আমি
শূর্পনখা।
না।
লঙ্কেশ্বর রাবণের আদরের দুলালী বোনটি নই আমি। আমি রাজান্তঃপুরের এক নগণ্য
পরিচারিকা। অশোকবনে সীতাকে পাহারা দেওয়া এক চেটী। ঐ যে শিংশপা বৃক্ষটা দেখছেন,
তার তলায় স্বর্ণবেদীটা? ঐখানে অঙ্গে
একখানা হলুদ কাপড় জড়িয়ে সীতাদেবী রামের জন্যে চোখের জলে নাকের জলে হোত আর আমরা
তাকে ঘিরে পাহারা দিতুম। এক আধ চুমুক সুরাপান করতুম। সঙ্গে থাকত মাংসের চাট। এই
দুদিন আগেও।
আমরা সক্কলে
কেমন দেখতে? ঘোরদর্শনা। আমাদের কারো এক চক্ষু, কারো এক কান, কেউ কানকাটা, কেউ দীর্ঘ গ্রীবা, কারোর নাক মাথার উপরে, আমরা কেউ শূকরমুখী, ব্যাঘ্রমুখী- এইরকম দেখতে তো? শুনুন মা জননী আর বাবা
জনকরা, এইসব
গালিগালাজ আর অপমান না যুগ যুগান্তর ধরে শুনতে শুনতে আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু মজাটা হচ্ছে, আমাদের বেশ স্বাভাবিক স্বাভাবিকই দেখতে।
বর্ণ পিঙ্গল বা কালো, মাথা ভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল আর আর্যরমণীদের মতো কোমল পেলব রেশমমার্কা নই বলে আমাদের দেহ চাবুকের মতো বলিষ্ঠ দেখতে লাগে। তাই বুঝি আর্যপুত্রদের মনে হয়,
আমরা ভীষণা।
তা কথাটা যেন
কি চলছিল, হ্যাঁ মনে পড়েছে, পুষ্পকরথে করে রাজামশাই সীতাকে লঙ্কায় এনে তো ফেললেন। তারপর নিজে যখন
কোনমতেই তাকে সিধে করতে পারলেন না, তখন আমাদের হুকুম করলেন
অনুকুল প্রতিকুল - যে কোন উপায় হোক না কেন সীতাকে রাজার বশে আনার কাজটা আমাদের
করতেই হবে।
উনিও কইলেন
আর সীতাও শুনলেন।
কি জেদ
ছুঁড়ির! মাগো।
একবেণী ধরে সেই যে দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে রইল তো রইল। রাম ছাড়া কিছু দেখে না,
কিছু শোনে না কানে।
ঐ একটা
মেয়েমানুষের জন্য এই সোনার লঙ্কা পুড়ে ছাই হয়ে গেল গো! না একজন নয়, দুজন। ঐ আমার নামে যার নাম, সেই মাগীই তো যত নষ্টের গোড়া। কে বলেছিল, রামের প্রতি পীরিত দেখাতে। তিনকালে গিয়ে এককালে
ঠেকা বুড়ি কোথাকার। সেই থেকেই তো যন্ত্রণার শুরু। বলি, একটা রাক্ষস জুটল না তোর ঢলানি করার জন্য? হ্যাঁ মানছি, তোর সোয়ামী বিদ্যুৎজিহবকে রাবণ রাজা
ভুল করে মেরে
ফেলেছিল। তাই তো ছোট্ট বোনটিকে জঙ্গলে ঘোরার স্বাধীনতা দিয়েছিল, ধন - সম্পদ, প্রাচুর্য, নতুন করে বর খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা- এসব দিয়ে
নিজের পাপের
প্রায়শ্চিত্ত করতে চেষ্টা করেছিল রাজামশায়। তা বলে অত কিসের নোলা তোর, যে অমন একখানা চাঁদপানা বৌ ঘর আলো করে রয়েছে দেখেও তুই রামের কাঁধে চাপতে
গেলি। লোকে তো অন্যরকম কানাকানিও করে। বলে নাকি, রাজামশায়ের
প্রতি স্বামী- হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে মাগী খাল কেটে রামকে ডেকে এনে। তা, তুইও কি বাঁচলি? ওরা তো স্রেফ মজা করল তোকে নিয়ে।
লক্ষ্মণ পুতুল খেলার মতো তোর নাক কান কেটে দিল। অতটা উত্যক্ত কেন করেছিলি ওদের?
