।।এক।।
আজ সকাল থেকেই তুমুল এক ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।
শুধু কি ব্যস্ততা? এক
বিশাল সমারোহ। সারা
বাড়ি টুনি লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফটক দালানে লাগানো হয়েছ গ্লাডিওলাস, অর্কিড, জায়বেরা, গোলাপ,
রজনীগন্ধা ফুলের কারুকার্য। বাড়ির পেছনে যে বিশাল ফাঁকা জায়গা পড়ে
আছে সেখানে ভিয়েন বসানো হয়েছে। সকাল থেকেই রান্নার ঠাকুররা তাদের পটু হাতে বিশাল
বিশাল উনুনে বড় বড়
কড়াই চাপিয়ে
দিয়েছে। হামান দিস্তায় নানারকম মশলা পেষার টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সারা বাড়িময়
সুগন্ধি খাবারের গন্ধ ম ম করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খুশিতে হুটোপুটি শুরু করে
দিয়েছে। গোটা এলাকার মানুষজনের গত কাল থেকে শুরু করে আগামী পাঁচদিন এই চৌধুরী
নিবাসে নেমন্তন্ন। এবার এই আড়ম্বরের আসল কারণে আসি। আজ জমিদার প্রতাপাদিত্য
চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী গতকাল বিবাহ সম্পন্ন করে তার
নববিবাহিত স্ত্রী সুহাসিনী দেবীকে নিয়ে ঠিক বিকেল পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটে চৌধুরী নিবাসে ফিরবেন।
পঞ্জিকা দেখে এইসময়কেই শুভ সময় বলে এ বাড়ি থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বাড়ির বড়
গিন্নিমা রমলাসুন্দরী অর্থাৎ প্রতাপাদিত্যের স্ত্রীর কড়া নির্দেশ যাতে আয়োজনের কোন
ত্রুটি না থাকে।
খোকনের আসার সময় হয়ে এলো, ওরে ও পারুলের মা বরন ডালাটা হাতের কাছাকাছি রাখ ,
হুকুম করে রমলাসুন্দরী অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । পরনে লাল পেড়ে
সাদা গরদের শাড়ি, গলায় সীতাহার, কানপাশা,
হাতে দুটো চওড়া চওড়া চুড়,কপালে বড় সিঁদুরের
টিপে গৌরবর্ণা সুহাসিনী দেবীকে আজ সাক্ষাৎ দেবী দুর্গা দেখাচ্ছে। চারিদিকে তীব্র
উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল। বাড়ির ফটকের মুখে
রাজেন্দ্রনারায়ণের পেল্লাই
অস্টিন গাড়িটি এসে থামল। শোনা যায় প্রতাপাদিত্যের বিভিন্ন শখের মধ্যে একটি শখ হল
বিদেশি গাড়ি সংগ্ৰহ করা। এই অস্টিন গাড়িটি তিনি ইংল্যান্ড থেকে আনিয়ে ছিলেন ছেলে
রাজেন্দ্রনারায়ণ যেবার বিলেত থেকে ওকালতি পাশ দিল তার উপহার হিসাবে।
পূর্ববঙ্গের রাজশাহী এলাকার জমিদার প্রতাপাদিত্য
চৌধুরীর দুটি পুত্র ও একটি কন্যা। জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজেন্দ্রনারায়ণ ব্যারিস্টার।
প্রতাপাদিত্য ও রমলাসুন্দরী বহু খোঁজ করে পাশের গ্ৰামের জমিদার ভবেন্দ্রকুমারের
একমাত্র অতীব সুন্দরী কন্যা সুহাসিনীর সাথে রাজেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ দেন। কনিষ্ঠ
পুত্র তেজেন্দ্রনারায়ণ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা
করছে। আর সবার বড় হল কন্যা যশোদাসুন্দরী। যেমন তার রূপ তেমনি তার মেধা। যশোদাসুন্দরী
নিজের আগ্ৰহেই বাড়িতে পণ্ডিত রেখে সংস্কৃতি চর্চা শুরু করেছিল। একে একে হিতোপদেশ, গীতগোবিন্দ, কথাসরিৎসাগর
প্রভৃতি কাব্যগ্ৰন্থের পাঠ নিতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু এ বাড়ির রীতি বা প্রথা
