বাংলা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম ড.শুভ জোয়ারদার। বাজারে যাওয়ার পথে কুমোরপাড়ার শিল্পীদের মূর্তি বানানো দেখে শিল্পী জীবনের শুরু। তারপর গান গাওয়া-লেখা-সুর করা; নাটক লেখা-অভিনয়-নির্দেশনা, ছবি আঁকা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, ছড়া লেখা। এবং শেষ পর্যন্ত পুতুল নাট্যকলায় বিপ্লব ঘটানো। 'বঙ্গপুতুল'এর সৃষ্টি। পুতুলনাট্যকলার একাডেমিক পঠনপাঠনের বঙ্গীয় জনক। ৬০/৭০ দশকের আগুনে রাজনীতির প্রত্যক্ষ বাহক ও পালক। যা কিছু করেছেন, জনগণেশের মুখ চেয়ে, সাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য, মানুষের কল্যাান-মঙ্গলের জন্য ।
-------------------------------
শুভ জোয়ারদার: ধন্যবাদ ’এবং সইকথাকে। আমার কন্যাসমা শীলা বিশ্বাস, এবং ভ্রাতৃসম মৈনাক
সেনগুপ্তকে। সাক্ষাৎকারের নামে আমার করা কিছু কাজের প্রতি ঔৎসুক্য দেখানোর
জন্য।
দেখো, সব শুরুর আগেও তো একটা সলতে পাকানো পর্ব থাকে। সেই পর্বটা শুরু হয় কৈশোরের অনেক আগে, আমারও তাই। যখন সে পারিবারিক চৌহদ্দিতে থাকে, তখন সে যে প্রকৃতির মধ্যে থাকে, তাকে ঘিরে থাকে যে মানবিক পরিমণ্ডল তার একটা বিরাট প্রভাব পড়ে তার ভবিষ্যৎ কাজকর্মে । মানুষ সেই বয়েসে নানারকম মানুষকে মনের মধ্যে জায়গা দিতে শুরু করে। সেই সময় থেকেই ঠিক হয়ে যায় সে কোন পথে যাবে। সেই সময় মানুষ যাদের সঙ্গে interect করে, যে পরিবেশে থাকে, তারই একটা বড়ো প্রভাব পড়ে তার ভবিষ্যৎ জীবনে। শুরুটা একটু বলিঃ
আমার ধারণায় প্রাকৃতিক জ্ঞান বা প্রকৃতজ্ঞান আমাদের মগজে ঢোকে শৈশবে আর
সামাজিক জ্ঞানগুলো আহরিত হয় তারুণ্যে। আমার ক্ষেত্রে অন্তত তেমনটা মনে হয়।
খড়দহের গঙ্গাতটবর্তী গোস্বামীতীর্থ ও জুটমিল সন্নিহিত কালচার আর পরবর্তীতে
সাঁতরাগাছির বিস্তীর্ন গাছগাছালি ঘেরা অর্ধগোলাকার ঝিল-জলাশয়ের প্রায়
কমিউনপ্রথার আবাসনযাপন আমার জীবনে বেশ অনেকটাই প্রভাব ফেলেছে। সুখেদুঃখে
কর্তব্যে উৎসবে বহুমাত্রিক সমবেতযাপনের এক উদাহরণ আমি নিজেই !
এবং সইকথা: বেশ। প্রায় মধ্যচল্লিশের দশকে আপনার জন্ম, খড়দহে। আপনারই কথায় ‘প্রাকৃতিক জ্ঞান’ বা ‘প্রকুত জ্ঞান’এ কেমন ছিলো ছেলেবেলাটা ?
শুভ জোয়ারদার: ১৯৪৪ সালে আমার জন্ম প্রায় নিম্ন মধ্যবিত্ত, পূববাঙলার লালনভূমি কুষ্টিয়া থেকে আসা একটি পরিবারে। আমার জন্ম কিন্তু এপারে এবং সেটা পার্টিশনের আগে। দেশভাগের আগেই আমার পরিবার তাড়া খেয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে খড়দহ অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয় । তাড়া খাওয়ার মূল কারণ ছিল স্বদেশী আন্দোলন । ইংরেজ পুলিশের তাড়ায় আমার পরিবারের পুরুষরা প্রথমে এখানে আসেন । দেশভাগের সময় পর্যন্ত পরিবারের মেয়েরা ওপারেই ছিলেন।
আধা গ্রাম, আধা সহরের একটা মেজাজ ছিল তখন ঐ অঞ্চলে। চটকল, পেপারমিল ছিল। শ্রমিকদের বস্তি, তাদের নিত্যযাপন ছিল। গঙ্গায় ইলিশমাছ
ধরার পরিবেশ ছিল । শ্রমিক আন্দোলন সূত্রে ঘরে একটা বামপন্থী আবহ ছিল। সেইরকম
আবহই প্রথম জীবনে পেয়েছিলাম পারিবারিক জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে।
আমার
শিল্প জীবন শুরু হয় ছবি আঁকা ও মূর্তি গড়ার মাধ্যমে। পরিবারে একটা শিল্প
বাতাবরণ ছিল। দিদিরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। বাবা নাটকে অভিনয় করতেন।
শ্রীপাঠ খড়দহ ছিল চৈতণ্যদেবের প্রত্যক্ষ শিষ্যবর্গের গৃহাশ্রম আরম্ভের ঐতিহাসিক
পুণ্যভূমি। ঠাকুমার কোলে চড়েই থিয়েটার, যাত্রা, পালাকীর্তন ইত্যাদি শুনতাম।
সময়টা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর টালমাটাল অবিশ্বাসের কাল। একসময়
রবীন্দ্রনাথও ছিলেন এই গঙ্গাতটে বেশ কিছুদিন।
এবং সইকথা: আপনি খড়দহ অঞ্চলে বড়ো হয়েছেন। পাশেই পানিহাটি, পানশিলা,সুখচর- অর্থাৎ জলের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল কি? অথবা এই পরিবেশ কি মনে কোন ছবি তৈরি করত, যার ফলে আপনি ছবি আঁকা শুরু করলেন? যে কারণে আপনার শিল্পজীবন শুরু হয়েছিল ছবি আঁকার মাধ্যমে ?
