল ভরতে এসেছে  নদী তীরে।  নকশি শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে নিয়েছে কোমরে। খোলা গলা। উদল কাঁধ, পিঠে রোদ পড়েছে ঝাঁপিয়ে। হাঁটু জলে  নেমে  আঁচল  বিছিয়ে দেয় বালিকা ভবো।  ডান  হাতের পাঁচ আঙ্গুলে জলের উপর জলটোকা মেরে মেরে  মাছেদের ডেকে বলে, শুনিছিস বিয়ে হয়ি যাতিছি আমার ! জম্মের মতন চলি  যাতিছি কলিকেতা। ভবো ভবো  করি ডাকলিও   আর কিন্তুক  দেখা হবি নানে তোগের সাথে ! ওরা আমার নামখানও পাল্টি দিয়িছে। আমি আর তোগের ভবতারিণী নাই। এখন মিরানিলি হয়ি গিয়েছি, বুঝিছিস ও নদী !  অন্তরা দেখে,কয়েকটি হাঁস লালচে হলুদ পা তুলে ডিগবাজি খাচ্ছে গড়াইয়ের জলে। নীলফুল কচুরীর দামে চলছে শালিকের অবিরাম কিচিরমিচির। চমকে হাসে অন্তরা।  মনে মনে মনছবি আঁকার অভ্যাস আর গেলো না ওর ! কল্পনার জল বেয়ে  কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কখন চলে এসেছে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রাম।  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি। আচ্ছা কেউ কি কখনো বলে এইযে এটা ভবতারিণীর বাড়ি?  ঠাকুরবাড়ির সাধারণ এক কর্মচারী বেণিমাধব রায় চৌধুরীর বালিকা কন্যা ভবতারিণী এক সন্ধ্যায়  হয়ে গেলো চিরকালের মৃণালিনী !  ভবতারিণী কি আর কখনো ফিরে এসেছিলো দক্ষিণডিহি গাঁয়ে ? এসেছিল কি ! গড়াইয়ের জলে আঁকিবুঁকি কাটে অন্তরা। ও জানে এখানে এই শিলাইদহে ভবতারিণী এসেছিল। তবে সে ছিল মৃণালিনী হয়ে আসা। আঁচলের গিঁটে ঝুলেছিল চাবির গোছা।    কয়েকটি শিশু মা মা করে ঘিরে রেখেছিল তাকে। স্বামী ছিল নিকষিত সুন্দর। কবি। মানুষটা কখনো কখনো তাকে ছুটি বলে ডাকে। কখনো লম্বা চিঠিতে লেখে, ছুটি ছুটি ভাই ছুটি! তোমার যে বড় অভিমান মেয়ে ! সেই মৃণালিনী, সংসার সংসার গন্ধমাখা হাতে একবারও কি ছুঁয়েছিল গড়াইয়ের জল? বলেছিল কি, যা জল, বয়ে যা। গিয়ে বল একবারও ভুলিনি তাকে। বুকের ভেতর সোনারূপা স্মৃতিঘরে জেগে আছে প্রিয় দক্ষিণডিহি গ্রাম, আমার অতীত বসতবাড়ি। 


        