অনুযায়ী মেয়েদের অতিরিক্ত পাণ্ডিত্য অর্জনের আশংকার পূর্বেই বিবাহ দেওয়া হয়। সেই
রীতি যশোদা সুন্দরীর ওপরেও বর্তে ছিল। যশোদাসুন্দরীর যখন সবে ষোল তখন বরিশালের
জমিদার কৃষ্ণসিংহ রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীকান্তের সঙ্গে বিবাহ হয়। যশোদাসুন্দরী
অতি অল্পকালের মধ্যেই তার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শ্বশুর বাড়ির সকলের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্ত্ত তার এই সুখের ঠিকানা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ করেই এক অনাগত ঝড় তার জীবনকে তছনছ করে দিল। যশোদাসুন্দরীর আট মাসের গর্ভস্থ সন্তান তার পেটেই নষ্ট হয়ে
যায়। এর প্রায় ছয়মাসের মধ্যেই তার স্বামী শ্রীকান্তের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়।
এরপর থেকেই শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে অপয়া, রাক্ষুসী এইসব বদনাম
মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছিল। এইসময় হঠাৎই প্রতাপদিত্য না জানিয়ে যশোদার শ্বশুর
বাড়িতে উপস্থিত হন। সেখানে মেয়ের অসহায় অবস্থার কথা তিনি আন্দাজ করতে পেরে সেই
দিনই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। এর পরবর্তীকালে যশোদার শ্বশুর বাড়ি
থেকে কেউ কোনদিনই যশোদাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কোন পত্র দেয়নি। শুধু আসার প্রায় পাঁচ
বছরের পর যশোদার শ্বশুরমশাই কৃষ্ণসিংহের মৃত্যুর খবর জানিয়ে একটি পত্র এসেছিল। সেই
থেকে আজ প্রায় দশবছর হল যশোদা তার পিত্রালয়ে আছে। তবে মা বাবার আদুরে একমাত্র কন্যা হিসাবে যশোদার এ
বাড়িতে যথেষ্ট প্রভাব। হয়তো এই অতিরিক্ত আশকারার পেছনে প্রতাপাদিত্যে ও
রমলাসুন্দরীর যশোদার প্রতি প্রচ্ছন্ন সহানুভূতিও কাজ করে। এছাড়াও এই চৌধুরী নিবাসে
থাকে প্রতাপাদিত্যেরর ভাই আদিত্যনারায়ণ চৌধুরী, তার স্ত্রী
মায়াদেবী ও তাদের একটি পাঁচ বছরের কন্যা মৈত্রেয়ী। আদিত্য তার দাদার অত্যন্ত
অনুগত। সর্বদাই দাদার আদেশ মেনে চলতে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে।
ও দিদিমণি,
এই ভরসন্ধ্যায় তুমি শুয়ে আছ কেন? পারুলের
কথায় যশোদা উঠে বিছানায় বালিশের ওপর ঠেস দিয়ে বসল। এই নাও বড়মা তোমার খাবার পাঠিয়ে
দিয়েছে। পারুল একটা কাঁসার বাটিতে সাবুদানা, দুধ, নারকেল কোরা ও দুটো সবরি কলা এগিয়ে দিল। আজ একাদশী তাই যশোদার জন্য এই
খাবারের বন্দোবস্ত। যশোদা ডুবানো দুধের ভেতর থেকে এক টুকরো কলা চামচে দিয়ে কেটে
মুখে পুরতে পুরতে ভাবল সারা বাড়ি এমনকি গোটা এলাকার মানুষ আজ এই চৌধুরী বাড়ির ভোজ খাবে আর তার জন্য এই খাবার
আনা হয়েছে। বৈধব্যের এই অসম রীতি এখনও যশোদা ঠিক মেনে নিতে পারেনি। তার মনের ভেতরে
তীব্র এক আক্রোশ, যন্ত্রণা, এক ঘৃণার
সঞ্চার হয়। এই বাড়িতে তার যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও বৈধব্যের এইসব রীতি নীতি খুব কঠোর
ভাবে তার ওপর জারি করা হয়। আর তাই তো একাদশীর কারনেই বড় ভাইয়ের বৌ এর মুখ আজ তার
দেখা বারণ।
পারুল কেমন দেখলি নতুন বৌকে?