শুভ জোয়ারদার: তোমার সোজা প্রশ্ন যদি এমন হয় যে, আমার ছবি আঁকা শুরু হওয়ার কারণ কী ? --তাহলে বলা যায় , ছবি আঁকা শুরু করার মধ্যে কোন কারণ ছিল না। আবার কারণ ছিলও। যেমন আমি গান শুনতে ভালোবাসি, যাত্রা-নাটক দেখতে ভালোবাসি, একা একা গঙ্গার পাড়ে, বনে বাদাড়ে ঘুরতে ভালোবাসি। আমার মতো বয়সে ছেলেমেয়েরা যেখানে যায়না, একটা কঞ্চি হাতে আমি সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হয়ত মনের মধ্যে যাত্রার দেখে আসা কোন একটা রাজপুত্রের ছবি ছিল। একটা ইমেজারি মনে তৈরি হত। শিশুসুলভ কল্পনাপ্রবণতার একটা জায়গা তো ছিলই ।
আবার মূর্তি গড়া শুরু করা প্রসঙ্গে বলি,- আমাদের পাড়া ছিল গঙ্গার খুব কাছে। বাড়ি থেকে বাজার যাওয়ার মাঝে ছিল কুমোরদের পাড়া। অঢেল এটেলমাটি বেলেমাটি ছিল গঙ্গায়। মা-কাকিমা কেউ হয়তো আমাকে বললেন-- বাজার থেকে লংকা নিয়ে আয়। আমি ঐ কুমোর পাড়া হয়ে বাজারে যেতে যেতে ওখানেই আটকে যেতাম। কুমোররা গঙ্গার এটেল মাটি -বেলে মাটি ছেনে প্রতিমার আঙ্গুল বানাচ্ছে। আমি হাঁ করে দেখছি। কুমোরদের আঙুল চালনায় কীভাবে প্রতিমার আঙুল হয়ে উঠছে। আমি ঐ মূর্তি বানানো দেখতে দেখতে যেন ঐ জগতে ঢুকে পড়তাম। তার মধ্যে ঢুকে পড়া ছিল যেন অভিমন্যুর চক্রব্যূহের মতো। ঢুকে তো পড়েছি, বেরোনোর রাস্তা জানা নেই। --তারপর, গঙ্গা থেকে মাটি তুলে আনা, মূর্তি গড়া শুরু হলো। শৈশবে দেখা কুমোরদের আঙুলের যাদুই আমার মূর্তিনির্মাণের উৎস বলা যায়।
ওদিকে লংকা আনার কথা বেমালুম
ভুলে গেছি! হয়ত দেড়ঘন্টা পরে মেজদাদা এসে কান ধরে বলছেন--" হনুমান, তোমাকে লংকা
আনতে পাঠানো হয়েছে, আর তুমি
এখানে আঙ্গুল বানানো দেখছো ?"
আমি তখন পাঠশালায় পড়তাম। আমাদের মাস্টার মশাই ছিলেন শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি
বিএ পাশ করেছিলেন, কিন্তু চাকরি পাননি। নিজের ছোট্ট ঘরে একটা পাঠশালা
খুলেছিলেন। ওতে যা আয় হত, তা-ই ছিল ওঁর রুজি রোজগার। ভদ্রলোকের চাহিদা বেশি ছিল
না। উনি অবসর সময়ে মূর্তি বানাতেন। ছোট ছোট পুতুল আর সরস্বতীর মূর্তি বানাতেন।
আমি ওঁর কাজ দেখতাম বসে বসে। সব মিলিয়ে বলতে পারি, কুমোর পড়ার শিল্পীরা, আর ঐ
শঙ্কর মাস্টারমশাই ছিলেন আমার একলব্যসুলভ গুরু বা গাইড।
এবং সইকথা: আসলে আমরা চাইছি আপনার অভিজ্ঞতা জেনে নিতে এবং পরের প্রজন্মে তাকে সঞ্চারিত করতে। যাতে আমরা উপকৃত হই । আমাদের শিল্প সমৃদ্ধ হয়।
এর ঠিক পাঁচ বছর পরে আপনি
গানের জগতে আসছেন। মূর্তি, ছবির পর্ব পার করে গানের জগতে আসা। এসব দেখে আমাদের
মতো গুণমুগ্ধদের মনে হয়, আপনি আসলে শিল্পের সবকটি বিষয়কে আস্বাদন করতে চাইছেন।
গানেও আবার বহুমুখী বিস্তার। অনেকে সারাজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েই থাকেন। আপনি
লোকগান, পালা গান, হাসিরগান , যাত্রার গান, নাটকের গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত,
গণসঙ্গীত সব কিছুই চর্চা করছেন। সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বা পীযুষকান্তি
সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন। এবারে আমরা জানতে চাই, গানের জগতে আপনি কীভাবে এলেন?
