আসলে
বাংলাদেশের ওপর একটা গভীর টান অনুভব করি। সেটা বারতিনেক যাওয়ার পর। যতদিন যাইনি,
সেদেশের কারও সঙ্গেই প্রত্যক্ষ পরিচয়ও হয়নি ততদিন তেমনটি অনুভব করিনি। দেশ শুধু মনে হয়েছে দেশভাগের
কোপে পড়ে আমার বাবা-ঠাকুর্দা, ঠাকুমা-দিদিমারা সাতপুরুষের যে ভিটে ছেড়ে পালিয়ে
আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে ছেড়ে আসা ঘর-গেরস্থির গল্প শুনেশুনে বড় হলাম, সে বাড়ি
একবার দেখে এলে বেশ হয়। ‘৫২এর ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণভূমি, ‘৭১এর মুক্তিযুদ্ধের পুণ্যভূমি; অগ্নিপুরুষ! বাংলাদেশ নামের নতুন
রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও কর্মভূমি দর্শন করার ইচ্ছে ছিলই।
শ্রদ্ধেয়া আলোকিত নারী বেগম রোকেয়ার জন্মও ওই বাংলাদেশেই। শ্রদ্ধেয়া জাহানারা
ইমাম। আরও কতকত অগ্নিপুত্র-কন্যার জন্মস্থল বাংলাদেশ, তাঁদের আত্মোৎসর্গের রক্তে ও
কান্নায় ভেজা সেদেশের ধূলিকণা!
পুণ্যসলিলা তটিনীর মতো ছন্দময় মধুর বাংলা অক্ষরমালার চাষে লিপ্ত কবি
লেখকদের বাস সেদেশে! ভাষার প্রতি গভীর প্রেমে কবি শামসুর রহমান লেখেন ‘বাংলাভাষা
উচ্চারিত হলে/ নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ’…আহা! একবার পদ্মাপারের শিলাইদহ, কপোতাক্ষ তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রাম, ধানসিঁড়ি, মেঘনা, পদ্মার ঢেউ সবই
দেখবার ইচ্ছে ছিল মনের গহনে। একবার দেখতে পেতাম যদি! কবি নজরুলের অন্তিম শয্যাও সেখানেই। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর...কত নতুন স্বপ্নের উদ্গমস্থল! প্রিয় কত লেখকের বাসভূমি দর্শন
করার ইচ্ছে জাগবে না? হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু
গুণ, ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হোসেন আরও অনেক প্রিয় বিদগ্ধ কলমের পুষ্টি সেই
ভূমিতে! সে দেশ তত দূরে তো নয়, সীমান্ত পেরিয়ে গেলেই হয়, যাবার ইচ্ছেও হৃদয়ে লালিত
হতে থাকে। কিন্তু পাশপোর্ট, ভিসা, অপরিচয়ের ভয়, দুটি রাষ্ট্রের মাঝে দন্ডায়মান
প্রহরী, কাঁটাতার, আরও কত ব্যক্তিগত দূরত্বের বাধা সরে গিয়ে একদিন সেদেশে যাবার পথ
সুগম হল। বাংলাদেশের নন্দিনী সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে সেদেশে
যাতায়াত শুরু হল আর তখন থেকে কুয়াশা কুয়াশা সব অদৃশ্য মানসিক দূরত্ব রইল না।
সেদেশে প্রীতিপূর্ণ হৃদয়বান কতিপয় স্বজন সুজনদের সঙ্গে তৈরী হল অপূর্ব
আত্মিকবন্ধন! দেশ মানে শুধু মাটিই তো নয়, দেশ মানে মানুষও।
আজ শোনাতে বসেছি চতুর্থবারের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এ শুধুই বেড়াতে যাওয়া
নয়, যেন আবিষ্কার। বলতে দ্বিধা নেই সে দেশে প্রতিবারের ভ্রমণই অসীম প্রাপ্তি। হৃদয়
আনন্দে ভাসে বারেবারেই, ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর? / মানুষেরই
মাঝে স্বর্গ, নরক-মানুষেতে সুরাসুর।‘—হ্যাঁ পরিচয় তো ছিলই এমন উদাত্ত অক্ষরমালার সঙ্গে। সেই চতুর্থবারের ভ্রমণে সেই উদারচিত্ত কবি
শেখ ফজলল করিমের জন্মভিটে ছুঁয়ে এসেছিলাম, এই প্রসঙ্গে রাঢ়ভূমির অপর এক পদকর্তার
নাম কেন যে বারবার মনে পড়ল বলতে পারিনা! দুজনে দুই সময়কালের, তাঁদের উচ্চারণের
ভঙ্গিও পৃথক কিন্তু কি এক অদৃশ্য মহতী অনুভবের বন্ধন, ভাবজগতের সাম্য দুজনের
মধ্যে!
