ট্যাব ও লেখক
শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো তাঁর । কেন ? এমনটা নয় যে তিনি কোন পাইথন দেখেছেন যা তাঁকে গিলে
খাবে বা কোন বিষধর সাপ যা পায়ের কাছে অদ্ভুত , অকারণ শিরশিরে
ভাবের জন্ম দেয় ।
তবে কিসের ভয় তার । পেশায় তিনি ছিলেন একজন সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ।
চাকরি জীবনে ব্যস্ততাঁর অন্ত ছিল না । অবসরে লিখতেন আর ভাবতেন চাকরি জীবনে ছেদ
ঘটলে অনেক অনেক লিখবেন ।
চাকরি জীবনের অবসর তাঁর হয়েছে । বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো । তিনি যে খুব
অপরিচিত লেখক হিসেবে তেমনটাও নয় ।
অনেকগুলি বই তাঁর রয়েছে । সবগুলিই উপন্যাস । তবে একটা বাদে সব
কটা-কেই নভেলা বলা যায় ।
একটা উপন্যাস তিনি ঢাউস লিখেছিলেন , যাকে ক্লাসিক্যাল বলা চলে আয়তন এবং স্ট্রাকচারে।
বাকি সব কটিতে তিনি শুরু করতেন বেশ কিন্তু শেষটা তাড়াহুড়োর ছাপ থাকত ।
একটা উপন্যাস শেষ করে তিনি দ্রুত আরেকটি উপন্যাসে চলে যেতেন ।
নতুন লেখা আবার নতুন কল্পনা । শেষ হলেই তিনি আর ফিরে তাকাতেন না । বড়
প্রকাশক যেহেতু তাঁর লেখা উপন্যাস ‘বই’ করে বের করে , ছোটরা তাঁর
লেখা যাচাই করত না । সহজেই বই হয়ে যেতো , সংখ্যাও বাড়ছিল ।
ছোট-বড় পুরস্কারের অভাব নেই , তিনি সেসবও পেয়েছেন ।
ক্ষমতা ছিল তাঁর অন্য রকমের , সেটা তাঁর চাকরির । ফলে একদল ফন্দিবাজ তোষামুদেরা ছিলই । তারা কেউ প্রশাসক
কাম লেখকের নিন্দে করত না ।
এর মানে এই নয় যে তিনি সাহিত্যে লঘুক্রিয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছেন । বরং
তিনি সিরিয়াস লেখক । একটা খোঁজ বা অনুসন্ধান তাঁর লেখায় থাকত । কিছু সৎ
পাঠক-পাঠিকাও তাঁর ছিল – যাঁরা
আশা করতেন এরকম সৎ অন্বেষণে তিনি কৃশ থেকে সত্যিকারের বিপুলায়তনে পৌঁছে যাবেন
যেদিন তিনি সত্যিকারের অবসর পাবেন ।
এইসময় একটি পুরস্কার তিনি পেলেন । পুরস্কারটি একটি অন লাইন সাহিত্য
পত্রিকার ।
যেখানে ঘোষিত ছিল উপন্যাস প্রথম হলে একটি ট্যাব উপহার দেওয়া হবে ।
তিনি পাকা লেখক । চতুর ঔপন্যাসিক । অন্যরা তাঁর সঙ্গে পারবে কেন !
বিশেষ করে যাঁরা অন লাইনে লেখেন তাঁরা তো লেখক অমরেশ মুখোপাধ্যায়ের তুলনায়
দুগ্ধপোষ্য শিশু বললেও চলবে ।
এমনিতে অমরেশবাবু সাবেকি লোক । পাঞ্জাবি পরলে তিনি স্বস্তি বোধ করেন
। অফিস ফেরৎ স্নান সেরে ‘চা’
পান করে নিয়মিত লিখতেন কাগজ আর পেনে ।
এইসময় তাঁর-ই অফিসের একজন ছোকরা বললে – স্যার – আর কাগজ পেন – আপনি এবার ট্যাবে লিখুন ।
সেই শুরু অমরেশ বাবুর । অন লাইন পত্রিকা আর ট্যাবে লেখা । লেখার ব্যাঙ্ক
ব্যালান্স তাঁর পুষ্ট ছিল বলে লক ডাউন ওঠার পরও জমা দেওয়া ২-৩ টে উপন্যাস নতুন করে
বেরিয়ে গেলো ।
আর তাঁর ফাঁকি শুরু হলো কাগজ , পেনের সঙ্গে । সেই যে তিনি ট্যাবে লেখা শুরু করলেন কাগজ পেন প্রায় বিদায়
নিলো ।
মনে মনে ভাবতেন অন লাইন সাহিত্য তো চলতি যুগের হাওয়া ।
নতুন উপন্যাস কাগজ , পেন নিয়ে লিখতে বসেন আর তখনই ট্যাবের দিকে নজর যেতো । উপন্যাসের দীর্ঘ
অধ্যবসায়ের বদলে চটজলদির মোহ তাঁকে যে কখন গ্রাস করে ফেলছিল তিনি টের পাননি ।
অবসরের পর সময় অনন্ত হলো কিন্তু কাগজ-পেনের লেখা হচ্ছে না ।
তাই তিনি চেঞ্জে এলেন । নিরিবিলিতে যদি লেখা হয় । পাহাড়ও নয় , সমুদ্রও নয় । অচেনা একটি গঞ্জ । তবে প্রচুর সবুজ
রয়েছে । অরণ্য না হলেও বেশ গাছপালা রয়েছে , আর রয়েছে ছোট্ট
নদী ।
নাম অচেনা , পালাং ।
বেশ সুন্দর ।
নিবিড় রাত । স্তব্ধতা রয়েছে ।
টেবিলে কাগজ , পেন নিয়ে
বসেছেন । ট্যাবটা একটু দূরে রয়েছে ।
ঐতিহাসিক একটি উপন্যাস তিনি ধরলেন । পাতা দুয়েক লেখার পর চোখ গেলো
ট্যাবটার ওপর।
হিংস্র , ক্রূরতা
নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । দীর্ঘ অনভ্যাসে কল্পনা যেন উধাও হয়ে গেছে।
মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিম শীতল স্রোত নামতে শুরু করেছে এবং সেটা আর
কিছু না , তাঁর লিখতে না পারার ।
ভয় হচ্ছে তাঁর । আরো একটা দীর্ঘ জীবন তাঁর রয়েছে , সময় এখন অসীম ।
অজান্তে সাদা পাতায় কালো আঁচড়ে পড়তে শুরু করলেন ।
এর মধ্যে আবার বিজলি বাতি চলে গেলো ।
হোটেলের এই ঘরে একটা লন্ঠনও রয়েছে । অভ্যেস নেই , তবুও সহজেই জ্বালাতে পারলেন
।
মশক দংশন শুরু করেছে কিনা টের পেলেন না । লন্ডনের আলোয় তিনি কাগজে
কালির আঁচড় ফেলতে শুরু করলেন । লেখা শুরু হলো সেই পুরোনো , সাবেকি গতিতে ।
লিখতে লিখতে এক সময় তিনি ট্যাবটার দিকে স্মিত , শ্লেষাত্মক হাসি ফেরৎ দিলেন যেন ।
ভোরে এসে লজের মালিক বললেন – লেখা এলো !
বাইরে তখনই অঝোরে বৃষ্টি নামল । অমরেশবাবু বললেন – আসুন , বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন যে
!