আমরা আগে খানিকটা শুনেছি, এবারে ফর্মালি গানের জগতে আসার বিষয়টি জানতে চাই। এর
আগে আপনার সৃষ্টিরা কথা বলত না, এবার থেকে আপনি নতুন একটা ফর্মে এলেন। এটা একটু
বলুন।
শুভ জোয়ারদার: গানের ক্ষেত্রেও শুরুর আগে একটা সলতে পাকানো পর্ব ছিল। সেই সময় থিয়েটার, পালার খুব জনপ্রিয়তা ছিল। গান ছাড়া নাটক ভাবা যেত না। গণনাট্যের নাটকেও প্রচুর গান ছিল। সেই সময় বিশাল মঞ্চ বেঁধে থিয়েটার হত। জেলার বিখ্যাত ‘প্যারাগন’ মাঠে বিশাল মঞ্চ বেঁধে 'হাওড়া সমাজ'এর ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালা আমি দেখেছি। কেদার রায়, চাঁদ সদাগর, রাহুমুক্ত প্রভৃতি পালা হত গণনাট্য সংঘে।
আবার
যাত্রায়ও প্রচুর গান থাকত। আমাদের খড়দহে শ্যামসুন্দরের মাঠে রাসের মেলা বসত।
মেলায় যাত্রাগান হত। আর মাইকে সারাদিন বম্বে ফিল্মের হিন্দি গান বাজতো। কে.এল.
সায়গল, নূরজাহান, সি এইচ আত্মা ,পঙ্কজ মল্লিক, সামসাদ বেগম-- এঁদের গান শুনতাম সারাদিন। রফি বা মুকেশ তখন ওঠে নি। আমাকে যদি বলতে বলো, আমি
রকের ছেলের মতো হিন্দি গানের নাড়িনক্ষত্র বলতে পারব।
এবং সইকথা: অর্থাৎ, ছবি যেমন দেখে শিখছেন, গানও তেমনি শুনে শিখছেন।
শুভ জোয়ারদার: তার মানে-- মনের মধ্যে যাহা ঢুকিতেছে তাহা স্টোর হইতেছে। sedimentation
এর পর্ব চলছে তখন।
এবং সইকথা: আবার সুযোগ পেলেই তাহা প্রকাশও পাইতেছে!
শুভ জোয়ারদার: হ্যাঁ, প্রকাশ পাওয়ার জন্য নানা রকম চর্চাও চলছিল।
এবং সইকথা: একটা মজার জিনিস দেখুন। প্রথমে আপনি ছবি আঁকছেন। two dimension, তারপর মূর্তি বানাচ্ছেন-- 3D, তারপরে গান গাইছেন, মানে ভাষা পাচ্ছে কাজ। তারপরে সিনেমা, অর্থাৎ move করছে। -- তাহলে আপনার যাত্রাপথকে এলোমেলো বলা যায়না, বরং একটা নিয়মে ক্রমশ উত্তরণ ঘটছে। আপনার অজান্তেই হয়তো বা একটা অভিমুখ তৈরি হচ্ছে আর আপনি যে কাজগুলি করছেন তাতে একটা স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল। ছবি আঁকছেন দাদাকে দেখে, মূর্তি গড়ছেন আপনার পাঠশালার মাস্টামশাই ও কুমোরপাড়ার কুমোরদের আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুল বানানো দেখে। গান শিখছেন রেকর্ডের গান শুনে বা মাইক্রোফোনহীন বিবেকের ভিস্যুয়াল গান শুনে।
শুভ জোয়ারদার: ঐ সময় খুব পছন্দের গান ছিল সুধীরলাল চক্রবর্তীর "মধুর আমার মায়ের হাসি" গানটি।
আমি খুব ভালো কপিমাস্টার ছিলাম। যা শুনতাম; রেডিওর গান, কলেরগান শুনেই সুর লাগাতে পারতাম। ঐসময় দিদিরা, দিদির বন্ধুরা দেখলেই আমাকে জড়িয়ে ধরত, হাত
ধরে টেনে নিয়ে যেত, গান গাইতে হবে। তাহলেই কিছু পাওনা হবে। কুলের আচার, পেয়ারা,
চাটনি । "মধুর আমার মায়ের হাসি", " আমার সাধ না মিটিল" - এই গানগুলি গাইতাম। সাত-আট বছর বয়েসেই ওগুলি শুরু হয়েছিল। গান না শিখে, যাত্রার গান শুনেই গান গাইতাম-- 'ওরে গাণ্ডীবে দে না টংকার'…(.বলতে বলতে গাইতে শুরু করলেন)
এবং সইকথা: তার মানে, গানের ক্ষেত্রে
'কান' আগে তৈরি হয়েছে বলা যায়।
শুভ জোয়ারদার: ছবি আঁকা, হাতের লেখা, এগুলো যেমন অনুকৃতি, শুনে শুনে গানে নোট লাগানোও একটা
অনুকৃতি। এরপরেই, গান লেখা এবং গাওয়া শুরু করি। আমার এক ক্লাস নিচে একটি ছেলে
ছিল। সে ভট্টাচার্যবাড়ির বড়োলোকের ছেলে, ডাকনাম ছিল-- কান্তু: খেলাধুলো
সাঁতারে বেশ দড়ো ছিলো আর অর্গান বাজাতো। সে আমার সহকারী। দুজনে মিলে সুর
তুলতাম। তারপর নাটকের গান লিখে বসালাম, গানের সুর দিলাম। নাটকে সে গান প্রয়োগও
হয়েছে।
এবং সইকথা: এরপরেই আপনি অনেকটা organised হচ্ছেন। সচেতন ভাবে সরে যাচ্ছেন লোকসংস্কৃতির
জগতে। একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করছেন-- ইনস্টিটিউট অব ফোক কালচার। আপনি পি এইচ
ডি'ও করছেন লোক সংস্কৃতি/লোকনাটক নিয়ে। আপনার এই গবেষণার ক্ষেত্রটা কী ছিল
?