সেবারে বাংলাদেশের
উত্তরভাগের ‘লালমনিরহাট ‘ জেলাশহরের ‘স্বর্ণামতি নন্দিনী’ সাহিত্য সংগঠনের
বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে ডাক পেয়েছিলাম। পূর্বপরিচিতা ভগ্নীপ্রতিম
ফেরদৌসি রহমান বিউটির আন্তরিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনুষ্ঠানের আগের দিন আমরা দুজন
সকাল সকাল রওনা হলাম। চ্যাংরাবান্ধা-বুড়িমারি সীমান্ত পেরোলাম বেলা বারোটা নাগাদ।
গাড়ি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বিউটি। দুপাশে ছড়ান ফসলের ক্ষেত, মাঝেমধ্যে ছোটবড় লোকালয়, বাঁশবন,
মেঠোপথ দেখছি আর ভাবছি সত্যি আমাদের
উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির সঙ্গে এত মিল! ভারতের সিম এখানে চলেনা, ড্রাইভার সাহেবের
ফোনে মাঝে মাঝেই আমাদের সংবাদ
নিচ্ছেন বিউটি। তিস্তার জলবন্টন, খবরের কাগজ-বই- ম্যাগাজিন ইত্যাদি দুদেশের মধ্যে
সহজপ্রাপ্য হলে, ভিসার ঝামেলা না থাকলে কত ভাল হ’ত তা নিয়ে কথা হয় ড্রাইভার সাহেবের সঙ্গে। বারবারই আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ
অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন, ভাষাআন্দোলনের সূত্র ধরে এবং কঠিন লড়াই ও রক্তের বিনিময়ে
তাঁরা স্বাধীনতা অর্জন করেছেন এবং একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছেন বলেই হয়ত তাঁরা
অনেক বেশি স্বচ্ছ ধারণা রাখেন, আন্তর্জাতিক ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে। ভালবাসেন,
সন্মান করেন বাংলাভাষাকে অন্তর দিয়ে।
বেলা প্রায়
তিনটে নাগাদ পৌছোলাম লালমনিরহাটে। বিউটি হাসিমুখে, ফুলের স্তবকে আমাদের অভ্যর্থনা
জানালেন। ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে বিউটির গৃহে মধ্যাহ্ণভোজ সারা হল। টেবিল ভর্তি সুপ্রচুর নানা পদের রান্না।
মৃদুভাষী গৃহকর্তা একজন উকিল এবং রাজনৈতিক দলের নেতা। একসঙ্গেই খেতে বসা হল। নানা
বিষয়ে আলাপচারিতা চলল। এরপর পড়ন্ত বিকেলে আমরা চললাম স্বর্ণামতী নন্দিনী সংগঠনের
সভাপতি, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জাকিউল ফারুকির অতিথিগৃহে। ঢাকা এবং আরও অন্যান্য
জায়গা থেকে আমন্ত্রিত অতিথিরা এসেছেন; অনেকেই পূর্বপরিচিত, বড় ভাল লাগার এক
সম্পর্ক। পারস্পরিক কুশল বিনিময়, গরম চা পান করতে করতেই ডাঃজাকিভাই চলে এলেন
হাসপাতাল থেকে। খুব হাসিখুশি চমৎকার মানুষ, তিনি কবিতা লেখেন শুনেছিলাম। পরে
আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তাঁর ইতিহাস অনুসন্ধানী, দেশপ্রেমী, মানবপ্রেমী হৃদয়টির
পরিচয় পেয়ে বড় ভাল লেগেছিল। তিনি জানান ‘ আজ পূর্ণিমা, অসুবিধা নাই, আপনারা রেডি
হয়ে নীচে আসেন। আপনাদের কয়েকটা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাব। আমি অপেক্ষা করছি। দশ
মিনিটের মধ্যে সবাই চলে আসেন।‘ বেশ দলনেতার বৈশিষ্ট্য রয়েছে ওনার মধ্যে। যার যার
নির্দিষ্ট ঘরে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে নীচে এসে গাড়িতে বসে গেলাম। মাইক্রোবাস, ড্রাইভিং
সিটে জাকি ভাই স্বয়ং।
জ্যোৎস্না প্লাবিত
চারিধার, জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখি। বাসে আমরা জনাদশেক মানুষ, শহর ছাড়িয়ে
গ্রাম্য পথ ধরে যাচ্ছে গাড়ি। বেশ খানিকটা পথ চলার পর রাস্তার একধারে গাড়ি থামিয়ে
