বই:স্বীকারোক্তি বাকি আছে
কবি: সন্দীপ কুমার মন্ডল
প্রকাশক: বার্নিক /প্রচ্ছদ:সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
আলোচক: মন্দিরা ঘোষ
বইমেলায় কিছুটা কৌতুহল বশেই কিনে ফেলেছিলাম লিটিল ম্যাগাজিন স্টলে। বাড়ি ফিরে প্রথম দু একটি পাতা অবাক না করলেও মন্দ লাগেনি। এরপর সময় নিয়ে যখন ওল্টাতে লাগলাম পাতা, চমকে গেলাম একের পর এক স্বীকারোক্তিতে।
বইয়ের নাম"স্বীকারোক্তি বাকি আছে",কবি সন্দীপ কুমার মন্ডল।
যদিও আমার কাছে অপরিচিত নতুন একটি মুখ,আদ্যন্ত অন্তর্মুখী কবিকে চেনার সহজ পথ এই বইটি মনে হলেও পুরোপুরিভাবে চেনা গেল না বোধহয়!
কিভাবে ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি কালসীমা অতিক্রম করে এক দীর্ঘ পরিক্রমায় পৌঁছে যায় বুঝতে পারি কবির ভাষায়....
'এই ক্রংক্রিটের পথে কোন বাঁক,সেমিকোলন বা দাঁড়ি নেই অথচ এক পিছুটান'।
কবির কাছে প্রত্যাশা এক মূল্যহীন সময়ের নাম। প্রত্যাশার কোন মাপকাঠি নেই। কবির একাকীত্ব এখানে প্রত্যাশার নীরব সাক্ষী হয়ে যায়। সেই একাকীত্বকে যেন সহজেই চিনে ফেলা যায়,অনেকটা আপনজনের মতো।
'নিঃসঙ্গতা আসলে কিছুটা স্মৃতি, কিছুটা সময়,কিছুটা দূরত্ব। যে দুরত্বে চেপে আমি পৌঁছে গেছি নশ্বর ফেরিঘাটে। যেখানে ঢেউয়ে ঢেউয়ে চকচক করছে ফেলে আসা সময়,সময়ের গা জুড়ে আবিল স্মৃতির ঘ্রাণ,যে ঘ্রাণে কোনো নৌকা বুক পাতেনি উজান টানে।'...দুরত্বের সীমা যেন কবিকে নিঃসঙ্গতার পরতে জড়িয়ে রেখেছে। বিষাদের আঁজলা ভরা ঘ্রাণে যেন মুছে নেবে একাকিত্বের ক্ষতস্থান,রক্তের ওপর সময়ের মনখারাপ।
কবির দর্শনে 'প্রতিটি মৃত্যুই আসলে একেকটা এপিটাফের অজুহাত'-যেখানে কবিকে ভাঙা কাচের ভাঁজে সহস্র রঙের ছটা ভুলিয়ে দেয় 'প্রতিটি ভেঙে পরাই আসলে একেকটা বেঁচে থাকার প্রতিফলন'।এখানে কবির ভাবনার উত্তরণে চলে আসে- 'না-বলা অনঙ্গের বিষে শরীর নীল হলে মেখে নিই নীরবতার অ্যান্টিভেনাম।'...নীরবতা আর মৃত্যু যেন কোথাও সমার্থক হয়ে যায়।আবার সংশয় দ্বন্দ্বেরও পিছু ছাড়ে না...'সমস্ত মৃত্যুর পথে বৃষ্টির মতো কিছু শব্দবাতিক সংশয় জমে থাকে।অথচ নির্জলা দৃষ্টির মতো দীঘির পাড় শুকিয়ে যাচ্ছে, মড়মড়ে চোখ।বর্ণান্ধ কথোপকথন কলমিশাকের বুকে হেঁটে যাচ্ছে ধূসর কাঠবেড়ালি। এক অনস্বীকার্য নৈঃশব্দ...' আমাদের থামতে হয়।