গড়াইয়ের চরে কুমারখালির হলুদ চেক চাদরে শুয়ে আকাশ দেখছে সুমিত। কাশ ঝোঁপের ছায়া  পড়েছে চাদরে। গৃহস্থের আপন বারান্দার মত গন্ধ ভাসছে তাতে। সুমিত দেখে, গাঙ শালিকরা জোট বেঁধে ঝগড়া করছে। দূর আকাশে মেঘের পাশে উড়ে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো চিল। মেরুন রং একটা ডাহুক ভিজে বালুতে আধখানা গা ডুবিয়ে সুমিতের দিকে লাল চোখে চেয়ে দেখছে। বহু বহু বছর আগে একজন দীর্ঘ সুন্দর, কবি মানুষ ওদের নিয়ে ছড়া লিখেছিল। পাখি সমাজের ইতিহাসে  পালকের অক্ষরে লেখা আছে সে সব  কথা।  একদিন সেই মানুষটি, এই শিলাইদহে, হিন্দু মুসলিম, ছোট জাত, নীচু জা্ত, উঁচু জাতের বিভাজিত  চাদর  সরিয়ে  বসে পড়েছিল  আম মানুষের পাশে। পদ্মার খর জলে সোনার তরী  ভাসিয়ে তিনি দেখেছিলেন, জোতদারের গোলায় রাশি রাশি ভারা ভারা ধান তুলে দিয়ে গরীব কৃষকের অভাবের কাছে দেওয়া আত্মহুতিকে। কাঁচাহলুদ জ্যোৎস্নায় শিলাইদহের মাটি ছুঁয়ে তিনি ভেবেছিলেন এখানে ইশকুল হোক। এই মাটিতে গান ভাসে। এই মাটির বুকে সুর জাগে। এই মাটির পর বসলে থেকে থেকে গেয়ে ওঠে মন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি--   অন্য দশটি সাধারন  পিতাদের মত  তিনিও ছেলে রথীর বুকের নীচে হাত রেখে সাঁতার শেখাতে শেখাতে হাঁক দিয়ে  বলেছিলেন , চন্দ্রবাবু কি হাঁটে যাচ্ছেন ? তিন  পয়সার জ্যোৎস্না কিনে  আনবেন ত। আজ গগন বাউলের গান শুনব মাঝরাত্তিরে। সুমিত অদৃশ্য প্রায় দূরে দেখা যাওয়া রবীকুঠির  দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, ঠাকুর বড়  বর্ণিল মানুষ ছিলেন  বটে। মহা স্বপ্নবাজ। সুমিতের হাসি দেখে  শণবনের ছায়া ভেঙ্গে লম্বা পায়ে বেরিয়ে আসে এক ডাহুকী। নিবদ্ধ চোখে সে ডাহুকী তাকিয়ে থাকে সুমিতের দিকে। কাকে দেখে? সুমিত হেসে উড়িয়ে দেয়,  সে কে জানে ! কে জানে ! 


        

