সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অভিষেক ঘোষ



অথৈ
  
                (১)
           চেম্বারে ঢুকেই সৃজার মনে হয়েছিল, হোয়্যাইট রেভলিউশন ঘটে গিয়েছে ! সব কিছু  সাদা  ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলোয়, সাদামাটা ঘরটায়, ধবধবে সাদা পোশাকে পাহাড়ি স্যান্যালের মতো হাসি মুখে এনে  সৌম্যদর্শন ডাঃ মুখার্জি বললেন, “আবার তুমি অন্যমনস্ক হচ্ছ মা ! যা যা বললাম, কিছুই শোনো নি ! তাই না ?”  

              সৃজা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ভাবতে থাকে, সে এখানে কি করছে ! কেন এসেছে ? ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলেও যেমন মাঝে মাঝে মায়ের কথায় হাতে মাদুলি বাঁধতে হয়, এই ডাক্তারখানায় আসাটাও তেমনি একটা প্রহসন । সৃজা যে ড্রাগ নেয়, বেশিদিন না হলেও নিচ্ছে, সে তো সেকথা কাউকেই বলবে না । না বললে ডাক্তার বাবুও বুঝবেন না নিশ্চিত । যতই উনি সেই বাচ্ছা বয়স থেকে ওকে দেখুন না কেন ! কিন্তু পাশে মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ সৃজাকে অস্বস্তিকর দোটানায়  ফেলে  বলবে না চেপে যাবে ! ডাক্তার বাবুও সেই থেকে ঠায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সৃজার হঠাৎ মনে হয়, উঠে পালাবে ! দূর থেকে একটা গোঁ গোঁ শব্দ ক্রমশ ওর কাছে এগিয়ে আসছে । মাথার ওপরে বাঁদিকে টিউবের আলো সহসা আরো উজ্জ্বল বোধ হয় তার। নিজেই খেয়াল করে নি এতক্ষণ ও নিজের দুটো হাত দৃষ্টিকটুভাবে ঘষে চলেছিল । লাল হয়ে যাওয়া ত্বকে মা নিজের হাত-টা রাখতেই সৃজা যেন একটা গভীর কুয়ো-তে পড়তে পড়তেও শেষ মুহূর্তে উঠে এল, সচেতন হয়ে উঠল ।

 ডাক্তার বাবু এবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, “ভালো বুঝছি না । এত অমনোযোগ ! ও তো আগে লেখাপড়াতেও নেহাৎ মন্দ ছিল না। আর তাছাড়া আমার মনে হয়, ও বলতে ভয় পাচ্ছে  লক্ষণ বলছে, এ হল ড্রাগের অ্যাডিকশন, এখনো প্রাইমারি স্টেজ । আমি বিশেষজ্ঞ-ও নই। তবে আমি ভালো ডক্টর সাজেস্ট করতে পারি।” সৃজার কানে কাছে শব্দ-টা তখন আরো জোরে হচ্ছে । “বয়সটা তো বোঝেন, চোখে চোখে রাখতে হবে একটু । আর সমস্যাটা যা মনে হচ্ছে, ওর যা যা মনে হচ্ছে, যেমন কেউ সারাক্ষণ ওকে ফলো করছে, রাস্তার মোড়ে সর্বক্ষণ কালো কাঁচ ঢাকা একটা গাড়ি, কে বা কারা ওকে কেবলি লুকিয়ে দেখছে, এসবই ওর মাথায় হচ্ছে । আসলে আমরা তো ভয় পেতে ভালোবাসি। ধরুন যেকারণে বাচ্ছারা, এমনকি বড়োরাও, বিশেষত কিশোরীরা ভূতের সিনেমা দেখে আর কি ! সুতরাং, যে বিপদ বা, ভয়ের কথা ও বারংবার আপনাদের বলছে, ওগুলো ওই অজানা ড্রাগের কারণেই হ্যালুসিনেশন গোছের ব্যাপার । যেটা অবচেতনে ওর মস্তিষ্ক পছন্দই করছে এবং বারবার ঐ একই অনুভূতি বা ওই রকমের উত্তেজনা পেতে চাইছে । আর সেই তাড়না থেকেই ও ফের .  