দিদিমণি,একেবারে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী প্রতিমা। যেমনি রং তেমনি মুখ। জানো গো দিদিমণি,
কত গয়না যে গায়ে পরেছে। গলায় সীতাহার নেকলেস, লম্বা ঝোলানো হার। আর কানে একটা বড় দুল সারা কান জুড়ে বসে থাকে- কি যেন নাম? ও
দিদিমণি, তুমি শুয়ে পড়লে? পারুল এখন যা
এখান থেকে। কানের কাছে বকর বকর করিস না।
আচ্ছা গো দিদিমণি, আমি যাই। আজ তো বাড়ির সবাই নতুন বৌকে নিয়ে ব্যস্ত।
তোমার কিছু দরকার হলে আমাকে ডাক দিও ।
আলোটা নিভিয়ে দে পারুল।
যশোদা এক গভীর নিশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরল।
।।দুই।।
যশোদার প্রতিদিনের অভ্যাস খুব ভোরে উঠে স্নান
সেরে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঠাকুর ঘরে কাটানো। তিনতলার ওপরে ঠাকুরঘর। সাদা থান পড়া স্নিগ্ধ,পবিত্র যশোদার
ঠাকুরঘরে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকার দৃশ্যটি সত্যিই অবাক করার মত। এই সময় যদি পৃথিবী
রসাতলে তলিয়ে যায় তবুও যশোদাকে তার এই পবিত্র কর্মটি থেকে সরানো যাবে না। যশোদার
স্বভাবগত ব্যক্তিত্ব এইসময় তার মুখের ওপর আরো তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। খুব সকাল সকাল
বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে। আজ রাজেন্দ্রনারায়ণের বৌভাত। প্রতিদিনের অভ্যেস মত যশোদা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে
একবার হেঁশেলে
ঢোকে। রাঁধুনিদের কি কি করতে হবে তা ঝাঁঝালো সুরে নয়, তীক্ষ্ণ
আদেশ দিয়ে বেরিয়ে লম্বা ঝুল বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসে । আসতে আসতে হঠাৎই ডানদিকের
রাজেন্দ্রনারায়ণের ঘরের দিকে খিল খিল হাসির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায়। যশোদা ধীরপায়ে
সেই ঘরের দিকে এগিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
আরে যশোদা তুমি বাইরে কেন ?
এবাড়ির ছোট মা মায়াদেবী যশোদাকে হাত ধরে টেনে
ভেতরে নিয়ে যায়। ঘরের ভেতরে এক বিরাট পালঙ্কের ওপরে সুহাসিনী ঘোমটা দিয়ে লজ্জায়
হাসি মুখে মাথা নীচু করে বসে আছে। আর তাকে ঘিরে জনা দশ বারো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে কৌতুহলী মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তবে সবার মধ্যে মৈত্রেয়ীর অধিকার সর্বাগ্ৰে তার
নতুন বৌমনির ওপর। ওর এই
অধিকার বোধ ওর মুখেই ফুটে উঠেছে। নতুন বৌ এর পাশে কে বসবে এই নিয়ে ওদের মধ্যে একটা গুপ্ত
রেষারেষি চলছে। মায়া দেবী সুহাসিনীর কাছে গিয়ে হাসি মুখে বলে, এই দেখ নতুন বৌ, এ তোমার একমাত্র বড় ননদ। প্রনাম কর।
সুহাসিনী টুক করে খাট থেকে নেমে যশোদার পা ছুঁয়ে প্রনাম করল। যশোদা সুহাসিনীর
চিবুকে আলতো করে স্নেহের আঙুল ছুঁয়ে বলে, ভালো
থেকো। কাল রাতে তোমার ঠিকমতো ঘুম হয়েছিল? সুহাসিনী নিরুত্তর
থেকে শুধু
ঘাড় নাড়ে। যশোদা একদৃষ্টিতে গভীর ভাবে সুহাসিনীকে লক্ষ্য করে কিছুক্ষন পরে ঘর থেকে
বেরিয়ে এল।
সন্ধ্যা হতে না হতেই সারা বাড়ি আবার আলোয় ঝলমল
করে উঠল। দেউড়ির
ওপরে নহবৎখানার একটানা সানাই বেজে চলেছে। একে একে সব অতিথিরা আসতে শুরু করেছে।
প্রতাপাদিত্যের ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক কয়েকজন ইংরেজে গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে
চৌধুরী নিবাসের বংশ মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। সুহাসিনীকে জাম রংএর বেনারসি
পরানো হয়েছে। সারা গা ভর্তি সোনার অলংকার। মাথায় দেওয়া হয়েছে এই বাড়ির
বংশানুক্রমিক সোনার মুকুট। যশোদা দূর থেকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে সুহাসিনীকে দেখে
যাচ্ছে। যশোদা জানে এই শুভদিনে সবার সঙ্গে আনন্দ করা তার বারণ। প্রতাপাদিত্য বা
রমলাসুন্দরী এই ব্যাপারে যশোদাকে কিছু না বললেও যশোদা এই চরম সত্যটা অবগত। সবার
অলক্ষ্যে যশোদা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এতবছর পরে আজ শ্রীকান্তের কথা
তার খুব মনে পড়েছে। যশোদা দেওয়ালে টাঙানো শ্রীকান্তের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায় ।
কত কথাই মনে পড়ছে। প্রথম যেদিন শ্রীকান্তের সাথে শ্বশুর বাড়িতে গেল সারা বাড়ি
ভর্তি লোক তাকে দেখার জন্য ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার লাল বেনারসি। যশোদা ভয়ে
একেবারে কুঁকড়ে ছিল। যশোদার মনের অবস্থা টের পেয়ে শ্রীকান্ত সবার অলক্ষ্যে যশোদার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলেছিল দূর!