অবশ্য আর্যরা আমাদের মতো রাক্ষসী দেখলেই নাক কান কেটে দিত।
অয়োমুখী, শূর্পনখা, তাড়কা কারোকে ওরা
রেয়াত করে?
আর রাবণ
রাজারও বলিহারি। মহারাণী মন্দোদরী ঐ সীতার চেয়ে কত লক্ষ গুণ সুন্দরী আর গুণী! তবু
সীতা সীতা সীতা। মন্দোদরী তো ছাড়, রাজার অন্দরমহলে ঢুকলে মনে হয়, যেসব নক্ষত্রেরা শাপভ্রষ্ট হয়ে আকাশ থেকে খসে পড়েছে,
তারাই বুঝি রাবণের নর্মসহচরী হয়ে তাঁর শয্যায় লীন হয়ে আছে। তবু তাঁর
সীতা বাই গেল না।
আসলে ঐ একটা
জায়গাতেই তো
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। এত বড় রাজা, দেব, দত্যি, দানব, সূর্য, যম সক্কলকে দমন করার
ক্ষমতা রাখে যে লোকটা, মেয়ে দেখলেই তার জিভ থেকে লালা ঝরতে
থাকে। কম মেয়ের সব্বোনাশ করেছে!! চঞ্চলাক্ষী বেদবতী বাজসা সুলেখা, এমনকী বড় ভাই কুবেরের ছেলে নলকুবেরের প্রিয়া রম্ভা,
তা সে তো পুত্রবধূই হল, তার অব্দি কাপড় ধরে
টানাটানি! রাজামশাইয়ের কেচ্ছা শুরু করলে এক মহাকাব্যি। তারপর গোদের উপর বিষফোঁড়া
এসে জুটল এই জানকী।
বেশ হয়েছে।
সবংশে মরেছে। রণভূমির ঔ অতখানি জায়গা জুড়ে রক্ত কাদায় আর রক্তচন্দনে মাখামাখি ঐ বিশাল
মন্দর পর্বতের মতো দেহটা- কেমন ধুলোয় পড়েছিল! লঙ্কাধিপতি রাবণ। নীলকালির মতো বর্ণ, বুকে রজতহার, বাহুতে কেয়ূর
আর পঞ্চশীর্ষ অঙ্গদ - সেই লঙ্কেশ্বর রাবণ শিশুর মতো অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন। তার স্তব্ধ
বুকের উপর মন্দোদরী আর অন্য অন্তঃপুরিকারা আছড়ে পড়ে কি কান্নাটাই না কাঁদছিল। তারা আসলে কাঁদছিল না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ছোবল মারছিল। একটা মেয়েমানুষের জন্য? এত বড় দাম চোকানো? আজ তার হীরে জহরত খচিত মুক্তাজালমন্ডিত মুকুট মাথায়
নিয়ে রামের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরশত্রু বিভীষণ। ছিঃ!
মরেও যেন
শান্তি না পায় লোকটা। কেউ যেন আর কখনো শান্তি না পায় এই সংসারে। আমি যেমন জ্বলছি, তেমন রাবণের চিতাও জ্বলুক চিরটাকাল। আমার যূপাক্ষ'
র চিতাও যেমন জ্বলছে। যূপাক্ষ, আমার সন্তান। কিংবা যজ্ঞশত্রু, মহোদর,
মহাকায় বা প্রহস্ত- যে নামটা আপনার পছন্দ সেই নামটাই রেখে দিন না
আমার ছেলে হিসেবে। কি আসে
যায়। এরা তো আপনাদের কাছে একটা সংখ্যা। একটা লাশ। নামমাত্র।পুড়িয়ে ফেললেই তো চুকে
গেল। চুকে যাচ্ছেও। ওই তো
দেখুন না দেখুন,
আমার গর্ভ থেকে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসা আমারই রক্তমাংসপিন্ড কেমন রাম রাবণের যুদ্ধে আগুনের
শেষ নীলচে লালায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
রণভূমিটার
দিকে তাকান একবার। লাশের ওপর লাশ, লাশের পাশে লাশ, লাশের নীচে লাশ, অথচ এরা কেউ
লাশ নয়। ঐ যে সামনেই যে কুড়ির পেলব মুখের ঘুমন্ত ছেলেটা, যার
পেট ফাঁক হয়ে নাড়িভুঁড়ি গুলো সুতোর মতো কুন্ডলী পাকিয়ে রয়েছে, যেন এক্ষুনি সেগুলো ছাড়িয়ে কোন বস্ত্র তৈরি হবে, সে
শোণিতাক্ষ। আমার যূপাক্ষের বন্ধু আর ঐ যে মাথাহীন দেহটা দেখছেন, ভাল করে লক্ষ্য করুন, ওর তর্জনীতে একটা আঁচিল আছে। ও
কম্পন, আমার প্রতিবেশী মিশ্রকেশীর ছেলে।
ইন্দ্রজিৎ
চিতায় জ্বলেছেন, রাবণেরও
সৎকার হল আর এবারে শুরু হয়েছে গণ চিতায় গণ সৎকার। ঐ ঐদিকের গণ - চিতাতেই লীন হয়ে
যাচ্ছে আমার যূপাক্ষ। দইলবণ দিয়ে সেদ্ধ করা বরাহের মাংস খেতে কিই না ভালবাসত
ছেলেটা। আজ
নিজেই ঘি চন্দনে সেদ্ধ হচ্ছে! আশ্চর্য! আমি এখনো বেঁচে আছি!
