সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সৌমী আচার্য্য




ঘোর





সরোদ বাজছে শুনতে পাচ্ছি অনকক্ষণ।আলসেমি ছাড়তে মন চাইছে না মোটেই।হঠাৎ ঝনঝন করে বাসন পড়ার আওয়াজ
  পেলাম।আজকাল তাড়াহুড়ো করতে পারিনা।পেসমেকারটা বসার পর থেকে সব ঝিমিয়ে থাকে বুকের কোণে।তবু একটু জোরেই বললাম....


"বীণা কি ভাঙলি?"...

বলেই মনে পড়লো আজ পাঁচদিন হলো সবাই তো ছুটি নিয়েছে।তাহলে?তবে কি?মনে হতেই লাফিয়ে উঠলাম।খাট থেকে নেমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ডাইনিং কাম ড্রইং রুমে পা রাখতেই দেখি মেঝেতে উপুর হয়ে পড়ে আছে দীপঙ্কর।ঘরময় বাসন ছিটিয়ে আছে।গলার কাছটা শুকিয়ে উঠলো।শরীরটার কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম....

"এ্যাই শুনছো?কি গো?"....

কোনো সাড়া পেলাম না।সাথে সাথে মোবাইল টা হাতে নিয়ে মৌকে ফোন করলাম....

"হ‍্যালো,মৌ....তোর বাবা পড়ে গেছে,রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে।আআআআমি কি করবো বুঝতে পারছি না।"......


"বুঝতে পারছো না মানে?এক্ষুনি এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করো।কুইক।"......

মোবাইল হাতড়ে ফোন করলাম আবার....


"হ‍্যালো এ্যাম্বুলেন্স!যত তাড়াতাড়ি পারেন যোধপুর পার্কে আসুন প্লিজ...কি,কি বলছেন?.....নেই মানে?আমার প্রয়োজন এক্ষুনি,প্লিজ,শুনুন,হ‍্যালো,হ‍্যালো"

.....ফোনটা রেখে কোন রকমে বেসিন থেকে জল এনে ওর শরীরটা সোজা করার চেষ্টা করলাম।চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিলাম কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না।রতনকে ফোন করলাম রতনের গাড়িতেই আমরা যাতায়াত করি....

"হ‍্যালো রতন?রতন তোর মেসো পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে শিগগিরই আয়,নার্সিং হোমে নিতে হবে।...কি?পারবি না।আলু কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে আছিস?...রতন প্রচুর রক্ত বেরুচ্ছে ।না,না,...হ‍্যাঁ আমি জানি আরো ১৯ দিন লক ডাউন চলবে।কিন্তু মানুষটা যে মরে যাবে রে!"

....হাউহাউ করে কেঁদে উঠলাম ওর শরীরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঝাঁকাতে লাগলাম।

"আরে কি হলো এই,এই রঞ্জনা,এই"


...ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।বিছানায় দিব্ব‍্যি শুয়ে আছে দীপঙ্কর।আশ্চর্য... এই যে দেখলাম।দীপঙ্করের কাছ ঘেঁষে সরে এলাম।ও আমার হাতটা হাতে নিয়ে বললো....

"তারপর কি
  করলে?"

..."কার পর?"

...."ঐ যে আমায় নিয়ে গেলে কি করে নার্সিং হোমে?"

..."তারপর" ......

তারপর আমাদের ফ্ল‍্যাটের উল্টোদিকের প্রশান্ত,নির্ঝরদের ডাকলাম।ওরা মাস্ক পরে এসে ধরাধরি করে ওকে সোফায় তুললো।তখনো শ্বাস চলছে ।দীর্ঘ সময় ছুটোছুটি করেও একটা গাড়ি পাওয়া গেলো না।দীপঙ্করের শরীর ক্রমশ ঠাণ্ডা হতে লাগলো।মোবাইলে রিং হতেই ধরে দেখি মৌ।...

"মা ট্রেন,বাস সব বন্ধ।
করিমপুর থেকে আমার পৌঁছাতে ছয় ঘন্টা লেগে যাবে।তাও তোমার জামাই আসতে পারবে না।ওদের
  কোনো ছুটি দেওয়া হবে না।তাছাড়া এই গ্রামীণ হাসপাতালে ডাক্তারই বা কটা।তুমি বুঝতে পারছো?"

......ফোনটা রেখে দিলাম।যে গজ দিয়ে মাথা ব‍্যাণ্ডেজ করেছিলো,সেটাও ভিজে উঠেছে।হঠাৎ চিৎকার চ‍্যাঁচ‍্যামেচি।কোন রকমে ব‍্যালকনিতে গিয়ে দেখি নির্ঝর আর প্রশান্তকে পুলিশ খুব মারছে।ওরা চিৎকার করে বলছে...