শুভ জোয়ারদার: লোকনাট্য। তবে সেটা অনেক পরে। সত্তরের দশকে। এটা প্রাথমিক ভাবে কোন ফর্মাল
গবেষণা ছিল না।
অডিটের কাজে আমার সুযোগ
হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা জেলায় ২/৩ মাস করে থেকে কাজ করার । সারাদিন
অডিটপেন্সিল হাতে কাজ করার পর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। কোথায় কোন লোকশিল্পী
আছেন, কোথায় লিটল ম্যাগাজিনের কাজ হচ্ছে? কে ভাওয়াইয়া গাইছে দোতারা বাজিয়ে, এসব
খুঁজতাম।
এবং সইকথা: তার মানে আপনি নিজে যেমন সাধক, তেমনি সবখানেই সাধক খুঁজছেন।
শুভ জোয়ারদার: সাধক কিনা জানি না, তবে অডিটের কাজ করতে করতেই প্রতিদিন, সেদিনকার
সান্ধ্যঅভিযানের নকশা তৈরি করে ফেলতাম। অফিসের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।
গ্রামে-গঞ্জের প্রচুর নাট্যকর্মী, গায়ক, লেখককে আমি সরাসরি চিনতাম। ফোনে বা
কলকাতায় বসে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়নি কোনওদিন।
এই লোকসংস্কৃতি করতে
করতেই ছড়া লেখার একটা চেষ্টা শুরু হয়। জেলায় জেলায় ঘুরছি, নানা ক্ষেত্রের মানুষ
ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি।
এই কাজগুলি যখন করছি তখন একদিন ধরা পড়ে গেলাম 'যুগান্তরের' সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরির হাতে। খেপলা জালে যেমন মাছ
ধরা পড়ে তেমনি। উনি একদিন ডেকে বললেন, কী করছ ? যা করছ, তা লেখ। তা, আমি বললাম,
আমি যা লিখব তা কি কাগজে বেরোবে ? উনি বললেন, তোমাকে লিখতে বলেছি, লিখবে। কী
বেরোবে, কতটা বেরোবে, তা আমি দেখব। তারপরে আমি যখন দুইকিস্তিতে সারা
উত্তরবঙ্গের লোকনাট্যের দলিলকর্মটি ওঁকে দিলাম, উনি বললেন-- এতো পি এইচ ডি হয়ে
গেছে। আমি একটু ঠিকঠাক করে দেব। তারপরে রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে।
এবং সইকথা: অর্থাৎ যাত্রার মতোই কারো নির্দেশে নয়, মনের আনন্দে কাজ করেছেন।
শুভ জোয়ারদার: কিন্তু আমরা যেহেতু শিক্ষিত লোক, যে কাজই করব, তা'তো একটা সিস্টেমে পড়বে, একটা
method-এই কাজটা হবে, তাই-ই হল। উনি সে কাজ দেখার পরে বললেন, এতো তোমার একটা
গবেষণাপত্র হয়ে গেছে, আর একটু ঘষে মেজে নাও।
আর যখনই কোন কাগজের
সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়, তখন বেশ সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন National School
of Dramaতে আমি গেছি। একটা কোর্স করেছি নাটকের উপর।
কাগজের একটা
Recommendation থাকে। কাগজের পক্ষ থেকে তারা কোন না কোন সম্মেলন, ফেস্টিভ্যালে
একজনকে পাঠায়, গাইড করে । ঐরকম যেখানে গেছি, খরচাপাতি তারাই বহন করেছে। এই
সুযোগটা আমি পেয়েছি।
এবং সইকথা: ঐ পত্রিকার অলংকরণটাও বোধ হয় আপনি করতেন।
শুভ জোয়ারদার: হ্যাঁ, বিশেষ বিশেষ সংখ্যার আর নাটুকে ছড়ার কলমটা, ঐ অতনু আজকাল যেটা
নিয়মিত লেখে, ওটা আমারই পরিকল্পনা। আমি যুগান্তরে প্রকাশিতব্য অনেক সাক্ষাৎকার, লেখা ইত্যাদি
প্রথমদিকে অবলীলায় আননায়ুধে প্রকাশের জন্য স্বপনের হাতে তুলে দিয়েছি !
এবং সইকথা: অতনু
বর্মণ আপনার ছড়া খুব পছন্দ করেন, আপনাকে গুরু হিসাবে মানেন। আমরা জানি
'যুগান্তরের' সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরির সঙ্গে আপনার দারুন সখ্যতা। এখন প্রশ্ন হল
ছড়া লেখার সূত্রে অমিতাভবাবুর সঙ্গে পরিচয়, না ছড়া লেখা শুরুই হয়েছে অমিতাভবাবুর সঙ্গ সূত্রে ?