স্বামী আগেই
গেছেন। রাবণ যেবার যমলোকে গেলেন যমরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে, সেই
সঙ্গে আমার স্বামী ধূম্রাক্ষও গিয়েছিলেন রাবণ-সেনা হিসেবে। যমের বিরুদ্ধে জয়লাভ
করে রাবণ ফিরে এলেন। কিন্তু আমার স্বামীকে যম ফিরিয়ে দিলেন না। এইসব ছোটখাটো সংখ্যারা কখনো কোন
ইতিহাসে বা মহাকাব্যে থাকেন না।
ইতিহাস আসলে
রাজাদের ইতিহাস। তাদের খাম খেয়ালের ইতিহাস। কতবার বোঝানো হয়েছিল লঙ্কেশ্বরকে। সীতাকে মুক্তি দেওয়া
হোক। নইলে লঙ্কা টিকবে না। মন্দোদরী বুঝিয়েছেন, বিভীষণ
বুঝিয়েছেন, মহাপ্রাজ্ঞ মাতামহ মাল্যবান, মহাবীর কুম্ভকর্ণ, মহাসচিব শুক ও সারণ, মহাবৃদ্ধ সতস্বভাব রাক্ষস অবিন্ধ্য - সক্কলে মিলে
পাখিপড়ার মতো বুঝিয়েছিলেন; বারংবার সাবধান করেছিলেন। কিন্তু পাথর যদি বা গলতে
পারে, রাবণ শেষ অব্দি গললেন না। চিতায় যখন তার ঐ বিরাট বপুকে
শোয়ানো হচ্ছিল, তখনো তিনি সিঁদুর মাখা জগদ্দল হয়েই ধোঁয়ায়
ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন।
চোখ নামিয়ে
রেখেছি। পাতা ফেলছি না। পাছে একটিও জলবিন্দু মাটিতে পড়ে। এ মাটিতে একদিন
স্বর্ণরেনু পড়ে থাকতো, সেই
মাটিকে লোনা জলের মতো অকিঞ্চিকর তুচ্ছ জিনিস দিয়ে স্পর্শ করব? না, আজ এই ভেঙে যাওয়া খিলান, স্তম্ভ,
প্রাসাদ, অট্টালিকা, উদ্যান
-গুঁড়িয়ে ধূলিস্মাত হয়ে গেছে বলে কি আমার সোনার লঙ্কার মহিমা ভুলে যাব?
এই যে রণভূমি
থেকে ঐ দূরে চওড়া রাস্তাটা দেখেছেন,
যা বানররা শিলা, বৃক্ষের বাড়ি মেরে মেরে ফালা
ফালা করে দিয়েছে, সেই রাস্তা দিয়ে ময়ূর আর রাজহংস চলে ফিরে
বেড়াত। কত শত মনোরম
পুষ্করিণী ছিল এই লঙ্কায়, তাতে রাজহাসেরা খেলে বেড়াত মাথা
হেলিয়ে। রং বেরঙের পদ্মফুলেরা সূর্য প্রণাম করত প্রতিদিন।
হায় রে, আমার লঙ্কা। ত্রিকূট পর্বতের উপর সোনার প্রাচীর
দিয়ে বেষ্টিত ! প্রাচীরকে ঘিরে ছিল এক বিরাট গভীর পরিখা! তাতে অজস্র কুমীর কিলবিল
করত। মণিমানিক্যের কারুকার্যময় চার চারটে প্রবেশ দ্বার স্বর্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে
থাকত। প্রতিটি দ্বারের সঙ্গে একটি যান্ত্রিক সেতু বাঁধা ছিল। শত্রুরা কেউ সেতুতে
পা রাখলেই যন্ত্রের কৌশলে পড়ে যেত পরিখায় আর কুমীরের খাদ্য হোত। বর্মধারী রাক্ষসরা
সর্বক্ষণ প্রহরায় ছিল রত। রথ বিমান হাতি ঘোড়া সবসময়েই সুসজ্জিত। চারটে
প্রবেশদ্বারেই পাথর আর তীর ছোঁড়ার যন্ত্র ছিল। শয়ে শয়ে লোহার শতঘ্নী নিয়ে সেনারা
সদা প্রস্তুত।এসব আমার স্বামীর মুখ থেকে গল্পকথায় শোনা। সেই অভেদ্য লঙ্কা একটা
বানর এসে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গেল?