"মারছেন
 
কেন মানুষটা মরে যাবে যে,প্রচুর রক্ত বেরোচ্ছে।চলুন দেখবেন চলুন,আহ্...উফ্...কথাটা শুনুন"

....আমার গলা শুকিয়ে কাঠ,তবু প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম ....

"ওদের মারবেন না,মারবেন না,আমার স্বামীর মাথা ফেটে গেছে।ওদের মারবেন না প্লিজ,প্লিজ।".......

"মাসিমা,ও মাসিমা চিৎকার করছেন কেন?কে ,কাকে মারছে?"

......ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে দেখি অনেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।নির্ঝর,প্রশান্ত একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কিসব বলে চলেছে।আমি ডাকলাম ....

"নির্ঝর!একটু শোনো।"

...ও বেশ হেসে বললো....

"হ‍্যাঁ মাসিমা,বলুন"

...."তোমায় পুলিশ আর মারেনি তো?আমাদের উপকার করতে গিয়ে তুমি অনেক মার খেলে বাবা"

....নির্ঝর চোখ স্থির করে আমার দিকে তাকিয়ে হাঁড়ির ভেতর থেকে শব্দ তুললো.....

"পুলিল হাসপাতালে পৌঁছে আপনাকে কি বললো মাসিমা?"

".....বললো"....

বললো....

"ওনার মাথা ফেটে ইন্টারনাল হেমারেজ হয়েছে,অপারেশান থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে কিন্তু আপনি এতো কাশছেন কেন?"

....আমার তো গত তিনদিন ধরে জ্বর,কাশি ছিলো।লকডাউনে কাজের লোকজন ছুটিতে তাই হয়তো আমাকে কাজ করতে দেবে না বলেই দীপঙ্কর বাসন ধুতে গিয়েছিলো আর তারপর হয়তো ....পুলিশের ছেলেটা বললো....

"তিনদিন ধরে জ্বর,ডাক্তার দেখিয়েছেন?"

.....ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করেছি,কিন্তু হয়ে ওঠেনি।তাছাড়া জ্বরটা বেশী নয়।পুলিশের ছেলেটি বললো....

"আপনি হাঁপাচ্ছেন কেনো?চলুন তো আমার সাথে।"

.....আমি হাঁইহাঁই করে উঠলাম আরে আমার বুকে পেসমেকার হাঁফ তো ধরবেই।তাছাড়া ওনাকে ওটিতে নিয়েছে কেন যাবো আমি,আমি কিছুতেই যাবো না।কিন্তু ছেলেটি কোনো কথা শুনলো না।আর যে ডাক্তারের কাছে নিলো সে হিসেব কষতে বসলো রনি কবে দেশে এসেছিলো?কবে ইতালী ফিরলো এইসব।খুব গম্ভীর ভাবে বললেন....

"আপনারা খবর দেখেন না টিভিতে?খবরের কাগজ নেই বাড়িতে?"

.....আমি আমতা আমতা করতেই,খুব নরম ভাবে বললেন...

"আপনাকে ভর্তি হতে হবে মিসেস সাণ‍্যাল।"

.....আশ্চর্য আমি কেনো ভর্তি হবো?আমার ছেলে ইতালী থেকে যখন এলো ওর একটু শরীরটা খারাপ ছিলো ঠিকই কিন্তু এমন কিচ্ছু না।সিজেন চেঞ্জে এমনটা হয়।তাছাড়া ও ফিরে গেছে সাতদিন আগে।পরশু কথা হয়েছে।কিছু তো বলেনি।তাহলে এতো প্রশ্ন কেন?এরমধ‍্যেই মোবাইলে রিং হয় মৌ ফোন করছে।পুলিশের ছেলেটি বললো...

"আমায় দিন প্লিজ।"

....আমি বেশ রেগে গিয়েই ফোনটা দিলাম।....

"হ‍্যালো হ‍্যাঁ,..... আমি সাব ইন্সপেক্টর অংশুমান বলছি,...হ‍্যাঁ, ওনার কনট‍্যাক্ট নম্বরটা দিন ...হুম্,হুম্,ওকে,লাস্ট কবে কথা হয়েছে.....আচ্ছা,হ‍্যাঁ আপনি আসুন রাস্তায় চেক হলে সত‍্যি ঘটনা বলে আমায় ফোনে ধরিয়ে দেবেন।আমার নম্বরটা নিন 9930162547"

.....তারপর আমায় ভর্তি করে নিলো।যেখানে আমায় রাখলো,সেখানটা বড্ড বদ্ধ।রাতে মনে হচ্ছিলো আমার দম বোধহয় এখনি আটকে যাবে।দীপঙ্করের খবর জিজ্ঞাসা করেছিলাম একটা নার্সকে।কটমটে চোখে মুখোশের মধ‍্যে দিয়ে বললো ....

"ছেলে তো শেষ করে গেছে দুজনকে।আর আপনারা কাকে কাকে শেষ করেছেন বলুন?বলুন?"