বোকা মেয়ে । আমি তো তোমার পাশেই আছি। অত ভয় কিসের। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজের
অজান্তেই যশোদা একবার হেসে উঠল। সেই দিন থেকেই যশোদা আস্তে আস্তে শ্রীকান্তকে
ভালোবাসতে শুরু করেছিল। শ্রীকান্তের আদর্শ, ভাবনা, চিন্তাধারা যশোদাকে খুবই প্রভাবিত করেছিল। যশোদার শ্বশুর মশাই কৃষ্ণসিংহ রায় ইংরেজদের
তাবেদারি করে ইংরেজ সরকার থেকে রায় বাহাদুর খেতাব পায়।
কিন্তু শ্রীকান্ত ছিল তার পিতার ঠিক বিপরীত। ইংরেজদের ভারতে শাসন, তাদের অন্যায়
জুলুম কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। শ্রীকান্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রামের অনুশীলন সমিতির তৎকালীন বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। পুত্রের এই রূপ দেশপ্রেমিক কার্যকলাপে
ভয় পেয়ে কৃষ্ণকিশোর খুব শীঘ্রই শ্রীকান্তের বিয়ে দেন। কিন্তু এর ফল হয় ঠিক উল্টো । বিয়ের পরে যশোদা তার
স্বামীকে দেশের কাজে আরো উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। আর যার ফলস্বরূপ পুলিশের গুলিতে
শ্রীকান্তের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষ ভাবে যশোদাকেই দায়ী করা হয়েছে।
যশোদা অনুভব করছে তার সারা শরীর জুড়ে এক তীব্র শিহরণ জেগে
উঠছে । ভেতরে দীর্ঘদিনের জমে থাকা দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমান আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ন্যায় প্রবল বেগে বেরিয়ে আসছে। সে
নিজের মনে মনে বলে উঠল না আমি তো কোন দোষ করিনি। তবে কেন আমার মত বিধবাদের প্রতি
এই অন্যায় বিচার? কেন এই গৃহবন্দীত্ব? কেন
সবার থেকে আমাকে শুভ কাজে শত সহস্র দূরে রাখা হয়েছে? হঠাৎই
যশোদা তীব্র অভিমানে এক ঝটকায় আলমারি খুলে তার লাল বেনারসি শাড়ি বের করে গায়ে
জড়ালো। আলমারির
লকার থেকে সব গয়না বের করে ঝটপট সেগুলো পড়ল। আচমকা আঙুলের ডগায় সূঁচ ঢুকিয়ে রক্ত
বের করে সিঁথিতে ভরিয়ে দিল। এরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ দেখে কিছুক্ষণ অবাক
হয়ে তাকিয়ে হঠাৎই অঝোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে
অত্যন্ত ঠান্ডা ভাবে ধীরে ধীরে আবার সব গয়না, বেনারসি শাড়ি
আলমারিতে তুলে রাখল। মুখে জলের ঝাপটা দিতে আস্ত আস্তে স্নানঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
।।তিন।।
সুহাসিনী এই বাড়ির বৌ হয়ে এসেছে তা এক বছর পূর্ণ
হতে চলল। সুহাসিনী এই এক বছরের মধ্যেই চৌধুরী নিবাসে বড় বৌ এর স্থান নিজের
কৃতিত্বেই বেশ তৈরী করে নিতে সক্ষম হয়েছে। পূর্বে হেঁশেলের পুরো কতৃত্বই ছিল
যশোদার দখলে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল সুহাসিনী যশোদার সেই দখলে ভাগ বসায়। বিশেষতঃ
তার স্বামী রাজেন্দ্রনারায়ণের পছন্দ অপছন্দের ওপর সুহাসিনীর কড়া নজর।
রাজেন্দ্রনারায়ণও এই কয়েকদিনের ভেতরেই পত্নী প্রেমে অন্ধ। যা কখনও কখনও যশোদার
অবচেতন মনে ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুহাসিনীর সর্বদা পরিতৃপ্ত ঝলমলে হাসি মুখ, বাড়িতে সবার সুহাসিনীর প্রতি বিশেষ নজর, সুহাসিনীর উপচে পড়া রূপ, ঐশ্বর্যের কাছে যশোদার
নিজেকে কেমন যেন তুচ্ছ, গুরুত্বহীন, অত্যন্ত
অবহেলিত, আশ্রিত বলে মনে হয়। যদিও সুহাসিনী যশোদাকে যথেষ্ট
সম্মান করে। এমনকি প্রতাপাদিত্য কোন কাজে বাইরে গেলে যশোদার সাথে সাক্ষাৎ না করে
যান না।
যশোদা মা এই আমগুলো দিয়ে মানদা মাসিকে আচার করে রাখতে বলিস।
যশোদা অবাক হয়ে রমলাসুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বলে
আচার! কার জন্য মা? রমলাসুন্দরী
একগাল হেসে যশোদার কানের কাছে এসে বলে তুই পিসি হতে চলেছিস যশো। আমি সুহাসিনীর শইল