আর সে কী রাগ
লঙ্কেশ্বরের? আমরা, মানে রাক্ষসীরা যারা
সীতাকে পাহারা দিই, তারা তো গিয়ে নালিশ ঠুকলুম, একটা হতচ্ছাড়া বাঁদর অশোকবন একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে গা, আবার সীতার সঙ্গে কীসব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করেছে। যত জিজ্ঞেস করি,
লোকটা কে? সীতা কিছুতে মুখটি খোলে না, এক্কেবারে পাথরের মূর্তিটি।
শুনেই তো
রাবণরাজা চিতাগ্নি'র মতো
জ্বলে উঠলেন। সেদিনকার সেই চিতাগ্নিই আজ গোটা লঙ্কা জ্বালিয়ে দিল।
ভস্ম হয়ে
গেলে হে ফুল ফল বন - বনানী ভরা সবুজ ঘাসের দেশ লঙ্কা আমার! কি প্রশস্ত রাজপথ! অট্টালিকারা মেঘ ছুঁয়ে থাকত।
প্রায় প্রতিটি অট্টালিকাই পদ্ম বা স্বস্তিকের আকারে গড়া হোত। প্রতিটি সোপান বৈদূর্যমণি শোভিত, প্রতিটি ঘরের দরজা সোনায় মোড়া। রাজপ্রাসাদ ছিল স্বর্ণময় মায়াদুর্গ!
সকালে
নীলাকাশে সোনার আসন পাততেন
সূর্যদেব। বেদ -বেদাঙ্গ পাঠে মুখর হয়ে উঠত ভোর। শত শত কাজ কর্মে মুখরিত সকাল ক্রমে
ক্রমে দুপুরের
আলিস্যি মাখত, রোদ্দুরের ঝলসানি সোনারঙ যখন সোনার লঙ্কাকে চাবুক মারত। সকলের চোখ ধাঁধিয়ে
যেত। আবার শান্ত সন্ধ্যায় যখন সমুদ্রের লবণাক্ত মদির বাতাস আমাদের দেহকে সুশীতল করত আর বয়ে নিয়ে আসতো পাঁচমিশালি
ফুলের সুবাস , সেই হাওয়ায় পতপত করে উড়ত স্বর্ণলঙ্কার পতাকা, কোথাও
ধ্বনিত হোত মধুর সঙ্গীত, কোথাও বা বেদপাঠ, কখনো বা পাখির কূজন, হরিণের ডাক..হাতিশালে হাতি,
ঘোড়াশালে ঘোড়া... এই অভাগিনীর মতো কতশত বিধবা পুত্রহারা অভাগিনীর রূপকথার দেশ... লঙ্কা।
যাক। আজ থেকে
মুক্তি। সীতা পাহারা দেবার কাজ থেকে মুক্তি। কী যে এক বিরক্তিকর কাজ ছিল। একটা
দুঃখিনী মেয়েকে ধমকাও, চোখ রাঙ্গাও, মেয়েটা স্বামীর
শোকে আর রাবণের ভয়ে কেঁদে কেঁদে আধমরা হয়ে থাকত। দেহের গড়ন দেখলে মনে হোত বুঝি
পল্লবিনী লতা। কিন্তু ভেতরে ছিল বটগাছের জেদ। ত্রিভুবনজয়ী রাবণ, যাকে দেখলে ইন্দ্রের সিংহাসন নড়ে ওঠে, তাকে
প্রত্যাখ্যান- সে কি যে সে মেয়ে!