ছমিরুদ্দিন হাত জালে মাছ ধরছিল। কাছামারা পুরানো লুঙ্গিটা ভিজে লেপটে আছে। মেদহীন কোমর আর সুঠাম দুটি নিতম্ব জলে ভিজে আরো সুস্পষ্ট করে তুলেছে পুরুষ শরীরকে। কোমরে  দড়ি দিয়ে বাঁধা টিনের হাঁড়ি। হাঁসের মত দুলে দুলে ভাসছে। মাছ পেলেই হাঁড়িতে চালান করে একেক  বার দেখে  নিচ্ছে চরে শোয়া মানুষটিকে। কিছু দূরে জলের ধারে বসে আছে শ্যামাপানা  একটি মেয়ে। মাঝে মাঝে জলে নেমে জলটোকা দিচ্ছে মেয়েটি। মেয়েটির চোখের কোণে এক ফালি মেঘ। এই মেঘ দেখে সামাল সামাল করে পদ্মার মাঝি তীরে ফিরে আসে। এই মেঘে ঝড়ের পূর্বাভাস লেখা থাকে। ঝড় আসেই। ছমিরুদ্দিন ভাবে , কুঠিবাড়ি দেখতে এসে গড়াইয়ের চরে ঘুরতে এসেছে এরা। এমন তো রোজ রোজ কতজনাই আসে! অভিজ্ঞ চোখে  ছমিরুদ্দিন বোঝে, দলে দলে যারা আসে তাদের চেয়ে এরা যেনো একটু আলাদা । কেমন অন্যরকম ! এরা ঝোঁপ  খুঁজে বসেনি, শণবন বা কোন মহাবৃক্ষের আড়াল খুঁজে নেয়নি। নির্জনতার সুযোগে এরা কেউ  কাউকে জড়িয়ে ধরেনি আদিম কামনায়।  দুজনের  কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। তাকিয়েও দেখছে না। অথচ  সম্পর্ক যে আছে তা বোঝা যায়।  কি যে সে সম্পর্ক ছমিরুদ্দিন যা ভাবে হয়ত তা নয়। মানুষের সম্পর্কের নানারঙ্গের সূতো কেমন ছোট আর ঝামেলার হয়ে উঠছে দিন দিন। ভাঙছে , ছিঁড়ছে, তালি লাগছে, তালি ছিঁড়েও ঝুলঝুল করছে। তার উপর আবার  নানারঙের তাপ্পি পড়ছে। কতশত বাহানা, ঢং , নকশা। একবার এক নামী লেখক এসেছিল। সাথে বউ, পরীর মত তিনটি মেয়ে আর বন্ধুদের   নিয়ে। গাঁয়ের সবার সাথে হাত মিলিয়ে তিনি বাঁশবেতের টঙ্গে বসে গল্প করেছিল।  ঘন দুধের মালাই চা আর কুষ্টিয়ার স্পেশাল কুলফি খেয়ে বাউলদের গান শুনে খুব  জমিয়েছিল সেই লেখক। একতারা, দোতারার তার ধরে দেখতে দেখতে নিমগ্ন সুরে বলে গেছিল আবার আসবে। বার বার আসবে। গানওয়ালা, সুর ভাসা এই শিলাইদহ কি ভোলা যায়! কয়েক বছর  পরে লেখক সত্যিই আবার এসেছিল।  কিন্তু  এবার সাথে ছিল অল্প  বয়সী এক মেয়ে। গাড়ি থেকে নেমে সেই মেয়েই তড়বড়িয়ে বলেছিল, আমি উনার স্ত্রী। কেমন আছেন আপনারা? অনেক গল্প শুনেছি আপনাদের। তাই দেখতে এলাম। আমাদের গান শোনাবেন ত আপনারা ? এবার আর লেখক মন খুলে গল্প করেনি। মালাই চা খেতে গেলে সেই স্ত্রীটি কিছুতেই খেতে দেয়নি। কুলফির মোড়ক খুলতেই হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। অস্ফুটে বলেছে, যত্তোসব রাবিশ চয়েস । তবে সেই মেয়ের  মত দেখতে স্ত্রীটির বড় সুরেলা গলা। জমিয়ে গান গেয়েছিল বাউলদের সাথে,   আমি  কোথায় পাবো তারে আমার  মনের মানুষ যে রে---কিম্বা আমি ধরি ধরি, ধরতে না পাই--  লেখকের গতবারের বউকে ভাবি ডেকেছিল বাউলরা। এবারের বউকে মা জননী ডেকে আশির্ব্বাদ করেছিল সবাই। শামুক গুগলিসহ কতগুলো কুঁচো  চিংড়ি হাঁড়িতে রাখতে  রাখতে ছমিরুদ্দিন ভাবে মানুষের সম্পর্কের মত নদীর জলও কমি আসতিছে। তালি তাপ্পির মত চর ভাসতিছে  গড়াই নদীর হেথা হোথা। এই জলেই ভাসি আসিছিল লালন ফকির, এই জলের পথেই আসিছিল রবীন্দ্র ঠাকুর। অথচ দেহো মন্ত্রীর বেটা মন্ত্রী নদী ভরাট করি কেমন জমিন বানাতিছে । মানুষের জন্যি নাকি বসত গড়পিনে শুয়োরেরবাচ্চাটা। চালাকি করি আবার নাম রাখিছে লালনের নামি। যে ছিল ফকির তারে বানাইছে ব্যবসাদার! এহন আর  কিডা কি কতি আসপিনে কও তো দেহি! আর কজনার ঘাড়েই বা মাথা আছে কিছু কবার ! কয়েকটা টেংরা, পুঁটি  হাঁড়িতে রেখে আবার জাল  টানে ছমিরুদ্দিন। পাঞ্জাবী পরা তিনটে ছেলে মোটর সাইকেল থেকে নেমে দ্রুত ছুটে আসে সুমিতের কাছে। ওদের মুখ ব্যাজার। নির্ধারিত সময়ের অনুষ্ঠান শুরু হতে  আরো ঘন্টা তিনেক লেগে যেতে পারে! মহামান্য অতিথির আসতে দেরি হবে। স্যার কিছু কি লাগবে ?   বিদেশীর সাথে কিছু কেরু দিতে বলে সুমিত ওদের আশ্বস্ত করে। ও জানে প্রধাণ অতিথি জাস্ট টাইমে এলে ভ্যালু কমে যায় তার। মানুষকে অপেক্ষায় রেখে নিজেদের  মহার্ঘ করে তোলার আর্ট জানতে হয়। ছেলেমানুষ এরা। কি করে  জানবে এসব লাগসই ট্রিক্স! তবে জেনে যাবে। কেউ কেউ হয়ত ফলোও করবে পরবর্তি জীবনে!  অই কবিতাটি পড়বেন ত স্যার ? সবুজ পাঞ্জাবী পরা যুবকের চোখে এক নরম আকুল   আলো। সুমিতের  গলায় স্থায়ী হয়ে বসে গেছে,  আমারই  চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুণী উঠল--  আবদারে ছেলেটা ঘেমে গেছে।   ডাহুক দম্পতি লুকিয়ে  পড়েছিল ছেলেদের দেখে। ওরা চলে যেতেই  ফিরে এসেছে ডাহুক।  একলা। একা। এক সুরে ডেকে যাচ্ছে কোয়াক  কোয়াক কোয়াক। সুমিতের  হঠাত মনে হয় আজ অন্য কোন  কবিতা পড়লে কেমন হয় ? চেনা জানা সুরের  একঘেয়ে গৎ ভেঙ্গে একেবারে নতুন কিছু কবিতা !   

