সায়ন্তনীর
হোম-টাস্ক হয়নি । সাবজেক্ট বাংলা । সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ । সকলেই হিন্দি নিয়েছে ।
বাবা-মায়ের দুজনেরই বাংলা ভাষার প্রতি চোরাটান রয়েছে । মা কখনও কখনও হারমোনিয়ামে
গান গায় । টেগোরের লেখা একটা –দুটো গান সায়ন্তনীও গেয়ে থাকে ।
পুরোনো
সেই দিনের কথা .......
সুরটার
মধ্যে ওয়েস্টার্ন ছোঁয়া আছে । টেগোর লন্ডনে থাকার সময় নিউ ইয়ারে চার্চে একটা গান
শুনেছিলেন ।তাতেই ইন্সপায়ার হয়ে লেখেন ~ পুরোনো সেই দিনের কথা এটসেটেরা ।
রুচিরা
ম্যাম রোগা , হাই –পাওয়ায়ের চশমা চোখে । ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলের বাংলার টিচার । ফলে
সব সময় নিজে নিজে কথা বলেন ।
মাস
ছয়েক আগে আরো একজন ছিল । এখন সে আর নেই । ফলে সায়ন্তনী একাই সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ
বেঙ্গলির একমাত্র ছাত্রী । ৬ মাস আগেও যে মেয়েটি ছিল , আজ আর নেই ~ তাকে রুচিরা
ম্যাম বেশী ভালোবাসতেন ।
স্কুল
বিল্ডিং একদম ফাঁকা । জানলা দিয়ে তাকালে একটা বাড়ি দেখা যায় । সেই বাড়ির যে ঘরটায়
একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছিল , তাঁর নাম ছিল চন্দন দাশ । সে নাকি বাংলা মিডিয়ম
স্কুলের , টেন স্ট্যানডার্ডের ফাইনালে ফেল করেছিল । ওর সেই ঘরটা এই সন্ধেয় স্পষ্ট
দেখতে পেলো সায়ন্তনী , লাল একটা লাইট জ্বলছে । সেই যে মেয়েটি জল-ট্যাঙ্কে যার ডেড
বডি ভাসছিল , মুখটা প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধা আর হাতের শিরা- কাটা ~ নামটা ছিল বেশ
ফানি । হরিপ্রিয়া সেনগুপ্ত । খুব একটা কথা বলতো না । অনেকেই লেগ পুলিং করতো ।
ডাকতো ~ হরি , হরি ~ হরিবল । বাবা বোধহয় বিজনেস করে পয়সা করেছিল । তাও কিনা
গ্রসারি শপ । শিট ~ ভাবলেই কেমন গা ঘিনঘিন করছে । কুকুরদেরও পেডিগ্রি দেখা হয় আর
হেড ম্যাম ~ ও কে কেন যে মনে পড়ছে !
টাস্ক
শেষ । রুচিরা ম্যাডামকে আজ অন্য রকম লাগছিল । ক্রুয়েল । এমনিতে আবহাওয়া আনক্যানি ।
কালই তো করে নিয়ে আসতে পারতো । আজ অকারণে কেমন ‘গা’ ছম ছম করছে । পার্ক স্ট্রীটের
গ্রেভইয়ার্ড বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ।
একবার
রুচিরা ম্যাম আর সেই হরিপ্রিয়া মিলে টেগোরের বার্থ-ডে সেলিব্রেট করেছিল । মালা
নিয়ে এসেছিল সায়ন্তণী । ব্যাস এইটুকু । মা অবশ্য তাকে টেগোরের ‘নির্ঝরের
স্বপ্নভঙ্গ’ শিখিয়েছিলেন কিন্তু বাংলা কবিতা ~ হাউ ফানি । মাই ফুট । এসব করা যায় ।
রশ্মি
বললো – সো , রুচিরা ম্যাম্ বার্থ ডে কেক আর মোমবাতি , ম্যাজিক ক্যান্ডেল ইয়ার ।
রুচিরা
ম্যাম বাংলা পড়ায় বলে রশ্মি এভাবেই কথা বলে ।
হঠাৎ
চমকে উঠলো সায়ন্তণী । পায়ের কাছে সুড়সুড়ির মতোন লাগল । বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ।
তারপর সামান্য সাহস ফিরে এলো । বোজা চোখ দুটো খুলে দেখলো ~ গাই ইজ ‘টোপর’ । তাদের
দিনের বেলার কিউট র্যাট ।
পাওয়ার
ওঠা-নামা করছে । লাইটগুলি জ্বলছে , নিভছে ।
সে
ডাকলো ~ কানাই-দা ।
বুড়ো
দারোয়ান সাড়া দিলো –
বহিন
, ভয় পাবে না । আমি আসছি । কামিং । ডরো মাত ।
কানাই-দা
‘কামিং’ ‘গোয়িং’ ‘ফাইটিং’ ~ এরকম সব জানে ।
লাইট
চলে গেলো । আবার বুকটা কেঁপে উঠল কিন্তু এই সময় কানাই-দা মোমবাতি হাতে নিয়ে ঢুকলো ।
বাইরে
ঝড়ের মতোন হচ্ছে । হাওয়ার দাপটে মোমবাতি নিভে গেলো । অন্ধকারে কানাই-দাকেও আর দেখা
যাচ্ছে না ।
ঘুরেফিরে
ওর কথা মনে পড়ছে । হরিপ্রিয়া । দমবন্ধ অবস্থায় হাতের শিরা কেটেছিল । পারফিউমের
গন্ধ আর ফিনাইল মিলেমিশে খেলা করছে ঘরটায় , টের পেলো সায়ন্তণী ।
কানাই-দা
আবার মোমবাতি জ্বালালো । মোমবাতির শিখায় কানাই-দার ডান হাতের শিরা স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে । মনে হচ্ছে শিরাটা নিখুঁত ভাবে ব্লেড দিয়ে কাটা । রক্ত গড়িয়ে পড়ছে । মেঝের
দিকে তাকালো সায়ন্তণী । রক্ত মেঝেতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । হরিবল , এসব কি সত্যি !