শুভ জোয়ারদার: আমার গ্রাজুয়েশন ১৯৬৫ সালে। ঐ বছরই এজি বেঙ্গলে অডিটর হিসাবে ঢুকি। পরে এম.এ. করি কাজ করতে করতেই। আমাদের অফিসটা বিচিত্র
জায়গা। কবি ,ছড়াকার সাহিত্যিক, সম্পাদক সবাই আমার সহকর্মী। আন্তর্জাতিক মানের
কুস্তিগীর, টেবিল টেনিস প্লেয়ার আমার সহকর্মী। ওখানে আমার কনিষ্ঠ এক কবি কমল
বল একদিন বললেন, -- শুভদা, আপনি
পদ্য লেখেন, গান লেখেন,নাটক করেন, আপনার ছন্দজ্ঞান তো দারুন। আপনি ছড়া লিখুন।
ছড়া কিন্ত
আলাদা জিনিস। পদ্য বা কবিতা নয়। এমনকি সুকুমার রায়ের সব ছড়াও খাটি ছড়া নয়। আপনি
কার্টুন আঁকেন তো, রাজনীতি ভালো বোঝেন। তাই স্যাটায়ারটা আপনি ভালো ধরতে পারেন।
আপনার ছড়া হবে- কেননা, আপনার কাজের সঙ্গে ছড়ার একটা যোগ আছে। মনে রাখবেন, ছড়া
গভীর কিন্তু গম্ভীর বিষয় নয়। ব্যাঙ্গাত্মক।
আমি একটু দ্বিধা করে
একটা লিখেও ফেললাম। সেই প্রথম ছড়াটি হলঃ-
বৈঁচির
পিসে মোর নাম তার চিনিবাস
কাল হল
কিনে এক লড়ঝড়ে মিনিবাস।
লিখেই ওকে দেখালাম। রাজনীতি সচেতনতা, সমকালীন প্রাসঙ্গিক বিষয়, তীক্ষ্ণ কৌতূকস্নিগ্ধ দৃষ্টিভঙ্গী, টইটম্বুর ছন্দজ্ঞান আর কমল বলের পরামর্শ আমার ছড়া সৃষ্টির অনুঘটক
নিশ্চয়। সত্যিটা হলো, ছড়াই আমাকে অমিতদার কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো।
পরের দিনই
গেলাম। উনি আমাকে বললেন, আপনি আমার এখানে গদ্য লিখুন। আমি তো অবাক। বললাম, কখনও
গদ্য লিখিনি। আমি কি পারবো?
উনি বললেন,
পারবেন। আমি বলছি লিখুন। সময়টা ঠিক পুজোর মুখোমুখি। উনি আমাকে পূজোমন্ডপ কী কী
দিয়ে গড়া হয়, সেগুলি কোথা থেকে আসে, সে সব নিয়ে ফিচার লিখতে বললেন।
আমি "মন্ডপের
পিছনে" লেখাটা জমা দিলাম, দেখলাম যুগান্তরের মতো পত্রিকায় প্রথম পাতার প্রথম
কলামে তা ছাপা হল, বেশিটা অংশ। বাকি অংশ গেল পাঁচের পাতায়। ছোটবেলা থেকে অনেক
কিছু ভেবেছি, নায়ক হবো, গায়ক হবো, গীতিকার হবো, নাটক লিখবো, কিন্ত সাংবাদিক হবো
কখনও ভাবিনি। সাংবাদিকতা কী? খায় না,মাথায় মাখে, আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত
পরিবারের ফরম্যাটে তা কখনই ছিল না । কিন্ত না চাইলে কি হবে? একদিন সকালে উঠে দেখলাম আমি সাংবাদিক হয়ে গেছি। কি ভাবে যে সেটা হলো, ভাবলে এখন
অবাক হয়ে যাই !
এরপর
অমিতাভদা আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন। ড্রামা এ্যাপ্রিশিয়েশনের কোর্স করতে
পাঠিয়েছেন, ইন্টারন্যাশানাল ডান্স এন্ড থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে আমাকে যুগান্তরের
প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন। সেখানে পৃথিবীখ্যাত সব শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে।
সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। রিচার্ড শ্যেগনার, জন মার্টিন, ইউজিন বার্বা, অমল পালেকর,
মোহন আগাসে, চতুরঙ্গ মন্ত্রীশাস্ত্রী, মল্লিকা সারাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি। এটা
৮০দশকের গোড়ার কথা।
আমার মতো খড়দা শিবনাথ হাইস্কুলের একটা সাধারণ ছেলে, এমন চাঁদের হাটে, আন্তর্জাতিক একটা অনুষ্ঠান কভার করছে, ভাবা যায় না!
এবং সইকথা: এবারে
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি তো নাটক লিখেছেন, নাটকের গান লিখেছেন, সুর
দিয়েছেন, কখনও নাটকের নির্দেশনা করেছেন ?
শুভ জোয়ারদার: আমার প্রথম নির্দেশনা ক্লাস এইটে পড়তে পড়তে। সুকুমার রায়ের ‘ঝালাপালা’। পরে ৬০ এর দশকে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। আমি বড়োদের থেকে ছোটদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি বেশি। দুটো কারণে। একঃ ছোটরা মাটির তাল। ডিজাইন অনুযায়ী ভাঙাগড়া যায়। দুইঃ এরা খুব অনুগত, ভুলে যায় না। তাই এদের সঙ্গেই আমার কাজের সংখ্যা বেশি। প্রায় ৩০টির মতো।
'থিয়েটার ওয়ার্কশপ' এবং
‘থিয়েটার কমিউন' নামে দুটো দলের আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলাম। বিভাস
চক্রবর্তীসহ আমার অফিসে তখন একাধিক ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপে’র সদস্য ছিলো। ‘কমিউনে
গিয়েছিলাম সহকর্মী, বন্ধু, নাট্যকার তরুণ ঘটকের হাত ধরে। অভিনয়ও করেছি প্রথম
দুটি প্রযোজনা ‘বিভুর বাঘ’ ও ‘পরবর্তী বিমান আক্রমণ’ নাটকে।
এবং সইকথা: খড়দা'তে প্রায় একই সময়ে থিয়েটার কাজ করতেন প্রবীর গুহ। তাঁর সঙ্গে আপনার
যোগাযোগ ছিল ?