আমাদের নেমে আসতে বললেন উনি। আশেপাশে বাড়িঘর নেই, সামান্য হেঁটে আমরা একটা ছোট্ট
সেতুর ওপর দাঁড়ালাম। নীচে জল, বাঁশবন এবং ঝোপঝাড়ের কালোছায়া জলের ওপর, চাঁদের
কিরণে ভেসে যাচ্ছে চারিধার। চাঁদের দিকে চেয়ে মনে হল সে এক রূপবান যুবক! তার
প্রতিবিম্ব জলের ওপর, যেন সে একা এই নির্জনে জলকেলিতে ব্যস্ত! সে দৃশ্যের সামনে
আমরা স্তব্ধ হয়ে রইলাম। হৃদয়ের গভীরে চিরকালীন পটচিত্র হয়ে রয়ে গেল সে দৃশ্য আর
অপূর্ব এক অনুভব। জাকি ভাই বলেন, ‘ এই স্বর্ণামতী নদী, এখন আর একে নদী বলা চলেনা,
রুগ্ন স্বাস্থ্য। আর ওই হল আপনাদের পূর্ণিমাচাঁদ।‘ জাকি ভাইকে ধন্যবাদ জানালাম।
সত্যি একজন প্রকৃতিপ্রেমিক কবি বটেন। ওনার সৌজন্যে এমন অদৃষ্টপূর্ব অভিজ্ঞতা
হল। আবার চলছি আমরা; দুধারে জ্যোৎস্না প্লাবিত ফসলের ক্ষেত, চমৎকার মিঠেল হাওয়া...
এই পথ, পথের সাথীরা, ওই আকাশ-আলো সবই যেন অলৌকিক! যেন সত্যি নয় সবটাই স্বপ্ন!
একসময় গাড়ি থামল। জায়গার নাম জানলাম ‘কবিবাড়ি’। ভাবি বেশ নাম। সামান্য হেঁটে একটি বাড়ির কাছে এলাম। জাকি ভাই কাউকে ডাকতে গেলেন। বিউটি আমাদের বাড়ির অন্যধারে দেওয়াল ঘেরা একটা বাগানের কাছে নিয়ে এল, ভেতরে একটি কবর দৃশ্যমান। সাথীরা সবাই আঁচলে বা ওড়নায় মাথা ঢেকে নিয়েছেন এবং প্রার্থনা করছেন। তাদের দেখে আমিও মাথা ঢেকে প্রার্থনা করলাম কিন্তু তখনও স্পষ্ট জানিনা কার আত্মার শান্তি কামনা করছি। জাকিভাই আমাদের ডেকে নেন, একটি বহু পুরনো ঘরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হই। উনি জানান, ‘‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতা রচয়িতার গৃহ এটি। তাঁরই কবরে প্রার্থনা করে এলেন আপনারা। এ কবির পুরো নাম জানেন বা কবিতাটি পুরো বলতে পারবেন আপনারা কেউ? এই গৃহটিতেই তিনি বাস করে গেছেন। ওনার আত্মীয় আসছেন, দরজা খুলে দেবেন। কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র সব দেখা যাবে। আমরা ওনার স্মৃতিতে এখানে একটি মিউজিয়ম বানানোর চেষ্টা করছি। ‘ আমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘কবির নাম শেখ ফজলুল করিম। স্কুলে ‘স্বর্গ ও নরক’ পাঠ্য ছিল, কবিতাটির কিছুটা মনে আছে, সবটা বলতে পারবনা। মনে নেই।‘ ‘ ফজলুল করিম নয়, ফজলল করিম, শেখ ওনাদের বংশগত পদবী। আসুন সবাই ভেতরে, কবির ব্যাবহৃত জিনিসপত্র সব আছে।‘
বাড়ির টিনের চালা ছেয়ে
আছে গেরুয়া রঙা গোল্ডেন শাওয়ার লতায়। বারান্দা পেরিয়ে শ্রদ্ধানম্র চিত্তে ঘরে
প্রবেশ করি। কবি ব্যাবহৃত দোয়াত কলম,
চেয়ার, টেবিল, খাট, ড্রেসিং টেবিল, টুপি, নোটবুক,বোতাম, কাচের আলমারি, বোতাম,
থালা-গ্লাস, গ্রামাফোন এবং প্রাপ্ত মেডেল এসব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই কলমে কবির
স্পর্শ আছে, এই চেয়ার টেবিলেই তিনি সাহিত্য কর্মে ব্যস্ত থাকতেন, নোটবুকে কবিকৃত
অক্ষর রয়েছে! আজ সব শূন্য পড়ে আছে! মন স্মৃতিকাতর হয়। সব দেখে আমরা বেরিয়ে পড়ি
আবার। জাকি ভাই বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেন, ‘’কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে
বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক-
মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনি মোদের
বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে
তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি-প্রেমের পুণ্য
বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন
আমাদেরই কুঁড়েঘরে।‘’ ( আষাঢ়, ১৩২১,ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত )
জাকিভাই বলেন, দেখেছেন
কেমন উদার হৃদয় মানুষ ছিলেন এই কবি। মানব ধর্মের জয় গেয়েছেন, ক্ষুদ্রতা, ধর্মীয়
সংকীর্ণতা অনেক উর্ধ্বে তিনি। আজ আমরা আধুনিক হচ্ছি কিন্তু মনে বড় দারিদ্র নিয়ে
নানা বিভাজন নিয়ে বেঁচে আছি, কত দুঃখের বিষয়। এই কবি জন্মেছিলেন ১৮৮২ খ্রীঃ আর একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও
ধর্মনির্দিষ্ট স্বর্গ নরক নিয়ে বিভেদ যুদ্ধ নিয়ে মাতোয়ারা মানুষ! প্রীতি-প্রেম
হৃদয়ের ঐশ্বর্য নিয়ে মাথাব্যথা নেই! চিত্ত উদার নাহলে সাহিত্য হয়, না ভালো কিছু
সৃষ্টি হয়?’
‘আছে দাদা আছে। নইলে আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এতগুলো মানুষ একত্র হত?
ভারত থেকে এইযে দুজন অতিথি আমাদের ভালবাসার ডাকে সাড়া দিয়েই তো সীমান্ত পেরিয়ে
এতটা পথ এসেছেন?‘ বলে বিউটি। আমিও বলি ‘একশ বার। ভালবসার টানেই তো এসেছি। আমার
কিন্তু কবিবাড়িতে এসে আমার দেশের বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে জন্ম, মধ্যযুগের
বিখ্যাত পদকর্তা চন্ডীদাসের পদ মনে পড়ছে। হয়তো ভিন্ন প্রসঙ্গে কিন্তু তিনি আদতে মানুষেরই
জয়গান গেয়েছেন। উদার কন্ঠে তিনি বলছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই।/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।।‘
‘ গাড়িতে বসে নানা
প্রসঙ্গ উঠে আসে। পূর্ণিমার আলোয় ভাসমান চরাচর কেমন ধ্যানমগ্ন, আমার চোখে ভাসে
কবিবাড়ির গোল্ডেন শাওয়ার লতা, আর এক নীরব কবর। কবি শেখ ফজলল করিমের বিষয়ে বা রচনা
কিছু পাঠ করার ইচ্ছে জাগে। ওনাদের আলোচনায় জানলাম জায়গাটির নাম কাকিনা, থানা
কালিগঞ্জ, জেলা লালমনিরহাট। আগে এটি রঙ্গপুর জেলাভুক্ত ছিল। একসময় কাকিনা ছিল এক
অতি সমৃদ্ধ জনপদ। এখন নাকি অতি সাধারণ শহরতলী। রাত হয়ে গেছে গাড়ি ঘরের পথ ধরে। ফেরার
পথে আবার বিউটির বাড়িতেই ডিনার, সব্বাই বেশ হৈচৈ করে খেয়ে উঠে অতিথিশালায় ফিরি।
ঘরে যাওয়ার আগে জাকিভাই সবাইকে একটি করে বইয়ের প্যাকেট উপহার দিলেন। শোবার সময়
প্যাকেট খুলে জাকিভাইয়ের দুটি কবিতার বই এবং মোঃ আশ্রাফুজ্জামান মন্ডলের ‘ কবি শেখ
ফজলল করিমের স্মৃতি নিদর্শন’ নামে বইটি পেয়ে খুবই উল্লসিত হলাম।
কবির জন্ম ১৮৮২ খ্রীঃ এবং
তিনি প্রয়াত হন ১৯৩৬ খ্রীঃ মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। বইটিতে রয়েছে কবির আত্মজীবনীর
পান্ডুলিপি; ‘ আমার জীবন-চরিত’—বড় প্রাপ্তি। সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি, চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তবু অনেকটাই
পড়ে ফেলি। সে বই থেকেই জানছি স্বল্পায়ু জীবনে কবির সৃষ্টিসম্ভার কিছু কম নয়। অবাক
হবার বিষয় ক্লাস ফাইভে পড়বার সময় শিশুপাঠ্য কবিতাগুচ্ছ ‘ সরল পদ্য বিকাশ’ রচনা
করেন! লিখেছেন – মদন ভস্ম কাব্য, লায়লী-মজনু আখ্যান, মানসিংহকে নিয়ে প্রবন্ধ,
তৃষ্ণা কাব্যগ্রন্থ, বিবি রহিমা উপন্যাস, আফগানিস্থানের ইতিহাস, হারুন অল রশিদের
গল্প, প্রতিদান নামের উপন্যাস, শুশু পাঠয় গল্পসংকলন, জোয়ার ভাটা উপন্যাস,
যীশুখ্রীষ্টের জীবনী, ছেলেদের শেক্সপিয়র, চাঁদ সুলতানা ঐতিহাসিক উপন্যাস, রোমিও
