দ্য ভিঞ্চির শহর মিলানে
এয়ার-ইন্ডিয়ার জাম্বো বিমানে
দিল্লী ছেড়েছিলাম দুপুর দু’টোয়।
বহু নীচে একে একে পশ্চিম এশিয়ার ধূসর সুলেমান-জাগ্রোস-খিরথর-পন্টিক পর্বত আর কৃষ্ণ সাগর-কাস্পিয়ান সাগরের ঘন নীল জল
ছোঁয়া মানুষের আবছা সংসারগোধুলি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে বিমান। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায়
বারো হাজার মিটার উচ্চতায় শূন্যাঙ্কের প্রায় নব্বই ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে থাকা শীতল
বরফকুচি আর মেঘে মাখা বিমানের এই আকাশপথের সংসারে সহযাত্রীদের কত সুখ-দুঃখের গল্প। জানালার বাইরে
মায়াময় আলোয় বিকেলে থেকে সন্ধের হালকা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে মহাপৃথিবীর
সংসার- “হে মোর সন্ধ্যা যাহা কিছু
ছিল সাথে/ রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি’/ আঁধারের সাথী, তোমার করুণ হাতে/ বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের
রাখী”। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার
পাশাপাশি কবীর-বাল্মীকি-কালিদাস-হাইনরিখ হাইনের কত
দৃশ্যকাব্য যে আকাশের মেঘে-মেঘে
আঁকা হল কতবার।
স্থানীয় সময় সন্ধে সাতটায়
মিলানের মালপেনসা বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করল। সেখান থেকে অত্যাধুনিক বাসে
চেপে এগিয়ে চললাম মিলান শহরের প্রায় কেন্দ্রে থাকা মিলানো চেঁত্রালের দিকে। রাস্তা
যে খুব প্রশস্ত তা নয়, কিন্তু
অতি দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে বাস। কোথাও ভীড় নেই, অপেক্ষা নেই, অপরিচ্ছন্নতা নেই। হেমন্ত সন্ধ্যার নরম আলো
মাখা এক শান্ত শহর বড় শৈল্পিক প্রথায় স্বাগত করছে। চেঁত্রালে থেকে বাকি সামান্য পথ
স্থানীয় ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিওয়ালা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর ইতালিয়ান মিশিয়েই আলাপ
জমান।
হোটেলে ঢুকতেই রিসেপশনের
ছেলেটি পুরোদস্তুর পেশাদারী কেতায় শহরভ্রমণের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিলেন। ঘড়ির কাঁটা
তখন রাত দশটা ছুঁয়েছে। হোটেলেরই লাগোয়া ছিমছাম বাগানটায় একটা মায়াময় রেস্তোরাঁ
রয়েছে। হেমন্তের ঝরা পাতা আর শিশির মাখা একটা খোলা টেবিলে সামান্য পিৎজা আর ইয়োগার্ট
নিয়ে বসতেই ‘সেনর, মে আই জয়েন ইয়্যু’ বলে এক সোনালী চুলের সুন্দরী
সামনে এসে বসলেন। চেহারা দেখে ভেবেছিলাম জার্মান বা স্ক্যান্ডিনেভীয়, পরে দেখলুম পুরোদস্তুর
ইতালীয়। আমি যে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে এসেছি, তাতেই যোগ দিতে এসেছেন।
নৌবিভাগের আবহবিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজকর্ম নিয়ে ভূমধ্যসাগর, উত্তর সাগর আর বাল্টিক সাগরে