দেখে পেথমেই ঠাহর করেছিলাম। আজ সুহাসিনীকে আলাদা করে জিগ্গেস করতেই জানতে পারলাম।
হঠাৎই যশোদার বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। সে তৎক্ষণাৎ হেঁশেল থেকে বেরিয়ে খুব জোরে
জোরে পা চালিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। রমলাসুন্দরী মেয়ের অকস্মাৎ এইরূপ আচরণে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। যশোদা নিজের ঘরে এসে
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই মনে মনে নিজের এইরূপ আচরণে
নিজেকে ধিক্কার দিল। ছিঃ ছিঃ,এই সুখবরে তো আমার খুশি হওয়াই
উচিত। সেই আমার মনে কিনা, ছিঃ ছিঃ । যশোদার সারা শরীর,
মন জুড়ে আত্মগ্লানিতে ভরে উঠল। আবার নিজেকে বড় ছোট মনে হল। যশোদা তার অবসন্ন শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমের গভীর অতলে
তলিয়ে গেল।
এই দেখ যশো তোমার জন্য কি এনেছি। আগে চোখ বন্ধ
কর।
শ্রীকান্ত একটা হাতে যশোদার চোখ দুটো চেপে ধরল।
এবার হাত বাড়াও। একি! এতো আমার সেই গীতগোবিন্দ বইটি। আবার চোখ বন্ধ কর। আরেকটা জিনিস দেওয়ার আছে।
কি বলনা?
আগে চোখ বন্ধ কর। যশোদা চোখ বন্ধ করতেই শ্রীকান্ত টকাস করে ওর দুটো পুরু ওষ্ঠ দিয়ে যশোদার গালে এক গভীর চুম্বন করল।
যশোদার গোটা মুখ একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। যশো মা দরজা খোল। দেখ্ কে এল।
রমলাসুন্দরীর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে যশোদা ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসল।
কি রে যশো এই অবেলায় শুয়ে! শরীল খারাপ নয়তো? যশোদা ক্লান্ত মুখে বলে, না
মা। এমনি একটু ...।
হ্যাঁ যেটা বলতে এসেছি। নীচে বৈঠক খানায় মৃন্ময়
বসে আছে।
ওকে ওপরে পাঠিয়ে দাও মা।
আচ্ছা। রমলাসুন্দরী ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে
গেল।
এদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবে গোটা দেশ উত্তাল।
যৌবনের টগবগে গরম রক্তের উদ্দীপনায়
অনেক বাড়ির যুবকরাই স্বাধীনতা আন্দোলনের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ভারতে দীর্ঘ দুশো বছর ইংরেজদের রাজত্বের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে
তারা ইংরেজদের দেশ ছাড়া করে স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। এই মৃন্ময় হল
এক গুপ্ত দেশপ্রেমিক। যদিও ওর এই পরিচয় যশোদা ছাড়া আর কেউ জানে না। যশোদা মৃন্ময়ের
সাথে একবার কথা বলার ফাঁকে ওর এই কর্মের পরিচয় টের পেয়ে গিয়েছিল। মৃন্ময়কে চেপে
ধরতে সে যশোদার কাছে সব সত্যিটা স্বীকার করে নিয়েছিল। মৃন্ময়ের আরকটা পরিচয় হল সে
প্রতাপদিত্যের প্রধান আমলাদার গুরুপদ রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র। ছোট বেলা থেকেই
মার্তৃহারা মৃন্ময়কে সঙ্গে নিয়েই ওর বাবা চৌধুরী নিবাসে আসত। অত্যন্ত বিনয়ী,
শান্ত, লাজুক স্বভাবের মৃন্ময়কে এই বাড়ির
সবাই খুবই
ভালোবেসে ফেলেছিল। বিশেষতঃ মৃন্ময় ছোটবেলা থেকেই ছিল যশোদার গা ঘেঁষা। যশোদা
মৃন্ময়কে নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করে। যশোদার বড্ড মায়া এই মৃন্ময়ের প্রতি।
রমলাসুন্দরী তো একবার গুরুপদর কাছ থেকে মৃন্ময়কে নিজের বাড়িতে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু গুরুপদ
অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন। একমাত্র মৃন্ময়
ব্যতীত অন্দরমহলের ভেতরে অন্য কোন বাইরের পুরুষের প্রবেশের নিষেধ। ফর্সা, পাতলা চেহারার মৃন্ময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে, আসব
যশোদি।
আয় ভেতরে আয়। যশোদা মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু
দুটিকে ঈষৎ কুঞ্চিত করে বলে, তোকে এমন উদ্ভ্রান্তের
মতো দেখাচ্ছে কেন? কোন সমস্যা হয়েছে? মৃন্ময়
উত্তেজিত হয়ে বলে, মাস্টারদা আমাদের কিছু কিছু অস্ত্র
সামগ্ৰী সংগ্ৰহের নির্দেশ দিয়েছেন । যশোদি আমাদের এখন অর্থের দরকার। যশোদা চিন্তিত মুখে উঠে গিয়ে আলমারির লকার থেকে
দুটো সোনার বালা কাপড়ে জড়িয়ে মৃন্ময়ের হাতে দেয়। মৃন্ময় দ্রুত তা পাঞ্জাবির পকেটে
ভরে যশোদার পা ছুঁয়ে প্রনাম করে দৃঢ় কন্ঠে বলে বন্দমাতরম্। মৃন্ময় বেরিয়ে গেলে যশোদা শ্রীকান্তের ছবির সামনে
দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বিড় বিড় করে বলে ওঠে বন্দেমাতরম্।
সুহাসিনী অত্যন্ত বিচক্ষণ। সে বুঝে গেছে যশোদার তার প্রতি মাঝে মাঝে এই রূপ বিরূপ আচরণের পেছনে তার মনের মধ্যে এক বিরাট
অসহায়তা, দুঃখ, কষ্ট, কাজ করে। সুহাসিনী তাই সব সময় যশোদার মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে। আবার কখনও কখনও
যশোদাই হঠাৎই সুহাসিনীর এই পোয়াতি অবস্থায় নিজের হাতেই ভালো কোন সুস্বাদু পদ
রান্না করে দেয়।
এইরূপ চলতে চলতে সুহাসিনীর আজ সাত মাস পূর্ণ হল।
চৌধুরী নিবাসে আজ সুহাসিনীর সাধ ভক্ষণ। বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। বাড়িতে অনেক মহিলা
কুটুম্বরা এসেছে। সুহাসিনীকে মেঝেতে বসিয়ে কাঁসার ঠালায় পাঁচ রকম ভাজা, ডাল, বাসুমতী চালের ভাত,
পদ্মার ইলিশ, ইচা (চিংড়ি মাছ), পাবদা মাছ, দই, মিষ্টি,
পায়েস সহযোগে খেতে দেওয়া হয়েছে। ঘরের ভেতর সব মহিলারা ভিড় করে
দাঁড়িয়ে। রমলাসুন্দরী একেবারে খুশিতে ডগমগ হয়ে সুহাসিনীর পাশে বসে আছে। এই সময়
হঠাৎ সুহাসিনী একটা কান্ড করে বসে। সুহাসিনী ঘরের চারিদিকে একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে
নিয়ে দীপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে যশোদি না এলে আমি সাধ ভক্ষণ করব না।
।।চার।।
আচমকা সুহাসিনীর এই রূপ বক্তব্যে ঘরের উপস্থিত
মহিলা মন্ডলী একেবারে হতভম্ব
হয়ে গেল। প্রত্যেকে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। সারা ঘরের ভেতর একটা
ফিসফিসানি গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। সবার প্রথমেই মুখ খোলে প্রতাপাদিত্যের বড় দিদি
সুরবালা দেবী। সুরবালা দেবী তীব্র কর্কশ গলায় প্রতিবাদ করে বলে ওঠে কি অলক্ষুণে
কতা গো। শুভ কাজ্জে কিনা বেধবা মেয়ে মানুষ! রমলা তোমার বৌমা এ কি কতা কইতেছে ।
যতসব নষ্টামি কতা।
তাকে বলতে দেখে ঘরের বাকি কিছু মহিলারাও সুরবালা দেবীর সমর্থনে গলা মেলায়। সুহাসিনীর পাশে
বসা রমলাসুন্দরী এই রূপ জটিল পরিস্থিতিতে অত্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। মায়াদেবী তাড়াতাড়ি
ছুটে এসে সুহাসিনীর হাত ধরে চাপা স্বরে বলে চুপ্ কর নতুন বৌ। না হলে এক বিরাট
অনথ্ব হয়ে যাবে। কিন্তু সুহাসিনী নিজের সিদ্ধান্তে অচল থেকে আবারও কঠিন কন্ঠে বলে
ওঠে যশোদি না এলে আমি কিছুতেই সাধ ভক্ষন করবনা এই বলে রাখলাম। কোন উপায়ন্ত না দেখে
রমলাসুন্দরী সুহাসিনীর মা কাদম্বরী দেবীর দিকে অসহায় ভাবে তাকায়। কাদম্বরী দেবী তার মেয়ের জেদ ভালো করেই জানে। কাদম্বরী দেবী
সুহাসিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে শান্ত হ সুহাসিনী। এই অবস্থায় এমন উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়। সুহাসিনী হঠাৎই কোন কথা
না বলে হন্ হন্ করে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ঝুল বারান্দা দিয়ে একেবারে পূর্বের
কোনে যশোদার ঘরে ঢোকে। এই সময় হঠাৎ করে সুহাসিনীকে তার ঘরে আসতে দেখে যশোদা
হকচকিয়ে যায়।
নতুন বৌ তুই এখন?
