সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শ্রীশুভ্র




এনকাউন্টার অফ  দ্য ক্রাইম 





এনকাউন্টার অফ দ্য ক্রাইম
শ্রীশুভ্র

‘এক’

যে দেশে প্রতি পনেরো মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়, সেই দেশে মেয়েদের অবস্থা বুঝতে পনেরো সেকেণ্ড সময় লাগার কথা নয়। ভারতবর্ষে ধর্ষণের জন্য আইন নাই, বিষয়টা এমন নয়। আইনের ধারায় বিচার করার মতো আদালত নাই, এমন নয়। রাষ্ট্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য পুলিশ নাই এমনও নয়। দেশে প্রশাসন চালানোর মতো সরকার নাই, তাও নয়। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় দেশসেবার উদ্দেশে নিবেদিত এবং নাগরিকের পক্ষ নিয়ে কথা বলার জন্য রাজনৈতিক দল নাই, তাও নয়।  নাগরিক সমাজ ধর্ষণের বিষয়ে উদাসীনও নয়। প্রশ্ন, তাহলে প্রতি পনেরো মিনিটে একটি করে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ সংগঠিত হয় কি করে? এখানেই ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট। এতসব কিছু থাকতেও এদেশের মেয়েরা সুরক্ষিত নয়। নিরাপদ নয়, যেকোন সময় একটি মেয়ের জীবনে নেমে আসতে পারে ধর্ষণের মতো বিপর্যয়।

এবং সেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা মাথায় নিয়েই মেয়েদের প্রতিদিনের জীবনযাপন। এরপর রয়েছে গণধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ। যা প্রায় সংগঠিত দাঙ্গার সমতুল্য। এবং অধিকাংশ সময়ে যার পরিণতি ধর্ষিতাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নয়তো কুপিয়ে খুন করে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা। এই যে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি মেয়েদর মাথার উপর, এর মধ্যেই প্রতিটি নারীর রোজকার জীবনযাপন। ঘরে বাইরে। সেইখানে দাঁড়িয়ে পুলিশের হাতে ধর্ষকের এনকাউন্টারে মৃত্যু, যেকোন নারীর কাছেই একটি সুবিচার। বিশেষ করে ভারতীয় আইন ও তার প্রয়োগের অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রীতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধের রাজনৈতিক রক্ষাকবচের সুবিধার কথা বিবেচনা করলে এমনটিই হওয়া স্বাভাবিক। সংগঠিত অপরাধের পর অপরাধীরা যে ভাবে রাজনৈতিক দলের রক্ষাকবচের উপর নির্ভর করে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, এবং নির্যাতিতা ও তার পরিবারের উপর বলপ্রয়োগ ও ভীতিপ্রদর্শন করে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে, তাতে এনকাউন্টারে ধর্ষক নিধনই ভারতীয় নারীর কাছে প্রকৃত সুবিচার বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

এখন প্রশ্ন এনকাউন্টারে মৃত্যু মানেই কি প্রকৃত অপরাধীর মৃত্যু? নাকি অপরাধীকে বাঁচাতেও এনকাউন্টারে হত্যা আসলে অপরাধের তদন্ত সমাপ্ত করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও হতে পারে? আমরা কি নিশ্চিত থাকতে পারি এইভেবে যে, পুলিশ যখন এনকাউন্টারে মেরেই ফেলেছে, তখন নিশ্চয়ই প্রকৃত অপরাধীকেই খতম করেছে। ভারতীয় পুলিশের উপর ভারতবাসীর এমন ভরসা রয়েছে তো? সম্প্রতি হায়দ্রাবাদের পশু চিকিৎসক তরুণী হত্যায়, পুলিশি এনকাউন্টারে ভারতবর্ষব্যাপি যে তুমুল অভিনন্দনের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হওয়ার কথা; ভারতীয় পুলিশের উপর মানুষের অগাধ আস্থা রয়েছে। বিশেষত নারী সমাজের। সকলেই এনকাউন্টার করা হায়দ্রাবাদী পুলিশের ধন্য ধন্য করছে। ঠিক যে পুলিশ, ঘটনার রাতে অপহৃত পশু চিকিৎসকের খোঁজ করতে কোনরকম ভাবেই তৎপর হয় নি। হলে, ধর্ষণের ঘটানাটিকে প্রতিহত না করতে পারলেও, নিশ্চিতভাবেই তরুণীর মূল্যবান প্রাণ রক্ষা করা যেত। অন্তত যে কোন সুসভ্য দেশেই এইরকম ঘটনায় পুলিশ নিমেষের মধ্যেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, মানুষের নিরাপত্তা ও প্রাণ বাঁচানোই পুলিশের প্রধানতম দায়িত্ব। বিশেষ করে হায়দ্রাবাদের ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার সময়, অপহরনের সময় ও নির্যাতিতার মৃত্যুর সময় হিসাব করলেই, পুলিশের চরমতম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অপদার্থতা এবং জেনে বুঝে নিস্ক্রিয়তার ছবিই প্রমাণ হয়। যেকোন সুসভ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুলিশের এই ধরণের নিস্ক্রিয়তা আদালতগ্রাহ্য চরমতম অপরাধ বলেই বিবেচিত হওয়ার কথা।

