একটি
চিঠি
ঘটনাটা নয়ের দশকের শেষের দিকে। মোবাইল আসেনি। ফেসবুক, হোয়াটসাপ দূর
অস্ত। ফোন
ছিল তবে চিঠি তখনও ব্রাত্য হয়ে যায়নি।
সেই সময়কার একটা রবিবার।ছুটির
দিন। দুপুরবেলা।
অবিনাশ দুপুরের খাবার পর বিছানায় গড়াচ্ছিল। হাতের কাজ সেরে রুমি বিছানা
নিল আধঘণ্টা পর। অবিনাশ
অপেক্ষা করছিল। সপ্তাহে
এই একটা দিন একটু অন্যরকমভাবে কাটাতে পারে অবিনাশ। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে নেয়। রুমি বিছানায় এলে কেমন একটা মিষ্টি গন্ধে বিছানাটা
ভরে যায়। একটা
পবিত্রতা ছেয়ে যায় সর্বত্র। অবিনাশ জড়িয়ে ধরে রুমিকে। রুমি কৃত্রিম ভাবে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তারপর নিজেই ধরা দেয় যেন।
অবিনাশ আর রুমির বিয়ে হয়েছে চার মাস। গা থেকে বিয়ের জল এখনো
শুকোয়নি। প্রতি
মুহূর্তে যেন একে অপরকে চোখে হারায় । প্রেম করে বিয়ে নয়। একজন আত্মীয়ের মাধ্যমে ওদের জানাশোনা। বিয়ের আগে দু'একবার দেখাসাক্ষাৎ। তারপর সটান বিয়ের পিঁড়িতে। আসল প্রেমটা বিয়ের পরেই চলছে। এই চারমাস ধরে।
দুপুরের আদর-খেলা শেষ হলে রুমি ঘুমিয়ে পড়েছে। অবিনাশের চোখও বুজে আসছিল। হঠাৎ কলিংবেল। এই সময় কাজের মাসি আসে না। অন্য কেউ হবে। অবিনাশ বিছানা থেকে উঠে দরজার আইহোলে চোখ রাখলো। খাকি ড্রেস পরে কাঁধে ঝোলা
নিয়ে দাঁড়িয়ে পিয়ন। দরজা
খুলতেই একগাল হাসি। লোকটা
প্রায়ই আসে। নন-বেঙ্গলি।কিন্তু বাংলায় কোন জড়তা নেই। শুধু চিঠিকে ‘
চিটঠি' বলাটা ছাড়তে পারেনি।
চিটঠি আছে বাবু--- এই বলে একটা খাম ধরিয়ে দিল সে।
অবিনাশ ঘুম ঘুম চোখে চিঠিটা নিয়ে দরজা বন্ধ করলো। সে চিঠিটার ব্যাপারে খুব
একটা উৎসাহ দেখাল না। এখনকার বেশিরভাগ চিঠি কেজো চিঠি। হয় ব্যাঙ্কের নয়তো এল আই সি র। আর আছেন ছোট পিসি । রাঁচীতে থাকেন । মাঝে মাঝে চিঠি লিখে
খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে তার উত্তর অবিনাশের কোন দিন দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ছোটপিসির চিঠি ভেবেই অবিনাশ অতটা গুরুত্ব দেয়নি।
এক গ্লাস জল খেলো। তারপর রুমির দিকে একবার তাকালো। অঘোরে ঘুমচ্ছে। খোলা চুল। কপালে ঘেঁটে যাওয়া টিপ। লাল রঙের শাড়িটা ঈষৎ
অবিন্যস্ত। ব্লাউজের
একটা হূক খোলা। দুধে-আলতার
মতো বুকটা চকচক করছে। কয়েক গোছা চুল এসে ঢেকে দিয়েছে মুখের একপাশটা। রুমি ঘুমিয়ে পড়লে অবিনাশ ভালো করে তাকে দেখে। কী মায়াবী লাগে তাকে! কী পবিত্র! যেন এক অপরূপা দেবী ! প্রাণ ভরে সেই মাধুরী পান করে সে।
ঘুম ভাবটা কেটে গেছে অবিনাশের। তবুও একটু গড়িয়ে নেবার