'আমাকে ছুঁয়ে থাকে নাবালক কুয়াশা' অথবা 'পর পর কয়েকটা প্যারাসিটামল জানে ছাতিমগন্ধে আমার জ্বর আসে হু হু করে।ভেলিয়াম টেন-এর মতো বিফল কেউই বুঝবে বিফলতার অর্থ।'-লাইনগুলি জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমাদের দৈনন্দিন বিফলতার টুকরো। যেখানে এক হতাশ যাপন প্রতিনিয়ত কবিকে নিঃসঙ্গতার দিকে নিয়ে যায়।
'বিষোদগারণ আসলে একটা ক্ষয়, নির্বিষতার দিকে এগিয়ে যাওয়া।বিষোদগারণ আসলে একটা অহংকার।এই শীতকে মেনে নিলে শীতঘুমের ভবিতব্য কখন যেন প্রার্থিত শীতঘুম হয়ে যায়'....এই স্বীকারোক্তি আদতে আমাদের সকলের।যেখানে অঘ্রাণের শীতের রোদে ছড়িয়ে থাকা নবান্নের স্বপ্ন গুলি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয় অথচ তা নাগাল পায় না।
কবির রোমান্টিকতা যখন প্রকৃতির ডানায় আশ্রয়ে ডুবে যায় পাঠককেও নিয়ে যায় সেই অসীমের মাঝখানে যেখানে মেঘ আসলে প্রেমিকার অভিমানি চিঠি। বর্ষাতিরা বুঝিয়ে দ্যায় বৃষ্টি আসলে বাষ্প-শরীর। 'মেঘ আজকাল ভয় নয়,রোমাঞ্চ নিয়ে আসে,দুহাতে উঠোন ঢাকার বিজ্ঞাপন।'পড়তে পড়তে আমরা ভাসি, যেখানে বন্যা এখনও দাঁড়িয়ে আছে ভাসানোর প্রত্যাশায়।
'...আমি শুধু হেঁটে যাবার গন্ধ পাই,নিজের মুদ্রাদোষে তৃণশয্যা থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাই তোমার ভ্রুক্ষেপহীন পা'....তখন প্রেম আর নিঃসঙ্গতার যমজ শ্বাস আমাদের বুক ভারী করে। এই স্বীকারোক্তি হয়ত আমাদের সকলের ! এই আনত শব্দের আকাশে কখনো মেঘ,কখনো বৃষ্টি, কখনো আতুর যন্ত্রণা,এক গভীর দহন থেকে উঠে আসা শব্দের দীর্ঘশ্বাস, পড়তে পড়তে ভিজতে হয় ।
পুরো বইটির শব্দগুলি যেন আঁচল টেনে রেখেছে! বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই- 'দক্ষিণের ব্যালকনিতে ফুলের বদলে ফুটে আছে অন্তর্বাস'....এক স্বপ্নময় ঝাঁকুনিতে পাঠককে পৌঁছে দেয় কল্পনার রোমান্টিসিজমে। পড়তে পড়তে অবাক হয়েছি,নিবিড় উপলব্ধি না থাকলে এমন প্রেমের লাইন লেখা যায় না বোধহয়! 'পৃথিবীর যা কিছু গোপন তাই অমোঘ,যা কিছু অমোঘ তাই নীরব,যা কিছু নীরব তাই অন্তঃসলিলা। তুমি তো এভাবেও আসতে পারতে!’
চিরকালীন বিরহের নির্মাণে দেখি অভিমানের অস্তরাগ ছুঁয়ে আছে কবির বুক, 'এত কথা জমে আছে বলেই নদীর আদিগন্ত বিস্তৃত নির্বাক বুক।এত কথা জমে আছে বলেই কয়েকটা সংখ্যা আমার আঙুলের ডগায় এক মানবী রচনা করে,যাকে আমি কোনোদিন ডায়াল করবো না।কয়লাখনির ঘর্মাক্ত শ্রমিকের মতোই খুঁড়ে যাব নিজেরই অন্ত্যেষ্টির গোপন জ্বালানি'......বুঝলাম বইটি কিনে একটুও ঠকিনি।