ভয়ে , আতংকে সে কি সব কল্পনা করছে !
কানাই-দা
, তোমার কি হয়েছে ! কোনক্রমে বললো সায়ন্তণী
।
এবার
বেশ বৃষ্টি শুরু হয়েছে , ঝড়ের দাপটও রয়েছে । মোমবাতি আবার নিভে গেলো ।
অন্ধকারে
কানাই-দার উত্তর ভেসে এলো ~ এখানে কেউ আর বেঁচে নেই । তোমার বাবার গাড়ির আওয়াজ
পেলাম । এলেই চলে যেও ।
রুচিরা
ম্যাডামই থাকতে বললেন ।
আর
এসব কি বলছো ! বিকেলেও তো কথা হলো , তুমি তো বেঁচে ছিলে ।
কানাই-দা
অস্ফুট উওর দিলো –
‘ও’
ভি জিন্দা লাশ আছে । আমরা যারা বেঁচে নেই তাদের সঙ্গে কথা বলে ।
তুমি
কি বেঁচে নেই ~ কানাই-দা ।
না
। আমিও মরে গেছি । হাতের শিরা নিজেই কাটলাম । একদম নিখুঁত । তবে দিনের বেলা বেঁচে
উঠবো । তখন কিছুই বুঝতে পারবে না ।
সায়ন্তণী
বললো ~ তুমি আমায় ভয় দেখাচ্ছ ।
এবার
কানাই-দা ঘরঘরে গলায় বললো – বাংলা নিয়ে পড়লে কেন ! ওই রুচিরা ম্যাডাম ডাইনি আছে ।
তার
মানে ! সায়ন্তণী সাহস এনে জিজ্জেস করল ।
ওই
ভাষা নিয়ে কেউ পড়ে আজকাল । বাড়িতে দু-বেলা মার খেতো তোমার বন্ধু । ওই ভাষায় তার
কাল হলো ।
মনে
পড়ছে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে হরিপ্রিয়া গেয়েছিল ~ মম চিত্তে নিতি নৃত্যে ।
মম্
এসেছিল সেদিন । হরিপ্রিয়ার গানের খুব প্রশংসা করেছিল ।
কানাই-দা
বলল এবার ,
রুচিরা
ম্যাডামের শরীরটা কেমন রক্তশূন্য মনে হয় না । তোমারা টেও পাও না , আমি জানি ।
সায়ন্তণী
বললো – হরিপ্রিয়া কেন সুইসাইড করলো ~ তুমি জানো !
‘ও’
যে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়তো ~ বাড়িতে বলেনি । লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তো । ধরা পড়ে গেলো
বাড়িতে । তখন আর বাঁচার উপায় রইল না ।
তুমি
কেন এসব করলে !
হরিপ্রিয়ার
জন্য । তার বিদেহী আত্মা একা একা ঘুরে ফিরে । আমার কাছে কাঁদতো । তাই আমি ওর সাথী
হলাম ।
কিছুই
বোধগম্য হচ্ছে না তার ।
সায়ন্তণী
এবার কাতর গলায় বললো – আমি কি বেঁচে আছি ।
জরুর
আছো । কিন্তু বাংলা ভাষা তোমাকে ছাড়তে হবে । না হলে হরিপ্রিয়ার মতোন হবে ।
সায়ন্তণী
বললো ~ আমার মা-বাবা দুজনেই বাংলা নিয়ে পড়তে বলেছেন । ওঁরা চান আমি বাংলা ভাষাও
জানি ।
তাজ্জব
কি বাত ! ওই ভাষা কেউ এখন ভালোবাসে ! তুমি বাবা মাকে ড্যাডি , মাম্মি বলো না !