১৯৭৬ সালে আমাদের
পালা ’সূর্য ওঠার দিন’ পঃ বঙ্গ
নাট্য উৎসবের শ্রেষ্ঠ পালা বিবেচিত হয়। আমাদের সঙ্গে ছিলেন পবিত্র
বন্দ্যোপাধ্যয়, শঙ্কর নন্দী, হারাধন মান্না, কল্যাণ মুখোপাধ্যায়, সুগত
মুখোপাধ্যায়ের মতো সেই সময়ের থিয়েটারের বাঘা বাঘা লোকেরা। লিলিদির ছোটবোন ইতি
চক্রবর্তীকে আমরা পেশাদারী অভিনেত্রী হিসাবে সই করিয়েছিলাম।
আমাদের দল একবছর
চলেছিল। আমরা নাটকের উৎকর্ষে জয়ী হলেও পুঁজির অভাবে হেরে গিয়ে দল তুলে দিতে
বাধ্য হই। তবে এই অভিজ্ঞতাটাই আমার লাখটাকার পুঁজি !
এবং সইকথা: এর পর
দেখছি আপনি তথ্যচিত্রে কাজ করছেন, চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্য লেখার কাজ করছেন।
শিল্পের প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজ করে চলচ্চিত্রে বা সিনেমায় এলেন। এখানে প্রশ্ন
হল, সিনেমায় আসা কীভাবে, এবং তাঁর অভিজ্ঞতাই বা কেমন ?
শুভ জোয়ারদার: না, সিনেমা যাকে বলে ( কাহিনি চিত্র) তাতে আমি আসিনি। একটা স্ক্রিপ্ট
পেয়েছিলাম, যেটাকে নাটক করা গেল না বলে তথ্যচিত্র বানালাম।
সেই সময়
আমার পরিচয় হয় একজন আলুর ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বললেন, স্ক্রিপ্ট পছন্দ হলে
তিনি টাকা দেবেন। শুনে আমি বললাম, আপনাদের আমি বিশ্বাস করি না। লিখে নিন, স্ক্রিপ্ট আপনার পছন্দ হবে না। পরে
একটা ভালো স্ক্রিপ্ট পেয়ে ওঁর কাছে যাই। উনি বললেন, এই মুহুর্তে সত্যিই আমার
আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আলুর ব্যবসা হল ফাটকার খেলা। এখন আমি মাইনাসে রান
করছি। যাই হোক স্ক্রিপ্ট ওঁর
পছন্দ হল। আর্থিক অনটনের মধ্যেও উনি টাকা দিতে রাজি হলেন। বললেন, কত লাগবে
বলুন। আমি দশ লাখ টাকা চেয়েছিলাম। তবে আটলাখেই কাজ উঠে যায়। জলের নিচে কয়েকটা
শট ছিল বলে খরচটা একটু বেড়ে গিয়েছিল। স্ক্রিপ্টটা ছিল স্বাক্ষরতার উপরে।
"টিপসই" নামের ছবিটা বানালাম। আন্তর্জাতিক পুরস্কারও একটা পেল। আমার থেকেও
প্রযোজকের আনন্দ হয়েছিল বেশি ! তারপরে আর একটা ডকুমেন্টারি করি, আমাদের এ.জি.
অফিসের দেড়শ বছর উপলক্ষ্যে। প্রযোজক ছিল এজি ত্রিপুরা।
আমার চলচ্চিত্রে
আসার, সিনেমা তৈরির কারণ যদি বলি, তবে বলব, প্রয়োজনের দাবি মেনে আমাকে
চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে হয়েছে।
এবং সইকথা: এরপরেই
আমরা পুতুল নাচের প্রসঙ্গে আসব। আমরা আপনার কাছেই শুনেছি মানুষের সভ্যতার গোড়া
থেকেই পুতুলের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। গাছতলার ‘আখড়া’তে বলেছিলেন, মনে আছে?
আপনিতো পুতুল নাচে নতুন একটা
ধারার প্রবর্তন করেছেন।
শুভ জোয়ারদার: না, নতুন ধারা নয়, আমি নতুন রকমের পুতুল বানিয়েছি। নতুন পদ্ধতিতে তৈরি
পুতুলের নাচেও অভিনবত্ব এসেছে। নতুন একটা উপকরণ বলতে পারো পুতুল নাটকে। নতুন
টেকনিকের প্রয়োগ ঘটছে।
এখানে তোমার
প্রশ্নটি কী ?
এবং সইকথা: প্রশ্নটা হল, এমন একটা পুরনো লোকশিল্প যা সারা ভারতে জনপ্রিয়, আপনি তাতে নতুন মাত্রা যোগ করলেন, তাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে, সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেন। আপনার মনে হয়না, এমন একটা ঐতিহ্যবাহী শক্তিশালী, বিনোদনমূলক এবং একই সঙ্গে শিক্ষামূলক একটি মাধ্যম বর্তমানে সরকারি এবং বেসরকারি দুই তরফ থেকেই অবহেলিত?
শুভ জোয়ারদার: না, একদমই না। যদি অবহেলিত হত তাহলে সরকার সারা দেশে পুতুলনাচের খাতে
কয়েক হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর অনুদান বন্টন করত না।
আসলে তোমার
প্রশ্নে একটা স্ববিরোধিতা আছে, যেটা আমি ধরতে পারছি।
এবং সইকথা : তাহলে
তো বলতে হয় আপনি যে খাটনি করছেন, সেটা একরকম লড়াই। নতুন রকমের পুতুল বানাচ্ছেন,
নতুন নতুন ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছেন। সেটা তো তাহলে এক ধরনের অন্য মাত্রা পাচ্ছে।
যার পেছনে হয়ত রাজনৈতিক মানুষ শুভ জোয়ারদারের রাজনৈতিক সচেতনতা কাজ করছে।
শুভ জোয়ারদার: এটা স্পস্ট যে, আমি যা যা করেছি, সেখানে রাজনৈতিক সচেতনতা, মানুষকে
জাগিয়ে তোলার একটা বিষয় থেকেই গেছে।
এবং সইকথা: এবারে
প্রশ্ন হল হল -- শিল্পের প্রায় সব কটি ক্ষেত্র (ছবি, ছড়া, নাটক,পালাগান,
চলচ্চিত্র) চষে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে নিবিষ্ট হলেন কেন ? এর পিছনে কোন
রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কাজ করেছে ?
