সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শ্রাবণী গুপ্ত সরকার


প্রতিমার নেপথ্যে
                       
   আজ রথের দিন। আমি একটু বোকা বোকা নষ্টালজিয়ায় ভোগা মানুষ। খুব ইচ্ছে করছিল, তাই আদিবাড়িতে গেলাম একবার। আদিবাড়ি মানে দাদার বাড়ি। মা, বাবা গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর। আমাদের ভাইবোনের যোগাযোগটা শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে দিব্যি বেঁচে বর্তে আছে। আর এর জন্য অবশ্যই প্রধান কৃতিত্ব বৌদির। তো সেই যাই হোক,গল্পগাছা, আড্ডার পর স্বগৃহে  ফেরার রাস্তা ধরলাম। না, দূরত্ব কমই—তবে যানবাহন একটু ঝামেলার। তাই বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি, বাস, অটো বা ওই জাতীয় কিছু যদি পাওয়া যায় এমনই মনোভাব নিয়ে। একটা টাটা ম্যাজিক এসে থামতেই সুবিধাজনক সিট আছে দেখে উঠে পড়লাম টুক করে। দুজন দন্ডায়মান মহিলাও ছিলেন তারা বিফল মনোরথ হয়ে দোনোমনা করায় ড্রাইভার বললো, “সামনে একজনের হবে, যাবেন?” যাবেন একজনই, তিনি এগোতেই রাস্তার আলোয় দেখলাম –ওমা! এতো বুটি—আমাদের পাড়াতুতো দিদির মেয়ে। অন্যজনকে খেয়ালই করি নি—ইরাদি—অনেক বছর পর দেখার অভিঘাতে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছো?” ইরাদি একগাল হেসে বললো, “ভালো। তুমি ভালো আছো তো?” ম্যাজিক ছেড়ে দিল। 
   ইরাদি ভারী সুশ্রী দেখতে –ছিল না, এখনো আছে। বেশ লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, খুব মায়া কাড়া মিষ্টি মুখ। মেয়েটা অমন নয়, ফর্সা কিন্তু কেমন যেন খরখরে দেখতে। ইরাদিকে প্রথম চিনেছিলাম যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। পাড়ার ক্লাবে মেয়েদের একটা নাটক হবে। ডাক পড়েছে সেখানে। একটা ছোট পার্ট জুটলো গৃহবধূর। পাড়ার দিদি, বৌদি আর আমরা ছোটরাই কুশিলব। রিহার্সালটা খুব মজার একটা জমজমাট আড্ডা বিশেষ। ইরাদিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমাকে খুব আদর করলো যে! আমার মায়ের স্কুলের ছাত্রী কি না। দিদিমণির মেয়ে বলে কথা। শুনলাম, ইরাদি পেশাদারী মঞ্চে থিয়েটার করে। বিধবা, একটা ছোট মেয়ে আছে, আমাদের থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। সেও নাটকে পার্ট করছে। বেশ দাপুটে অভিনয়। সবাই হাসতো—মায়ের মত অভিনয় করে বলে।

   মুগ্ধতার জেরে বাড়িতে এসে মাকে বললাম ইরাদির কথা। তারপরেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ইরাদির মা নিজের স্বার্থে এক আধাগুন্ডার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ খুব কম বয়সেই মা হয়ে গেছে ইরাদি। গুন্ডা বর বয়সে আর শারীরিক অত্যাচারে মারা গেছে বহুদিন। অসহায় অবস্থায় নিজের শারীরিক সৌন্দর্য আর সহজাত অভিনয়কে কাজে লাগিয়ে ইরাদি যাত্রা করতে আরম্ভ করেছে। মেয়ের পড়াশোনা চালাচ্ছে খুবই সিরিয়াসলি।

   আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে দিদির সংখ্যা অনেক। অবাক হয়ে দেখলাম দুই অবিবাহিতা দিদির সহপাঠী ছিল ইরাদি। ওরা বললো ক্লাশ এইটে পড়ার সময়ে সবাই মাঠে এক্কাদোক্কা খেলছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইরাদি। পরনে ফ্রক, হাতে শাঁখা-পলা-লোহা, মাথাভর্তি সিঁদুর—পেটটা ফুলে আছে—সন্তান সম্ভাবনায়। ভীষণ কান্না পেয়ে গিয়েছিল, মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। ইরাদি সবসময় হাসে। কি মিষ্টি হাসি। এত কষ্ট নিয়ে হাসতে গেলে মনের অনেক জোর লাগে। আমি চাকুরে বাবা-মায়ের আদুরে মেয়ে, প্রতিষ্ঠিত দাদার আহ্লাদি বোন—আমার গায়ে আঁচ লাগে না—মা বাবা নিজেরা কষ্ট করেও আমাকে যত্নে রাখেন—বোঝার কথাই নয় ইরাদির কষ্ট।তবুও বুঝতাম। কি করে জানি না। হয়তো একটু বোকা বলেই।

   ইরাদির মেয়ে বুটি মানে সিঞ্চিতা একদিন ভীষণ ক্ষেপে উঠলো—কে ওর মাকে খারাপ কথা বলেছে—লাল চোখ-লাল মুখ নিয়ে তেড়ে ঝগড়া শুরু করলো। মায়ের অপমান সহ্য করতে পারে নি বেচারি—অনেকেই বললো ও পাগল! আমার কিন্তু তা মনে হলো না একদম।

   একদিন রিহার্সালে তুমুল অশান্তি। ইরাদি শো আর রিহার্সালের কারণে মাঝে মধ্যে মহড়ায়  থাকতে পারে না। তাতে ওর অসুবিধা নেই, পেশাদারিত্ব দিয়ে খুব সুন্দর ম্যানেজ করে নেয়, আনাড়ি সহঅভিনেত্রীদের হয়তো একটু সমস্যা হয়। একজন বলেই বসলো, “এখানে তো আর টাকা পায় না, তাই যেদিন খুশী আসে”। ইরাদির কানে ঠিক খবর গেল, খুব দুঃখ পেয়েছিল সেদিন, রাগও করেছিল। তবে আমার যেটা খুব ভালো লাগতো ওর সাহায্য করার হাত বাড়ানোর মনোভাব। আমার তো ছোট্ট পার্ট, আমাকে ধরে ধরে শেখাতো ‘ঝুমকি, এই ভাবে বল। সব  হাততালি তুই পাবি। সবাই মন দিয়ে দেখবে তোর পার্ট’। কখনো গল্প করতো ওর অভিনীত  চরিত্রের। খুব ভালো লাগতো শুনতে। ফাংশনের দিন ইরাদি আমাদের সবার চুল বেঁধে দিলো খুব যত্ন করে। নিজের মেকআপ নিজেই করলো। বুটিও দেখলাম দিব্যি এক্সপার্ট। ছোট পনিটেল রোল করে দিব্যি নিজেই খোঁপা বেঁধে নিলো। খুব মজা লাগছিল দেখে।  

   নাটক দিব্যি জমে গেল। হ্যাঁ, আমার অকিঞ্চিতকর রোলও ইরাদির পরামর্শে খুব বাহবা পেল। আনন্দের সপ্তম সর্গ একেবারে। তারপর কয়েকটা দিন খুব ফাঁকা ফাঁকা—মন কেমন—যেমন হয় আর কি একটা আনন্দ ফুরিয়ে যাবার পর।  