ঘুরে বেড়ান। তার ওপর ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব
আর মিথোলজি নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ। আর তেমনই তার গল্প বলার ক্ষমতা। কাছের গীর্জায়
রাত বারোটার ঘন্টা বেজে উঠতেই নিতান্ত অনিচ্ছায় প্রায় হাতজোড় করে তাকে থামালুম ‘ম্যাডাম, কাল সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাকে
বোলজানো যেতে হবে। প্লিজ, অনুমতি
দিন’
‘শ্যিওর, তাহলে পরশু কনফারেন্সে দেখা
হচ্ছে’ হেসে বিদায় নিলেন। শান্ত রাত্রিতে তারপর কোন আওয়াজ নেই। শুধু মাঝে
মাঝে অচিন পরিযায়ী পাখির ডাক আর পবিত্র ক্যাথলিক গীর্জার ঘন্টাধ্বনি।
পরদিন কাকভোরে বেরিয়ে
পড়েছিলাম বোলজানো শহরের উদ্দেশ্যে। সে অন্য শহরের গল্প। সন্ধেয় ফিরে এলাম মিলানে।
শহরের দ্রষ্টব্যস্থলগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কাজেই ভাল রেস্তোরাঁ খুঁজে
ভূমধ্যসাগরীয় কোন ধ্রুপদী খাবার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করাই ভাল। আমার হোটেলের
রিসেপশন থেকে খবর নিয়ে পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তার ধারেই ছোট
রেস্তোরাঁ। কোন চাকচিক্য নেই, বাইরে থেকে চট করে বোঝার উপায় নেই। ভেতরে
শৈল্পিক আভিজাত্যে ঠাসা। মা-মেয়ে
রেস্তোরাঁ চালান। এমন অভ্যর্থনা করলেন যেন কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া মাসী আর
মাসতুতো বোন। তাঁদের ইংরেজিতে দখল ভাল নয়, আমারও ইতালিয়ান তথৈবচ, তবু ভাঙা ভাঙা ইংরেজি-ইতালিয়ান মিশিয়ে বাৎসল্য
রসালাপের অন্ত নেই। আমার গবেষণা কর্ম আর কনফারেন্সের বিষয়ের প্রতি সম্ভ্রম দেখিয়ে
প্রায় বিনা পয়সাতেই পিৎজা খাইয়ে দেন আর কি! আমি বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁদের নিরস্ত করি। ‘কিছু পয়সা তো নিতে হবেই।
পুলস্ত্য ঋষি বলেছেন, তীর্থের
পথে প্রতিগ্রহ করতে নেই। আর জীবনের পথ তীর্থের পথ...’ মহাভারতের গল্প শোনাই আমি। তারপর বলি ‘ধ্রুপদী কোন শৈলীতে পিৎজা
বানিয়ে খাওয়ান বরং। আর কিভাবে বানাচ্ছেন, সেটা কিন্তু আমায় দেখাতে হবে’।
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। উইথ প্লেজার’ তাঁরা আমাকে নিয়ে গেলেন
রান্নাঘরে। বিশাল এক অগ্নিকুন্ড সেখানে বৌদ্ধ কালচক্রের মতো ঘুরছে। ময়দা মাখতে
মাখতে মা আর মেয়ে ছুটে ছুটে দেখিয়ে যান কি কি সবজি দিচ্ছেন। পোমোদোরো (টমেটো), জুচিনো (শশা), ফর্ম্যাজ্জিও (চীজ) আরো কত কি যে দিচ্ছেন, উচ্চারণে ঠিকঠাক ধরতে পারছি
না। অধিকাংশ মশলা চিনতেই পারলাম না। কিন্তু স্বাদ
তার অতুলনীয়। রন্ধনশৈলী, উষ্ণতা নাকি আত্মার আত্মীয়তা – ঠিক কিসের গুণে অমন স্বাদ হয়েছে কে জানে!