আমরা সকলেই জানি, ভারতীয় পুলিশের উপর স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও প্রতিপত্তির কথা। এই দেশে পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে কতটুকু কাজ করতে পারে, আর কতখানি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বার্থ ও তার নেতানেত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য করতে হয়, সেই বিষয়ে ভারতবাসী মাত্রেই ওয়াকিবহাল। আমরা এও জানি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, পুলিশকে কাজে লাগিয়েই অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া হয়। আদালত অব্দি বিচারের জন্য যেতেই দেওয়া হয় না। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ক্ষমতাই শেষ কথা বলে। এই বিষয়টি কারুরই অজানা নয়। কিন্তু তাসত্তেও আপামর ভারতীয় নারীর হায়দ্রাবাদী এনকাউন্টারে এমন বিপুলভাবে পুলিশের নামে জয়ধ্বনি দেওয়ার কারণ কি? প্রশ্ন এখানেই। প্রশ্ন উঠতো না, যদি না অপরাধীদের ধর্ষিতা নিজেই শানাক্ত করে দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। ঠিক যে ঘটনাটি ঘটছে, এই ঘটনার পরপরেই উত্তরপ্রদেশের সেই উন্নাওয়ে। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী বিধায়কের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণের অভিযোগ ঝুলে রয়েছে। সেই উন্নাওয়েই অন্য আর একটি অপরাধের ঘটনায়, আদালতে সুবিচার পেতে যাওয়ার পথে ধর্ষিতাকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে ধর্ষিতা অপরাধীদের নাম বলে দিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সেইক্ষেত্রে এনকাউন্টার হলে আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম, আসল অপরাধীই খতম হলো বলে। কিন্তু হায়দ্রাবাদ কাণ্ডে সেরকম ঘটেনি। ফলে, পুলিশ যে আসল অপরাধীকে আড়াল করতেই, এই এনকাউন্টার সংঘটিত করে নি, সুনিশ্চিত হয়ে সেকথা বলা যায় না। তাসত্বেও আসমুদ্রহিমাচল মানুষ বিশেষত নারীসমাজ এই এনকাউন্টারকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই অভিনন্দিত করছেন। সমস্যা সেখানেই।

‘দুই’

ধর্ষণের ভিতর প্রধানতম দুইটি শ্রেণীভেদ রয়েছে। একটি ধর্ষণ। অন্যটি গণধর্ষণ। এর পরেও ভারতবর্ষে ধর্ষণের আরও দুইটি শ্রেণী বিভাজন করা সম্ভব। একটি জৈবিক প্রবৃত্তির উপর হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে। অন্যটি ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশবিক উল্লাস জনিত কারণে। হটাৎ নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে ঘটা ধর্ষণ ও ক্ষমতার ধারাবাহিক অপব্যবহারের কারণে ধর্ষণ, দুটিই সমান অপরাধ। এখন অধিকাংশ সময়ে দেখা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ঘটা ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন সংগঠিত হয় না। হয় না কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরণের ধর্ষণের ঘটনার মূল অপরাধী হয় কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর আসনে বসে থাকে, যার সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বিশেষ যোগাযোগ থাক। নয়ত ধর্ষক নিজেই কোন রাজনৈতিক দলের ছোট বড়ো কিংবা হেভিওয়েট নেতা থেকে জনতার ভোটে নির্বাচিত বিধায়ক বা সাংসদ হিসাবেই পরিচিত থাকেন। ফলে তাদের ক্ষমতার দৌড় সরকারের উচ্চতম পদ থেকে বিচার ব্যবস্থার শীর্ষতম আসন অব্দি বিস্তৃত থাকে। যার ফলে, তাদের চেলাচামুণ্ডারা দোর্দণ্ড প্রতাপে যেকোন আন্দোলনকে প্রতিহত করার ক্ষমতা ধরে। সাধারণ মানুষ স্বভাবতঃই তাদের ভয়ে এতটাই ভীত ও সন্ত্রস্ত, যে কেউই প্রায় পথে নামতে সাহস করে না সহসা। ফলে আন্দোলনও দানা বাঁধে না। এবং অধিকাংশ সময়েই এই শ্রেণীর ধর্ষক তাদের সকল রকম রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে, অর্থবলে, পেশীশক্তির জোরে, নিজ নিজ অপরাধকে আইনের হাত থেকে বাঁচিয়ে  ধামাচাপা দিতে সফল হয়। সাধারণ জনতা এইসব কিছুই জানে। এবং বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না।

