সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শ্রাবণী গুপ্ত সরকার




ঋণ


         অস্তিকা চুপ করে বসেছিল নটরাজ শিবমূর্তির সম্মুখে। নাগরাজ বাসুকির আদরের বোন অস্তিকা বড়ো আকর্ষণীয়া সুন্দরী কিন্তু ভরা যৌবনেও সে অনূঢ়া।মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন জাগে,মাথা তোলে অভিমান। তার সব সঙ্গিনীর পরিপূর্ণ বিবাহিত জীবন আর এত রূপ নিয়েও সে আজও অনাঘ্রাতা! কেন? কানাঘুষো শুনেছে কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে এখনো অবিবাহিতা রেখেছেন নাগরাজ। তবে তার স্বরূপ অজানা অস্তিকার কাছে।অনুমান করতে পারে নেহাত অকারণে এত যত্নে সে প্রতিপালিত হয় নি,এতদিন ধরে। নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা কাজ করছে এর পিছনে। মনে ভার জমলেই অস্তিকা এসে প্রাসাদ সংলগ্ন নটরাজ মন্দিরে এসে শান্ত করার চেষ্টা করে চিত্তকে। 

         দাসী সারিকার ডাকে সচেতন হয়ে ওঠে সে। দাদা ডেকেছেন,সেই খবর নিয়েই এসেছে সারিকা।প্রাসাদের মন্ত্রণাকক্ষে ডাক পড়েছে রাজভগিনীর। আশঙ্কায় কম্পিত মন নিয়ে এগোচ্ছে অস্তিকা।
        "বোন আমার!  তুমি তো জানো আমার কত আদরের তুমি। আমরা নাগ বংশীয়রা আজ চরম বিপদের সম্মুখীন। মাতা কদ্রুর ভয়াবহ অভিশাপের খড়্গ আমাদের উপর উদ্যত। সেই কতদিন আগে মা ও বিমাতা বিনতার বাজিতে আমাদের কিছু ভাই  মায়ের কথামতো কাপট্যে রাজী না হওয়ায় জননী শাপ দিয়েছিলেন কুরুরাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে তাদের মৃত্যু অনিবার্য। বোন এবার বুঝি সেই সময় সমাগতপ্রায়। ঋষি শৃঙ্গী মহারাজ পরীক্ষিতকে তক্ষকের দংশনে মৃত্যুর অভিশাপ দিয়েছেন। আমাদের সর্বনাশের আর বাকি নেই। একমাত্র তুমিই ভরসা।" বিস্ময়ে রুদ্ধবাক হয়ে যায় অস্তিকা।মেয়েদের তো তেমন কোনো ভূমিকা নেই রাজনৈতিক বা দৈবিক সমস্যা পূরণে!তবে?

       "বোন আমরা কুলগুরুর সঙ্গে আলোচনা করে, দেবতাদের পরামর্শ নিয়ে জানতে পেরেছি ঋষি জরৎকারু এবং তোমার পরিণয়ের ফলে যে সন্তান জন্মাবে একমাত্র সেইই মাতুলকুলকে এই অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। বোন, এই বংশের কন্যা হিসেবে এই দায়িত্ব তুমি নিশ্চয়ই পালন করবে।" এতক্ষণে বিষয়টি পরিষ্কার হয়,বংশঋণ শোধ করতে হবে। 

      "ঐ ঋষি বিবাহে সম্মতি দিয়েছেন? " বাসুকি বলে ওঠেন "ওনার পিতৃপুরুষের স্বর্গবাস অক্ষয় করার জন্য উনি সমনাম্নী কোনো নারীকে বিবাহ করতে প্রস্তুত। আর তুমি তো জানো তোমার কৌলিক নাম জরৎকারু। এ বিবাহ বিধিনির্ধারিত।" চমৎকার! কি সুন্দর বংশের অভিশাপ কাটানোর দায়িত্ব চেপে বসলো পূর্বাপর না জানা কুমারী অস্তিকার কোমল কাঁধে!  ভাবনার তো কোনো শব্দ হয় না! কাজেই মহা সমারোহে বিবাহ বিধি সম্পন্ন হলো দুই জরৎকারুর। দুই বিপরীত জগতের বাসিন্দার।

      মনের সায়হীন কর্তব্য পালন করেছিলেন দুজনেই। কেবল সন্তানজন্মই ছিল দুই তরফের উদ্দেশ্য। ভিন্ন ভিন্ন কারণে দুজনেই বংশঋণ মেটাতে চেয়েছিলেন। তাই একের চোখে অন্যের অসহিষ্ণুতাই ধরা পড়েছিল বড়ো হয়ে। 