  

 

ভিজে হাতে জল ছানতে ছানতে অন্তরা ভাবে, রঞ্জনাকে তো সবাই জানে। রঞ্জনার গাঁ, নদী, বন্ধুও  সবার চেনা। এবার না হয় অন্তরা খুলে দেবে নিজেকে। নিজের আবেগ  অনুভূতির আকুলতা‍য় এবার  অন্যমনা এক অন্তরা বাইশে শ্রাবণকে স্মরণ করবে তার নিজের মত করে! পাঁজরের হাড়ে কতকাল ধরে জন্মে আছে অশোক বটের সাথে হিজলের লাল ক্ষত। একটা আটপৌরে লাল বাড়ি। বাতাসে বাড়ি  খেয়ে দুলে যাচ্ছে বাঁশ কাঠের গেট। অপরাজিতার নীলফুল ফুটে আছে গেটজুড়ে। সাঁঝ সন্ধ্যায় দুই পুরুষের পুরানো বাগানটা তছনছ করে গেছে পাড়ার গুন্ডারা। পোষা পুলিশও এসেছিল ওদের সাথে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সম্ভ্রম ভেঙ্গে অন্যধর্মের ছেলের সাথে পালিয়ে  গেছে অন্তরার দিদি। বিষফুল ফোটার মত ভেসে এসেছিল গালিগালাজ, জারজ জারজ। বাপটাকে জুতা মার। মায়েরও প্রশ্রয় ছিল নইলে কি করে মেয়ে  বেরিয়ে যায় অন্যধর্মের ছেলের সাথে ?  সবকিছু ফেলে মাঝরাত্তিরে পালিয়ে এসেছিল ওরা। তারপর  কেবল সংগ্রাম। নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে কাজ নিয়েছিল হাসান সুলতান। তার মেয়ে অন্তরার  গলায় কবিতা হয়ে উঠে শঙ্খিনীর মত।  মহিলা কলেজে অনার্স পড়তে পড়তে সুমিতের আবৃত্তি সংঘের  সাথে জড়িয়ে পড়ে। ছ বছরের মাথায় অন্তরা দেখে কিভাবে  যেন ব্যক্তি সুমিতের দেহমনের সাথে  এই সমাজ সংসারেও  সে জড়িয়ে গেছে । সুমিতের সাথে চষে বেড়িয়েছে সারা বাংলাদেশ। অনেকেই  জানে অন্তরা সুমিতের দ্বিতীয় স্ত্রী। অন্তরাও ভাবত এই তো কয়েকটা দিন। কিন্তু সব ভাবনা ত আর সত্য হয় না। সুমিতের স্ত্রী  লায়লা আপু। ননগভর্ণমেন্ট এক অফিসের জবরদস্ত এমডি। একটি  পালিত সন্তানের পিতামাতা সুমিত লায়লা। যদিও সুযোগ পেলেই সুমিত নিজের সন্তানহীনতার দুঃখের গল্প করে অন্য নারীদের সাথে। স্ত্রীর অক্ষমতার দায়ভার বইতে হচ্ছে তাকে ! নিজের ঔরসে সন্তান চায়  সুমিত। সে কিন্তু লায়লার গর্ভ থেকে। অন্তরাকে দুবার  অ্যাবার্ট করিয়েছে। অন্তরা রুখে দাঁড়াতেই চোখ গরম করে সুমিত বলেছিল, আমি সিঁড়ি হয়েছি  বলেই না  আজ তুই রুমকি হাসান অন্তরা। নইলে কোথায় থাকতিস তুই? কত টাকার চাকরি করিস যে সন্তান চাস?  অন্তরা এখন বোঝে  লায়লাআপুকে ছাড়তে পারবে না সুমিত।  নিশ্চিত অর্থের  যোগানদার হাতছাড়া হলে সুমিত ভেসে যাবে। অন্তরা ত সাধারণ  চাকুরে মাত্র। কতই বা বেতন!  সুমিতের  সাহচর্যে আছে বলেই না সাধারণের মাঝে অসাধারণ  আজকের অন্তরা।  সুমিতের নামের সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে সে একথা তো মিথ্যে নয়!  সুমিতই ঠিক করে দেয় অন্তরার কবিতা। রেডিও টিভির অনুষ্ঠান। পত্রিকার  সাক্ষাৎকার । নিয়ন্ত্রন করে সাক্ষাতকারের কতটুকু প্রকাশ পাবে অথবা কোনো অনুষ্ঠানে অন্তরা ঠিক কতটুকু পারফর্ম করবে। অন্তরার আলাদা কোন ইমেজ নেই।  পরিচয় নেই। সে শুধু  কেবলই  সুমিতের  লাভিং পার্টনার। কবিতা সহচরী।  গড়াইয়ের গেরুয়া জলে মুখ দেখা যায় না। এলোমেলো জল ছিটিয়ে অন্তরা ভাবে   আজ তার  আরেক জন্ম  হোক। কাদম্বরী, মণিমালা, মৃন্ময়ী, সুরবালা , এলা , লাবণ্য ,  কেতকি অথবা বিনোদিনী চারুলতা নয়। রুমকি হাসানের। প্লাস্টিকের পুরান ব্যাগ হাতে পরাজিত দোকান কর্মচারী হাসান সুলতানের মেয়ে সে। ভাঙ্গা বাজারে ফেলে রাখা পোকায় কাটা তরিতরকারীর সস্তার বাজারী এক অসহায় মানুষের আত্মজার কাহিনী সে কি পারবে না আমজনতার সামনে তুলে ধরতে ? 