আর ঠিক সেই কারণেই, জনতা যখন দেখে ধর্ষক অত্যন্ত সাধারণ ঘরের। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সরাসরি কোন যোগ নাই। অশিক্ষিত দরিদ্র। এবং মুটে মজুর কৃষক শ্রেণীভুক্ত খেটে খাওয়া সম্প্রদায়ের কেউ। তখনই জনতার সকল ক্ষোভ গিয়ে আছড়ে পরে সেই অপরাধীদের উপর। জনতা জানে, এদের বিরুদ্ধে পথে নামলে নিজের কোন বিপদ নাই। তাই আত্মসুরক্ষা নিশ্চিত বুঝেই সাধারণ জনমানস ধর্ষণের বিরুদ্ধে পথে নেমে সোচ্চার গণআন্দোলন গড়ে তোলে। না, সবসময়েই যে আত্মসুরক্ষা সম্পূর্ণ নিশ্চিত থাকে, তেমনও ঠিক নয়। ধর্ষক সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রেণীর হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ধর্ষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণন্দোলনকেও বানচাল করে দিতে সক্রিয় হয়। সাম্প্রতিক অতীতেও আমরা সেরকম নিদর্শন দেখেছি। কিছু কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াই এর কারণ হয়ে উঠতেই পারে। কিন্তু তাছাড়া, অধিকাংশ সময়েই ধর্ষকের পেছনে রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়া না থাকলে, ধর্মীয় আখড়ার ছাউনি না থাকলে তবেই জনতার ক্ষোভ ধর্ষণ ও ধর্ষকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের রূপ নেয়। ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোই এর জন্য দায়ী।

আর ঠিক সেই কারণেই সাধারণ মানুষ তখন আর কোন কিছুই বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে রাজি থাকে না। তারা তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদান দেখতে উৎসাহী হয়ে পরে। তারা খুব ভালো করেই জানে, ভারতীয় বিচার ব্যাবস্থার ফাঁক ফোঁকড়গুলি এতটাই প্রশস্ত, যে অপরাধী সেই ফাঁক গলে বেড়িয়ে যেতেও সক্ষম। এবং যদি, শাস্তিও হয়, তবে অপরাধ সংঘটন ও শাস্তি প্রদানের ভিতর অযথা দীর্ঘ সময়ের কালক্ষেপ বিচার ব্যাবস্থার উপর মানুষের ভরসা ও বিশ্বাস দুইই নড়িয়ে দেয়। আর ঠিক সেখানেই পুলিশি এনকাউন্টার মানুষকে আশার আলো দেখাতে শুরু করেছে। ক্ষমতার শীর্ষে বসে প্রতিদিনের ধর্ষকদের রাজনৈতিক রক্ষকবচ থাকায়, জনতার আক্রোশ গিয়ে পড়ে হঠাৎ প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ হারানো সমাজের নীচুতলার ধর্ষকদের উপরেই। সেখানেই পুলিশ যদি সেই নীচুতলার কয়েকটি মুখকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়েই ধর্ষক ধরার বয়ান দেয়, মানুষের বিশ্বাস করতে বিলম্ব হয় না আর। জনতার সকল ক্রোধ তখন আক্রোশে পরিণত হয়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠে ধর্ষক নিধনের স্বপ্নে। এনকাউন্টার সেই স্বপ্নকেই পরিপূর্ণ করে। করে বলেই এমনকি সমগ্র নারী সমাজও, এনকাউন্টারকেই এমন বিপুল উৎসাহে বরণ করে নিতে পেরেছে। দেখতে রাজি হয় নি, তাতে আসল অপরাধীই নিধন হলো কিনা। বিশ্বাস করে ফেলেছে পুলিশি বয়ানেই। যে পুলিশের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে পুলিশের দৌড় সম্বন্ধে কারুরই কোন সন্দেহ নাই।