   এরপর আমার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স, পোস্ট গ্রাজুয়েশন--- চললো। হ্যাঁ, পাড়ার ক্লাবের ফাংশন, নাচ তাও চললো—কিন্তু নাটক আর হলো না। তাই ইরাদির সঙ্গে দেখাও হতো পথে-ঘাটে, বাসে। এর মধ্যে আরেকটা কান্ড—বুটির বিয়ে—মাত্র আঠারো বছর বয়সে! বাসে দেখা হলো ইরাদির সঙ্গে। বললাম, “মেয়েটারও বিয়ে দিয়ে দিলে দিদি—এত কম বয়সে? ওতো পড়াশোনায় খারাপ ছিল না গো”। ইরাদি বলল, “আমার অবস্থা তো জানো, বাড়ি থাকি না, যদি কোনো ভুল করে ফেলতো, নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। তাই ভালো ছেলে পেয়ে দিয়ে দিলাম।  ওরা পড়াবে আর আমার মেয়ে খুব চালাক। বাচ্চা কাচ্চার কথা এখন ভাববেই না। আমাকে তো দেখছে বলো ছোট থেকেই”। চুপ করে গেলাম। সত্যিই তো ওর মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারি নি আমরা। তাই এটা অনধিকার চর্চাই বটে।
   আরো অনেক বছর কেটে গেছে। আমি তো কবেই বিয়ে হয়ে পাড়া ছাড়া। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি নিজেও স্বাবলম্বী, উপার্জনশীলা। মা হবার আগে বাবার বাড়িতে এসেছি। একতলায় বৈঠকখানায় গল্পগুজব চলছে। আমাদের বাড়িতে পাড়ার কেউ কেউ আসে গল্প করতে। হঠাৎকথা প্রসঙ্গে ইরাদির কথা বলতেই নাক শিঁটকালো শুভ্রা—আমাদের ছোটবেলার সাথী—‘জানিস, এই বয়সে শাশুড়ি হয়ে আবার বিয়ে করেছে। বয়সে ছোট একটা নাটকের দলের ছেলেকে। একটা বাচ্চাও হয়েছে--- লজ্জাও করে না’।
   আমার কানের ভেতরে যেন গরম সীসা ঢেলে দিল কেউ। বুকের মধ্যে কেউ বলে উঠল, ‘প্রতিবাদ করো’। আমি খুব আস্তে আস্তে বললাম (এখন উত্তেজিত হওয়া বারণ যে), “দেখ ইরাদি জীবনে কি পেয়েছে বল তো? বাবার বয়সী একটা বর, যার সঙ্গে শোনা যায় ওর মায়ের সম্পর্ক ছিল। চোদ্দ বছর বয়সে মা হয়ে গেছে। সতেরো বছরে বিধবা। একটা সুন্দরী অসহায় মেয়ে লড়াই করে বেঁচেছে সৎপথে। মেয়েকে সাধ্যমতো লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছে। তারপর অবকাশ পেয়েছে নিজের দিকে তাকাবার। ভালোবাসার বুঝি বয়স আছে কোনো? ও বড়োলোক, সিনেমা স্টার হলে বলতিস এমন? ভালোবেসে বিয়ে করেছে। নোংরামি তো করে নি। যা করেছে বেশ করেছে। আমি খুব খুশী হয়েছি”। শুভ্রা চুপ করে গেল, মুখ-চোখ দেখে বুঝলাম রেগে গেছে, বয়ে গেছে। আমার মনটা ভরে গেল ইরাদির জন্য শুভ কামনায়। মাও আমার কাছে সব শুনে খুব খুশিই হলেন। বুঝলাম, ভুল করি নি।  

   দেখা হলো বুটির সঙ্গেও। সব কথার পর ওর মা কেমন আছে জানতে চাইতেই ও কেমন সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো আমার দিকে। মনে পড়ে গেল সেই দিনটা মায়ের অপমানে লাল টুকটুকে কচি মুখখানা। আসলে আমরা খুব নিষ্ঠুর তো। অকারণে অন্যের দুর্বল স্থানে আঘাত করে রক্ত দেখতে বড় ভালবাসি। আদিম প্রবৃত্তি বলে কথা। বুটিরাও সেটা দেখতেই অভ্যস্ত। তাই আমার প্রশ্নের আড়ালে ও ব্যঙ্গ খুঁজছে। দোষ নেই ওদের। আমরাই ওদের এমন ভাবতে শিখিয়েছি।

   আজ আবার অনেকদিন পর ইরাদিকে দেখলাম। গন্তব্যস্থলে নেমে দুটো কথা হলো বুটির সঙ্গেও। ওর মেয়ে কলেজে পড়ে ফার্স্ট ইয়ার। ইরাদির চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ছে—তবুও বড়ো সুন্দর। হাসিভরা মুখটা দেখে খুব ভালো লাগলো। আজ রথযাত্রা—দুর্গা প্রতিমার কাঠামো বাঁধা শুরু—ইরাদি যেন সেই কাঠামোর প্রতিভূ। 

    


 শ্রাবণী গুপ্ত সরকার