আমি হরিজটা
বিকটা একজটা দুর্মুখী কত বাবা বাছা করে বুঝিয়েছি। বিনতা তো কেটে খেয়ে ফেলার ভয়
অবধি দেখিয়েছিল। লম্বিতস্তনী ঘুঁষি পাকিয়ে মারতে বাকি রেখেছিল, চন্ডোদরী শূল ঘুরিয়ে ভয় দেখাত অবিরত। প্রঘসা তো গলা টিপেই মারে আর কি। অজামুখী ভয় দেখিয়ে বল্লে, একে
মেরে মাংস খাওয়া যাক। আমি বল্লাম, আমারও তাই মত।
এইভাবে সারাক্ষণ
কত্তরকম ভাবে প্রাণের ভয় দেখালাম, তবু সে বেটি ভয় পেল না। বলে, কেটে খেয়ে ফেল আমাকে। মানুষী কখনও রাক্ষসের ভার্যা হতে
পারে না! দেমাক দেখ। আমরা হয়তো আরো খানিকক্ষণ কড়কাতাম, নইলে
যে রাজা আমাদের আস্ত রাখবেন না।
এমন সময় ত্রিজটা বুড়ি ঘুম ভেঙে শিউরে উঠে আমাদের বলতে এল,
সে নাকি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছে- রাক্ষসকুল ধ্বংস হবে।
সীতাপতির জয় হবে। এই বৃত্তান্ত শুনে আমাদের বুকটা ছাঁত করে উঠেছিল। সেসব হল
এক্কেবারে গোড়ার দিকের কথা।
তারপর থেকে
আমি অন্ততঃ ওই সর্বনেশে মেয়েকে বেশি ঘাঁটাই নি। মাঝে মাঝে রাজামশায় এলে ওপর ওপর
চোটপাট করতাম বটে। তবে তাতে ধার ছিল না। রীতিমতো মায়াই পড়ে গেছিল মেয়েটার উপর। মুখখানাও বেশ
পদ্মপানা ছিল বটে। শোকে দুঃখে চেহারাটা হয়েছিল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন অগ্নিশিখার মতো। বিভীষণ মহিষী সরমার সঙ্গে ছিল সীতার যত পীরিতের
কথা। সরমা'র বড় মেয়ে কলা'
র সঙ্গেও চলত তার মাঝেসাঝে ফুসুরফুসুর।
কিন্তু সত্যি
বলছি, যেদিন আমার যূপাক্ষ একটা বানরের
শিলার আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল, আর উঠল না, সে খবরটা পেয়েই মনে হয়েছিল ওই পদ্মপানা মুখটা পাথর দিয়ে থেঁতলে ভোঁতা করে
দিই। পিশাচী রক্তখাকি! গোটা রাক্ষসকুলে বাতি দিতে কারোকে রাখলি না অলপ্পেয়ে
মেয়েমানুষ! সেদিন ত্রিজটা বুড়ি আর লম্বিতস্তনী আমার দুটো হাত চেপে না ধরলে সত্যিই
ওকে থেঁতলে মাংসপিন্ড করে দিতুম!
কিন্তু আজ এই
শ্মশানভূমি কিংবা হৃদয় পাথর দিয়ে গড়া। কেউ স্বামী, কেউ পিতা, কেউ পুত্র,
কেউ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব, শিলারই মতো
অনুভূতিহীন। সীতাও পাথর। এত দীর্ঘ দুঃখভোগের পর গভীর সুখে গাঢ় ।
বিভীষণের
অভিষেক হয়ে গেছে। কানাঘুষোয় শুনলাম,
রামচন্দ্র রাবণের মৃত্যুর খবর জানাতে হনুমানকে সীতার কাছে
পাঠাচ্ছেন। হনুমানের
আসার কথা শুনেই হৃতকম্প হল। অশোকবনে তার দাপাদাপি আর বিনষ্টির কথা মনে পড়ল।
যদিও একমাত্র নিজের প্রাণটুকু ছাড়া আর কারোরই কিছু খোয়ানোর নেই, তবু ওই প্রাণটা যদি সম্মানের সঙ্গে যায়, সেও তো একটা
যাওয়ার মতো যাওয়া.. কিন্তু এই বর্বর বানর আমাদের কাছে পেয়ে আস্ত তো রাখবেই না,
সম্মানের মৃত্যুটাও দেবে না। যারা ইন্দ্রজিৎ কে যজ্ঞাগারে কৌশল করে
মারে, তারা চেটীদের বীরাঙ্গনার মৃত্যু দেবে?
