শিল্প ও সামাজিকতা
“ জন্মদিনে খুকী কি নিবি বল - দাদা পারলে একবস্তা চাল দিস ! “ একটি
বিখ্যাত ছবি মেঘে ঢাকা তারা । চরম বৈপরীত্যের দুটি মুখ নীতা এবং শঙ্কর, সম্পর্কে
ভাই বোন। আবেগ। দুটো মানুষের মধ্যে বাস্তবতার টানাপড়েন । একদিকে
খুকীর মধ্যে চরম বাস্তবতা ,অন্যদিকে শঙ্কর একজন গায়ক তার বিচরণ সুরের জগতে ; তার কল্পনাপ্রবণতা
প্রকট। এক্ষেত্রে নীতার পারিবারিক অর্থনৈতিক
দুঃস্থতায় এই চাওয়াটা যেমন ভীষণ সামাজিক বা Realistic ; তবে সমাজের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়েও
যথেষ্ট প্রষ্টব্য । তেমনি সৃষ্টির উচ্ছলতায় মশগুল শঙ্কর
ইমন-কল্যান , বাগেশ্রী , হংসধ্বনিতে বুঁদ হয়ে সংসার নামক বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত ; তাই খিদের জ্বালায় তাদের গলা থেকে বেরিয়ে আসে গান বা রক্ত
তবু বাস্তবতার নিরিক্ষে চূড়ান্ত অ-সফল ।
আলব্যের কাম্যুর আত্মজীবনীমুলক উপন্যাস ‘ লেত্র্যজে-‘ র নায়ক ম্যরেসের সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্কটা একটা জটিল দ্বন্দ্বীক সম্পর্ক , মায়ের মৃত্যু , নায়কের সাড়া না
দেওয়া কোথাও
একটা সামাজিক দায়বদ্ধতার টানাপড়েন ,
কারণ ম্যরেসের মনে হয় মৃত্যু একটা তকমা যার শেষ পরিনতি একটা শংসাপত্র , স্বাভাবিক ভাবে আমাদের সমাজে মায়ের
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কেউ যদি না কাঁদে তবে তার সমালোচনা হওয়া অবশ্যম্ভাবী কারণ সে
নির্দিষ্ট নিয়মগুলি মেনে চলতে বাধ্য , তাকে শোকের আবহে দাঁড়িয়ে জড়াতেই হবে শোকের
নামাবলি , অথচ চিরবিচ্ছেদের বেদনা যদি একজনের কাছে মনে হয় মিথ্যে সত্যকে আঁকড়ে ধরে
থাকতে চায় বলেই যদি সে মায়ের মৃত্যুতে নির্বিকার , শোকাচ্ছন্নহীন বা নিদ্রাচ্ছন্ন
হয় আমাদের সমাজ তথাকথিত এই বৈপরীত্যকে
মেনে নিতে
পারে না , অথবা
সেই মায়ের সাথে দূরত্ব যে
মা বোধির হওয়ায় তার সন্তানের প্রতি হয়ত তিনি যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন না । অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবে একে সামাজিকতা বলা চলে কিনা
যথেষ্ট প্রশ্নাতীত। প্রাত্যহিক জীবনযাপনের এই দুঃখগুলি একান্তই ব্যক্তিগত , তা যে
প্রকাশযোগ্য নয় একবারে শৈশব থেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কাম্যু।
এক্ষেত্রে তার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক লুই জারম্যা কাম্যুর নোবেল প্রাপ্তির পর যা
বলেছিলেন – ‘ I believe that
throughout my career I have respected what is most sacred in a child : the
right to seek out his own truth ‘. নিজের কাছে যা সত্য , তা-ই অনুসরনীয়
, তাঁরই খোঁজ – যা আসলে অনুসন্ধান-সবচেয়ে পবিত্র । হয়ত এই জীবনের পথেই হাটতে
চেয়েছিলেন ম্যরেস বা কাম্যু। সমালোচকেরা
