প্রতিদিন একটা গল্প,এক বোতল মদ ও সাদাত হসন মন্টো ....
একবার মন্টো সাহেবের (উর্দুর মহান গল্পকার সাদাত হসন) এক বন্ধু মন্টো সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন .."আপনি উপন্যাস লেখেন না কেন?" মন্টো উত্তর দেন .."প্রতিদিন আমার মদ খাওয়ার জন্য টাকা চায়,তাই প্রতিদিন গল্প লিখি,কিছু টাকা পাই। তাহলে উপন্যাস কেন লিখতে যাবো?"
এটা বিচিত্র অন্তর্বিরোধ যে মন্টো টাকার জন্য গল্প লিখতেন,যদিও তাঁর কাছে টাকার কোনো গুরুত্ব ছিলো না। নিত্যদিনের প্রয়োজনের জন্য তাঁর টাকার প্রয়োজন ছিলো,কিন্তু আত্মসম্মান হারিয়ে কদাপি নয়। একবার মন্টো সাহেব আমেরিকার নীতির ওপর টিপ্পনি করতে গিয়ে 'চাচা সাম 'নামে বেশকিছু চিঠি লেখেন। তা প্রকাশিত হতেই সে সময় তুমুল হৈ চৈ পড়ে গেছিল। তখন পাকিস্তানের আমেরিকার হাইকমিশনার মন্টোকে বলে পাঠান.."আপনি যদি আমাদের সংবাদপত্রের জন্য নিবন্ধ লেখেন,তাহলে এক একটা লেখার জন্য আপনাকে পাঁচশো টাকা করে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে"
মন্টো সাহেব উপলব্ধি করেন
...এই প্রস্তাব তাকে কিনে নেওয়া এবং মুখে তালা লাগানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। আর্থিক
দুরবস্থা সত্ত্বেও তিনি তৎক্ষণাৎ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন "মন্টো
বিক্রি হতে পারে না"।
মন্টোর সারাটা জীবন উচ্ছৃঙ্খলতার
মধ্যে দিয়ে কেটেছিল। মদ্যপান ও বেঁচে থাকার জন্য দৈনিক একটা করে গল্প লিখেছেন। তাঁর
জীবনের বাহ্যিক ও আন্তরিক বাস্তবতাকে যদি দূরদৃষ্টির সঙ্গে দেখা হয়,তাহলে মন্টোর জীবনে,জীবন
এবং মৃত্যু একটা মুদ্রার দুটি দিক নজরে পড়ে।
উর্দুর মহান বামপন্থী কবি ফ্যায়জ
আহম্মদ ফ্যায়জ এলিস কে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে এই প্রসঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
ফ্যায়জ লিখেছেন..."ব্যাপারটা হলো যখন আর্থিক দুরবস্থার জন্য শিল্প এবং জীবন পরস্পর
ধাক্কা খেতে থাকে তখন দুটোর মধ্যে একটাকে বলিদান দিতে হয়। "
প্রতিদিন একটা করে গল্প লেখার
কারণ হিসাবে মন্টো সাহেব বলেছেন ..."এর দ্বারা আমি টাকা পাই। টাকা দিয়ে মদ খাই,সংসার খরচা চালাই। "
আমি কি লিখি সে ব্যাপারে মন্টো
বলেওছেন ..."রুটি এবং শিল্পের সম্পর্কটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকে,কিন্তু কি করা
যায়,খোদার এটাই মর্জি। উনি নিজেকে সর্বদিক দিয়ে নিরপেক্ষ বলেন..এটা ভুল। তিনি নিরপেক্ষ
ও নির্লিপ্ত কদাপি নন। খোদা ইবাদত্ (ভক্তি)চান,আর ইবাদত্ অত্যন্ত নরম ও কোমল রুটি,বলা
উচিত ঘিয়ে চোবানো রুটি,যা দিয়ে উনি নিজের পেট ভরান। "
রুটি এবং শিল্পের এই বিচিত্র সম্পর্ককে নিজের স্নায়ুতেন্ত্রর ওপরে সহ্য
করে,প্রতিদিন একটা করে গল্প লেখার বাধ্যবাধকতাকেও মন্টো এক শিল্পীর মতো পালন করেছেন,এবং
তা করেছেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে,কোনো ব্যাপারেই সমঝোতা না করেই। তিনি বলেছেন..."মদ
খাওয়ার মতো গল্প লেখাটাও আমার কাছে আসক্তির। প্রতিদিন গল্প না লিখতে পারলে তিনি মনে
করতেন,আজ পোশাক পরেননি,উলঙ্গ,কিম্বা স্নান করেননি বা মদ খাননি।
মন্টো যেসব কালজয়ী গল্প লিখেছেন,সে ব্যাপারে বলেছেন.."আমি নিজে গল্প
লিখি না,গল্পই আমাকে লেখে। "
প্রতিদিন এক বোতল মদের বিনিময়ে একটা করে যেসব গল্প লিখেছেন,সেসব গল্প শিল্পের
কোন রূপ শর্ত ভঙ্গ করে না। তাঁর প্রতিভাও এসব গল্পে পরিপূর্ণ ভাবে উপস্থিত। সামান্য এক টুকরো ঘটনাকে কি অসাধারণত্বেই না পৌঁছে
দিয়েছেন মন্টো।
মন্টো 1955সালে 18ই জানুয়ারি মারা
যান। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উন্মাদের মতো মদ খাওয়া তাঁর ভেতর ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো। কিন্তু
মন্টো এসব অগ্রাহ্য করে জীবনকে গল্পে আর গল্পে জীবনকে খুঁজে গেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