পরের দিন শহর ঘুরে দেখা।
ঐতিহ্যবাহী কমলা রঙের ট্রাম। সে ট্রাম নিয়ে শহরবাসীদের গর্বের শেষ নেই। পর্যটকদেরও
উৎসাহের অন্ত নেই। এক কামরার ট্রাম, ভেতরে কাঠের আসন পাতা। ভেতরে ঢুকে বসতেই উপকথার
বৃদ্ধ মানুষের মতো এক ব্যক্তি এসে পুরনো ট্রামের গল্প বলতে শুরু করলেন। তাঁর
নামটিও ক্রিস্তোফার। ১৯২৯ সালে পথে নামা এক ট্রাম এখনো ছুটে চলেছে রাস্তায়। তার
শরীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমার চিহ্ন। রেস্তোরাঁ ট্রাম, ডিস্কো ট্রামের গল্প শুনতে
শুনতে কখন যেন চলে এসেছি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঙুরবাগিচায়। লা বিগ্না দি
লিওনার্দো। এখানে লিওনার্দো নিজের হাতে আঙুর চাষ করতেন, আঙুর থেকে ওয়াইন বানিয়ে সে
ওয়াইন পান করতেন আর মেতে থাকতেন অমর সব সৃষ্টিকর্মে। “আমি ঈশ্বর এবং মানবসভ্যতাকে
রুষ্ট করেছি, কেননা
আমার সৃষ্টি সেই প্রত্যাশিত মানে পৌঁছতে পারে নি” স্বয়ং লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নাকি একথা বলেছিলেন
এখানে বসেই। শিহরিত হই সেসব ভেবে। এখান থেকে সামান্য দূরত্বেই লিওনার্দোর অমর
সৃষ্টি ‘অন্তিম নৈশভোজ’ (দ্য লাস্ট সাপার)। সান্তা মারিয়া দেল গ্রাৎজি
প্রাসাদের ভোজনকক্ষের দেওয়ালে অতিকায় এই শিল্পকর্ম তৈরি করেছিলেন লিওনার্দো। কয়েক
বছর ধরে গবেষণা আর উদ্ভাবনীশক্তির মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত এই ছবি।
প্রায় ৪.৬ মিটার লম্বা আর ৮.৮ মিটার চওড়া এই সুবৃহৎ
ছবিটি আঁকতে লিওনার্দো প্রচলিত ফ্রেস্কো পদ্ধতি ব্যবহার না করে নতুন পদ্ধতিতে
শুষ্ক দেওয়ালে ছবি আঁকেন। নিজের তৈরি রঙ ব্যবহার করেন, যার মধ্যে সামান্য সোনা-রূপো মিশিয়ে দেন। অমর এই
ছবির সামনে এসে দাঁড়ালে সত্যিই যেন নিজের দেবত্বকে অনুভব করা যায়। দর্শনার্থীর ভীড়
রয়েছে, কাজেই ১৫ মিনিটের বেশী
দাঁড়ানো যায় না।
বেরিয়ে এসে স্ফোরজেস্কো
প্রাসাদের দিকে হাঁটতে থাকি। ঐতিহ্য-চিত্রশিল্প-ইতিহাস-পুরাতত্ত্বের খনি এই প্রাসাদ। রত্নগর্ভ এই
প্রাসাদের ভিতর রয়েছে নয়টি অতুলনীয় মিউজিয়াম, একটি লাইব্রেরি এবং আরো অনেক শিল্পকর্ম। কোনটা
ছেড়ে কোনটা দেখি? বাঁশবনে
ডোম কানা অবস্থা। দুর্গাধিপতি স্ফোর্যার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আঁদ্রিয়া মান্তেনিয়ার
অনবদ্য সৃষ্টি ‘ত্রিভালজিও
ম্যাডোনা’, ভিনসেন্তো ফোপা, টিন্টোরেতোর একের পর এক ছবি
দেখছি আর মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। প্রাসাদের ভিতরে একটা ঘরের পুরো ছাদ জুড়ে দ্য
ভিঞ্চির অনন্য চিত্রকর্ম। একটি মানুষের সৃজনীশক্তি এবং উদ্ভাবনীশক্তির নমুনা দেখে
বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি বহুক্ষণ। গাইড এবার তাড়া দিতে থাকেন। অনর্গল বকবক
করতে করতে দ্রুত দেখিয়ে চললেন বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহালয়, পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালা, প্রাচীন শিল্প সংগ্রহশালা, মিশরীয় মিউজিয়াম, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর
শিল্পকীর্তি। লাইব্রেরিতে ঢুকে আবার আটকে গেলাম আমি। দ্য ভিঞ্চির আর মাইকেল
অ্যাঞ্জেলোর হাতের লেখার সামনে দু’মিনিটের জন্য দাঁড়িয়েছি। আবার তাড়া দিলেন গাইড ‘শহরের শরীর জুড়ে বাহান্নখানা
মিউজিয়াম। এক মিউজিয়ামে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। হেমন্তদিনের আলো ফুরিয়ে আসে
তাড়াতাড়ি’।
মহালয়ার ভোরে বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ‘জাগো, তুমি জাগো’ গানটির জন্য পঙ্কজ মল্লিক
যেভাবে হেমন্তকে টেনে এনে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন, সেভাবে গাইডসাহেব আমায় টেনে
নিয়ে মিলানের ক্যাথিড্রালের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। ইতালির বৃহত্তম এবং বিশ্বের
চতুর্থ বৃহত্তম এই চার্চ মিলানের শিল্প-ইতিহাস-ঐশ্বর্য্য সবকিছু নিয়ে সার্বিক অস্তিত্বের
প্রতীক। অস্তমিত রোমান সাম্রাজ্যের শিল্প-স্থাপত্যের শেষ ছোঁয়াটুকু থেকে শুরু করে
রেনেসাঁ যুগের শিল্পীদের হাতের ছোঁয়া- মিলান ক্যাথিড্রালের নির্মাণ বহু শতাব্দীর বহু
মণীষার কাজ। গাইড সুললিত ভাষায় বর্ণনা করে চলেছিলেন ক্যাথিড্রালের সুদীর্ঘ ইতিহাস।
এর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত শিল্পী ও স্থপতির সংখ্যা নাকি কয়েকশোরও বেশী। এই চার্চ
দেখে মার্ক টোয়েনের মুগ্ধতার কথা, অস্কার ওয়াইল্ডের বিরক্তির কথা, শীর্ষে থাকা সোনার ম্যাডোনার
কথা - কিছুই বাকি রাখলেন না। দর্শনার্থীর যথেষ্ট ভীড় রয়েছে, কিন্তু এক পবিত্র নীরবতা সর্বত্র। পবিত্র জল রাখা
রয়েছে এক জায়গায়। এক অন্ধকার কোণে পর্দা ঢাকা ছোট্ট কুঠুরিতে একে একে নিজের পাপ
কবুল করে যাচ্ছেন মানুষেরা। ছাদের সুবিশাল চিত্রকর্মের নীচে যেন নীরব এক মহাসংসার।
গাইড আমার মনের কথা পড়ে
নিয়ে হাসলেন ‘বসতে
চাইলে বেঞ্চে দু’মিনিট
বসতে পারেন। বাট নট মোর দ্যান দ্যাট’। চোখ বন্ধ করে
বসলাম। বহুদূর থেকে যেন এক পবিত্র ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছে ‘শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য/ করুণাঘণ, ধরণীতল
কর কলঙ্কশূন্য’
আবার চলতে চলতে এসে পড়লাম
লিওনার্দোর জগতে। লিওনার্দোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিউজিয়াম। লিওনার্দোর তৈরি প্রায় দু’শোটি যন্ত্রের ইন্টার্যাক্টিভ
প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছে এখানে। একটি মানুষের প্রতিভা আর উদ্ভাবনী শক্তি কতদূর
যেতে পারে, তা
দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই।
বিকেলের আলো তখন ফুরিয়ে
আসছে। গাইড এবার ঘড়ির দিকে তাকালেন ‘চলুন, এবার নাভিগ্লিও গ্র্যান্ডের দিকে যাওয়া যাক।
সন্ধের আলো সবে জ্বলতে শুরু করেছে ওখানে। এইসময়টার সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত’। মিলান শহর থেকে
গাড়িতে মাত্র কুড়ি মিনিটের রাস্তা। খালের দু’ধারে