জন্য বিছানায় শুলো। মিনিট দশেক পর কথাটা মাথায় এলো। আরে! রাঁচীর
ছোটপিসি তো ছয়মাস আগে মারা গেছেন। তাহলে চিঠিটা
অন্য কারোর হবে। অবিনাশ
চিঠির প্রতি হঠাৎ যেন উৎসাহিত হয়ে পড়লো। চশমা চোখে দিয়ে চিঠিটা হাতে নিল। তার নামটা কেমন যেন অস্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে অনেক দিন আগে
লেখা। পোস্ট
অফিসের সিলের ওপরে যে তারিখটা আছে তা প্রায় ছয়মাস আগে। অর্থাৎ চিঠিটা প্রায় ছয়মাস পরে তার হাতে এসে পড়েছে। ডাকবিভাগের কাজের গতি দেখে
প্রথমে খুব রাগ হলো তারপর হাসিও পেল। ভাবলো আগে দেখলে বিহারী পিয়নটাকে দু'কথা শুনিয়েই দিতো। কিন্তু সব হাসি উবে গেল প্রেরকের নাম দেখে। রুমি সেনগুপ্ত। তাহলে বিয়ের আগে রুমিই এই
চিঠি পাঠিয়েছিল ? কই এই নিয়ে রুমি তো তাকে কখনো কিছু বলেনি। মনের মধ্যে একটা তুমুল আলোড়ন
খেলে গেল তার। বিয়ের
আগে তার সঙ্গে রুমির দেখা হয়েছিল দু’একবার। অনেক কথাও হয়েছিল। কিন্তু কী এমন কথা যা রুমি তাকে সরাসরি না বলে চিঠি
লিখে জানিয়েছিল ?
এক ঝটকায় বের করে ফেললো চিঠিটা। ছোট চিঠি। রুমিরই হাতের লেখা।
“
প্রিয়,
অনেকবার বলবো বলবো করেও একটা কথা তোমাকে বলে উঠতে
পারিনি। অথচ
তোমার জানা দরকার। জানি
না এরপর আমাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু বিবেকের দংশনে তোমাকে এই চিঠি লিখছি। বিয়ের আগে এটা তোমার জানা
খুব প্রয়োজন।
আজ থেকে দেড়বছর আগে পর্যন্ত আমার সঙ্গে একজনের
সম্পর্ক ছিল। বলতে
পারো আমরা বিয়েই করবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তা আর হয়ে ওঠেনি। একটা পথ দুর্ঘটনায় সে
মারা যায়। আমি
খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু
তুমি আসার পর কিছুটা হলেও জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছি। এই কারনে তোমার কাছে আমি কিছু লুকতে চায়নি। ছেলেটার সাথে আমার
সম্পর্ক হালকা ছিল না। বরং একটু বেশি গভীর ছিল। বেশ কয়েকবার আমরা শারীরিক ভাবেও...
এই গল্প শোনার পর বেশিরভাগ পুরুষই আর মেনে নিতে
চাইবে না। তুমিও
আমাকে ছেড়ে দিতে পারো। তোমার সামনে দাঁড়াতে আমারও খুব লজ্জা লাগছে এখন। যদি মনে করো এই সম্পর্ক রাখতে চাও না তবে শুধু
চিঠি লিখে জানিও । আর
যদি মেনে নাও এবং আমাকে বিয়ে করতে চাও তবে কোন উত্তরের দরকার নেই। কথা দিলাম আমি এই প্রসঙ্গ
আর কখনো তুলবো না। আমার
এই ইতিহাসও ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবো ।
উৎকন্ঠায় থাকলাম।
ইতি
রুমি “
অবিনাশ কী করবে ভেবে পারছিল না। শুধু তার সুন্দরী অপরূপা বউয়ের
দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।
শোভন মণ্ডল