সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

রবীন বসু



প্রপোজ ডে




কাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে  একটানা হয়ে যাচ্ছে থামার কোন লক্ষণ নেই  আজ রবিবার ছুটির দিন তাই একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে আনন্দী এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসেছে  ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তাটা জলে ভরে গেছে   একহাঁটু জলের মধ্যে বাচ্চা ছেলেরা সব ছেঁড়া মশারি কেটে জাল বানিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরছে মাছ পেলে তাদের মুখে কি যে আনন্দ ঋক যখন ছোট ছিল সেও ফ্ল্যাটের সামনে জমা জলে  নেমে মাছ ধরত এক বছর হল ঋক দিল্লিতে ওখানকার শ্রী ভেঙ্কটেশ্বরা কলেজে বাইয়োলজিক্যাল সাইয়েন্স নিয়ে পড়ে ঋক চলে যাবার পর আনন্দী বড় একা হয়ে গেছে

সারাদিন ব্যাংকে কাজে কেটে যায়
কিন্তু বাড়ি ফিরলে একটা মন-খারাপ তাকে পেয়ে বসে দুঃসহ এক সঙ্গহীনতা ঋক যখন এখানে ছিল তখন সবিতার মাকে সব সময়ের জন্য কাজে রেখেছিল  ঋকের ছোট- অবস্থা থেকে সবিতার মা তাদের বাড়িতে কাজ করছে ও খুব বিশ্বস্ত ওর ভরসাতেই আনন্দী নিশ্চন্তে চাকরি করতে পেরেছে  কিন্তু এখন ঋক দিল্লিতে পড়তে যাওয়ার পর আনন্দীই বলেছিল, “ফাঁকা বাড়িতে সারাদিন একা একা ভালো লাগবে না তোমার মাসি তুমি বরং সকাল আর সন্ধ্যে একবার করে এসে কাজ সেরে যেও, তোমার মাইনে যা দিতাম তাই দেব সবিতার মা একমুখ হাসি নিয়ে বলেছিল, “বাঁচালে দিদিমনি, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক বৌমাটা  পোয়াতি হয়েচে ঠিকমত রান্নাবাড়া কত্তি পারে না ছেলেটা অধ্যেক দিন দুপুরে বাড়ি এসে পাঁউরুটি খায়  বাড়ি থাকলে তবু একমুঠো গরম ভাত পাবেl”

রজতের চলে যাওয়াটা এমনই আকস্মিক আচমকা ঘটেছিল যে, আনন্দীর অনেকটা
 সময় লেগেছিল বুঝতে সেই স্কুল-লাইফ থেকে রজত আর আনন্দী বন্ধু ওদের গ্রুপটা বেশ বড়ই ছিল স্কুলের পর কলেজ লাইফেও সে বন্ধুত্ব অটুট ছিল রজত জার্নালিজম এণ্ড মাসকমিউনিকেশন নিয়ে পাশ করার পর একটা বড় সর্বভারতীয় চ্যানেলের কলকাতার অফিসে জয়েন করল আর  আনন্দী ঢুকল ব্যাংকে কলেজ জীবনে ওরা দলবেঁধে খুব হৈ-হৈ করেছে লিটল ম্যাগাজিন বের করেছে বেড়াতে গেছে কবিসম্মেলনবইমেলা আর এরই ফাঁকে রজত কখন বন্ধু থেকে বিশেষ বন্ধু তারপর  মনের মানুষ হয়ে গেল, তা সে নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি যখন বুঝতে পারল তখন রজতই একদিন সন্ধ্যেবেলা বাইক হাঁকিয়ে সোজা তাদের বাড়ি এক ররম টানতে টানতে তাকে নিয়ে বাবার সামনে হাজির তারপর ব্যাগ থেকে নিজের পে- স্লিপ বের করে বাবার সামনে রেখে কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল, আপনার মেয়েকে কি আমি বিয়ে করতে পারি? বাবা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকার পর   হেসে ফেলেছিল
 