শৈল্পিকভাবে সাজানো এই বাজারের বয়স প্রায় ৮৫০ বছর। শুধু বাজার বললে ভুল হবে, নানারকম রেস্তোরাঁ, মিউজিক ক্লাব, শিল্পীদের ওয়ার্কশপ, ক্যাফে, প্রত্নবস্তু ও কসমেটিক্সের
দোকান আর আলোকসজ্জায় এক মোহময় জগৎ। এপ্রিলে নাকি নানারকম ফুল আর আলোয় সাজানো থাকে
এ বাজার। আবার জুন মাসে খালের জলে সারি সারি সুসজ্জিত নৌকা ভাসানো হয়। সে সময়ের
সৌন্দর্য্য কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হই। বাজার ঘুরে ঘুরে দেখতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা
আটের ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে, বুঝতে
পারি নি। গাইডের কথায় চমকে উঠলাম ‘সেনর, আমার সময় শেষ। এবার কমপ্লিমেন্টারী ডিনারটা
এখানে সেরে নিতে হবে। তারপর আমার ছুটি’। সে ডিনার
অর্কেস্ট্রা সহযোগে। প্রায় পঞ্চাশ রকমের
কন্টিনেন্টাল খাবারের এক বুফে। নিরামিষ খাবার কম। অনেক বেছে যেসব খাবার নিলাম, সেগুলো চিজ-মাখনের জোরে অতুলনীয়
স্বাদের। মিষ্টি পদগুলো অবশ্য সুবিধের নয়।
সারাদিন ঘোরাঘুরির জেরে
নিজেদের মধ্যে কথা হয় নি। অনেক জোরাজুরিতে গাইড এবার নিজের কথা বলতে শুরু করলেন।
নাম মিরোস্লাব পেট্রোভিচ। ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভ যুদ্ধে যখন বাবা-মাকে হারান তখন মিরোস্লাবের
বয়স মাত্র ছয়। অন্ধকার এক বারুদ-মাখা রক্ত-মাখা কোথায় যে দিনরাত্রি কাটিয়েছেন তার সবটুকু
তাঁর স্মৃতিতে নেই। প্রায় দু’বছর পর ভিখিরিদের মধ্যে থেকে কাকা-কাকিমা মিরোস্লাবকে প্রায়
মির্যাকলের মতো উদ্ধার করেন। কয়েক বছর পরে কাকা-কাকিমারও মৃত্যু হয়। ইতালিতে এসে প্রথমে হোটেল
পরিচারকের কাজ করেন। তারপর আস্তে আস্তে পড়াশুনো করে এখন মিলানের ক্যাথলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিদ্যার পোস্টডক্টরাল গবেষক। অবসর সময়ে গাইডের কাজ করাটা
শুধু তাঁর শখ নয়, গাইডের
কাজ থেকে উপার্জনের পুরোটাই দিয়ে দেন আফ্রিকার গরীব বাচ্চাদের পড়াশুনা এবং
চিকিৎসার জন্য। নিজেই সেই এনজিও চালান। মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাজকর্মের কথা শুনি। কথা
বলতে বলতে মিরোস্লাব এবার ঘড়িতে চোখ রাখেন ‘স্যরি সেনর, এবার উঠতে হবে। কাল সকাল আটটা থেকে আপনার
কনফারেন্স। আর ইয়ে, মানে, ওই কনফারেন্সে আমারও একটা
পেপার আছে’
মিলান ভ্রমণ আমি ওখানেই শেষ
করেছিলাম। বাকি দু’দিন
কনফারেন্সে তাত্ত্বিক কচকচানি।
কিভাবে যাবেনঃ-
মিলানের মালপেনসা বিমানবন্দর
থেকে অত্যাধুনিক বাসে মিলানো চেঁত্রালে কিম্বা ইউরোপের বড় বড় শহরগুলি থেকে রেলপথে
মিলানো চেঁত্রালে হয়ে পৌঁছতে পারেন শহরের হৃদপিন্ড মিলান সিটি সেন্টারে। এর
কাছাকাছি কোন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে নিন। রোমের তুলনায় মিলানের হোটেল একটু
দামীই। আগে থেকে অনলাইন বুকিং করে নিলেই সবচেয়ে ভাল হয়।
আপনার রুচি যেমনই হোক না কেন, মিলানে আপনার দ্রষ্টব্য
অসংখ্য। তাই সময়ের ঠিকঠাক সদ্ব্যবহার জরুরি। শহর-দর্শনের জন্য বাসে তিন রকমের ব্যবস্থা রয়েছে।
রয়েছে ট্রামেরও বিশেষ ব্যবস্থা।
তন্ময় ধর