কখনও
কখনও বলি ~ তবে বেশীর ভাগ সময় মা , বাবা বলেই ডাকি ।
কানাই-দা
বললো –
তুমি
একটা জিনিস খেয়াল করলে !
সায়ন্তণীর
সামান্য সাহস বাড়লো । কানাই-দার সঙ্গে এতো কথা কোনদিন হয় না । ভূত হয়ে গিয়ে সে তো
কোন ক্ষতি করছে না । বরং ওকে ছাড়া এখান থেকে সে বের হবে কি করে !
সে
এবার বললো – তুমি তো হিন্দি জানতে না । বাংলা ভাষায় কথা বলতে । হেড ম্যাম রাগ করতেন ।
মরে
গিয়ে আমি এখন হিন্দি শিখছি । বিহারী কিছু ব্রহ্মদত্যির সঙ্গে ভাব হয়েছে । এইসময়
গোঙানির আওয়াজ পাওয়া গেলো । কোন কিশোরী কণ্ঠের আর্তনাদ ।
কানাই-দা
বললো ~ যাও তুমি । অপঘাতে মৃত্যুতো ~ আমাদের মুক্তি নেই । ওর কাছে যেতে হবে ।
পিয়াস লাগছে ওর ।
সিঁড়ি
দিয়ে নামতে থাকলো সায়ন্তণী । বাইরে ঝড় এখন থেমে গেছে । রাস্তার আলো সার্সি দিয়ে
দেখা যাচ্ছে । সে বেঁচে আছে , তাকে বাঁচতে হবে । তার কোন ডিপ্রেশান নেই । গোঙানির শব্দ তীব্র হচ্ছিল । কানাই-দা তার নতুন শেখা হিন্দিতে বলছে
, ‘রো মত বেটি’ । স্পষ্ট শুনতে পেলো সায়ন্তণী ।
অবশেষে
বাবার গাড়ির হেড লাইট দেখে সে জানতে পারলো ~ মরে নি , বেঁচেই রয়েছে । কিছুতেই বলতে
পারলো না বাবাকে যে সে আর বাংলা পড়বে না । সেকেন্ডে ল্যাঙ্গুয়েজ ‘বাংলা’র জন্য
হরিপ্রিয়া সুইসাইড করেছে । বাড়ি ফিরে দেখলো মা গান গাইছে । “ আমি চিনি গো চিনি
তোমারে ......”
সায়ন্তণীকে
দেখে মা কাছে ডাকলো ~ এতো দেরী হলো যে !
সায়ন্তণী
সেইসব বিদেহী আত্মাদের কথা কিছুই বলতে পারলো না , বরং মা-কে জড়িয়ে ধরে বললো ~
মা
~ গাইব ! ন্যাশনাল অ্যান্থাম । জন – গণ – মন অধিনায়ক জয় হে ।
মা
বললো ~ গাও তবে ।
সায়ন্তণী
শুরু করলো , মা – বাবাও ধরলেন । সকলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাইছিলেন জাতীয় সংগীত । মনে
মনে খুব কাঁদছিল সায়ন্তণী । হরিপ্রিয়া , বাংলার রুচিরা ম্যাম স্মৃতিতে ভাসছিল । আর
ভাসছিল একটা ভাষা , হারিয়ে যাওয়া ভাষা । গাইতে গাইতে এক সময় গর্ব হলো সায়ন্তণীর ।
পিয়ানোর ঠিক উপরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট্ট একটা ছবি । টেগোর নয় তিনি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর । মনে মনে উচ্চারণ করল সায়ন্তণী । হরিপ্রিয়া সালোয়ারের ওড়না দিয়ে পরম যত্নে
মুছেছিল রবি ঠাকুরের ছবিটা । কোন গোঙানির শব্দও যেন বহু দূর থেকে শুনতে পেলো
সায়ন্তণী ।
জাতীয়
সংগীতে পর আর কিছু গাইতে নেই , তবুও সায়ন্তণী দেখতে পেলো , শুনলো মা-বাবা দুজনে
মিলে গাইছেন ~ মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
প্রিয়তম
হে জাগো জাগো জাগো ......।
একফাঁকে
জানলা দিয়ে দেখলো সায়ন্তণী রাত্রির আকাশ তারায় তারায় ভর্তি হয়ে রয়েছে । আর সেই
তারায় ভরা আশ্চর্য পথে একা একা উড়ে চলেছে হরিপ্রিয়া ।
অভিজিৎ চৌধুরী