সাধারণ মানুষের এই সাধারণ মনস্তত্বই ক্ষমতার অলিন্দের সাথে যুক্ত থাকা পেশাদার ধর্ষকদের আর একটি রক্ষাকবচ। তারা এইভাবে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হওয়ায় নিশ্চিন্ত। নিজেদর সুরক্ষার বিষয়ে। অনেকেই বলতে চাইবেন, তা কেন। হায়দ্রাবাদের এনকাউন্টারের পরেই তো সেইসব ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ক্ষমতাধর ধর্ষকদের বিরুদ্ধেও এনকাউন্টারের দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে ঠিক। কিন্তু সেই দাবি উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রেই। রাজপথে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক রক্ষকবচের সুবিধাভোগী নির্দিষ্ট ধর্ষকদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন কী আছড়ে পড়েছে? না। এখনও দেখা যায় নি তেমনটা। জনগণও জানে, এইসব কেষ্টবিষ্টুদের শাস্তি দেওয়ার উপায় সুনিশ্চিত করা ভারতীয় বিচারব্যাবস্থায় প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। হলেও সেটি সংখ্যায় এতই নগন্য হবে, যে তা ধর্তব্যের বিষয়ই নয়। উল্টে ক্ষমতাসীন ধর্ষক বিধায়কের হয়ে জনতাকে রাজপথে মিছিল করতেও দেখা গিয়েছে। এখানেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি।

তাই এনকাউন্টারকে বিশ্বাস করে নিশ্চিন্তে বসে থাকা কতটা যুক্তিযুক্ত সত্যই ভেবে দেখারই বিষয়। প্রথমতঃ এনকাউন্টারের পুলিশি বয়ানের সত্যাসত্য যাচাই করার উপায় নাই। দ্বিতীয়ত যদি ধরেই নেওয়া যায়, এনকাউন্টারে প্রকৃত অপরাধীই নিধন হয়েছে, তাহলেও সেই একই এনকাউন্টার যে ক্ষমতাধর ধর্ষকদেরকে নিধন করতে সক্ষম হবে না, সে কথাও বলাইবাহুল্য। ফলে এই এনকাউন্টার তত্বের উপর ভরসা করে এদেশের ধর্ষণকে এনকাউন্টার করা যাবে না কোনভাবেই।

‘তিন’

তাহলে প্রশ্ন, কিভাবে সম্ভব ভারতবর্ষে নারী ধর্ষণের সত্যকার এনকাউন্টার? আসলে ধর্ষণ অন্যান্য অপরাধগুলির মতোই একটি অপরাধ। সেটির প্রকৃতি অবশ্যই জঘন্যতম সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহলেও এটি একটি অপরাধ। অন্যান্য অপরাধের মতোই। এখন দেখার বিষয়, একটি রাষ্ট্রের শাসন ব্যাবস্থায় তার বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামো অপরাধ প্রতিরোধে কতটা সক্ষম্। অবশ্যই ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে এটি একটি প্রধানতম বিষয়। যদি বিশেষ ভাবেই সক্ষম হয়, তবে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধেরও দ্রুত ও সঠিক বিচার হবে। হবে অন্যান্য অপরাধের মতোই।  আমরা সকলেই জানি, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামোর প্রকৃত অবস্থা। কিন্তু বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামো যাই হোক না কেন, তাকে সঠিক দিশাতে পরিচালিত করার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছা কিরকম বা কতটুকু, সেটাই হয়তো আরও বড়ো প্রশ্ন।