আবার একটা জিনিস
দেখো, জনসচেতনতায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে পুতুল নাচ। এটা
পণ্ডিতরা মনে করেন। আমার উদ্দেশ্য হল জনগণের মধ্যে পৌঁছনোর। তাই রাজনৈতিক মানুষ হিসাবে মানুষের কাছে পৌঁছনোর হাতিয়ার হিসাবে আমি এটাকে
ব্যবহার করেছি। এই প্রসঙ্গে জর্জ বার্নার্ড শ’র একটি মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উনি বলেছেন, ‘Our theatre
and cinemas will disappear some day with nothing left but the puppet
theatre’!
নাটক থেকে পুতুল নাটকে shift
করে পুতুলনাচে আমি আমূল
পরিবর্তন ঘটিয়েছি। আগে পুতুল নাচ আটকে ছিল একটা জায়গায়। পুতুলের আকার ছিল বড়ো,
ভারী, যন্ত্রপাতি বহুল। রাশিয়ান পুতুলের মতো। আমি সেখানে পুতুলের জবরজং চেহারা,
পুরো ঝেড়ে ফেলে মেদহীন করেছি। ১৫ কেজির পুতুলকে ছাঁটতে ছাঁটতে আমি এখন ৫০০
গ্রাম করেছি। প্রচলিত পুতুলের যন্ত্রাংশ বানানো এবং চালানো বেশ শক্ত। আমি সেই
যন্ত্রপাতি বাদ দিয়েছি। পুতুল চালানোর নতুন কৌশল এনেছি। এতে পুতুল চালানো সহজ
হয়েছে ও ব্যয়ভার কমেছে। আমি জেলায় জেলায় পুতুল নাচের যে দল করেছি, তাতে নতুন
নতুন ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সাধারণ উপকরণ দিয়ে পুতুল তৈরি ও যন্ত্রপাতি
বর্জিত পুতুল হওয়ায় সাধারণ ছেলেমেয়েরা সহজেই এটা শিখতে পারছে। একটু common
sense বা নাটকের জ্ঞান থাকলেই তারা মাত্র সাত/আট দিনেই এটা শিখতে পারছে। এখন
আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, এই ক’ দিনের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমেই তোমাদের দুজনকে
আমি প্রফেশনাল পুতুলনাচের কর্মী বানিয়ে দিতে পারব। এতটাই সরল করেছি পুতুলনাচকে।
এখন দশ বারো বছরের একটা বাচ্চাও আমার পুতুল চালাতে পারে। এভাবে আমি যাদের তৈরি
করেছি বা করছি, তারা আমার এই কাজকে প্রসারিত করছে।
এই মুহূর্তে ‘বঙ্গপুতুল’ এত সরল ও সহজসাধ্য হয়েছে যে রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া আমার পুতুল পদ্ধতি অর্থাৎ বঙ্গপুতুলকে গ্রহণ করেছে। পুতুলের তো পেটেন্ট নেওয়া যায়না, গেলে আমার পুতুলনির্মাণ ও চালনা পদ্ধতি হয়ত পেটেন্ট পেত।
এবারে বলছি, নাটক যদি জনসচেতনতার মাধ্যম হয়, তাহলে পুতুল নাটক সেই কাজে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। আগে আমি যে রাজনীতি করতাম তা ছিল সংকীর্ণ রাজনীতি, পার্টি কমরেডদের জন্য রাজনীতি। কিন্তু পুতুল নাটকের মাধ্যমে আমি পৌঁছে যাই Mass এর মধ্যে। আমার বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র জনতার মধ্যে, যাত্রায় যেটা করা যায়নি, করতে পারিনি, সেটা এই ‘বঙ্গপুতুলে’র দ্বারা সম্ভব করেছি।
আমি
চাকদা'তে শুধু মেয়েদের নিয়ে একটা দল করেছি। তারা মেয়েদের সমস্যা নিয়ে নাটক
করছে। women empowerment এর কাজ করছে তারা।
দুই, সারা দেশে পুতুল নাটকের পঠন- পাঠনের কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই কেন
?
এবং সইকথা: আসলে এই জায়গা থেকেই আমি জানতে চাইছিলাম যে সরকারি স্তরে এত অবহেলিত কেন পুতুল
নাচ? এত বড়ো একটা গণমাধ্যমের একটা নিজস্ব মঞ্চ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠক্রম
নেই? এটা নিশ্চয়ই একটা অবহেলা।
শুভ জোয়ারদার: শুধু সরকারি স্তর কেন ? বেসরকারি স্তরেও তো হতে পারে। বেসরকারি বি.এড.
কলেজ, মেডিকেল কলেজ হতে পারে,
আর পুতুল নাটকের পাঠক্রম, প্রশিক্ষণ হতে পারে না !