যদিও ম্যরেস ও কাম্যুকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখেছেন। কারণ ১৯৫৭ সালে নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি জারম্যাকে
লিখেছিলেন - দ্বিতীয় ব্যক্তি যাকে কাম্যুর মনে পড়েছিল তিনি ছিলেন জারম্যা এবং
প্রথমজন ছিলেন তাঁর মা ক্যাথরিন। ইমদাদ
খাঁ রেওয়াজ করছেন তাঁর কাছে খবর এসে পৌঁছল
তাঁর কন্যার মৃত্যু হয়েছে , ইমদাদের সেতার থেকে ঝোড়ে পড়ছে বেহাগের করুন সুর , রেওয়াজ
ছেড়ে ওঠা অসম্ভব ; তিনি গেলেন না কেবল ইশারায় বলেদিলেন তোমরা এগোও । পরবর্তীকালে
ইমদাদ যখনই বেহাগ বাজিয়েছেন সে বেহাগ পেয়েছে অন্য মাত্রা কিন্তু আজও প্রষ্টব্য থেকে
গেছে তাঁর সামাজিকতা নিয়ে । অথবা সেই ডাচ
পরিবারের কনিষ্ঠ ছেলেটা আর পাঁচটা ভাইবোনের সাথে বেড়ে উঠছে । যারা
সকলেই অর্থ উপার্জন করে একমাত্র সেই কনিষ্ঠ ছেলেটি ছাড়া , যখন খাবার টেবিলে তাঁর
বাবা তাকে চূড়ান্ত অপমান করে তখন সে বিভোর প্যারিসে গিয়ে আলুচাষীদের সামগ্রিক
জীবনযাত্রা নিয়ে ছবি আঁকবেন বলে , অথচ জানা নেই তাঁর আঁকা ছবি কোনদিন বিক্রি হবে
কিনা । ভিনসেন্ট ভ্যান গগ আদৌ সামাজিক ছিলেন ।
(দুই)
ঘটনাগুলি
বেশ বিক্ষিপ্ত কিন্তু যথেষ্ট সাদৃশ্যপূর্ণ । দুটো পৃথক সত্তার আণবিকতা পাশাপাশি লক্ষণীয়
, সামাজিকতা এবং শিল্প।শিল্পী কতখানি সামাজিক। অথবা নিদিষ্ট সামাজিক অচলায়তন
অবস্থায় দাঁড়িয়ে শিল্পবোধকে কতখানি উৎভাসিত করা যায় অথবা যারা অসময়ে দৃঢ়তার সাথে মহৎ শিল্প সৃষ্টিতে সক্ষম তারা কতটা সমাজবদ্ধ
জীব । অতএব সত্ত্বা দুটির মাঝে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে বের করা দরকার ,
প্রারম্ভিকভাবে শিল্প ও সামাজিকতা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন ।
শিল্পের
ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে , প্রকৃতির বস্তু সকলের রূপ মানুষের মনে এক বিশেষ ভাব ও
রসের জন্ম দেয় । সেই ভাব ছন্দে প্রভাবিত হয়ে মানুষ বিভিন্ন আধারে , বিভিন্ন করণ ও
উপকরণের সাহায্যে, বিভিন্ন কলাকৌশলে সেই ভাবকে যে ছান্দনিক রূপ দান করেন তাকেই
শিল্প বলা হয়। অর্থাৎ শিল্পীর ভাবচেতনার সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশকেই শিল্পকলা বলে । ‘ The Soul of Man under Socialism ‘ প্রবন্ধে Oscar Wilde লিখেছিলেন – ‘ Art, is the most intense
mode of Individualism that the World has known ‘ and he condemns the right of
the community to interfere with the Individualism of imaginative art . আর
এখানেই তিনি সামাজিকতার জের টেনেছেন – The new Individualism , for
whose service socialism , whether it wills it or not, is working , will be
perfect harmony.... It will be complete , and through it each man will attain
to his perfection .