জুলিয়েটের খহিনী অবলম্বনে লেখেন তদ্গত প্রেম, বাগ ও বাহার উপন্যাস, চমচম ছোটদের
জন্যে কবিতাগুচ্ছ,আমার জীবন চরিত ইত্যাদি। আরও অনেক গ্রন্থনাম আর উল্লেখ করছিনা।
তাঁর আত্মজীবনী কিছু গদ্য ও কবিতা পাঠে মনে হয়েছে সহজ সরল ভাষায় জীবনের সহজ সুন্দর
দিকগুলো উঠে এসেছে। যা কিছু জগতের মিথ্যা, ছলনা, অন্যায় তার বিরুদ্ধে কবির কলম
ঝিকিয়ে উঠেছে। তিনি সততা ও সৌন্দর্যের পূজারী।
পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন,
স্কুলে পড়বার সময় রত্ন-প্রদীপ নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সচিত্র
সে পত্রিকার ছবি কবি নিজে আঁকতেন লিথোগ্রাফ পদ্ধতিতে। কল্লোলিনী নামের একটি
পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৩১৫ সনে বাসনা নামের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন কিন্তু সেটাও বেশিদিন চালান সম্ভব হয়নি। জমজম নামের মাসিক পত্রিকা মাত্র
ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়।
৪/৫ হাজার বই নিয়ে ১৮৯৬ খ্রীঃ ‘ করিমস আহামাদিয়া
লাইব্রেরী’ স্থাপন করেন। এই অতিথি গৃহে বসে ভাবছিলাম এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতবছর
আগে একজন মানুষ সাহিত্যসাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন! কিসের টান!
কোথা থেকে পেতেন এমন প্রেরণা?
সাহিত্য জগত থেকে
স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন কবি শেখ ফজলল করিম; পথ ও পাথেয় এবং চিন্তার চাষ বইদুটির জন্যে
নিখিল ভারতব্যাপী প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ স্থান পেয়েছিলেন।এর জন্যে রৌপ্যপদক এবমগ
নীতিভূষণ উপাধি পান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সাহিত্য বিশারদ, কাব্যভূষণ,
কাব্যরত্নাকর, বিদ্যাবিনোদ ইত্যাদি উপাধি লাভ করেন। স্বল্পায়ু জীবনে সৃষ্টির
সংখ্যা তাঁর কম নয় বরং বলব সুপ্রচুর।
এবারের ভ্রমণে পেলাম
‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতার কবিকে। তাঁর স্পর্শধন্য সকল স্মৃতি সুরক্ষিত থাকুক পরবর্তী
প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক এক লেখকের সদাজাগ্রত কলম ও হৃদয়ের ইতিহাস এবং
অবশ্যই কবির সমকাল।
পরের দিন অত্যন্ত আনন্দঘন
সাহিত্যসভা। গান, কবিতা, ভাষণ, ভারত-বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের সঙ্গে কিছু খোলামনে কথাবার্তাও ছিল যথেষ্ট
প্রাঞ্জল। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ দিয়ে যেমন অনুষ্ঠানের সূচনা
হয়েছিল ঠিক তেমনই জাকিভাইয়ের ব্যাবস্থাপনায় ভারতের জাতীয় সংগীত গাওয়া হল—‘জন গন মন
অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’ – মন ভরে গেল। অন্য দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের
দেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া কত আনন্দের ও সন্মানের সেদিন নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম।
পরদিন সারাদিনের জন্যে
ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থল, তাজহাট রাজবাড়ি,
দিনাজপুর কান্তনগরে শ্রী শ্রী কান্তজিউর মন্দির, রামসাগর দিঘি, কারমাইকেল কলেজ
আরও। সে বৃত্তান্ত আবার অন্যসময় শোনাব নিশ্চিত।
-----------------------------------------------------------------------------------
0 মন্তব্যসমূহ