           সৃজা চাপা গলায় বললো, “বাজে কথা। কে বললো আপনাকে আমি ড্রাগ নিয়েছি !” ডাক্তার মুখার্জি হাসলেন, বললেন, “মা তুমি তো এরকম ছিলে না । আর তোমাকেও আজকের প্রথম দেখছি না। না বললেও বোঝা যায় বইকি !”

(২)

          টিভি চলছিল, হাতে রিমোট আর কোলে কর্ণফ্লেক্সের বাটি-টা নিয়ে সোফায় বসে সৃজা ভাবছিল । ভাবছিল, এই শহরে এক-একটা জায়গা আছে, যেখানে আকাশটা হঠাৎ আটকে পড়ে । আকাশটার বেরোবার উপায় থাকে না । কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে দেখা যায়, ভাসমান মেঘগুলো  অথবা, পাখিদের  দল উড়ে নিখোঁজ হয়ে গেল ! এরকম একটা জায়গায় সৃজা প্রথম ড্রাগ নিয়েছিল । তীর্থ নিতে জোর করেছিল বলেই নিয়েছিল । তারপর তীর্থ-র কথা সৃজা ভুলেই গেছে  ওরকম কত তীর্থ আসবে যাবে ! কিন্তু নেশাটার অনুভূতি ভোলে নি । মাথাটা কেমন হঠাৎ হালকা হয়ে যায় । একটা দুটো ঝাঁকানি দিয়ে অনুভূতির বিমান অবচেতনের অবদমিত বাসনার জমিতে ল্যান্ড করে  তারপর সব গুলিয়ে যায় অথবা, সব ঠিক হয়ে যায় ! কিন্তু মুশকিল হল এই ভয়-টা নিয়ে । কে বা কারা ওকে ফলো করছে ! গত মাসে কলেজ হয়ে ট্যুইশন সেরে, সৃজা একটা শর্টকার্ট নিয়েছিল । সঙ্গে অতনুরা ছিল, কিন্তু ওরা শর্টকার্টে ঢুকলো না। তারপর সৃজা একাই হাঁটতে থাকে । এ গলি  ও গলি  তস্য গলি । হঠাৎ মনে হয় দুটো ল্যাম্প পোস্টের মাঝের জায়গাটায় পৌঁছলেই একটা কিছু ঘটছে । রাস্তায় তখনো লোকজন ছিল। তারপর বাড়ির যত কাছে যেতে লাগলো, ততই রাস্তা নির্জন হতে লাগলো । আচমকা ঘাড় ফেরাতেই যেন একটা কিছু সরে গেল ! একটা কিছু না, একটা কেউ ? এরকম মুহূর্তগুলোয় সৃজা-র মাথায় একটা অদ্ভুত জেদ চেপে বসে । ও চায় যে বা, যারা ওকে ফলো করছে, ও তাদের হারিয়ে দেবে  সৃজার মতো অলি-গলি কেই-বা চেনে ! কিন্তু সেদিন অন্যমনস্কতাবশতই বোধহয় সহসা সৃজা পৌঁছে গিয়েছিল একটা ডেড এন্ডে। দেওয়ালে একটা শ্লোগান । সৃজা পিছনে ফিরতেই কেউ যেন দৌড়ে আত্মগোপন করল ! চিৎকার করতে গিয়েও সামলে নিয়েছিল সৃজা । তারপর সোজা হেঁটে উঠেছিল বড়ো রাস্তায়। একটা অটো ধরে বাড়ি । মা-কে বলেছিল  মা বিশ্বাস করে নি, যেমন এর আগে কেউ কোনোদিন করে নি । কিন্তু সৃজা জানে, কেউ একজন আছে, যে খুব মরিয়া। কী চায় ! ওকে ছুঁতে, অপহরণ করতে নাকি অন্য কোনো মতলব ! শেষমেষ মায়ের পীড়াপীড়ি-তে ডাক্তার বাবুর কাছে যেতেই হল । উনি এম-ডি, মনোবিদ নন, কিন্তু পারিবারিক ডাক্তার বলে মা কখনোই ওনাকে জিজ্ঞাসা না করে অন্যত্র যান না । কিন্তু কেন কেউ বুঝতে চায় না, ওর বন্ধুরাই বা কেন, বিষয়টাকে হেসে উড়িয়ে দেয় ! তাই সৃজা ঠিক করে, এবার আর ভয় পাবে না  মুখোমুখি হবে । তারপর দেখা যাবে ।   টিভি-টা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। আকাশে মেঘ করেছে, জানালা দিয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। নে নো সিগন্যাল সোফা ছেড়ে উঠতে যেতেই রিমোট-টা মেঝেতে পড়ে গেল আর ওমনি ফের টিভি-টা চালু হল  সৃজার চোখে পড়ল, নিউজ চ্যানেলে দ্যাখাচ্ছে, একটা টেকটনিক প্লেটের সঙ্গে আরেকটি টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষ !

(৩)
খবর-টা সবজান্তা বাঙালির উন্নত মস্তিষ্কে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে  সন্দেহ নেই, দুটি প্লেট এবার পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এতে বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এমনকি এর ফলে সমুদ্রে পরিবহন স্থগিত রাখতে হয়েছে। উষ্ণ স্রোত ও শীতল স্রোত বলয়ে ঘটতে পারে বদল ! মনে করা হচ্ছে, আবহাওয়া-তে দ্রুত এর ফলাফল লক্ষিত হবে। এসব শুনতে শুনতেই সৃজা সর্বক্ষণ রেডিও চলতে থাকা দোকান-টা থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরলো। এবং তারপর থেকেই সেই অনুভূতি। মোবাইলের হেডফোন-টা কান থেকে খুলে  হ্যান্ড-ব্যাগে রেখে কানদুটোকে আরো সজাগ করল। এখুনি গলিতে ঢুকবে ও । ইচ্ছে করেই ওই ডেড এন্ড-টা অব্দি যাবে আজ। আজ একটা হেস্তনেস্ত হোক্ । ওকে জানতে হবে, কে ওকে অনুসরণ করে এবং কেন ! প্রতিটি মুহূর্তে বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি-টা বাড়তে থাকে ওর । মনে হয়, গাছের পাতারা নড়ছে না কোথাও । হাওয়া বইছে না। রাস্তায় লোক-চলাচল অস্বাভাবিক কম। কোথাও পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। বৃষ্টি হতে পারে, অথচ হচ্ছে না বলে অদ্ভুত গুমোট চারপাশ। সৃজা চলতে চলতে আচমকা একটা দোতলা বাড়ির আড়ালে থমকে যায়,  ফিরে তাকায় পিছনে ফেলে আসা গলি পথের দিকে  কেউ কোত্থাও নেই। আজ তো ও ড্রাগ নেয় নি ! তাহলে এমন তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে কেন ওর ! নিজের অবস্থাটা চিন্তা করতে গিয়ে ওর একটা পুরোনো স্মৃতি মনে পরে যায় । একবার দীঘা-তে বেড়াতে গিয়ে সাঁতার শেখানোর জন্য আর জল-ভীতি  কাটানোর জন্য বাবা ওকে সুইমিং পুলে ছেড়ে, জল থেকে উঠে গিয়েছিলেন । সৃজা-র বাবার ওপর যে প্রচন্ড রাগটা হয়েছিল, সেটা মূহূর্তে বদলে যায় ভয়ে। ওর হঠাৎ মনে হয়, ওর পা ধরে কেউ টানছে ! অথৈ জল। ও যেন তলিয়ে যাবে । অথচ  সোজা হয়ে দাঁড়ালে পুলে ওর কান অবধি জল । কিন্তু পুলের শান্ত নীলচে জলটাকেও সৃজার দূরের সমুদ্রের অথৈ বলে মনে হয়, যেন যেকোনো সময় ওই শান্ত জলরাশি আচমকা বিভীষিকাময় ঢেউ হয়ে ওকে তলিয়ে দেবে । হাঁচোর-পাঁচোর করতে করতেই অনেকটা জল খেয়ে ফেলেছিল সেদিন ও । অস্বাভাবিক  জোরে হাত-পা নাড়তে গিয়েই হোক্ বা, অন্ধ দিশেহারা  আতঙ্কেই হোক্  ওর তলপেটে খিঁচ ধরেছিল, পরে জ্বর এসেছিল । মা খুব রাগ করেছিল বাবার ওপর। এখন বাবাই বা কোথায় ! বাবার অফিস কলিগ হিসেবে যে রাণু মাসি-কে সে ছোটো থেকে চিনত, এখন বাবার সাথে দেখা করতে হলে, ফোনে তার অনুমতি চেয়ে নিতে হয় । সে আর মা দুবছর হল পাড়া ছাড়া, অথচ এখনো সৃজা মনের মধ্যে সেই চেনা পাড়া-টাকে হাতড়ে বেড়ায় ! কি করে কয়েকটা সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের জীবনটা বদলে যায় ! সৃজা এসব যতবার জোর করে ভুলতে চেয়েছে, ততবার বিপথে গিয়েছে । কিন্তু তেঁতো অসুধের মতো কিছু দুঃখ থাকে, যা জোর করে গিলতে হয় ।

          এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই অনেকখানি পথ কখন যেন চলে এসেছিল সৃজা। হঠাৎ একটা কালো কাঁচ  ঢাকা ইনোভা চারপাশের ঘনীভূত নিস্তব্ধতা চুরমার করে সশব্দে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সৃজার পিছনে। ঘটনাটা এত আকস্মিক যে সৃজা একেবারে ভিতর থেকে কেঁপে গেল । কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ও বুঝতে পারল ওর ঠিক পিছনে রাস্তার ধারের ড্রেন  বাঁদিকে সেই ডেড এন্ড-টা  ডানদিকে সতর্ক অথচ বিপদজনক ক্ষুধার্ত শিকারির মতো আপাদমস্তক কালো গাড়ি-টা দাঁড়িয়ে। সৃজা সসঙ্কোচে অনুভব করল,   নিজেই নিজের পাতা ফাঁদে, ভুলের জালে, আটকে পড়েছে । পালাবার পথ নেই । সৃজা একবার ভাবলো চিৎকার করবে। সব কি সত্যি ? নাকি কিছুটা ওর মাথার মধ্যে ঘটছে ! সৃজা জানে ওকে দ্রুত ভাবতে হবে। আর সময় নেই । কিন্তু ও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। গাড়ির কাঁচটা এবার আস্তে আস্তে নামছে আর সৃজার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। এত অসহায় ও জীবনে বোধ করেনি ! নাকি করেছে ! বারবার অনুভব করেছে !  সৃজা যেন সত্যিই অথৈ জলে একখন্ড কাঠের টুকরো সম্বল করে ভেসে এসেছে বরাবর। মা-বাবা সবার থেকে দূরে সরে গেছে । এখন ও কাকে ডাকবে ! কেই বা সাড়া দেবে ! মাথাটা ঘুলিয়ে ওঠে কেন ! উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে সৃজার হাতদুটো কাঁপতে থাকে, মাথা-টা ঝিমঝিম করে । কিন্তু এসব কি দেখছে ও ! গাড়ির নামিয়ে দেওয়া কাঁচটার ওপারে গোটা চারেক কালো পোশাকে ঢাকা শরীর, অথচ মুখগুলো সম্পূর্ণ সাদা ! মুখোশ ? যেন জনাকতক অশরীরী ক্লাউন। একটা শরীর দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখে। সৃজা নিশ্চিত হয়ে যায় ওদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। টলতে থাকা মাথা-টা  দুহাতে সজোরে চেপে পিছনে আর একটা পা যেতেই ও বুঝতে পারে আবার ভুল হল । ও পড়ছে । কিন্তু পতন কি এইরকম বহুস্তরীয় হয় ! ওর পিঠ আর মাথা সেকেন্ডের ভগ্নাংশের তফাতে কঠিন ও বক্র জমি স্পর্শ করা মাত্র প্রথমে তীব্র যন্ত্রণার কামড়  তারপর আবার পতন শুরু  এবার আরো দ্রুত  কেবল অন্ধকারে  পড়ছে তো পড়ছেই  অথৈ ! দুটো হাতের দশ-টা আঙুল যেন কোনো অবলম্বনের খোঁজে আকাশের দিকে উঁচু হয়ে উঠে তিরতির করে কয়েকবার কেঁপে উঠে থেমে যায় । কিন্তু পতন চলতেই থাকে। ওর নীচে যেন অস্বাভাবিক একটা মাধ্যাকর্ষণের টান  যেন গ্রহান্তরের অভিকর্ষ  এই টান যেন ওকে একেবারে চিড় ধরে যাওয়া দুই টেকটনিক প্লেটের নীচে নিয়ে গিয়ে ফেলবে ! যন্ত্রণা আরো যন্ত্রণা । আর তারপর সব নীরব আর অন্ধকার । কোথাও কোনো অনুভূতি নেই, সব অসাড় ।