         ঋষি শর্তই দিয়েছিলেন স্ত্রী অবাধ্য হলে বা অসম্মান করলেই তিনি তাকে ত্যাগ করবেন। এমন অকরুণ শর্তেও রাজী ছিলেন নাগরাজ। আর অস্তিকার মতামত কেউ জানতেই চায় নি। এক সুন্দর সন্ধ্যায় দেহকামনায় আকুল ঋষিকে সন্ধ্যাহ্নিকের কথা খুব সন্তর্পণে মনে করিয়ে দিতেই তিনি পরিত্যাগ করলেন অসহায় স্ত্রীকে।অন্ধকার নেমে এল রাজভগিনীর স্বল্পস্থায়ী দাম্পত্য জীবনে। আশঙ্কিত বাসুকি ছুটে এলেন বোনের কাছে। হ্যাঁ, দুঃখিত নন,শঙ্কিত। উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়ার ভয়ে,ব্যর্থতায় মলিন তার রাজকীয় পারিপাট্য। মৃদুভাষিণী অস্তিকা লজ্জার মাথা খেয়ে জানালো কাজ হয়ে গেছে। ঋষির সন্তান তার গর্ভে। 

     ব্যস আবার সসম্মানে নাগরাজপুরীতে প্রত্যাবর্তন করলেন রাজভগিনী। জন্মালো কন্দর্পকান্তি পুত্র। সৌম্যকান্তি  রাজভাগ্নের নাম হলো আস্তিক। 

       মৃত্যু হয়েছে মহারাজ পরীক্ষিতের। হ্যাঁ, অবশ্যই তক্ষকের বিষাক্ত দংশনে। পুত্র  জনমেজয় এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তিনি আয়োজন করেছেন মহাসর্পযজ্ঞের।ঋত্বিক যে সাপের নাম করে  আগুনে ঘৃতাহুতি প্রদান করছেন, সেই এসে অগ্নিকুণ্ডে পড়ছে। মায়ের অভিশাপ! সে যে বড়োই ভয়ংকর! তক্ষক প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইন্দ্রলোকে।

       বাসুকির প্রাসাদে অস্তিকা নিজের হাতে ছেলেকে সাজাচ্ছেন। সুকুমার মুখখানি দেখে যেন আশ মিটছে না।মা আর মামার কাছে সব শুনেছে আস্তিক। সে জানে আজ তার ঋণশোধের দিন। এই জন্যই তার  জন্ম। যে কোনো উপায়ে মাতুলকুলকে সে রক্ষা করবেই। 

      রাজধানীতে পৌঁছে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে কোনো অসুবিধা হয় নি আস্তিকের। নিষ্পাপ সুন্দর মুখ,অপরূপ  দেহকান্তি আর সুমিষ্ট ভাষণে স্বয়ং মহারাজ জনমেজয় মুগ্ধ হয়ে তার বাসনা পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছেন কুলগুরুএবং ঋত্বিকের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে। আগুনে তক্ষকের নামে আহুতি পড়েছে।মন্ত্রের অমোঘ টানে দেবরাজ ইন্দ্রের উত্তরীয়ের আড়ালে থাকা তক্ষকের সঙ্গে ইন্দ্রও আসছেন অগ্নিকুণ্ডের দিকে। বন্ধুপ্রীতি উবে গেছে দেবরাজের। ঐ যে চাদর ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন বেচারা তক্ষককে। সে সচীৎকারে  ধেয়ে আসছে আগুনের দিকে। আস্তিক বলে উঠলো," তিষ্ঠ! তিষ্ঠ! তিষ্ঠ! " পতন বন্ধ হয়ে শূন্যে ঝুলে রইলো তক্ষক।মিষ্টি হেসে আস্তিক প্রার্থনা জানালো "সর্প যজ্ঞ বন্ধ হোক মহারাজ! " বিমোহিত রাজা আদেশ দিলেন যজ্ঞ বন্ধের।

      আজ বহুদিন পরে ঋণমুক্ত অস্তিকা জরৎকারু শান্তিতে ঘুমোলেন। নারী হিসেবে বংশঋণ মেটাতে পেরে তৃপ্ত, ভারহীন সুষুপ্তি।



শ্রাবণী গুপ্ত সরকার