মহাকবি কায়কোবাদের সেকাল ও একাল
"কে ঐ শোনালো মোরে আজানের
ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিলো কি সুমধুর, আকুল হইলো প্রাণ, নাচিলো ধমনী। কি-মধুর
আযানের ধ্বনি।"- এরূপ অসংখ্য কবিতায় অসম্প্রদায়িক আধুনিক শুদ্ধ বাংলার পরিচয়
দিয়ে গিয়েছেন আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ধারার শেষ মহাকবি কায়কোবাদ। কায়কোবাদ নামে
পরিচিতি লাভ করলেও, তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী। তাঁর পিতৃপুরুষেরা
বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে বাগদাদের কোন এক অজ্ঞাত অঞ্চল থেকে অবিভক্ত ভারতে কাজের
সূত্রে আসেন। তাদের মধ্যে থেকে মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী নামের এক ব্যক্তি ফরিদপুর জেলার
গোড়াইলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই মাহবুব উল্লাহ আল কোরশীর প্রপৌত্র ছিলেন
কবি কায়কোবাদ। কবির বাবার নাম শাহামাতুল্লাহ আল কোরেশী, যিনি ঢাকা জেলা জজ কোর্টের
একজন বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু পিতার হঠাৎ মৃত্যুর পরে কবিকে নানা সমস্যার মধ্যে
পড়তে হয়।
১৮৫৭ সালের ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি
মতান্তরে ২৫ মার্চ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী
বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ
সিপাহী বিদ্রোহের সময়কালে জন্মগ্রহণ করেন। 'কায়কোবাদ' তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল।
মুন্সী বা মহাকবি কায়কোবাদও তাঁকে বলা হয়ে থাকে। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম সনেট
রচয়িতা। ঢাকার পোগোজ স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন কিন্তু
সেই সময় পিতার মৃত্যুতে তিনি ওই স্কুল ছেড়ে ঢাকা মাদ্রাসাতে (বর্তমানে কবি নজরুল
সরকারি কলেজ) ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। যদিও
তিনি সেখানে পরীক্ষা না দিয়ে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নিয়ে নিজের গ্রাম আগলায় চলে আসেন।
পুরো চাকরি জীবনটাই এই পোস্ট মাস্টারি করে কাটান। এবং এখান থেকেই চাকরি জীবনের অবসর
গ্রহণ করেন।
অতি অল্প বয়স যখন মাদ্রাসার
ছাত্রাবস্থা, তখন থেকেই কায়কোবাদ সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর
প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বিরহবিলাপ'(১৮৭০) প্রকাশ করেন। আর মাত্র ষোল বছর বয়সেই ১৮৭৩ সালে
রচনা করেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'কুসুম কানন'। বাংলার দুই মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
ও নবীনচন্দ্র সেনের কাব্যধারাকে অনুসরণ করে মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হন মহাকবি কায়কোবাদ।
তবে নবীনচন্দ্র সেনই ছিলেন তাঁর প্রধান আদর্শ। মুসলমান কবি রচিত জাতীয় আখ্যান কাব্যগুলোর
মধ্যে সুপরিচিত মহাকবি কায়কোবাদ রচিত 'মহাশ্মশান'(১৯০৪) কাব্যটি। যদিও বিপুল আয়তনের
এই মহাকাব্যটি ১৯০৪-১৪ সাল পর্যন্ত আকৃতি ও প্রকৃতিগত নানা পরিবর্তন সাধন করেছিলেন।
কায়কোবাদ মহাকবি নামে যে খ্যাতি পেয়েছেন, তা এই মহাশ্মশান কাব্যটির জন্যই। কবি জীবনের
প্রথম পর্যায়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ 'অশ্রুমালা', যা প্রকাশিত হয়
১৮৯৪ সালে। কায়কোবাদের কাব্যসাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়কে
তার অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করা এবং তা পুনরুদ্ধারে উদ্বুদ্ধ করা।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিরহবিলাপ(১৮৭০)
-এর পর প্রকাশিত হয় কুসুম কানন(১৮৭৩)। এরপর যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তা হল অশ্রুমালা
(১৮৯৫)। যা সেই সময়ের উৎকৃষ্ট কাব্য ছিল। তাঁর গীতিকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ
ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এর পরেই তিনি মহাকাব্য রচনায় হাত দেন। ১৯০৪ সালে মহাশ্মশান
রচনার মাধ্যমে যার যাত্রা শুরু হয়। মহাশ্মশান রচনার পরে তিনি রচনা করেন 'শিব মন্দির'
বা 'জীবন্ত সমাধি'(১৯২১), 'অমিয় ধারা'(১৯২৩), 'শ্মশানভষ্ম'(১৯২৪), 'মহরম শরীফ'(১৯৩৩)
এবং 'শ্মশান-ভসন' (১৯৩৮)।
মহাশ্মশান মহাকাব্যটি তিন
খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে ঊনত্রিশ সর্গ,দ্বিতীয় খন্ডে চব্বিশ সর্গ, এবং তৃতীয় খন্ডে
সাত সর্গ। মোট ষাট সর্গে প্রায় নয়শ' পৃষ্ঠার এই মহাকাব্য বাংলা ১৩৩১, ইংরেজি ১৯০৪
সালে প্রথম প্রকাশিত হয়; যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশ হতে আরো ক'বছর দেরী হয়েছিল। পানিপথের
তৃতীয় যুদ্ধযজ্ঞ
(১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ) ও মারাঠা শক্তির পতন রূপায়িত করতে গিয়ে কবি বিশাল
কাহিনি,ভয়াবহ সংঘর্ষ, গগনস্পর্শী দম্ভ এবং মর্মভেদী বেদনাকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন।