এই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন কেমন, সেটি বোঝা যাবে, আমরা যদি আমাদের সংসদ ও বিধানসভাগুলির দিকে তাকিয়ে দেখি। শুধুমাত্র বর্তমান লোকসভাতেই চল্লিশ শতাংশের মতো নির্বাচিত সাংসদদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে বিভিন্ন আদালতে ফৌজদারী মামলা চলছে। যার ভিতর ধর্ষণ ও খুনের মতো চরম অপরাধও রয়েছে। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে, এরা সকলেই জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে এসেছে। এই যে চল্লিশ শতাংশ অপরাধে অভিযুক্ত সাংসদ, তদের কী বিপুল জনসমর্থ! সেকথা ভাবলেই অপরাধ প্রতিরোধে এই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছার চিত্রটা ধরা পড়তে পারে। এর সাথে যোগ করতে হবে সকল বিধানসভায় নানান অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নির্বিচিত বিধায়কদের মোট সংখ্যাকে। না শুধু তাই নয়। তার সাথেও যুক্ত আছে, নির্বাচনে দাঁড়িয়েও ভোটের রাজনীতিতে পরাজিত অপরাধী প্রার্থীর মোট সংখ্যা। সেখানেই কিন্তু শেষ নয়। সকল অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতানেত্রীই যে নির্বাচনে দাঁড়ায় তাও নয়। অনেক ছোটখাটো মেজোসেজো নেতানেত্রীও রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধেও ফৌজদারী মামলামকদ্দমা চলছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের একটি বড়ো সংখ্যক অপরাধীই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ক্ষমতাচর্চার সাথে যুক্ত। কিংবা উল্টো দিক থেকে দেখলে, ভারতীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত একটি বড়ো অংশের নেতানেত্রীই নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার নেপথ্যে রয়েছেন।

এবং এদের পিছনে রয়েছে বিপুল জনসমর্থন। কারণ জনসমর্থন না থাকলে, তারা তো নির্বাচনে জিতে আসতে পরত না। এটাই ভারতবর্ষের রাজনীতির মূল চিত্র। ফলে এই দেশে বিচার ব্যবস্থাকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করার রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকৃত চিত্র কেমন হবে, সেকথাও বলাইবাহুল্য। আর এইটাই ভারতবর্ষের মূল সমস্যা। রাষ্ট্র যে রাজনৈতিক পরিকাঠামো তৈরী করেছে, গলদ তার অভ্যন্তরেই। যেখানে অপরাধীরাই সবচেয়ে বেশি সংগঠিত শক্তি। একটি রাষ্ট্রকাঠামো যখন অপরাধীদের স্বর্গ হয়ে ওঠে, সেই কাঠামোর অন্তর্গত রাজনৈতিক পরিসরই যখন অপরাধীদের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়; তখন সেই রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি কিভাবে কোনদিকে নিয়ন্ত্রীত হবে, হতে থাকবে সেই বিষয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ থাকার কথাও নয়। সেন্দেহ নেইও। তাই অন্যান্য সংগঠিত অপরাধের মতো ধর্ষণও যেখানে একটি সংগঠিত অপরাধ, সেখানে তার বিরুদ্ধে আইন আদালত সাধারণ বিচার প্রার্থীদের কাছে কতটুকু ভরসাস্থল সে বিষয়েও কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাই প্রতিপদেই যেখানে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে, সেখানে যে কোন এনকাউন্টারকেই মানুষ প্রাথমিক ভাবেই ভরসা করতে চাইবে। ভিতরের ঘটনা বিশেষ তলিয়ে দেখতে চাইবে না। সেটাই স্বাভাবিক মনস্তত্ব।

অর্থাৎ গলদ রয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক পরিকাঠামোর ভিতরেই। একটি দেশের রাজনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠে মূলত দুইটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে। একটি দেশের সংবিধান। অন্যটি দেশের সমাজব্যবস্থা। রাজনৈতিক পরিকাঠামোর ভিতর গলদ থাকলে, বুঝতে হবে এই দুটি স্তম্ভের ভিতেও রয়ে গিয়েছে গণ্ডগোলের শিকড়। দেশের মানুষকে সেই শিকড়ে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। দেখতে হবে, বুঝতে হবে অসুখ কতটা গভীর। সেটি ঠিকমত না বুঝলে অসুখের প্রতিষেধকের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হবে না আদৌ। এখন সংবিধানের ভারসাম্য নির্ভর করে সমাজব্যবস্থার ভিতের উপরেই। কারণ সংবিধান সমাজের জন্ম দেয় না। সমাজই সংবিধানের জনক। ফলে সংবিধানকে যথাযথ করতে পারে একমাত্র সমাজই। তাই আমাদেরকে পৌঁছাতে হবে শেষমেষ আমাদের সমাজের অভন্তরেই। আসল অসুখের গতি প্রকৃতি সন্ধান করতে। সেখান থেকেই খুঁজে নিতে হবে সঠিক প্রতিষেধকের হদিশ। সেইমত মেরামত করে নিতে হবে সাংবিধানিক স্তম্ভটিকেই। তারপর দূর হতে পারে রাজনৈতিক পরিকাঠামোর গলদসমূহ। যেটি না হলে নিরপেক্ষ সঠিক ও দ্রুত বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মেরামত করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে। শিকড়ের অস্থিমজ্জা থেকে। সেখান থেকে গলদসমুহের সঠিক এনকাউন্টার না করতে পারলে ধর্ষণ কেন কোন অপরাধ ও অপরাধীরই আসল এনকাউন্টার সম্ভব নয়।