সুহাসিনী প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বলে তুমি না গেলে
আমি সাধ ভক্ষণ করবো না যশোদি।
কি বলছিস নতুন বৌ? তুই ঘরে যা।বাড়াবাড়ি করিসনা। তোমাকেও যেতে হবে।
যশোদা দৃঢ় কন্ঠে বলে না তুই যা। আজ শুভদিনে জেদাজেদি করিসনা।
সুহাসিনী বলে ওঠে যশোদি শুনেছি তুমি অনেক বই
পড়েছ। তা তোমার কোন্ বইতে বিধবাদের শুভ কাজে প্রবেশ নিষেধ আছে আমায় দেখাও দেখি? যশোদা দেখল
সুহাসিনীর সাংঘাতিক জেদ। বাধ্য হয়েই যশোদা সুহাসিনীর সাথে সাধ ভক্ষনের ঘরে এল।
সুরবালা দেবী রাগে উত্তেজিত হয়ে তার দুই বৌমাকে সঙ্গে নিয়ে গজগজ করতে করতে বাড়ি
চলে গেল। সুরবালা দেবীর সমর্থিত গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজন সেই স্থান ত্যাগ করলেও বেশিরভাগ
মহিলারাই রয়ে
গেল। তারা চট্ করে জমিদার বাড়ির বিপক্ষে যাবার সাহস পেলনা। সুহাসিনী মেঝেতে আসনের ওপর বসে পাশে যশোদাকে বসায়। যশোদার হাত থেকে সবার প্রথমে পায়েস ভক্ষন করে। এরপর
যশোদার পা ছুঁয়ে প্রনাম করে। সঙ্গে সঙ্গে রমলাসুন্দরীর হাতে প্রবল জোরে তিনবার
শঙ্খ বেজে উঠল।। ঘরের মধ্যে উলুধ্বনিতে ভরে গেল। যশোদার গোটা মুখে দেখা দিল
আনন্দমিশ্রিত এক করুণ হাসি।
এখন প্রায় প্রতিদিনই বিকেলের দিকে সুহাসিনী
যশোদার ঘরে এসে যশোদার সাথে গল্প করে। যশোদার বিশেষ ব্যক্তিত, নানা বিষয়ের প্রতি তার গভীর জ্ঞান সুহাসিনীকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। যশোদা মাঝে মাঝে সুহাসিনীকে গীতা থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বানী পড়ে
শোনায়।
" ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরংমনঃ।
মনসসন্তু পরাবুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরস্তু সঃ"
।।
অর্থাৎ স্থুল জড়পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি
শ্রেয়। ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়। মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়। আর তিন (আত্মা) সেই
বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।
আচ্ছা নতুন বৌ সেইদিন কেন তুই এরকম কান্ড করে
বসলি বল তো?
কোন দিনের কথা বলছ যশোদি?