সেই প্রাণখোলা সহজ সরল রজত আজ কত দূরে
ইচ্ছা করলেও, হাজার চেষ্টা করে সে তাকে ছুঁতে পারবে না  বিয়ের পর দুজনে লোন নিয়ে কসবায় বিজন সেতুর কাছে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল তারা, অফিস যাতায়াতের সুবিধার জন্য আনন্দীর  আপত্তি সত্ত্বেও ফ্ল্যাটটা রজত তার নামে করেছিল হাসতে হাসতে বলেছিল, “বাড়ির গিন্নি হল স্থাবর সম্পত্তি আমরা সব অস্থাবর তাই ফ্ল্যাট তোমার নামে
হাসিতে গানে মজায় আর অসম্ভব এক পরিতৃপ্তিতে ভরে যাচ্ছিল আনন্দী
বিয়ের দুবছর পর এল ঋক
আনন্দী ব্যস্ত হয়ে পড়ল
রজতকে কেমন দায়িত্ববান মনে হচ্ছে যে কাজ বলা হত  তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত ওই সময় আনন্দীর মা এসে কিছুদিন ছিলেন মেয়েকে সাহায্য করতে যাওয়ার আগে সবিতার মাকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাই রক্ষে

ঋক বড় হতে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করল, তখন সকালে ঋককে স্কুলগাড়িতে তুলে দিয়ে আনন্দী রজতের বাইকের পিছনে চেপে বসত
ওকে ব্যাঙ্কে নামিয়ে তারপর রজত অফিস যেত আনন্দীর যে ভয় করত না, তা নয় রজতকে অনেকটা পথ বাইপাস ধরে যেতে হত বার বার বলে দিত আনন্দী, সাবধানে যাবে, একদম অন্যমনস্ক হবে না, স্পিড বেশি বাড়াবে না

তবুও অঘটনটা ঘটল
সেদিন ব্যাঙ্কে স্ট্রাইক ছিল আনন্দী বাড়িতে বারোটা হবে বোধহয়, ফোনটা এল গম্ভীর ভরাটে গলা  
বিধান নগর থানা থেকে বলছি, ভারপ্রাপ্ত অফিসার আপনি কি রজত রায়ের বাড়ির লোক?
আনন্দীর বুকটা কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়
  সে ভয় পেয়ে কোন রকমে জড়ানো গলায় বলেছিল, হ্যাঁ, আমি ওঁনার স্ত্রী বলছি
শুনুন ম্যাডাম, মনকে শক্ত করুন
আপনার জন্যে একটা খারাপ খবর আছে আপনার স্বামী মিঃ রজত রায়ের বাইক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে  পরমা আইল্যাণ্ডের কাছে একটা টাটা সুমো ওনাকে পেছন থেকে জোরে ধাক্কা মারে উনি খুব মারাত্মক ভাবে ইনজিওরড অ্যাপোলো গ্লেনিগেলস হসপিটালে অ্যাডমিট করা হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বিধান নগর থানাতে চলে আসুন আমরা আপনাকে হসপিটালে পৌঁছে দেব
হাসপাতাল পৌঁছেছিল আনন্দী, কিন্তু রজতের কাছে না
ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল মাথার মধ্যেকার আঘাত এত গভীর ছিল যে অপারেশনের পরও রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না শেষ রাতের দিকে আই সি ইউর মধ্যে অ্যাটাক হল মুহূর্তে সব শেষ