    

লায়লা ছুটি নিয়েছে দুদিনের। গেল মাসেই  রূপকের ইশকুলের কাছে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে সে। আজ কালকের ভেতর শিফট হয়ে যাবে। সুমিতকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।  সুমিত প্রায় তিনমাস বাসায় আসে না। অবশ্য ফোন করে মাঝে সাঝে। শুনেছে ইদানীং অন্তরার সাথেও  থাকছে না তেমন। লায়লা বোঝে, অন্তরা   মাটি হতে রাজী হয়নি। অসংখ্য দুর্ণামের বোঝা  মাথায় নিয়েও অন্তরা মুখ বুজে ছিল কেবল নিজেকে গড়ে নিতে। সাবাস অন্তরা। মন থেকে  বাহবা দেয় লায়লা। সুমিতকে কে চেনে বেশি লায়লার চাইতে ! নিজেকে জিরো না করে  সুমিতের  সাথে  কেউ  থাকতে পারবে না। কুড়িটি বছর লায়লা ঝুলে ছিল । আর নয়। সুমিতের  অফিসের ঠিকানায় ডিভোর্সের কাগজ কুরিয়ার করে নিজেকে খুব  হালকা লাগে ওর। ছেলের সাথে কথা বলেছে  লায়লা। এগারো বছরের রূপক জানে, তার মাই সব। বাবা ত গেস্ট মাত্র। কমন বন্ধুদের কেউ কেউ রূপককে প্রচুর আদর করে বিস্মিত হয় , সেই ছেলেটা না ?  ধানমন্ডির  শংকর বাসস্ট্যান্ডের কাছের ডাস্টবিনে  কারা যেন ফেলে গেছিল। ফজরের  নামাজীরা দেখে খবর দিয়েছিল থানায়। কি ভাগ্য ছেলেটার!  লায়লাকে দেখলেই তারা থেমে যায়। রূপক এখন বোঝে  তার জন্মে কোন ঝামেলা আছে। হাসপাতাল নয় ওরা  ডাস্টবিনের কথা বলে। রূপক কি তবে  যীশুর মত কোনো গোশালায় জন্মেছিল? অবহেলায় লজ্জায় আত্মীয় পরিজনের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা ছাড়া অনাদরের কোন গোয়ালঘরে জন্ম হয়েছিল তার ! ভয় আর শংকায় আরও বেশি করে লায়লাকে জড়িয়ে ধরে রূপক । লায়লাও ।  



                    