(৪)
          সরমা কোনোদিনই পরমাসুন্দরী ছিল না। কিন্তু মেয়ে সৃজা-র মতোই তার চেহারায় একটা অদ্ভুত নম্র লালিত্য ছিল। দিদিমা বলতেন, ভারী মনকাড়া মুখ খানা । কিন্তু সংসারের অব্যক্ত বেদনার ভার বইতে বইতে, দাম্পত্য জীবনের সুদীর্ঘ চারটে দশক অতিক্রম করে অবশেষে সরমা অনুভব করে, আয়নার সামনে দাঁড়ালে এখন যাকে দেখা যায়,  সে সরমা নয় স্বামীপরিত্যক্তা, বিগতযৌবনা যে কোনো নারী । 

 দাদা-বৌদির সংসারে আশ্রয় নিয়ে যে ব্যক্তিগত পরিসরটুকু মানুষের একান্ত প্রয়োজন হয়, সেটুকুও বিসর্জন দিতে হয়েছে  মুখে সরাসরি না বললেও বোঝা যায়। যেমন এই গত পরশু দিন বৌদি তার রাঁধা মাংসের ঝোল অম্লানবদনে চেটেপুটে খেয়ে, চালাকির হাসি হেসে মন্তব্য করল, “সরমা তোমার পাঁঠাটা বোধকরি আখের ক্ষেতে ঢুকে পড়েছিল ! বাস্তবিক সৃজা ঝাল খেতে পারে না বলেই না সরমা-কে রান্নায় মিষ্টি সামান্য বেশি দিতে হয় ! কিন্তু প্রত্যুত্তর দেওয়ার স্বাধীনতা সরমার নেই।  ছোড়দা-ও হয়তো বিরক্ত হয়ে বলবে, “আঃ সরমা ! ঐ টুকুই বলে, কিন্তু সরমার মনে ঐটুকুই সূঁচের মত বেঁধে । রঞ্জনের জন্যই তার এই দুর্গতি ! রোজ রোজ কদর্য  ঝগড়ার কারণে সৃজাও তাকে ভুল বুঝল,  এটাই বিরাট দুঃখের । সৃজা এখন যন্ত্রের মত বসবাস করে। কথা নিতান্ত যতটুকু না বললে নয়, বলে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না । এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ওর মনগড়া গল্পগুলো শোনার পরে । আচ্ছা এসব কোনো সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করতে পারে ! কোলকাতার রাস্তার কেউ একটা উনিশ বছরের মেয়েকে রোজ ফলো করে, অথচ রহস্যময় অনুসরণকারীদের দেখা যাচ্ছে না ! একেবারে উধাত্ত হয়ে যাচ্ছে !