আর সেই গভীরে পৌঁছাতে গেলে আগে আমাদের  বুঝতে হবে, ধর্ষণ আসলে একটি মানসিকতা। ধর্ষণ একটি শারীরীক প্রবৃত্তি। ধর্ষণ ক্ষমতাচর্চার একটি অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। সেই দুষ্টগ্রহ আমাদের সামজের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। পরিব্যাপ্ত মানুষের শিক্ষাদীক্ষায় অশিক্ষাকুশিক্ষায়। সর্বত্র। ধর্ষণের মূল শিকড় নিপীড়নের আনন্দের ভিতর। কথায় বলে শক্তের ভক্ত নরমের যম। আর এই নিপীড়ণ মানসিকতা শিক্ষার্থীর ওপর শিক্ষকের। স্ত্রীর উপর স্বামীর। নববধুর উপর শাশুড়ীর। বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ীর উপর বাড়ির বৌয়ের। পাড়ার নিরীহের ওপর পাড়ার দাদাদের। গৃহস্তের ওপর পাড়ার মস্তানদের। ক্লাসের বোকা ছাত্রটির উপর বাকিদের। কলেজের প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের ওপর সিনিয়রদের। কেরাণীর উপর দপ্তরের আধিকারিকের। জনসাধারণের উপর রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের। কয়েদীদের উপর পুলিশের। পরাজিত সৈন্যের ওপর বিজয়ী দেশের। সর্বত্র পরিব্যাপ্ত নিপীড়ন করার মানসিকতা। ধর্ষণ সেই মানসিকতারই অন্যতম জঘন্য এক প্রবৃত্তি।

অর্থাৎ, ধর্ষণের এনকাউন্টার করা তখনই সম্ভব হবে, সমাজ যখন সার্থক ভাবে এই সকল নিপীড়ণমূলক মানসিক ও শারীরীক প্রবৃত্তিগুলিকে এনকাউন্টার করতে পারবে। একমাত্র তখনই। তার আগে কখনোই নয়। সামজদেহকে সুস্থ না করতে পারলে দুই একটি পুলিশি এনকাউন্টার করে দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। দেশের নারী সমাজকেও বুঝতে হবে সেই সত্য। নারীসমাজ যদি জেগে ঘুমায়, তাহলে সামাজের কোন অসুখের সঠিক এনকাউন্টারই সম্ভব নয়। সেই নারী সমাজকে সকলের আগে চোখের ঠুলি খুলে বেড়িয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন তুলতে হবে আর কতদিন তাদের এইভাবে দিবানিদ্রায় ভুলিয়ে রাখবে সমাজ। সমাজের একেবারে ভেতর থেকে ঝাঁকি দিতে হবে। আর তার জন্য কাজ শুরু করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে। করতে হবে নিজের ঘর থেকে। শুরু করতে হবে নিজের সন্তানের ভিতর সুস্থ শিক্ষার শিকড় গেড়ে দেওয়ার কাজটি থেকেই। একজন জননীই এটা পারে। আপন সন্তানের প্রবৃত্তির ভিতর মনুষত্যের বীজকে বুনে দিয়ে যেতে। তখন সেই সন্তানই সমাজের প্রথম সৈনিক হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারবে সামাজিক অসুস্থ রোগগুলির প্রতিরোধে। সেখান থেকেই শুরু হয় সমাজসংস্কারের প্রাথমিক কাজ। সেই সমাজসংস্কারই প্রকৃত এনকাউন্টার। তখন তার জন্য কোন ফটোশেসনের দরকার পরে না আর।

কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত


শ্রী  শুভ্র