               
বৃষ্টি একটু কমেছে
সবিতার মা এখনও কাজে আসেনি  রাস্তায় যা জল আসতে পারবে কিনা কে জানেসেল ফোনটা বাজছে এই সকালে আবার কে ফোন করল
হাই, গুডমর্নিং
আমি সমীর বলছি, কেমন আছিস?
আনন্দী একটু ভেবে নিল
কে সমীর? গলা শুনে তো মনে হচ্ছে তাদের স্কুল গ্রুপের সমীর
হ্যাঁ, গুডমর্নিং, আমি ভালো আছি, তুই কেমন?
মোটামুটি
ধন্যবাদ গলা শুনে চিনতে পারার জন্য
না পারার কী আছে
আমরা সব স্কুললাইফের বন্ধু তা এতদিন পর খোঁজ নিচ্ছিস যে? তুই তো চেন্নাই ছিলিস?
হ্যাঁ, তবে এখন কলকাতা
রজতের খবরটা শুনেছিলাম স্বাতীর ফোনে ইচ্ছে করেই তখন তোকে ফোন করিনি অত দূর থেকে শুধু সান্ত্বনা দিয়ে কী লাভ বল কেমন আছিস আনন্দী?”
ছেলের মুখ চেয়ে আমাকে ভালো থাকতে হচ্ছে
তবে রজতকে খুব মিস করি তোর খবর বল, বিয়ে করে ছিলিস সে খবর পেয়েছিলুম
সে এক দুঃস্বপ্ন
কী দুর্মতি যে হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ কিন্তু বিয়ের পর স্বপ্নভঙ্গ রাজনীতি-করা মেয়ে সংসারের গণ্ডি তাকে বাঁধতে পারল না একদিন সব ছেড়েছুড়ে রাজনীতিক এক দাদার সঙ্গে দিল্লী পাড়ি দিয়েছে এম পির টিকিট জোগাড় করতে
তাহলে তুই
 এখন একা? আনন্দী  দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
আমাদের জীবনটা কি অদ্ভুত না
চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে কত ফারাক
তাই তো
 সেই কিশোর বয়স থেকে ভালোবাসতাম তোকে  কিন্তু মুখচোরা, বুকে সাহস কম ছিল, বলে উঠতে পারিনি
একটু থেমে সমীর আবার বলে, তোকে আজ একটা বিশেষ কথা বলব বলে বুকে সাহস সঞ্চয় করেছি, শুনবি আনন্দী?
আনন্দীর বুকটা কেঁপে ওঠে
 না জানি কী বলতে চায় সমীর
বল্ কী বলবি
আজ কোন্ দিন জানিস? আজ হল 8th February
 আজ প্রপোজ ডে অনেক দিন আগে এই দিনটাতে তোকে যে কথা বলতে পারিনি সংকোচে, আজ সেকথা বলব সব অতীত ভুলে যা, আমি তোকে প্রপোজ করছি আনন্দীআই লাভ ইউ
যা ভয় করেছিল তাই
রজতের বিষণ্ণ মুখ, ঋকের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল  মন চাইছে সঙ্গী কাউকে, আবার ভয়ও করছকিরে চুপ করে আছিস, কিছু বলবি না?
আচ্ছা ভেবে দেখি


রোজকার মত সেদিন রাতেও ঋক ফোন করল
মা কেমন আছ? তোমার শরীর ভালো তো?
আনন্দী জানাল, সে ভালো আছে
ঋকের শরীর কেমন জানতে চাইল
আমি ফাইন তোমাকে আজ একটা দারুণ খবর দেব, মাআজ তো প্রপোজ ডে জানো আজ রিয়া আমাকে প্রপোজ করেছে ও আমাদের ক্লাসে পড়েতোমার মত ওর মাথায় অনেক চুল ও খুব ভালো মা আমি ওকে হ্যাঁ বলে দিয়েছি
ঋকের উৎসাহ আর উচ্ছ্বাস দেখে আনন্দীর হাসি পায়
l
ঠিক আছে, ভালো করেছিস
রিয়ার ছবি আমাকে হোয়াটস্অ্যাপে পাঠাস সাবধানে থাকিস পুজোতে আসার চেষ্টা করিস

আনন্দীর খুব ইচ্ছা করছিল ঋককে বলে, আমারও তোকে
 কিছু কথা বলার আছে জানিস, তোর মত আমাকেও আজ একজন প্রপোজ করেছ  ভাবছি, হ্যাঁ বলে দেব
        

                   
রবীন বসু