তবে
তোমাদেরকে জানাই পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা কলেজের বাংলা বিভাগে আমরা একটা
ব্যাবস্থা করেছি পুতুলনাচ পঠনপাঠনের। ইউ জি সির অনুমোদন সাপেক্ষেই এটা হয়েছে।
আমরা উদ্বোধন করে আসার পরে দুবছর হয়ে গেল পড়াশোনা চলছে। পাঠক্রম কী হবে তারও একটা
রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছি। ইউ জিসির সঙ্গে কথা বলে "বঙ্গদেশের পুতুল
নাট্যকলা" নামের একটি
পাঠ্যপুস্তকেরও প্রকাশনা করেছি।
আমরাই পড়াচ্ছি।
এই
হচ্ছে পুতুল নাচের সাধারণ একটা ছবি। তবে একুটু বলতে পারি, থিয়েটারকর্মী হিসাবে
একটা নাটক করে টাকা পেলাম আর মালা পরে চলে এলাম , এটা পুতুলনাটক নয়।
পুতুলনাটকের বিরাট সম্ভাবনা আছে। জনমানসের সেবায় একে লাগাতে পারলে বিরাট কিছু
করা সম্ভব। বিদেশে এখন পুতুল নাটককে ব্যবহার করা হচ্ছে মানব সভ্যতার উন্নয়নের
জন্য। আমাদের দেশে সম্রাট অশোকের আমল থেকে, চৈতণ্যদেবের আমল থেকে পুতুলনাচ
প্রচলিত। সভ্যতার জন্মের সময় থেকেই পুতুলনাটক ছিল মানুষের পাশে। মানুষ যখন
ঘুমিয়ে থাকে, তখন পুতুল মানুষের ধান পাহারা দেয়। তাই এমন একটা মাধ্যমকে অবহেলা তো করবেনই না, ব্যবহার করুন আমাদের সামাজিক,
অর্থনৈতিক উন্নয়নে। আমরা পুতুল
নাটকে বিদেশের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। বিদেশে শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়,
মানুষের সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যও পুতুলনাটকের চর্চা করা হয়। আমরাও এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানব সভ্যতার ভিতকে আরও শক্ত করতে পারি। তার
জন্য আমাদেরও পুতুলনাচকে পশ্চিমের অনুসরণে সমতুল মানে নিয়ে যেতে হবে।
এবং সইকথা:
সাধারণ কৌতূহল থেকে একটা প্রশ্ন শুভদা। যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন। মজার
কথা হলো, এখানে উপস্থিত আমরা তিনজনেই সংস্কৃতিকর্মীও বটে, আবার সরকারিকর্মী তো
বটেই। আপনার সরকারিকর্ম কখনো আপনার সংস্কৃতিকর্ম তথা সমাজচর্চায় প্রতিবন্ধকতার
পাঁচিল তুলেছে? কোনো অভিজ্ঞতা?
শুভ জোয়ারদার: সরকার তো একটা যন্ত্র ! আর সব যন্ত্রেই প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হয়। আমার
ক্ষেত্রেও হয়েছে। প্রথমদিকে, মালদহে আমি অডিটের ডিউটি থেকে বিরত থেকে
কিংবদন্তীসম পুতুলনাট্য ব্যক্তিত্ব সুরেশ দত্তের সফরসঙ্গী হিসাবে দক্ষিণ ২৪
পরগণার প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে গবেষণাকর্মে যাওয়ার জন্য যে অফিস আমাকে শোকজ
করেছিলো, শেষের দিকে সেই অফিসের প্রধান, স্বয়ং এজি সাহেবই আবার চেম্বারে ডেকে
হাত ধরে অনুরোধ করেন, অডিটের গুডগভর্ণেস বিষয়ে একটা পুতুল-চলচ্চিত্র বানাতে !
ফলে, অবসরের মুখে আমি এতটাই স্বাধীনতা ও সম্মান পেয়েছি যে, একজন সাধারণকর্মী
হিসাবে তা হয়তো আমার পাওয়ার কথা ছিল না। তবে এতাদৃশ ঘটনা অবশ্যই
ব্যতিক্রমী।
এবং সইকথা: আপনাকে
সইকথার পক্ষথেকে ধন্যবাদ। আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য। আপনি ভরতের
নাট্যশাস্ত্রের অনুবাদ করেছেন, যদিও বহুলসংখ্যক মানুষের কাছে এখনও তা পৌঁছায়নি।
বেশ কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য নাটকটাই এখন থমকে আছে, আপনার অনুবাদ কর্মটিও
সর্বস্তরে পৌঁছায়নি। তবে আপনার এই কাজ থেকে যাবে, যেমন থেকে যাবে আপনার তৈরি
বঙ্গপুতুলের নতুন প্রকরণটি। আমরা আশা করি আপনি দীর্ঘদিন এই কাজ চালিয়ে যাবেন,
পুতুলনাটকও উত্তরোত্তর উন্নত হবে। আপনি আমাদের পথ দেখান, আমরা আপনার দ্বারা
সমৃদ্ধ হই।
শুভ জোয়ারদার:তোমাদেরও ধন্যবাদ। শীলার পত্রিকা, (মৈনাককে) তোমার নাট্যচর্চা আরও উন্নত হোক। জীবনে অনেক অনেক বুমের মুখোমুখি হয়েছি, তবে এতটা নিরাপদবোধ আগে কখনও হয় নি। এর জন্যও তোমাদের দুজনকে আর একবার ধন্যবাদ ! ভালো থেকো তোমরা।
বঙ্গদেশের পুতুল নাট্যকলা ৹ ROOTS Publication.
ভরতের নাট্যশাস্ত্র (অনুবাদ) ৹ যাপন প্রকাশনী
ছড়া কন ফিউশন ৹ সুচেতনা প্রকাশনী
-----------------------------------
1 মন্তব্যসমূহ
শ্রদ্ধেয় শিল্পীকে অশেষ শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আলোচনার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুনসইকথাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও একরাশ শুভকামনা।