           ছাতে কাপড় শুকোতে দিতে দিতে এসবই ভাবছিল সরমা । এই সময়েই মোবাইল-টা বেজে উঠল । স্ক্রিনে একটা অচেনা নাম্বার। কল-টা রিসিভ করতেই একটা উৎকন্ঠিত গলা বলে উঠল, “হ্যালো আপনি কি সৃজা ব্যানার্জির মা বলছেন ?”  সরমা কি বলবে বুঝে ওঠার আগেই ওকে হসপিটালের নাম আর বেড নাম্বারটুকু বলে উলটোদিকের কন্ঠস্বর ফোনটা কেটে দিল । তারপর একটা বিশ্রী আতঙ্ক, গলার কাছে একটা দলা পাকানো যন্ত্রণা । হসপিটালের বেডে সৃজার দীর্ঘক্ষণ জ্ঞান ছিল না । প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে কিনা । সরমা ওর বিছানার পাশে বসে ওর হাতটা চেপে ধরে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল । ঘরের ভয়াবহ নিস্তব্ধতা দূর করতে টেলিভিশন-টা চালানো ছিল কম ভলিউমে । হসপিটালের বেডে যখন সৃজার জ্ঞান ফিরল, প্রথমেই সে কিছু বুঝতে পারল না । সৃজা যেন বর্ষণপুষ্ট খালের স্রোতে ছেড়ে দেওয়া নৌকাটি ! ক্ষণে ক্ষণে ধাক্কা খেতে খেতে বুঝে নেয় জলেরা জানে না কোনদিকে বয়ে যেতে হয় । জানে না কোথায়, কখন বাঁক নিতে হয় । জানে না কখন থেমে যেতে হয় । প্রবাহিত জলস্রোতের কি ভাগ্যরেখা থাকে ?  ভাগ্যরেখা থাকে কি নৌকাদের ! বিহ্বল সৃজা সতেচন হওয়া মাত্রই টের পেল তলপেটে অসহ্য ব্যথা । যেন সেই সুইমিং পুলের অথৈ জল  যেখানে সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা, শান্ত নীল জল সহসা সমুদ্রের ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে পারে ! ব্লাড প্রেসার নর্ম্যাল  স্যালাইন  বেচারা  কি করছিল অত রাতে !  স্টুপিড কোথাকার  মা বাপ গুলোও তেমন  এই কথাগুলোই ঘুরে-ফিরে কানে আসে সৃজার । তারপর ও বুঝতে পারে এতক্ষণ ওর অসাড় হাত-টা ধরে ছিল আরেকখানা হাত । ওই শুধু অনুভব করেনি । মা একটা চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে ওর হাতের পাশে মাথা রেখে । টিভি-তে তখন  এক্সক্লুসিভ দেখাচ্ছে । মানবসভ্যতার একটা বিরাট ফাঁড়া কেটে গিয়েছে । টেকটনিক প্লেটদুটোর অন্তর্বতী ফাঁকটুকু বুজে গিয়েছে  প্লেটদুটো পরস্পরের কাছাকাছি আরো সরে আসায় । বিশেষজ্ঞরা গম্ভীর হয়ে তর্ক করছে, পর্যালোচনা চলছে এই ঘটনার কারণ নিয়ে । একটা হাতের নীচে আরেকটা হাত তখন সেই উষ্ণতা খুঁজে পেয়েছে, যা না থাকলে এই সভ্যতা কবেই চুরমার  হয়ে যেত ।




অভিষেক ঘোষ