সহমরণ
ফজরের নামাজের সময় থেকেই কথাটা গুন গুন করে
ঘুরে বেড়াতে থাকে বাড়িময়। নাফিসা বুঝতে পারে। দাদি আপন মনে কপাল চাপড়ায় আর বলে, “মেয়াছেল্যা, আবার কলেজি যাবে! ত্যাখনই জানি!” গতকাল রাতেই নাফিসার
চারভাই নাফিসাকে জেরা করছিল, নাফিসা কোথায় কার সঙ্গে
কলেজ যায়, আসে, আর কোথায় যায়……ইত্যাদি। নাফিসা সপাটে জানিয়ে দিয়েছে কিংশুকের কথা। আনোয়ার মুখ বেঁকিয়ে বলেছে, “হিঁদুর ছেলে?” নাফিসা বলেছে, “হিন্দু মুসলমান, আমি মানি না! সবাই মানুষ।”
সকাল হতেই দাদাদের বন্ধুরা
ছোট ছোট দলে আসছে……কি সব গোপন পরামর্শ সেরে
ফিরে যাচ্ছে। নাফিসা কান খাড়া করে শুনেছে। দাদারা বলছে, “ওরাই তো ছড়িয়েছে নোংরা ভিডিও…কলেজের ছেলে এই শিক্ষা?” কলেজের শিক্ষা বলতেই মনে এসেছে নাফিসার কথা। ঘরের দিকে তাকিয়েছে বড়দা। আপনমনেই
বলল কি? “আমাদের ঘরের মেয়্যাগুলারও বড্ড বাড় বেড়েছে…” চালের বাতা থেকে আনোয়ার দা, কাটারী নামিয়ে শান দিচ্ছে
নাফিসা দেখেছে। ভয়ে কাঠ হয়ে আছে নাফিসা। ছুট্টে গেছে মায়ের কাছে……দয়া……দয়া……শুধু
দয়া……।কিচ্ছু
করবে না। শুধু দয়া……। আব্বা, দাদারা যা বলবে নাফিসা
মেনে নেবে।
দুপুর নাগাদ আব্বা এসে খবর
দিল, কথা হয়ে গেছে। কিন্তু আশেপাশের হাওয়ায় বারুদ ঠাসা হয়ে
আছে। পাশের গাঁয়ের মণিরুল রাজি আছে। পঞ্চাশ হাজার লাগবে আর দু বিঘে জমি। সন্ধেবেলায় মৌলবী আসবে কলমা পড়াতে। সন্ধেবেলা হ্যাজাক জ্বলে ওঠে। আগুনও জ্বলে ওঠে ঘোষপাড়ায়। “আলহাম দুলিল্লাহ, শাদী কবুল, শাদী কবুল, শাদী কবুল।“ আব্বা, দাদারা রাতের অন্ধকারে মণিরুলকে বৌ নিয়ে
নিজের বাড়ি ফিরতে দেয় না। দিনকাল ভাল নয়। নিয়ামত ছুটে এসে খবর দেয় রহিমচাচার দোকান
জ্বলছে। ছুটে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে যায় আনোয়াররা। দাদি সমানে চ্যাঁচাতে থাকে, “ঘরের ভিতরি থাকো সব্বাই… বাইরে যাবা না…” নাফিসা মোবাইলে দ্রুত কাউকে খুঁজতে থাকে। মোবাইল পরিষেবা বন্ধ। মণিরুল দরজা
বন্ধ করে। দাদির ঘরে আয়োজন চলতে থাকে প্রথম রাত্রি উদযাপনের।
রাত্রি ঘন হয়ে আসে। নাফিসা শুনতে পায়, “বলহরি…হরিবোল……” কাঠ হয়ে যাওয়া নাফিসা
সুতীব্র চিৎকার করতে চায়, কিন্তু শব্দ কন্ঠনালী ভেদ
করে বাইরে আসে না। মণিরুলের আগ্রাসী অভিযানে চিতা সাজানো চলতে
থাকে। লেলিহান শিখায় খাক হতে হতে সহমরণে চলে নাফিসা।
শান্তা মুখোপাধ্যায়