বিশালতার যে মহিমা রয়েছে তাকেই রূপ দিতে চেয়েছিলেন এই কাব্যে। এ যুদ্ধে মহারাষ্ট্রীয়দের
পরাজয় এবং আহমদ শাহ আবদালীর বিজয় বর্ণিত হয়েছে।
‘মহরম শরীফ’ কবির মহাকাব্যোচিত
বিপুল আয়তনের একটি কাহিনি কাব্য। "মহরম শরীফ বা আত্মবিসর্জন” রচনা করেছিলেন শুধু
মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ কাহিনির সত্য ইতিহাসটিকে উপস্থাপন করার মানসে।
প্রতিটি সর্গে প্রথম থেকে চতুর্থ সর্গ পর্যন্ত তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে অতি চমৎকারভাবে
ঐতিহাসিক বিবরণাদি ফুটায়ে তুলেছেন। এখানে তিনি নাটকীয় রূপদান করেছেন প্রত্যেকটি সর্গে
যাতে পাঠক সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক সত্যটি চিত্রায়িত দেখতে পান আপন মনের অন্দরমহলে। তিনি
ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী, যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন রচনায় তিনি হিন্দু-
মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন।
বাংলা মহাকাব্যের অস্তোন্মুখ
এবং গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে মহাকবি কায়কোবাদ মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনি
নিয়ে ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য রচনা করে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন তা তাকে বাংলা সাহিত্যের
গৌরবময় আসনে স্থান করে দিয়েছে(নুরুল আমিন রোকন, সাপ্তাহিক মানচিত্র)। সেই গৌরবের
প্রকাশে ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব
পালন করেন কবি কায়কোবাদ। তিনি আধুনিক বাংলাসাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি। বাংলা কাব্য
সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’
ও ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি বাংলাদেশের মহান ভাষা
আন্দোলনের আগের বছর ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই ৯৪ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের সুদীর্ঘ ৮২ বছরই বাংলা সাহিত্য চর্চা করেই জীবন
অতিবাহিত করেন। পুরাতন আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
কবির মৃত্যুর বহু দিন পরে
প্রেমের ফুল (১৯৭০), প্রেমের বাণী (১৯৭০), প্রেম-পারিজাত (১৯৭০), মন্দাকিনী-ধারা (১৯৭১)
এবং গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ (১৯৭৯) প্রকাশিত হয়। অনেক বিলম্বে বাংলা একাডেমি কায়কোবাদ
রচনাবলী (চার খণ্ড, ১৯৯৪-৯৭) প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৬
সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে কবির বাড়ির সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয় কবির নামে। তখন
একটি নামফলকও নির্মাণ করা হয়। তবে রাতের আঁধারে ফলকটি কে বা কারা ভেঙে ফেলে। ফলে সড়কটি
যে কায়কোবাদের নামে, তা অনেকেই জানেন না। ১৯৭২ সালে সাবেক সাংসদ সুবিদ আলী খান কায়কোবাদের
সম্মানে তাঁর কর্মস্থল আগলা ডাকঘর-সংলগ্ন জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন কায়কোবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
কিন্তু এই বিদ্যালয়ে কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কোনো কর্মসূচি পালন করা হয়
না। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান বলেন, কায়কোবাদের অনেক বই রয়েছে। সেখান
থেকে শিক্ষার্থীদের জানার সুযোগ আছে। কাজেই বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানের দরকার নেই বলে মনে
করেন তিনি। এ ছাড়া নবাবগঞ্জে প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলার চৌরাস্তায় কায়কোবাদের নামে
চত্বর নির্মাণ করা হলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এটি সরিয়ে ফেলা হয়। বিভিন্ন
সংগঠন চত্বরটি পুনঃস্থাপনের দাবি জানালেও ১০ বছরে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
কায়কোবাদের নাতি টুটুল আলম
কোরায়শী বলেন, কবির বাড়িটি দখলমুক্ত করে কবির নামে একটি পাঠাগার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান
নির্মাণ করা জরুরি। এট হলে কবি সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে পারবে। তিনি
বলেন, দেশের অনেক কবির জন্য বছরে অন্তত দুবার তাঁদের জীবন-দর্শন সম্পর্কে আলোচনা সভার
আয়োজন করা হয়। কিন্তু কায়কোবাদের বেলায় এ রকম অনুষ্ঠান চোখে পড়ে না।
কায়কোবাদ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ
সম্পাদক আরশাদ আলী বলেন, মহাকবি কায়কোবাদ নবাবগঞ্জের গর্ব। বাড়ির সামনের যে মসজিদের
আজান শুনে কবি ‘আযান’ কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তথ্যসংগ্রহ:
১) আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা- ড. কাজী আব্দুল মান্নান
২) প্রথম আলো পত্রিকা
৩) বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান- সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত
৪) কায়কোবাদের কাব্যে ধর্মীয় অনুভূতি- আজহার ইসলাম
0 মন্তব্যসমূহ