...."আমি কাউকে কোনোদিন মনেও আঘাত দিয়ে কথা বলিনি বিশ্বাস
  করুন।আপনি ওমন ভাবে তাকাচ্ছেন কেন?আহ্ চোখে আলো ফেলছেন কেন?বন্ধ করুন,বন্ধ করুন,প্লিইজ........."

                          (২)

"দু বছর হয়ে গেলো জীবেশ,ও কি ভালো হবে না?"

"দ‍্যাখ,দীপঙ্কর, এইসব কেসে ডাক্তার প্রায় নিরুপায়।ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হতে যারা সামনে থেকে দেখেছে তারা এখনো অনেকেই ট্রমায়,ভাবতে পারিস?আর করোনার ভয়াবহতা,লক ডাউনের নির্জনতা তো মাত্র দুবছরের টাটকা ক্ষত।অপেক্ষা কর।"

"কিন্তু তাই বলে কাল্পনিক ছেলে ইতালীতে মরে গেলো,আমার মাথা ফেটে করোনা হয়ে মৃত‍্যু হলো এমনকি কাল নিজে মরে গেছে বলে কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে গেলো?মেয়ের কথা অবশ‍্য আর বলছে না।"

"দীপঙ্কর,এই লক ডাউনের সময় তোর ব‍্যবসার কাজে দিল্লীতে গিয়ে আটকে পড়া আর ওর একাকীত্ব ওর মনে মাল্টিপেল পারসোনালিটির জন্ম দিয়েছে।সেই চরিত্র গুলোই ওকে বিপদে ফেলেছে,উদ্ধার করেছে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি।হাজার হাজার মানুষের মৃত‍্যু,গণকবর মেয়েটা একা দেখেছে রোজ।"

"কিন্তু আমি তো রোজ ফোন করেছি রে?"

"তখন কোনো অস্বাভাবিকতা বুঝিস নি।"

"প্রথমে একেবারেই বুঝিনি।তারপর যখন বলতে শুরু করলো মৌ,রণি এদের কথা তখনি অসঙ্গতি বুঝতে শুরু করি।পরের দিকে ফোনটাও ধরতো না ঠিকঠাক।"

"হুম্।মেয়েটার ভবিষ্যৎ, বর্তমান সব গুলিয়ে গেছে।একটা চান্স নিতে চাইছি ।ইফ্ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড।"

"আরে বল,না।"

"দীপঙ্কর শেষ কবে বেড়াতে গেছিস?"

"২০২০ র জানুয়ারিতে গিয়েছিলাম।রামধুরা।"

"বেশ,তুই টিকিট কাট,আর সম্ভব হলে ছবি দেখে বার কর কোন কোন পোশাক ও পরেছিলো,কোন হোটেলে ছিলি সব,সব।একদম হুবহু সেই সময়টা যদি তুলে আনতে পারিস,খুব ভালো হয়।"

"প্রায় অসম্ভব।কারণ সময়টা ছিলো জানুয়ারি আর এখন ২০২২ এর জুলাই।"

"মানছি,তবু চেষ্টা কর।"

                    (৩)

মরে যাবার পরেও জীবন এতো সুন্দর হয় জানলে আমি আগে এতো ভয়ই পেতাম না।রণি মরে ইতালীর গণ কবরে,আমি আর দীপঙ্কর স্বর্গে।মৌ এর খবর জানি না।এখন যেখানে বসে আছি তার চারিদিকে বড়ো বড়ো সবুজ পাইন,দেওদার।নীচে দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী।দীপঙ্করকে মরে যাবার পর সেই বত্রিশ বছরের মতো দেখাচ্ছে।স্বর্গে যে ঘরে আমাদের থাকতে দিয়েছে তার আয়নায় নিজের চেহারা দেখে বিস্মিত হয়েছি।সেই যেন সাতাশ বছরের আমি।একটু বেশী রোগা।তবে তেমনটাই একমাথা চুল,ফর্সা,ছোট্ট নাক আর.....দীপঙ্কর বলে স্বপ্ন মাখা চোখ।ঐ যে দীপঙ্কর আসছে,বলেছে আজ হেঁটে হেঁটে স্বর্গ দেখাবে।এখানে মানুষ মানুষের কাছে আসে,মাস্ক লাগে না।জড়িয়ে ধরে কাছে বসে গল্প করে,কফি খাওয়ায়।আমি দুবার হেঁচেছি,কেউ ভয়ে সরে নি,বরং মৃদু স্বরে বলেছে..."ব্লেস ইউ".....আমি পাখির ডাক শুনছি,লাল লাল সোয়েটার পরে গোলাপি পুতুলের মতো বাচ্চারা হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। এখন ওর হাত ধরে সবুজ গালচে মোড়া পথে হেঁটে যাবো।টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো।মরে গেলে বৃষ্টি ভিজলে জ্বর হয় না হয়তো করোনাও না.......



সৌমী আচার্য্য