ঐ তোর সাধ ভক্ষনের।দিন।
ও তোমাকে আমি জোর করে নিয়ে গিয়েছিলাম তা বলছ? কেন আমি কি কিছু অন্যায় করেছি যশোদি? স্বয়ং বিদ্যাসাগর যেখানে মেয়েদের শিক্ষার প্রবর্তন করে গেছেন, বিধবাদের পুনরায় বিবাহ দেবার কথা বলে গেছেন,
বাল্য বিবাহ রোদ করার কথা বলেছেন তবুও কেন এখনও বিধবাদের প্রতি এই অন্যায়, কুসংস্কার নীতি চাপিয়ে দেওয়া হবে? যশোদা সুহাসিনীর গভীর চিন্তাধারা, বোধশক্তি দেখে
বিস্মিত হয়ে
সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
নতুন বৌ এই যে এখনও আমাদের দেশে ইংরেজরা রাজত্ব
করে চলেছে, গরীব কৃষকদের থেকে অন্যায় ভাবে
জোর জুলুম করে খাজনা আদায় করছে, আর দেখ গান্ধীজি ইংরেজদের
অন্যায়ভাবে লবন নীতির করবিরোধী যে আইন অমান্য আন্দোলন করলেন এতে আমাদের দেশে কত তরতাজা যুবক ইংরেজদের গুলিতে প্রাণ হারাল। এতে তোর মনে ইংরেজদের
বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ হয়না? মনে হয়না আমাদের দেশ ইংরেজ শাসনের অধীন থেকে মুক্ত
হয়ে স্বাধীনতা লাভ করুক? সুহাসিনী বিহ্বল হয়ে একমনে যশোদার কথা শুনে যায়। সুহাসিনী যত যশোদার সান্নিধ্যে আসছে তত তার মনে যশোদার প্রতি সম্মান ,ভক্তি,
শ্রদ্ধা বহুগুন বেড়ে যাচ্ছে।
আজ খুব ভোরে সুহাসিনী এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করে। চৌধুরী নিবাসে আবার এক বিরাট খুশির খবর। প্রতাপাদিত্য প্রথম নাতি হওয়ার খুশিতে
গোটা এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে। রমলাসুন্দরী এই সুখবর পাওয়ার পরেই মানদা মাসিকে
নিয়ে সোজা কালিবাড়ি পুজো দিতে চলে গেছে। রাজন্দ্রনারায়ণ প্রবল আনন্দে
তেজেন্দ্রনারায়ণকে পত্রপাঠ
তার কাকা
হওয়ার সুসংবাদ পৌঁছে দিয়েছে। এখন সুহাসিনীকে আঁতুরঘরে রাখা হয়েছে। সুহাসিনী ও তার
বাচ্চার পরিচর্যার জন্য যশোদা নিজের উদ্যোগেই দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছে।
আতুরঘরে রয়েছে
সুহাসিনী, সুহাসিনীর শিশু পুত্র আর যশোদা। সুহাসিনী তার পুত্রকে স্তন্যপান করিয়ে নিজের কোল থেকে যশোদার কোলে এগিয়ে দিয়ে নিরুত্তাপ গলায় বলে তুমিই
ওকে বড় করে তোল যশোদি। ও আজ থেকে তোমারই ছেলে। যশোদা সুহাসিনীর দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বলে কি
বলছিস নতুন বৌ। তুই মা হয়ে কি করে একথা মুখে আনছিস ?
সুহাসিনী হেসে বলে কেন হবেনা? তুমি পেটে ধরোনি বলে কি ওর মা হতে পারনা? যশোদা ব্যস্ত হয়ে বলে কিন্তু নতুন বৌ…..। যশোদাকে থামিয়ে সুহাসিনী বলে তাছাড়া আমি তো কোথাও চলে যাচ্ছিনা। একই
বাড়িতে তো রইলাম। আর দেখ যশোদি ওর মুখের আদলটা কিন্তু ঠিক তোমার মতোই।
যশোদার ভেতরে এক আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে।
যশোদার মনে হচ্ছে তার এতদিনের ভেতরে জমে থাকা এক দীর্ঘ যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা,দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ, শোকতাপ থেকে যেন
সে আজ
এতবছর পরে পরিত্রাণ পেল। বুকের ভেতর এক পরম সুখ, ঠিক সুখ নয় পরম শান্তি অনুভব করছে। যশোদা কিছুক্ষণ সদ্য ভূমিষ্ট শিশুটির দিকে এক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকে। এরপর শিশুটির তুলতুলে নরম শরীরটি নিয়ে দুহাতে বুকে জড়িয়ে কপালে আলতো করে ওষ্ঠ দুটি স্পর্শ করে বিড় বিড়
করে বলে ওঠে তুই এমন করে আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলি কেন? সুহাসিনী
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলে যশোদি আরেকটা কথা । আমিও তোমার আর মৃন্ময়দার সাথে আছি, আমাদের দেশের
কাজে । যশোদা অবাক হয়ে সুহাসিনীর দিকে তাকায়ে বলে তুই …....? সুহাসিনী বলে যশোদি আমায় ক্ষমা কর। সেইদিন তোমার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার
সময় তোমার আর মৃন্ময়দার কথা শুনে ফেলেছিলাম। যশোদা নিজের হাতটা সুহাসিনীর হাতের
মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে। সুহাসিনী তার পরিচিত দৃপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে বন্দেমাতরম্।