খুব
স্বাভাবিক ভাবে বলতে গেলে শিল্পীর সামাজিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন শিল্পীর সচেতন ,
সাধকচিত মনোভাব , একাগ্রতা ও সত্যনিষ্ঠার । এই প্রসঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিদগ্ধ
কবি-প্রাবন্ধিক এবং চিন্তক শ্রী সুধীর দত্ত মহাশয়কে প্রশ্ন করলে তিনি যে শানিত
গদ্য উপাদানে আচ্ছাদিত করলেন এই উভয় বিষয়কে তা হল – ‘ আমি বিশ্বাস করি , শিল্প বা
শিল্পীর নিজের ছাড়া আর কারোর কাছে কোনও দায়বদ্ধতা নেই । শিল্প হচ্ছে তাঁর আত্মখনন
এবং সেই খনন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতার নির্মাণ । অভিজ্ঞতা বলতে বুঝি , এই যে আমাদের বেঁচে
থাকা , বেড়ে ওঠা , এবং সেই সুত্রে আমাদের পরিপাশ্বের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যে সংঘর্ষ ও
সমবায়তার অনুভব । এখানে সমাজবাস্তবতা গৌণ । একজন সংবেদনশীল সামাজিক মানুষ হিসেবে
সমাজের যে সব অসঙ্গতি তাঁকে পীড়িত করে , যার দ্বারা তিনি ক্লিষ্ট হন , তার কথা
তিনি বলতে পারেন। একই সুত্রে থাকতে পারে তাঁর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ; থাকতে পারে
সেই সমাজ কে ভেঙ্গে নুতন করে গড়বার স্বপ্ন । আমি একে কোন সামাজিক দ্বায় বলি না ,
বলি নিজের প্রতি দ্বায়। এই সমাজকে তিনি তাঁর মতো করে বোঝেন ,
তা কোনও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সাথে সঙ্গে মিলতে পারে নাও মিলতে পারে । বরং বলবো ,
একজন শিল্পী সমস্টির মধ্যে থেকেও একা , সংঘের মধ্যেও নিঃসঙ্গ । তিনি গণ্ডারের মতো
একা বিচরণ করতে ভালবাসেন। তবে যেহেতু সততা ও সংবেদনশীলতা তাঁর চারিত্র্য , তাঁর
চিন্তন ও মননে সমাজের অহিত থাকে না । ‘
কবি
যেন এই বলার মধ্যে দিয়ে প্রবন্ধের সূচনা পর্ব থেকে পরিশিষ্টের মাঝে তৃপ্তিদায়ক
সেতুবন্ধন গড়ে দিলেন । আলোচনার একেবারে শেষভাগে এই সামগ্রিক অতিমারি পরিস্থিতিতে
যেখানে সমগ্র পৃথিবীর বিশেষ করে শিল্পচর্চা ক্ষেত্রে চরম অসহায়তার ছবিটি স্পষ্ট
হয়ে ওঠে , তখনই একবাক্যে আলোচিত হন শেক্সপিয়র এবং তাঁর সামাজিকতা বা সমাজচেতনার
বিষয়টি । তাঁর সম্বন্ধে আমরা কতোগুলো বিষয় বহুবার বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেছি যথা
তাঁর উত্থান ১৫৯০ থেকে ১৬১৩ এর মধ্যে প্লেগের মতো অতিমারি এবং সমগ্র ইংল্যান্ড জুড়ে
নাট্যমঞ্চগুলো বন্ধপ্রায় , অন্যদিকে ইংল্যান্ডের
রাজপরিবারে অস্থির পরিস্থিতি এর মধ্যেও তাঁর কাছে পাই ৩৭ টি নাটক । তবে এমত
পরিস্থিতে J. Dover Wilson এর পর্যালোচনাটি একটু আলাদা। “Wilson’s view was highly imaginative , artistic , romanticized one , and
he becomes the victim of his own paradox , at times insisting on a complete
separation of the man from the artist , at other times mixing them in heady
draughts of new wine. When his comments on the plays’ artistic qualities have
considerable merit , his views of Shakespeare’s morality must be rejected as
not squaring with known facts . Shakespeare’s involvement with his milieu was
always of a constructive nature , especially in matters political and religious
.”
Contd...
(তিন)
আলোচনার গতি প্রকৃতি যে ভাবে এগিয়ে চলেছে এবং তাতে আলোচিত
বিষয়ের উপর বিভিন্ন দিক থেকে যে ভাবে আলোকপাত করবার প্রয়াস হয়েছে তাতে যে বিষয়টি
ক্রমশ পরিস্কার হয়ে আসছে তা হল , শিল্পী সমগ্র্যের মধ্যে থাকলেও তাঁর জগত
স্বতন্ত্র সামজিক স্তরে তাঁর বিচরণ থাকলেও তাঁকে ব্যাপক অর্থে সামাজিকতায় বেঁধে
ফেলা মানে শিল্পের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা । Wilde তাঁর
প্রবন্ধের একেবারে শেষে শিল্পীর প্রতিপক্ষ সমর্থনে বলেছেন – form of Government that would be suitable for an artist would be no
Government at all . Authority over him and his Art is ridiculous . ।