শিলাইদহের অনুষ্ঠান শেষে কথা ছিল মেহেরপুর যাবে সুমিত অন্তরার দল। যে  আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছিল সেখানে ফুল দেবে ওরা  সবাই। অন্তরা আপত্তি করে। জানিয়ে দেয় যেতে পারবে না এখন। রাত বারোটায় শিলাইদহের আমবাগানে কবিগুরুর কুঠির সামনে অন্তরা সুমিতের তুমুল ঝগড়ায়  বন্ধুরাসহ ঘুমন্ত পাখিরাও হতচকিত হয়ে ওঠে । এর আগেও ওদের ঝগড়া হয়েছে। মিটেও গেছে । তবে ইদানীং বেশি বেশি হচ্ছে। কিন্তু অন্তরাকে এত দৃঢ় হতে আগে কেউ দেখেনি। শেষ মূহূর্তে সুমিত ভেঙ্গে পড়ে। চেঁচিয়ে ভয় দেখায়, তোর কেরিয়ার আমি ধ্বংস করে দেব শয়তানি।  দেখি কে তোকে তেলায়। এই চল ওকে আর আমাদের দরকার নাই। এখুনি পত্রিকায় নিউজ করে দে, সি ইজ আউট। ফিনিস অন্তরা। সুমিতরা চলে যেতে কুঠিবাড়ির পেছনে টেনিস কোর্টে এসে দাঁড়ায় অন্তরা । একা। দুঃখ   নয়, বিষাদ বা মন খারাপ  কিচ্ছু নয়। এক অপার্থিব মুক্তির আনন্দে চিকচিক করে  উঠে অন্তরার চোখ।  টেনিসকোর্টের লোহার বেড়ায় হেলান দিয়ে কুঠি বাড়ির  উপরে  তাকিয়ে নিঃশ্বাস নেয়। বহু বছরের জমানো ঘন নিঃশ্বাস । একটু পরেই স্থানীয় আবৃত্তিকার লতিকা আর শরীফ আসবে ওকে নিতে।  রুমকি হাসান অন্তরা একা নয়। ফিনিস ত নয়ই। নিজের সাথে নিজেই ফিসফিস করে ওঠে অন্তরা, ওক্কে সুমিত চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্টেড। আসছে পনেরো আগস্ট শোকদিবসে কবিতা পড়তে মুজিবনগরে সে আসছে । লতিকাদের গ্রুপের সাথে  চুক্তি হয়ে গেছে । দেশের সবাই দেখুক  রুমকি হাসান অন্তরা উঠে  দাঁড়াতে জানে !  সুমিতের পোষ্য নয় সে।বুক খুলে নিঃশ্বাস নিয়ে উপরে তাকায় অন্তরা। কুঠিবাড়ির ঝাঁঝরি কাটা জানালায় এক নারীর মুখ কি ভেসে উঠলো চকিতে ! বড় শান্ত, মায়াময়, মাটিমন এক নারীমুখ। স্পষ্ট দেখেছে সে।  কে এই নারী ?  কে? কে ?কুঠিবাড়ির  দক্ষিণপূর্ব  দিক থেকে ভেজা বাতাস বয়ে আসছে। সে বাতাসে শ্বাস নিয়ে সে নারী কি বুঝতে চাইছে, আহ, নদী নদী গন্ধ ! কোন নদীর আর্দ্রতা ভেসে আসছে এই বাতাসে  ? তবে কি তার নদী !  কার জন্যে শৈশব গন্ধমাখা এই উতল মাতাল বাতাস ? কার নামে অই দুলে উঠছে মধুমঞ্জুরীর ঘেরাটোপে নবীন আমপাতার রক্তিম ঝোঁপ ? তবে কি দক্ষিণডিহি মনে রেখেছে তাদের মেয়ে ভবতারিণীকে ! তাই কি অই দুলে দুলে ডাকছে মালতী লতার ফুল , ভবো, ভবো এই ভবোতারিনী ! শুনতি পাতিছিস আমাগের !  সালংকরা দু হাতে

বাম বুক চেপে ধরে সে নারী, নাই নাই, সে  ভবো আর নাই। সে যে কেবল মৃণালিনী। মৃন্ময়ী মা। রথী, মাধু রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্রনাথের প্রিয় আশ্রয়। জ্যোৎস্নাধরা আলোকজ   এক কবির প্রিয়তমা পত্নী। সে যে কবির প্রাণের ছুটি। ক্রমশ তালপুকুরে  ঘটি  ডুবে যাওয়া  ঠাকুরবাড়ির জমিদারীর জমজমাটে জমে যাওয়া ঈর্ষা, হিংসা, আনন্দ হাসিতে জারিত এক  সংসার প্রিয়া মৃণালিনী। ঝুঁকে আরো ঝুঁকে  মৃণালিনী কান পেতে দেয় বাইরের বাতাসে। শোনে গাছ, মাটি আর বাতাসের সাথে কোনো এক  মেয়ে গাইছে  বিষমপদী তেওট,  ধা দেন্‌ তা। তিট কতা। গদি ঘিন --- আমার মুক্তি  আলোয়  আলোয়, এই আকাশে --    








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