নিন, কি বলেছিলাম আপনাদের? আচরণে
বোঝা যায় কে বর্বর আর কে সুসভ্য। বর্বর হনুমানটা সীতাকে যা বার্তা দেবার, তা তো দিল, তারপর কি বল্ল জানেন?
-এই
কুৎসিত নিষ্ঠুর প্রকৃতির রাক্ষসীগুলো তোমাকে তর্জন করত দেবী, যদি অনুমতি দাও, তো এদের ঘুঁষি, কিল, লাথি মেরে খামচে কামড়ে নাক কান খেয়ে বা চুল ধরে
টেনে হত্যা করি।
বা রে বা! কী
অতিনাটকীয় সংলাপ!
অথচ
ইন্দ্রজিত যখন রথে একটি মায়াসীতার মূর্তি প্রস্তুত করে রণভূমিতে নিয়ে গেলেন আর তাকে খড়্গ দিয়ে প্রহার করতে লাগলেন, আর মায়াসীতা যখন 'হা রাম' বলে কেঁদে উঠল, তখন এই বর্বরই যুবরাজ মেঘনাদকে বলে উঠেছিল না..
-দুরাত্মা,
ব্রহ্মর্ষির কুলে জন্মেও তুমি রাক্ষসযোনি পেয়েছো, তুমি অতি নৃশংস নীচ দুর্বৃত্ত, পাপকর্মে তোমার ঘৃণা
নেই। বধযোগ্য পাপীরাও যে স্থানের নিন্দা করে, তুমি মরণান্তে
সেই স্ত্রীহত্যাকারীদের নরকে যাবে।
অর্থাৎ জগতে সীতাই নারী, তাকে প্রহার
করলেই পাপ হয়? আমরা রাক্ষসী বলে নারীই নই, আমাদের কিল
চড় ঘুষি মারা যায়, নাক
কান কেটে দেওয়া যায়, খিমচে কামড়েও দেওয়া যায়?
কিন্তু সীতার
আচরণে অবাক হলুম। সে বল্লে-
-এরা রাজার
আশ্রিত ও বশীভূত দাসীমাত্র, এরা প্রভুর আদেশেই আমাকে গর্জন করত, এদের কী দোষ? এখন রাবণ মারা গেছে। এরা আমাকে কিছুই করবে না।পরের আদেশে যারা পাপ করে,
প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তাদের উপর প্রতিশোধ নেন না।
না।
সীতার কাছে
আমরা কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি। একবারও বলিনি- 'সীতা তুমি ধন্য'। শুধু আমাদের দুঃখে পোড়া মুখগুলো একটু উজ্জ্বল হয়েছিল, কান্না শুকিয়ে পাথর হয়ে যাওয়া চোখগুলো চিকচিক করে উঠেছিল।
যা কিছু সাদা
নয়; তাইই তো কালোও নয়। তার মাঝে লাল
নীল ফিরোজা, তুঁতে- অনেক রকম রং গোঁজা আছে। সীতার সঙ্গে শত্রুতা আমাদের ফুরিয়েছে
লঙ্কেশ্বর ভূপতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তা বলে সে আমাদের বন্ধু হতে পারে না। কিছুতেই না। হনুমানের
হাত থেকে আমাদের নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় করে দিলেও না। সে যখন সব হারিয়ে বসেছিল,
আমাদের তখন ছিল সবকিছু অথচ আজ আমরা নিঃস্ব হয়ে বসে আছি আর সে পেতে
চলেছে তার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত গৌরব।
সম্পূর্ণ
বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা নারীরা আর যাই হোক, বন্ধু হতে পারে না।
তবু, বাড়িতে
সোনার খাঁচায় পোষা টিয়া'র উপরও তো লোকের মায়া পড়ে, সীতা চলে যাওয়ার সময়ে ঠিক সেই মায়াটিয়া চোখ ভাসিয়ে পিছন ফিরে আমাদের দেখল।
দু এক ফোঁটা মায়াজল আমাদের চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ল কি!
- ভালো
থেকো সীতা। তোমার জন্যই সব হারিয়েছি তা সত্যি। কিন্তু শেষপাতে যে সম্মানটুকু
আমাদের দিয়ে গেলে, সেই সম্মান যেন তোমারও প্রাপ্য হয়,
সারাটা জীবন ও জীবনান্তরে।
তামিমৌ ত্রমি